উমা পর্ব -২৬+২৭+২৮+২৯

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#২৬তম_পর্ব

শাশ্বত কিছুক্ষন চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। রুদ্রের মুখিটা লাল হয়ে আছে ক্রোধে। শাশ্বত একটি তাচ্ছিল্যময় হাসি হাসলো। তারপর বললো,
“তাহলে তুই বলে দে, মামা মশাই এর পুলিশে ধরাবার পেছনে কি তোর হাত ছিলো? আমি তো পুলিশকে কোনো খবর দেই নি, তবে এতোটা নিখুঁত খবর দিলোটা কে? মামা মশাই এর একজন ই বিশ্বস্ত কুকুর রয়েছে সে হলো তুই”

শাশ্বতের প্রশ্নে ঈষৎ বিস্মিত হলো রুদ্র। কিন্তু বিস্ময়ের কোন সুক্ষ্ণ রেখাও আনলো না মুখোভাবে। উলটো বিদ্রুপের হাসির প্রলেপ একে বলল,
“তোকে কি খবরের কাগজের দপ্তর থেকে ছাটাই করে দিয়েছে? দেখি তো বাড়িতেই বসে থাকিস, তা কি বাড়ি বসে বসে কি বোমকেশ হবার সখ জেগেছে নাকি? আবল তাবল বকছিস তাই”
“আমি আবল তাবল বকছি?”
“বকছিস না? ছেলে হয়ে বাপ কে কেউ জেলে দেয়?”
“তোদের বাপ ছেলের কি সম্পর্কের টান বলে কিছু আছে? তোরা তো শুধু সুযোগ খুজিস, কিভাবে অন্যকে চুষে নিজের ফয়দা করা যায়। ভুল বললাম? তুই খুব ভালো করেই জানিস মামা মশাই তোকে কোনোভাবেই নিজের পথের কাঁটা হতে দিবেন না। তাই তো তুই মামা মশাইকে শাহাদাতের কেসে ফাসালি। শাহাদাতকেও হাসপাতালে পাঠানোর পেছনে তোর হাত আছে। মামামশাই ভেবেছিলো ছেলেতো তার শত্রুতে শাস্তি দিয়েছে। তাই দুপুর হতে না হতে তিনি শহরে ছোটেন। তিনি আসলে কিশোরগঞ্জ গিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে ছেলে তো তাকেই নিজের রাস্তা থেকে সরাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তুই ভালো করেই জানিস, মামা মশাই এর নামে অপবাদ দিলে তাকে পার্টির লোকেরা এবার অন্তত দাঁড়াতে দিবে না। সেও খানিকটা ভয় পাবেন। সেই সুযোগে তোর হাতে খড়ি হবে পার্টিতে। ঠিক না?“

রুদ্র কিছুক্ষণ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাশ্বতের চোখের দিকে। শাশ্বতের কথায় এক অন্য আত্নবিশ্বাস রয়েছে। সে নির্ভীক, তার চোখে ভয়ের ক্ষীন রেখাও নেই। রুদ্র এবার শব্দ করে হেসে উঠে। তারপর হাসি থামিয়ে বলে,
“তুই তাহলে আমার পেছনে গুপ্তচর লাগিয়েছিস? আমি ত ভেবেছিলাম তুই শুধু রকিবুল মাস্টারের সাথে হাত মিলিয়ে বাবার পর্দা ফাঁশ করার ধান্দায় এসেছিস। এখন তো দেখছি আমাকেও ছাড়ছিস না। ভালো ভালো। তবে এতোক্ষন যা বললি, তুই সেটা প্রমান করতে পারবি না। কারন আমি বাবার ন্যায় কাঁচা খেলোয়ার নই। শোন আমি কি বলি, অহেতুক আমাদের পেছনে লাগিস না। কর্ম কর, ভালো সাংবাদিক তুই অথচ আমাদের পেছনে হাত পা ধুয়ে পড়েছিস। সত্যি বলছি সময় নষ্ট। কারণ আমি থামছি না, আমার খেলায় যে আসবে হয় তাকে সরে যেতে হবে নয়তো আমি সরিয়ে দিবো।“

