ইচ্ছে ডানা ❤️ পর্ব -১৪

❣#ইচ্ছে_ডানা
#চতুর্দশ_পর্ব ❤
বাপেরবাড়িতে প্রায় একমাসের ও বেশিদিন কাটানোর পরে, কেউ কিছু না বললেও, এই মুহূর্তে সৌরিতার মনে হচ্ছে ওর এবার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু আবার, আবার ঐ বাড়িটায় চলে যেতে হবে ভেবেই ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এই কয়েকদিন না চাইতেও সৌরিতার জীবনে অনেকগুলো পরিবর্তন এসে গেছে খুব গোপনেই, ধীরে ধীরে। আর সেটা হল, সৌরদীপ। আজকাল প্রায়ই ওর সাথে কথা হয়। কথার স্রোত, চ্যাটবক্স থেকে ফোনে কথাবার্তা অবধি পৌঁছে গেছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন বিষয় দিয়ে কথা শুরু হলেও অনিচ্ছাকৃতভাবেই কথার বাঁক সেই একই জায়গাতেই এসে থামে যেন। রাজীবের সাথে নিজের সমস্যার কথাগুলো প্রায় অনেকটাই সৌরদীপকে বলেছে সৌরিতা। বলার সময় অনেকবার মনে হয়েছে, থেমে যাবে, নিজের ব্যাপারে আর কোনো কিছু খুলে বলবেনা অপরদিকের মানুষটাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও থামতে পারেনি সে। সৌরদীপের কথা শুনতে শুনতে কখন নিজের কথাও যে বলে ফেলেছে তা বুঝতেও পারেনি সৌরিতা। সৌরদীপের কথা শুনেই বিশেষ করে ওর মনে আরো নতুন করে সাহস এসেছে, এটা ভেবেই ও আশ্বস্ত হয়েছে যে, ও একা না, যার জীবনে এতটা দুঃখ-কষ্ট জড়িয়ে আছে। ওর জীবনে তাও কিছু ফিরে পাওয়ার ক্ষীণ আশা থাকলেও আছে। কিন্তু যে মানুষটা আর এই পৃথিবীতেই নেই, তার জন্য সারাজীবন মিথ্যে আশা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের কষ্টটা আরো অনেক বেশি বোধহয়।

কিন্তু চেষ্টা করেও নিজেকে আটকে না রাখতে পারার আরো অনেক কারণ আছে বোধহয়। সেটা হল সৌরদীপের সাথে কথা বলার মুহূর্তে সৌরিতা যেন পৃথিবীর বাকি সমস্ত চিন্তাভাবনা থেকে অনেক দূরে চলে যায়। ঐ সময়টুকুতে ও যে আনন্দটুকু পায় সে তার রেশ অনুভব করতে গিয়েই যেন আরো বেশি করে জড়িয়ে পড়ছে সৌরিতা। কথা বলতে বলতে এই কয়েকদিনের এমন একটা অদৃশ্য জালে যেন জড়িয়ে গেছে সে, যে কিছুতেই সেটা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারছেনা। মনকে শতবার সে বোঝাচ্ছে, যে এটা অন্যায়, এটা ভুল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও মনের ভিতর থেকে কেউ যেন বার বার চিৎকার করে বলে উঠছে, বাধা দিয়ে উঠছে। বিয়ের পর থেকে এতমাস ধরে পাওয়া সমস্ত কষ্ট, দুঃখ গুলো যেন এই কয়েকদিনের আনন্দে যতটা পারে পুষিয়ে নিতে চাইছে সৌরিতা। অদ্ভুত ভাবে সে লক্ষ্য করছে, যে এই মুহূর্তে রাজীবকে তার আর মনে পড়ছেনা তেমন, এমনকি কোনো খারাপ লাগাও আর আসছেনা। সহ্য করতে করতে ওর মন এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছে গেছে, যে এতটুকু খুশির সন্ধান পেলে সেটুকুকে পুরোপুরি উপভোগ না করে যেন ছাড়তেই চাইছেনা। তাই নিজেকে অনেক বোঝালেও, অনেক সামলালেও সৌরিতা ক্রমশ যেন বুঝতে পারছে যে ও সৌরদীপের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। এটা আদৌ কি কোনো ভালোবাসার অনুভূতি ? নাকি কেবল মাত্র নিজের কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য, কাউকে একটা সম্বল হিসেবে আঁকড়ে ধরতে চাইছে সে? হয়তো সেই উল্টো দিকের মানুষটার এই নিয়ে কোনো ভাবনা-চিন্তাই নেই, সে হয়তো এই কথা বলার সম্পর্কটাকে কেবলই বন্ধুত্ব ভাবে। কিন্তু সৌরিতার অবাধ্য মন বারবার কেন না জানি বলে ওঠে আনমনে, যে সৌরদীপের মত এমন কেউ যদি থাকত, যে তার ভালোবাসার মানুষটা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও, এখনো তাকে ভালোবাসে, মনে করে। যে এত ভালো কারো বন্ধু হতে পারে, ভগবান কেন ওর মত কাউকে সৌরিতার জীবনে পাঠালোনা! তাহলে হয়তো ঐ একটা মানুষের জন্যই ওর জীবনটা আজ অন্যরকম হতে পারত……

