ইস্ক সাহেবান পর্ব -২২

#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-২২||

★রিভলবার মাথার এক পাশে ঠেকিয়ে পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে ইফতি। পরনে ভারী লেহেঙ্গা। নেই কোনো সাজ, নেই কোনো গয়না। চোখ দুটি থেকে অনবরত পানি ঝরছে। আর দুকদম পিছিয়ে গেলেই গভীর খাদ। ইফতির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইরফান, ইশরা, ইশাল, ফারিস। সবাই ভয়ে ইফতিকে সরে আসতে বলছে। কিন্তু ইফতি সরছে না। ইরফান যত বার এগিয়ে যেতে চেয়েছে ইফতি শুট করেছে। বুলেট থেকে কোনোমতে বেঁচে গেলেও ভয় থেকে ইরফান বাঁচতে পারছে না। ইফতি যদি একবার গভীর খাদে পড়ে যায় তাহলে শেষ। ইফতি কে নানান কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কথা বলতে বলতে এগিয়ে যেতে চাইলেই ইফতি পিছিয়ে যাওয়ার জন্য পা ফেলে। ইরফানের কলিজা ইতিমধ্যে ধড়ফড় করছে। ইবাদ ছুটতে ছুটতে এসে ইফতিকে পাহাড়ের কাছে দেখে থেমে গেল। ধীর পায়ে সবাইকে সরিয়ে ইফতি থেকে দুইহাত দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো। ইবাদকে দেখে ইফতি কান্নামিশ্রিত কন্ঠে হেঁসে উঠলো। ইবাদের পাশেই আছে ইরফান ইবাদ ইরফানের দিকে তাকাতেই ইরফান দৃষ্টি সরিয়ে নিল। হয়তো অপরাধবোধ হচ্ছে। ইবাদ শান্ত কন্ঠে বলল,

—–কেন এমন করছেন? এমন পাগলামি কে করে? সরে আসুন। ওখান থেকে সরে আসুন। আমরা একজায়গায় বসে কথা বলি?

——না কোনো কথা না। আমি কোনো কথা আপনাদের কারো সাথে বলতে চাইছি না। আপনারা চলে যান। আমি আপনাদের কাউকে চাই না। না আপনাকে, না আপনার এই বন্ধুকে। ইরফানের দিকে তাকিয়ে বলে ইফতি।

—–কাকে চান? কাকে চান আপনি? আমায় বলুন আমি এনে দেব! উত্তেজিত হয়ে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন না। সরে আসুন। প্লিজ!! ইবাদের করুণ কণ্ঠস্বর ইফতির হৃদয়ে সামান্য পরিমাণ নাড়া দিলো না। ইফতি বলল,

—–কাউকে চাই না। এগোবেন না কেউ আমি ঝাপ দেব বলে দিলাম। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ঝাপ দেব। বলেই ইফতি এক কদম পিছিয়ে গেল। ইবাদ চিৎকার করে ওঠে,

—-না! একদম না। আম আমি চলে যাচ্ছি। পিছিয়ে যেতে হবে না। সরে আসুন, আম আমি চলে যাচ্ছি।

ইবাদ পেছনে ফিরে দাঁড়াতেই ইশাল কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ইশালের সামনে দাঁড়িয়ে ইবাদ বলল,

—-ভাই ওকে বোঝা না! আমি চলে যাচ্ছি ওকে সরে আসতে বল।

—–সত্যিটা এখনো বলবি না তুই? এখন না বললে কখন বলবি ইবাদ?

——-না আমি বলবো না। তুই ওকে সরে আসতে বল। ইশরা আপনি বলুন প্লিজ ওনাকে সরে আসতে বলুন।

—–বলে দিন না ভাইয়া! সত্যিটা বলে দিন। ইশরার মুখে একই কথা শুনে ইবাদ নিজে থেমে গেল। পেছনে ফিরে ইফতির দিকে তাকিয়ে বলল,

——কেন জানিনা বলতে চেয়েও পারছি না। কি কারণ তাও জানি না। কথাটা শেষ করে ইরফানের দিকে তাকালো। ইরফান এতক্ষণ ইবাদের ছটফটানি দেখছিল। ইবাদকে আগে কখনো এমন করতে দেখেনি ইরফান।