বেশ ঠান্ডা কন্ঠে কথাগুলো বললো রুদ্র। শাশ্বত চোখ কুচকে তাকিয়ে রয়েছে রুদ্রের দিকে। রুদ্রের মতো জেদী মানুষের দ্বারা এমন কথা বলা অস্বাভাবিক নয়। কথা শেষ হবার পর শাশ্বতের উত্তরের অপেক্ষা করলো না সে। উমার কাছে যাবার জন্য পা বাড়ানোর সাথে সাথে শাশ্বত পেছন থেকে বলে উঠলো,
“তুই য়ার মামা মশাই এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই জানিস তো। একেবারে বাপের বেটা কি না”

কথাটা শুনে পেছনে ঘুরে তাকায় রুদ্র,। তার ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে আসে। তীর্যক দৃষ্টি প্রয়োগ করে শাশ্বতের দিকে। কিন্তু শাশ্বত তা উপেক্ষা করে শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
“ ভাবিস না তুই আর মামা মশাই আলাদা, ক্ষমতার জন্য যেমন মামা মশাই সকলকে ব্যাবহার করেন ঠিক তেমন ই তুই ও করিস। যেমনটা এখন উমাকে করছিস। আমি তোকে হাড়ে হাড়ে চিনি রুদ্র। শুধু নিজের লাভের জন্য ই তুই উমাকে ব্যাবহার করছিস। এই ষোড়শী মেয়েটি কেবল ই তোর দাবার গুটি। সুযোগ এলে ওকে বলি দিতেও দুবার ভাববি না।“

রুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। শাশ্বত তার পাশ কাটিয়ে চলে যায় বারান্দার দিকে। শাশ্বতের শেষ কথাটা কর্নকুহরে ঝংকার তুলছে। সত্যি কি সে তার বাবার মত? সত্যি কি সময় আসলে সে উমাকে ও বলি দিবে? প্রশ্নগুলো সময়ের জন্যই তোলা থাক। সময় সব প্রশ্নের উত্তর এক এক করে দিয়ে দিবে।

রাত ঘন হচ্ছে, ঘুমের ঔষধ দেবার কারণে ঘুমোচ্ছেন নিখিল বাবু। তার ঠিক পাশে বসে আছে উমা। রোগীদের একজন কে তার পাশে থাকতে দিচ্ছে। তাই উমাই থাকছে আজ রাত্রি। শাশ্বত এবং রুদ্র উভয় ই বাহিরের বেঞ্চিতে অপেক্ষারত। দুজন দুজনকে সহ্য না করলেও উমার খাতিরে মুখ বুঝে একই সাথে রয়েছে। রোগীদের জন্য রাত্রী খুব বিপজ্জনক। বেশিরভাগ অঘটন এই কালো রাত্রীতেই ঘটে। তাই রাত্রী সজাগ এবং সচার থাকাটা জরুরী। উমার দুপুর থেকে পেটে কিছুই পড়ে নি, রুদ্র জোর করে হাতে ঠান্ডা বনরুটি ধরিয়ে দিয়েছে। ঠান্ডা বনরুটিখানা দাত দিয়ে কাটতে চাচ্ছে না। তবুও পে্টের ক্ষুদা এক অসহনীয় যন্ত্রনা। উমা খানিকট জোর করেই খেলো রুটিটা। নিখিল নাকে অক্সিজেন লাগিয়ে ঘুমিয়ে আছে। উমা শান্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে চেয়ে রইলো। কাঁচা পাকা চুল গুলোয় ক্ষনে ক্ষনে হাত ঘুরিয়ে দিচ্ছে। মেয়ে বড় হলে পিতা হয়ে যায় পুত্র। উমার ক্ষেত্রেও সেটাই, তার অচেতন পুত্রকে ক্ষনে ক্ষনে আদর করে দিচ্ছে সে। তার বারে বারে চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তার। অসহায় মুখখানি দেখলেই কান্নার বেগ বাড়ছে। হ্যা্, নিখিল মানুষ হিসেবে অত্যন্ত অপদার্থ, কিন্তু সে একজন পিতা। আর সন্তানের কাছে পিতা যেমন হোক না কেনো সে তার সর্বোমূল্যবান ব্যাক্তি। উমা ও ব্যতিক্রম নয়, তাই তো পিতার এই দূর্সময়ে তার হাত খানা ধরে ক্লান্ত মেয়েটি অশ্রুসিক্ত নেত্রে রাত্রীযাপন করছে। হুট করেই নড়ে উঠলো হাতখানা, উমাও নড়ে উঠলো। মিহি কন্ঠে বলল,
“বাবা কিছু লাগবে?”

