#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-১৫||
★——–কেন আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন? আপনি আমায় ভুল বুঝেছেন ইশরা..? আমি কাল আপনাকে ইচ্ছে করে… থেমে গেল ইশাল। ইশরার মুখপানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সকাল থেকে হাজার বার চেষ্টা করেও যখন ইশরার সাথে কথা বলার সুযোগ পেল না তখন রুমেই ইশরাকে আটকে দিল। মারিয়াম কে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিল ইশরা নিজের রুমে আর তখনই ইশাল রুমে চলে আসে। রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয় ইশাল। দরজা বন্ধের শব্দ শুনে শোয়া থেকে উঠে বসতেই ইশালকে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিয়েছিল ইশরা। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে ইশাল হাত ধরে সামনে নিয়ে এসে এক দমে উপরোক্ত লথা গুলো বলে দিল। ইশালের এমন বেচয়েন অবস্থা দেখে ইশরার হাসি পাচ্ছে। অতি কষ্টে হাসি চেপে রাখলো সে। পুরো রুম নিরব। বাতাসের শো শো আওয়াজ কানে এসে ঠেকছে। দুটি মানুষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ইশরা দৃষ্টি নত করে রাখলেও ইশাল তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশরা কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দু হাতে ইশরার বাহু চেপে ধরে আরো একটু কাছে নিয়ে আসে। ইশালের বলিষ্ঠ হাতের শক্ত চাপে হালকা ব্যাথা অনুভব হলো। কপাল কুঁচকে চোখ বন্ধ করে নিল। ইশাল ফিসফিসিয়ে বলল,
—-আম’সরি। বুঝতে পারি নি উত্তেজনার বশে অমন একটা কাজ করে বসবো। ইশালের তপ্ত নিঃশ্বাস ইশরার মুখে আছড়ে পড়ছে। ইশরা চোখ খুলে নিজের বাহুই থাকা ইশালের হাতের দিকে একবার তাকালো তারপর ইশালের দিকে তাকিয়ে বলল,
—-আপনি এখন কী করছেন?
ইশরার কথা শুনে ইশাল ছেড়ে দিল। কিছুটা দূরে সরে আসে। ইশরা হালকা হেসে একটু এগিয়ে গিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো,
—এই প্রথম আপনি ভুল করেছেন এমন কিন্তু না।
ইশরার কথা শুনে ইশাল ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
—মানে?
—-মানে ভুল যখন স্বীকার করেছেন তখন চলুন আরো একটা জিনিস দেখাই। বলেই একটু এগিয়ে ইশালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাম পাশের চুল সরিয়ে ডান পাশে রেখে কাধের ওড়না একটু সরিয়ে দিল ইশরা। তারপর আচড়ের জায়গা দেখিয়ে বলল,
—এটাও আপনার করা কর্ম… এখন কুকর্ম নাকি সৎকর্ম তা বলতে পারছি না।
ইশাল অবাক হয়ে বলল,
—-আমার মানে?
—-ওইদিন রাতে মনে আছে। অন্ধকারে কি হয়েছিল? নাকি সেটাও হজম করে ফেলেছেন?
ইশরা বলতেই ইশালের মনে পড়ে গেল।
—-ওই রাতে?
—-আজ্ঞে, এইযে এই অস্ত্র দিয়েই। ইশালের হাত ধরে কনিষ্ঠা আঙুলের নখের দিকে ইশারা দিয়ে দেখিয়ে বলল।
—-সরি…মৃদুস্বরে বলে ইশাল।
ইশরা হেঁসে দিলো। হাসতে হাসতে বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো।
—-আমি কিছু মনে করি নি। ইটস ওকে…
ইশাল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির হাসোজ্জল মুখের দিকে। কিছু না বলে বেরিয়ে যায় ইশাল।
★——-আজ থেকে ৫বছর আগে যেই ভুল টা করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলি সেই কাজ টা আবার কী করা যায় না? ইবাদের এমন কথায় ইশাল ইবাদের দিকে তাকালো।
—-কী বলছিস? কফির মগে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ইশাল।
——–সরাসরি বলি?
—-বল..!
—–ইশরা কে কেমন লাগে তোর?
—-ঠিক আছে মেয়ে হিসেবে। একটু রাগী বাট যায়…. বলে আবারো কফির মগে চুমুক দিল ইশাল।
——আমারও লাগে। তোদের জুটি বেশ লাগে…
ইবাদের কথা শুনে ইশাল থেমে গেল। হাত থেকে কফির মগ রেখে ইবাদের দিকে তাকালো।
—-কী বলছিস জানিস?
—-কেন জানবো না? আমি ভুল কী বলেছি..?