—–ভাই তুই বললেই হতো আমি করতাম না বিয়ে! আমাকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি না করালেও হতো। আমি কিছু মেনে নিতে পারবো না, কিছু মেনে নেওয়ার মত শক্তি বা ক্ষমতা আমার নেই ইরফান। তুই একটি বার বলে দেখতি? ইরফান চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

পায়ে ব্যাথা থাকায় ইফতি দাঁড়াতে পারছিল না। পা দুটি এমনিতেই ফুলে আছে। তারউপর পাহাড়ের উঁচুনিচু মাটিতে আরো ব্যাথা বেড়ে গেছে। যেই জায়গায় ইফতি দাঁড়িয়েছে সেই যায়গা রক্তে লাল হয়ে এসেছে। রক্ত ঝরছে অবিরত। চোখ মুখ ঝাপসা হয়ে আসছে ইফতির। হাতে থাকা রিভলবার টাও ধীরে ধীরে মাথা থেকে সরিয়ে নিলো।
ইশরা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে কাপাস্বরে বলে,

—দেখ বোন, এমন করিস না। তুই যা ভাবছিস তা নাও হতে পারে। একবার মেজাজ টা ঠান্ডা কর। প্লিজ। তুই তো এমন ছিলি না? কত শান্ত ছিলি! কেন এমন করছিস? সরে আয় ওখান থেকে! প্লিজ।

★সব শুনে নাহিদা বেগম ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। ইবাদের সাথেই যে ইফতির আগে সম্পর্ক ছিল তা দিদার মাহসান এইমাত্র বলেছে। জাফর এহতেশাম এর দিকে একবার তাকিয়ে বলল,

—-ইফতি কী তবে সত্যি পালিয়েছে?

—–পালাতেও পারে আবার নাও হতে পারে! দিদার মাহসানের এমন কথায় নাহিদা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,

—-কেন?

—–এর মাঝে একটি ছোট্ট কথা, ইরফান ইফতিকে পছন্দ করতো। ইফতির পরিচয় জানার আগে ইবাদ চেয়েছিল ইফতির সাথে ইরফানের বিয়ে হোক। কিন্তু ইফতি অসুস্থ হওয়ার পর ইবাদ বুঝতে পারে ইফতি কে? তখন অনেকটা দেরী হয়ে গিয়েছিল। ইবাদ তাই প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে ইফতিকে সুস্থ করে তোলে। মাঝপথে ইরফান সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যায়। কিন্তু এভাবে হঠাৎ যাওয়াটা ইবাদের সন্দেহ হয়েছিল। ইবাদ জানতো ইবাদ যদি কখনো ইফতিকে বিয়ে করতে যায় ইরফান এমন একটা কান্ড ঘটাবে। আর তাই ইবাদ ইফতি সুস্থ হওয়ার সাথে-সাথেই বিয়ের বন্দোবস্ত করতে বলল। আমি ইরফানের দিকেই ইঙ্গিত করছি কারণ আমি ইরফান সম্পর্কে জানি। ইরফান ছাড়া ইফতির দিকে কেউ হাত বাড়ানোর মত নেই।

—-এখন কী হবে মামা? ইরফান সম্পর্কে আমি যতদূর শুনেছি ইরফান তো..

——কিচ্ছু হবে না। ইফতির জন্য ইবাদ যেই জুয়েলারি কিনেছিল সেই জুয়েলারিতে একটা মিনি ট্র‍্যাকার সেট করা আছে। ইফতি কোথায় থাকবে বা আছে সেটা ইবাদ দেখতে পাবে। জুয়েলারি যতক্ষণ ওর সাথে থাকবে ও সেফ। আর এতক্ষণে হয়তো ইবাদ ইফতির খোঁজ পেয়ে গেছে। ইফতি অবধি পৌঁছে ও গেছে হয়তো।

——– আমি চাইনা মামা ওরা আলাদা হোক। ওরা একসাথে থাকুক আমি এটাই চাই। কোনো বিপদ-আপদ না হলেই হলো।