নিখিল চোখ খুললো। প্রথমে কিছুক্ষন শুন্য দৃষ্টিতে চাইলো, হয়তো ঠাহর করতে পারে নি। উমা ধীর স্বরে বলল,
“আমি উমা, আমাকে চিনতে পারছো?”

নিখিলের চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। কাঁপাহাতে উমারহাত খানা আকড়ে ধরলো। কিছু অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেলো ঠিক ই কিন্তু বোঝা গেলো না। শ্লেষ্মা জড়ানো গোঙ্গানি বুঝতে পারলো না উমা। সে এগিয়ে গেলো। মুখের কাছে কান ঠেকালো। নিখিল গো গো করছে, উমা বুঝতে পারলো বাপের কষ্ট হচ্ছে। তাই মৃদু স্বরে বললো,
“কথা বলো না বাবা, কষ্ট হবে”

কিন্তু নিখিল থামলো না, সে কাঁদছে এবং গোঙ্গাচ্ছে। বারে বারে মাস্ক খোলার জন্য মরিয়ে হয়ে উঠছে। এক অস্থির অস্থিরতা কাজ করছে তার মধ্যে। যেনো এখন কথাখান না বললে তার শান্তি নেই। উমার বুকটা হুট করেই কেঁপে উঠলো। যেনো এক অদ্ভুত শক্তি তার আসে পাশে ঘিরে আসছে। প্রান যাবার সময় কি এমনটা হয়? নিখিলের অস্থিরতা বাড়লো। উমা সময় ব্যয় না করে হাক দিল রুদ্রকে,
“শুনছেন, বাবা যেনো কেমন করছে।“

রুদ্রের চোখ বুঝে আসছিলো। উমার ডাকে ঘুম পালিয়ে গেলো। সে ছুটে গেল উমার কাছে, শাশ্বত ডাক্তার ডাকতে গেলো। সরকারি হাসপাতালে এই এক সমস্যা, ডাক্তার পাওয়া যায় না। নার্স এলো হেলেদুলে। নিখিল যথারীতি হাসফাস করছে। গো গো আওয়াজটা বাড়ছে। নার্স তার অবস্থা দেখে একটা ইঞ্জেকশন দিলো। কিন্তু কাজ দিলো না। নার্সের মুখে চিন্তা দেখা গেলো। সে ওয়ার্ড বয়কে ডাকলো। উমা এদিকে ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বুকটা লাফাচ্ছে, এক অজানা অস্থিরতা কাজ করছে। নিঃশ্বাস যেনো আটকে আসছে। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। কি করলে বাবাকে ঠিক করবে তার জানা নেই। রুদ্র উমার হাত শক্ত করে ধরলো। কঠিন সত্যের জন্য সে প্রস্তুত কিন্তু তার ষোড়শী নয়। বেঁচারি নিজ পিতার এমন শেষ মূহুর্তটি ঠিক নিতে পারবে কি জানা নেই। ওয়ার্ড বয় এলো, বুকে বেশ কিছুবার আঘাত করলো। প্রায় আধা ঘনটা যমে কোস্তাকোস্তি করলো, অবশেষে……………
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#২৭তম_পর্ব