—-আমার সাথে ওনার যায় না। উনি নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। আর নিজের জীবনে একজন ভালো মানুষ ডিজার্ভ করেন আমি ওনার…..
—–তুই নিজেও জানিস তুই কী? কতটা যোগ্য বা কতটা অযোগ্য.. অযথা কথা ঘোরানোর মানে হয় না। ইশাল কে থামিয়ে দিয়ে বলল ইবাদ।
—-তুই যা বলছিস তা হওয়ার না। কারণ আমি…..থেমে গেল ইশাল।
—-বল? থামলি কেন? তুই কী? একজন ছেড়ে গেছে বলে আর কারো দিকে হাত বাড়ানো যায় না? আর কাউকে নিয়ে ভালো থাকা যায় না? কাউকে নিয়ে নিজের দুনিয়া সাজানো যায় না?
—–তুই ভুলে যাচ্ছিস যে গেছে সে আমার অর্ধাঙ্গিনী ছিল। মাই ওয়াইফ…
—হ্যাঁ জানি! ওয়াইফ ছিল। কিন্তু নামে কাজে না। তোকে কী দিয়েছে? তোর খেয়ে তোর পড়ে অন্যের গোড়া মজবুত করেছে। মরে গেলে মনকে শান্তি দিতে পারতাম কিন্তু না এমন কিছুই হয় নি। সে চলে গেছে অন্যের হাত ধরে। তোর অধীনে থাকা সত্ত্বেও……
ইশাল কে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইবাদ চুপ করে গেল। হালকা হেঁসে ইবাদ বলল,
—-আমি ওর যোগ্য ছিলাম না। এটা ও বুঝিয়েছে। আমিও বুঝে নিয়েছি যে, আমি কারো যোগ্য না। আর যদি পাওয়ার কথা বলিস তাহলে বলবো, ভালোবাসায় পেতে হবে কেন?
—–তুই কিসের আশায় বসে আছিস? ইশরা খারাপ কিসে?
——–ডেফিনেটলি ইয়েস! ইশরা একজন ভালো মেয়ে, ভালো মানুষ বাট আমি তার জন্য না। আমি পারফেক্ট না। বলেই উঠে দাঁড়ালো ইশাল। ট্রাউজার এর পকেটে দুহাত রেখে হাটা দিল। ইবাদ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
★সকাল থেকেই ইশরা নিজেকে ইশালের সামনে পড়তে দেয় নি। দিদার মাহসান এহতেশাম ভিলা গেছে। নাহিদা বেগম আর জাফর এহতেশামের সাথে জরুরি কথা ছিল। ইবাদ যেতে চেয়েছিল কিন্তু ইবাদকে যেতে দেয় নি।
সূর্য ডুবেছে সে অনেক্ষণ আগে। আকাশে এখনো হালকা আলোর আভা ছড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে পুরো আকাশ কালো আধারে ডুব দিল। ইশাল ফোনে কথা বলতে বলতে বাগানবাড়ির ছাদে এসে দাঁড়ালো। এদিকটা প্রয়োজন ছাড়া কেউ আসে না। ইবাদ আর ইশাল মাঝে মাঝে এসে আড্ডা দেয়। হঠাৎ ধপ শব্দ শুনে পেছনে ফিরে তাকালো। কান থেকে আস্তে আস্তে ফোন সরিয়ে পকেটে রেখে দিলো। ছাদের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে পা বাড়াতেই পুরো ছাদ আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল। ইশাল চমকে চারপাশে তাকালো। হরেকরকম মরিচবাতির আলোতে ঝলমল করছে ছাদ। চারপাশে তাকিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো লাল গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে ইশরা। গোলাপ টেবিলে রেখে এগিয়ে এল ইশরা। ইশালের সামনে দাঁড়িয়ে এক হাত বাড়িয়ে ইশালের ডান হাত ধরল। পিছনে পা ফেলে পিছিয়ে যেতে থাকে। ইশালের হাত তার হাতে থাকায় ইশালও এগিয়ে যাচ্ছে। টেবিল বরাবর গিয়ে ইশরা দাঁড়িয়ে গেল। টেবিল থেকে গোলাপ গুলো তুলে নিয়ে ইশালের দিকে এগিয়ে দিল। ইশাল ফুলের দিকে একবার তাকিয়ে ইশরার দিকে তাকালো। ইশরা চোখ দিয়ে ইশারা দিতেই ইশাল হাত বাড়িয়ে ফুল নিল। ইশরা একটু এগিয়ে এসে বলল,
—–আমি আপনাকে ভালোবাসি মি. ফায়াজ। আপনি নামক ব্যাক্তি আমার পুরো মন জুড়ে ভর করে আছেন। আমি হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও আপনার ভাবনায় মেতে উঠি। নিজের অজান্তেই আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমার বদমেজাজী মন তার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। যেখানে আমি নিশ্চিন্তে শান্তিতে ডুব দিই। আপনি আমার শান্তিস্থল। আমাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসের মুখোমুখি করানোর জন্য নিয়তি কে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি নামক মানুষটিই যে আমার ভালোবাসাময় অনুভুতিতে রাজত্ব করবেন আমি সেটা কখনোই কল্পনা করি নি। ভালোবাসি আমি আপনাকে…
ইশরার কথা শেষ হতেই ইশাল হাতে থাকা ফুলের দিকে তাকালো। ফুলগুলো টেবিলে রেখে দিয়ে একটু পিছিয়ে গেল,
—–ইটস নট পসিবল ইশরা। আপনার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারবো না।
মুহুর্তেই ইশরার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
—-কারণ?