——-বিপদ হবে ন। ইবাদ ঠিক ইফতিকে নিয়েই ফিরবে। আমার নাতি তো ভরসা আছে। ওকে আমি অনেক চেষ্টা এর আগে করেছিলাম কিন্তু ও ইফতিতেই আবদ্ধ হয়ে গেল। আমি জানিনা কিভাবে ইফতি ওর সাথে যোগ হল কিন্তু ইফতি ছাড়া এখন আমার ইবাদ সম্পুর্ণ খালি। আমি চাইনা আমার ইবাদ আবারো শূণ্যতার সর্বশিখরে পৌঁছে যাক। আজীবন যেই শূণ্যতা ওকে ঘিরে ছিল তা আমি কাটতে দেখেছি। ইফতিই সেই যাকে পেয়ে আমার ইবাদ বদলে গিয়েছিল একটু একটু। আমি আমার ইবাদের খুশি আবারো হারিয়ে যাবে এটা ভাবতে পারিনা। ইফতি ওর থেকে দূরে যাবে ভাবতেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠে। ইবাদের কথা বাদই দিলাম। যখন ইফতি অসুস্থ ছিল আমি দেখেছি রাতের পর রাত ঘুম হারাম করে ইবাদ কেমন ইফতির পাশে বসে থাকতো। ইফতিই যেন ইবাদের একমাত্র সুস্থ থাকার সম্বল। ইফতি হারিয়ে গেলে ইবাদ অসুস্থ হয়ে পড়বে মানসিক ভাবে।

—–ইফতির কিচ্ছু হবেনা মামা। ইফতিকে ইবাদ ঠিকই নিয়ে আসবে। তুমি চিন্তা করো না।

★—–ইফতি সরে আসুন। প্লিজ!! ইফতি এখনো নিজের হাতে রিভলবার ধরে রেখেছে। ইশালের কথা যেন ইফতি শুনতে পাচ্ছে না। ইফতি কাপাস্বরে বলে উঠল,

——আমি একজন কে ভালোবাসতাম। খুব ভালোবাসতাম। বাসতাম না আমি এখনো বাসি। আমি আজীবন তাকে ভালোবেসে যাবো। আমি কখনো তাকে দেখি নি। আমি তার নামও জানি না। আমি শুধু জানি উনি পেশায় ডাক্তার। আমি ওনার কন্ঠস্বরের প্রেমে পড়েছি। আমি যখন খুব জড়তা নিয়ে থেমে যাচ্ছিলাম বার বার, নিজের অব্যক্ত কথা বলতে পারছিলাম না, তখন উনি অনায়াসে আমার সমস্ত না বলা কথা বুঝে যেত। আমি অনুভব করতাম উনি আমাকে ভালবাসে। আমার থেকেও বেশি। আমি কখনো তার থেকে দূরে থাকার কথা ভাবিনি। আমি আপনাদের কারো সাথে নিজের জীবন জড়াতে পারবো না। কারণ আপনারা সবাই পেশায় ডাক্তার। তবে তার মত না। বলেই হাসলো ইফতি।
তার মত একটা গুণ ও আপনাদের মাঝে নেই। আমি আপনাদের মাঝে তাকে খোঁজার চেষ্টা করি। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি। কারণ সে তো সে-ই! তার মত কেউ হয় না। আর না আমাকে এত ভালো বাসতে পারবে! আপনারা সবাই সবার জায়গায় ঠিক। কিন্তু ওইযে আমি একজনেতে আবদ্ধ। আমার সব কিছু ওখানেই শেষ আর ওখানেই শুরু। তাই আপনাদের কাউকে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। বলেই ইফতি এক কদম পিছিয়ে গেল। ইরফান ইবাদের দিকে একবার তাকালো। ইফতির কন্ঠে, ইফতির চোখে, ইফতির প্রতিটি কথায় শুধু ইবাদের জন্য ভালোবাসা। অজান্তে হলেও ইফতি ইবাদকেই ভালোবাসে।

ইবাদ হালকা হেসে বলল,

—–আমার ভেতরবাড়ি শূন্য করে দেবেন না সাহেবান। রাণী না থাকলে রাজার কোনো মূল্য থাকে না। ইবাদের এই সামান্যতম কথা ইফতির কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই ইফতি ত্রস্তনয়নে তাকালো ইবাদের দিকে। চোখ জোড়ায় পানি টলমল করছে। ঝাপসা হয়ে আসছে সামনের দৃশ্য। ইফতির হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল। জ্ঞান হারিয়ে
ইফতি ঢলে পড়লো খাদের দিকে। সবাই আতংকিত কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে ‘ইফতি’ বলে।

চলবে…??

||ইফতি গোয়িং🙂||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here