রুদ্র উমার হাত শক্ত করে ধরলো। কঠিন সত্যের জন্য সে প্রস্তুত কিন্তু তার ষোড়শী নয়। বেঁচারি নিজ পিতার এমন শেষ মূহুর্তটি ঠিক নিতে পারবে কি জানা নেই। ওয়ার্ড বয় এলো, বুকে বেশ কিছুবার আঘাত করলো। প্রায় আধা ঘনটা যমে কোস্তাকোস্তি করলো, অবশেষে যমের বিজয় হলো। দুজন ওয়ার্ড বয় এবং একজন নার্স মিলেও বাঁচাতে পারলো না নিখিলকে, যমের কাছে হার মানতেই হলো। যে দেহ কে তিনজন ও সামলাতে পারছিলো সেই দেহ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেলো। মুখটা হা করে চোখ উলটে পরে রইলো পঞ্চান্ন বছরের নিখিল কুমার। ডিউটি ডাক্তার এতোক্ষনে এলো। সে নাড়ি পরীক্ষা করে জানালো,
“নিখিল বাবু আর নেই।“

শাশ্বত এতোক্ষন চুপ করে ছিলো। কিন্তু এখন আর দমে থাকতে পারলো না। তীব্র কন্ঠে বলে উঠলো,
“এতোক্ষন কোথায় ছিলেন? আপনার না রাতে ডিউটি? তাহলে কোথায় ছিলেন? আপনার রুমে পর্যন্ত আমি গিয়েছি। বড় ডাক্তারকে ফোন দেওয়ার পর ও তিনি কেন আসেন নি?”
“দেখুন আমিও মানুষ, আমি একটু রেস্ট এ গিয়েছিলাম। এই আধা ঘন্টায় এত কিছু হয়ে যাবে আমি কিভাবে বলবো বলুন।“
“আপনি কি মশকরা করছেন আমার সাথে? একজন সংকটপুর্ণ রোগীর ক্ষেত্রে একমিনিট ও অনেক কিছু। আপনাদের গুরুত্ব ই নেই। এই যে নার্স মহোদয়া এসেই না বুঝে একটি ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলেন। তারপর অবস্থা আরোও খারাপ হতে লাগলো।“
“দেখুন, উনি উনার কাজ করেছেন। আমরা মানুষ, ঈশ্বর নই। আমাদের হাতে যা ছিলো আমরা করেছি। জীবন বাঁচানো আমাদের ধর্ম, কিন্তু মৃত্যু আমাদের হাতে নেই।“

শাশ্বত শান্ত হলো না। তার মেজাজ অত্যধিক খারাপ। মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না সে। বারংবার মনের নাড়া দিচ্ছে অবহেলার জন্যই আজ নিখিল বাবুকে বাঁচানো গেলো না। তীব্র এবং শক্ত কন্ঠে বললো,
“হাসপাতালের ডাক্তারদের চাকরি যদি আমি না খাই আমি সাংবাদিক শাশ্বত চ্যাটার্জি নয়, এই বলে রাখলুম।“

শাশ্বতের হুমকিতে পাংশুটে বর্ন হয়ে গেলো ডিউটি ডাক্তরের মুখশ্রী। বেশ ভয় পেয়েছে সে। সরকারী কর্মকর্তাদের এই এক পেশার মানুষের ই ভয় থাকে, তা হলো সাংবাদিক। আমাদের দেশের সকল সাংবাদিকদের হয়তো অট্টলিকা নেই, সবার জন্য গাড়ি নেই, নন আনতে পানতা ফুরায়। কিন্তু তাদের কলমের যে জোর আছে তা হয়ত দেশের কোটিপতিদের ও নেই।