ইশাল ইশরার দিলে তাকালো।
—-আপনার না জানলেও চলবে। শুধু এটা জেনে রাখুন আমি আপনার যোগ্য না। আপনি ভালো কিছু ডিজার্ভ করেন।
ইশরার মস্তিষ্ক মুহুর্তেই এলোমেলো হয়ে গেল। এগিয়ে এসে ইশালের কলার চেপে ধরে বলল,
—–আমি কী ডিজার্ভ করি, কে আমার যোগ্য কে যোগ্য না সেটা আমি ভালোই জানি। আপনাকে অযুহাত দিতে হবে না।
—-ইশরা শান্ত হোন। কলার ছাড়ুন। ইশরা এক ঝটকায় ছেড়ে দিল।
—-আপনি বুঝতে পারছেন না।
—থাক! আমাকে আর বোঝাতে হবে না। একটা কথা বলুন তো? আমি কী আপনার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই মি. ফায়াজ।
——ব্যাপারটা এমন না ইশরা।
—-তাহলে কেমন ব্যাপারটা? আমাকে বলুন কেমন? কেন আপনি আমার সাথে থাকতে চাইছেন না? কেন আপনি আমায় রিজেক্ট করে দিলেন? আমি কী এতোই খারাপ?
—-ইশরা আপনি….
—–ডাক্তার আপনি কী চান? আমি শান্ত হয়ে যাই? ওকে ফাইন। আমি শান্ত হয়ে যাবো। আজ, এখন থেকে আমি শান্ত হয়ে যাবো ডাক্তার। আমি আর রাগারাগি করবো না। আমি আর অল্পতেই ভাঙচুর করবো না। প্লিজ ডাক্তার আমায় দূরে সরিয়ে দেবেন না। আমি আপনাকে ছাড়া একটি মুহুর্ত ও ভাবতে পারি না। আমি আপনার সাথে থাকতে চাই ডাক্তার। আমি আজীবন আপনার ছায়াতলে নিজেকে দেখতে চাই। এভাবে আমায় দূরে সরিয়ে দেবেন না। ইশরার আকুল কন্ঠের ব্যাকুলতার সুর যেন কাপিয়ে তুলছে ছাদের প্রতিটি ইট, প্রতিটি বালুর কণা। ইশালের বুকে কপাল ঠেকিয়ে কাদঁছে।
পাথরের ন্যায় শক্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইশাল। ইশরার কান্নায় চারপাশ ভারী করে তুললেও ইশালের মনে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন যেন হলো না। ইশরাকে নিজের থেকে সরিয়ে ইশাল বলল,
——শক্ত হোন। আমরা যা চাই তা সবসময় পাই না ইশরা। আপনার ভালোবাসা, আপনার অনুভূতি জমিয়ে রাখুন। আমি এসবের যোগ্য নই। আপনার চোখের পানির মূল্য আমার কাছে পাবেন না। নিজেকে শক্ত করুন। আমার থেকেও ভালো কেউ আপনার জীবনে আসবে ইশরা। আপনি যতটা ভালোবাসা নিয়ে আমার কাছে এসেছেন তার চেয়ে দ্বিগুণ ভালোবাসা নিয়ে কোনো একদিন কেউ আসবে আপনার জীবনে। তার জন্য নিজেকে সামলে রাখুন। কথাটা বলেই ইশাল ছাদ থেকে চলে গেল। ইশালের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ইশরা। টেবিল থেকে ফুল গুলো নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো।
—-আমি আর কোনোদিন কাউকে ভালোবাসবো না। কোনোদিন কেউ আমার জীবনে আসবে না আমি আসতে দেব না। হয় আপনি আসবেন নাহয় কেউ না। ছাদে বসে পড়লো ইশরা। দুহাতে হাটু জড়িয়ে কাদঁতে থাকে অঝোরে..
চলবে?