************

সৌরদীপ হাত ফোনটা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করছে অন্যমনস্কভাবে। হঠাৎ করেই অনেকদিন ধরে একটা কথা ওর মনে আসছে ঘুরেফিরে, এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই সেটা সৌরিতার ব্যাপারে।মেয়েটার ব্যাপারে কেন এত বেশি ভাবে সে, কেন ওর জীবনের সব ঘটনা শোনার পর থেকে আরো বেশি করে ওর প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়ছে সৌরদীপ? এতদিন পরে কাউকে মনের সবকিছু কথা মনখুলে বলার পর, কাউকে বোঝার পর , বোঝানোর পর, বারবার করে ওর এটাই মনে হচ্ছে, একটা মানুষের জীবনে অতীত থাকতেই পারে, তা ভালো হোক বা খারাপ। কিন্তু তাই বলে আরো জীবনটা কি সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে যায়? নাহ্, জীবন তো দিব্যি নিজের মত এগিয়ে চলে সময়ের নিয়মে, একটুও ভাবেনা অন্যদের কথা, শুধু ভাবে নিজের কথা। তাহলে কিছু মানুষ কেন ভাবেনা, ভাবতে পারেনা সেটা ?? ঠিক যেমন সৌরদীপ নিজে। ওর অনেকবার মনে হয়েছে, যে সবকিছু ভুলে গিয়ে নতুন একটা জীবন শুরু করতে, মাঝে মাঝে ওর প্রচন্ড রাগ হয় অর্পিতার উপরে। যে চলে যায় কষ্ট তো তার হয়না, সে তো সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে চলে যায়, আর সারজীবনের মতো মানসিকভাবে ভেঙে দিয়ে যায় বাকিদের। কষ্ট তো পায়, পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মানুষগুলো, যারা হাজারো স্মৃতির ভারে জর্জরিত হতে থাকে প্রতিদিন।

সৌরিতাকে দেখে কেন না জানি সৌরদীপের মনে একটা বিশ্বাস জাগে, ভরসা জাগে, মনে হয় এর সাথে একদিন না দিনের পর দিন কাটিয়ে দেওয়াও খুব একটা অসম্ভব ব্যাপার নয়। ও বিবাহিতা, ওর মনজুড়ে রয়েছে সেই প্রাক্তন এটা জানা সত্ত্বেও নিজের মনকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারেনা সৌরদীপ। নিজের মনের কথাটা সৌরিতাকে বলতে ভয় লাগে তার, যদি সৌরিতা ভেবে বসে এটাকে দয়া ভেবে! আর ও যে রাজি হবেই, এমনও তো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই! হয়তো খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এই নিয়ে সৌরদীপ, কিন্তু সত্যি বলতে কি অর্পিতাকে হারিয়ে ফেলার পর থেকেই সবসময় যেন একটা অদৃশ্য তাড়া ওকে অস্থির করে তোলে। কোন কিছুকে আর ফেলে রাখতে চায়না ও, অপেক্ষা শব্দ টার প্রতি তীব্র একটা বিদ্বেষ জন্মে ওঠে মাঝে মাঝে।

অনেকক্ষণ ধরে ভাবার পরে সৌরদীপ দুঃসাহসিক ভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল মনে মনে। এর ফলাফল কী হবে সে জানেনা, আদৌ এটা ঠিক না ভুল তাও সে জানেনা। তবু আজ যতই বাধা আসুক, কাজটা সে করেই ছাড়বে। মনের কথা মনে চেপে কষ্ট পাওয়ার থেকে মুখফুটে বলে দেওয়া অনেক ভালো নয় কি??…..

আর দেরী না করে, ফোনটা হাতে নিয়ে সৌরিতার নম্বরটা ডায়াল করল সৌরদীপ। রিং হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত, কেউ ধরছেনা। অস্থির হয়ে ফোনটা কেটে দিল সৌরদীপ, আবার ঘুরিয়ে করল। এবার অবশ্য ফোন আর কেটে দিতে হল না, ফোনটা রিসিভ হল কিছুক্ষণ পরেই। ওপাশ থেকে সৌরিতা খুব পরিচিত গলায় বলল,

-” হুমমম বলো। আজকে কি সারাদিন খুব ব্যস্ত ছিলে?”

-” না না, সেরকম কিছু না। আসলে একটু অন্য কথা ভাবছিলাম। আচ্ছা সৌরিতা, আমার তোমাকে কয়েকটা কথা বলার আছে, মানে আমি জানিনা কথাটা শুনে তুমি কী ভাববে! কিন্তু এই কথা গুলো আমাকে হয়তো এবার বলতেই হবে।”

-” কী কথা???” একটু চিন্তিত গলাতেই বলে উঠল কথাটা সৌরিতা।

-” আচ্ছা তোমার কি মনে হয়নি কখনো, জীবনের সমস্ত অতীত গুলোকে একদিকে সরিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে?”