নিখিলের মুখে চাদর টেনে দেওয়া হলো। মৃত্যু সনদ বানাতে চলে গেলেন নার্স। উমা এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কিছুক্ষন বাদে বাদে তাকে দেখছে। রুদ্র খেয়াল করলো উমা নড়ছে না কিন্তু তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। মুখ রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় ষোড়শী যেন স্তব্ধ পাথর মূর্তি হয়ে গিয়েছে। রুদ্রের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর সাক্ষী হওয়াটা খুব কঠোর কাজ, পৃথিবীর সবথেকে পীড়াদায়ক মূহুর্তটুকু চোখের সম্মুখে দেখাটা খুবই নিষ্ঠুর। রুদ্রের আজ আড়াই মাস পর মদ খেতে ইচ্ছে করছে। কথাটা হাস্যকর শোনাচ্ছে, কেউ কেউ সমালোচনা করে হয়তো মন্তব্য করবে,
“কি পাষণ্ড অমানুষ”

কিন্তু রুদ্রের তাতে কিছুই যায় আসে না, তার মস্তিষ্ক থেকে কিছুক্ষন পুর্বের স্মৃতিটুকু সরাতে ইচ্ছে করছে। এমন নয় যে রুদ্র নিজে যতবার মারাত্মক কাজ করে সেই স্মৃতি তাকে তাড়া করে না। করে, প্রচন্ড ভাবে করে। তখন মদ তার গিলতেই হয়। হয়তো এতোটা প্রকোট আকর্ষণ থাকে না৷ তবে ক্ষীন প্রভাবটা থাকেই৷ আজ ও ব্যাতিক্রম নয়, রুদ্রের মতে মৃত্যু পৃথিবীর সবথেকে কঠিনতম সত্য। কোনো স্বাভাবিক মানু্ষের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে এই মৃত্যুকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই রুদ্রের ভেতরটা আজ অশান্ত হয়ে রয়েছে। কিন্তু সে সরতে পারছে না শুধুমাত্র উমার কথা ভেবে। উমার জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব। নিখিলের সংবাদ কথা শোনার পর থেকে সে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। এক বিন্দু অশ্রু ও গড়ায় নি চোখ থেকে। চোখগুলো যেন সাহারা মরুভূমি হয়ে গেছে। শুধু শান্ত দৃষ্টিতে নিখিলের মৃত লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন পর পর ঈষৎ কেঁপে উঠছে। অল্প শোকে কাতর অতি শোকে পাথর। উমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা যেনো জ্বলন্ত সত্য। শুধু একটাই কথা সারা মস্তিষ্ক জুড়ে ঘোরপাক করছে তা হলো, সে আজ থেকে অনাথ। মা বাবা কেউ নেই তার। আপন মানুষের সংখ্যাটা ক্রমশ কমেই যাচ্ছে, বিধাতার এমন নিষ্ঠুরতাকে নীরব চিত্তে মেনে নিতে হচ্ছে উমাকে। আর করবেই বা কি? বিধাতার সাথে লড়ার ক্ষমতা সামান্য মানবীর নেই।

লাশ নিয়ে ফিরলো গ্রামে ফিরা হলো ভোরের দিকে। লাশবাহী এম্বুলেন্স গ্রামে ঢুকতেই সবার নজর সেটার দিকেই আকটে গেলো। চাপা রাস্তায় আর নিতে না পেরে এম্বুলেন্স থেমে যায়। এবার ধরাধরি করে লাশ নিতে হবে। রতী কেবল পুজো সেরে উঠেছিলো তখন ই লোক লোস্কর প্রবেশ করে নিখিলের আঙ্গিনায়। লোকের সমাগম দেখেই বুকটা কামড় পড়ে রতীর। আচলখান টেনেই আঙ্গিনায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। উমা যন্ত্রচালিত পুতুলের ন্যায় সবার আগে প্রবেশ করে। উমার দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো তার মুখখানা রক্তশুন্য লাগছে। বুঝতে বাকি রইলো না নিখিল আর নেই। ঘরের কাঠখানা ধরেই ধপ করে বসে পড়ে রতী। আর্তনাদ করে উঠে,
“উগো, তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে”