সৌরদীপের কথাটা শুনে খানিকটা চমকে উঠল প্রথমে সৌরিতা। ঠিক এই কথাটাই তো তার এই কয়েকদিনে বারবার মনে হয়েছে। এরকম কথা হঠাৎ আজকে সৌরদীপ কেন বলছে? তবে কি ওরও মনে এইরকম কিছু ভাবনা এসেছে??
অনেকক্ষণ ভেবে সৌরিতা ইতস্তত হয়ে উত্তর দিল,

-” হ্যাঁ মনে হয়েছে, বারবার, অনেকবার মনে হয়েছে। কিন্তু সবকিছুর ভয় কাটিয়ে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, আর মনেও হয়না কখনো সম্ভব হবে বলে।”

-” কীসের ভয়?”

-” সমাজের ভয়, মানুষের ভয়, সর্বোপরি নিজেকে ভয় পেয়েছি। যদি কখনো নতুন জীবনে গিয়েও, মনে হয় যে ভুল করে ফেললাম, আফশোস হয়, তখন আর কতবার ফিরে আসব পিছনে, তাই না??”

-” হুমম ঠিক, এটা ভুল কথা নয়। কিন্তু যদি এগুলো কখনো কোনো অসুবিধাই না হয়, তখন ??”

-” মানে??? আমি কিছু বুঝলাম না”

-” তুমি আমার সাথে জীবনটা নতুন ভাবে শুরু করবে সৌরিতা? এমন একটা সম্পর্ক তৈরী করতে পারবে? যেখানে তুমি আমি দুজনেই ভালোভাবে শ্বাস নিয়ে বাঁচতে পারব,? স্বামী-স্ত্রী কেবল না, তুমি তোমার ভালোলাগা গুলো নিয়ে থাকবে, আর আমি আমার মত। একছন বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো, ঠিক যেমনটা এখন আছো? আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তাই তুমি আমাকে খারাপ ভাবলেও, আজ এই কথাগুলো বলতে বাধ্য হলাম। পারলে ক্ষমা করে দিও আমাকে”

একদমে কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে গেল সৌরদীপ। ও কথাটা শেষ করেই চুপ হয়ে, সৌরিতার উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগল দুরুদুরু বুকে।

কিন্তু সৌরিতা এতটাই অবাক হয়ে গেছে এই মুহুর্তে যে, কোনো কথাই আসছে না ওর মুখে। আমতা আমতা করে ও ধীরে ধীরে বলল,

-” আর তোমার প্রাক্তন প্রেমিকা?? তাকে আর ভালোবাসো না তুমি?? ”

-” হ্যাঁ বাসি। ও আমার মনে যে জায়গাটায় আছে সেখানেই থাকবে। কিন্তু আমার জীবনে আর চাইলেও ও ফিরবেনা। অনেক সহ্য করেছি আমি, নিজের সাথে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছি। নিজের খুশির জন্যই এমন কাউকে একটা চাই, যার হাতটা আমি অবলম্বন করতে পারব। আর অপর দিকটাও মাথায় রাখব। আমিও সেই মানুষটার অবলম্বন হতে চাই যাকে আঁকড়ে ধরে আমি বাঁচতে চাইছি। তোমাকে আমি কোনো বাঁধনে বাঁধতে চাই না! তোমার যেদিন মনে হবে, কোনো আফশোস অনুভব হচ্ছে, তুমি আর থাকতে চাও না, সেদিন নির্দ্বিধায় চলে যেতে পারো। শতকষ্ট হলেও, আমি বাধা দেবনা”

-” কিন্তু আমি, এসব ভাবতেও পারিনা সৌরদীপ। তুমি বুঝতে পারছ না। আমি একবার বাড়ির অমতে বিয়ে করেছি। আর এই কয়েক মাসের ব্যবধানে আবার অন্য একটা সম্পর্ক, এটা কোনো ভাবে কি সম্ভব??”

-” তুমি কি রাজী?”

-” আমি নিজেও জানিনা। আমি জানিনা আমি কী চাই, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু নতুন করে আবার কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারব কিনা জানিনা। তবে এটুকু পরিস্কার করে বলতে তবে পারি, যে রাজীবের কাছে আমি আর কোনোদিন ফিরে যেতে চাইনা। এরপরে আমি আর কিছু জানিনা। প্লিজ আমাকে, আর এর থেকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করোনা, আমার কাছে উত্তর নেই, সত্যি নেই”

-” বেশ, তুমি ভেবে দেখ তবে। আমি কখনো জানিনা তোমাকে ভালোবাসিটা বলতে পারব কিনা, বা তুমি আমার জীবনে এলে হয়তো আর পাঁচটা স্বাভাবিক সম্পর্কে মতো আমাদেরটা হবেনা। কেবল বন্ধু হয়ে আমরা থাকতেই পারতাম, তবু আমি এই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে স্বীকৃতি দিতে চাইলাম, কারণ আমি চাইনা এই সম্পর্কটার নাম কেউ পরকীয়া নামে উচ্চারণ করে। সেই কারণে। এবার পুরোটা তোমার ইচ্ছা। আমি এই কথাগুলো না বলে হালকা হতে হত পারছিলাম না, তাই এভাবে বলে ফেললাম”

(ক্রমশ)

💜

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here