রাজশ্বী মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তার বুকখানা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। ছুটে যায় সে দিদির নিকট। দিদিকে ঝাকিয়ে বলে,
“দিদি, বাবা কি আর নেই?”
“না”

উমার স্বাভাবিক শান্ত কন্ঠের উত্তরে ধপ করে বসে পড়ে রাজশ্বী। সেই মূহুর্তেই নিখিলের লাশখানা ধরাধরি করে আনা হয়। রাখা হয় চৌকিতে। চোখ বুঝে শান্ত ঘুমন্ত নিখিলের মুখখানা দেখে থমকে যায় রাজশ্বী। পিতার নিথর দেহটি থেকে চিৎকার করে উঠে সে। রতীর আর্তনাদ, রাজশ্বীর চিৎকার সবই কানে যাচ্ছে উমার। কিন্তু সে নীরব, নিশ্চুপ। চোখ গুলো পানিশূন্য, ফ্যালফ্যালিয়ে মা বোনের দিকে চেয়ে আছে। একটা সময় রতী এসে তাকে ঝাকিয়ে বললো,
“বলেছিলি না বাবার কিছু হবে না। হলো তো? আমি জানতুম তিনি ফিরবেন না”

উমা উত্তর দিলো না। তার মুখ থেকে আর কোনো শব্দ কেউ শুনলো না।

রুদ্র জামাই হিসেবে সকল কার্য সম্পাদন করলো। সকালের সূর্য উঠতে শ্বশানে নিয়ে যাওয়া হলো নিখিলকে। নিখিলের আত্নীয়রা সমাবেশ করেছে, রতীকে শান্তনা দিচ্ছে। কেউ রাজশ্বীকে থামাচ্ছে। উমা তখন ও নিথর। কেউ বলছে,
“মেয়েটা বাপের শোকে পাতগর হয়ে গেছে, পাগল হয় কিনা কে জানে?”

গোপালের হাত ধরে মুখাগ্নি করে রুদ্র। লোকটির কাছে ক্ষমাটি চাওয়া হয় নি। বড্ড অনুতাপ হচ্ছে। সেদিন খুব খারাপ ব্যাবহারটি করেছিলো সে। এখন আক্ষেপ হচ্ছে, না করলেই হয়তো ভালো হতো। খুব অস্থির হয়ে রয়েছে রুদ্র। বাদল পাশে দাঁড়াতে শান্ত স্বরে বললো,
“দোস্ত আমার আর শরীর চলছে না।”
“সব বীরত্ব কি ফুরিয়ে গেলো?”
“তুই তো জানিস, ওইটা বাদে আমার মন বড্ড কাপুরুষ। মাল থাকলে দিস।”
“শ্বশুরের মুখাগ্নি করেই খাবি? লোকে শুনলে কি বলবে? আর বউ মনি? তাকে কথা দিয়েছিস?”
“আমি আর পারছি না বাদল। আমার মাথাটা ঘুরছে। ঘুমের প্রয়োজন ”

বাদল কিছুসময় চুপ থেকে বললো,
“দোকানের কোনায় আছে, আবারো বলছি। কেলেঙ্কারি হবে”
“হোক। মৃত্যু চেয়ে বড় কেলেঙ্কারি আর কি আছে? আমার সামনে পুরোনো স্মৃতি গুলো ঘুরছে”

বাদল আর কিছু বললো না। সে জানে রুদ্র কি বলতে চাইছে। রুদ্র ভেতর কোনো ঘূর্ণিজাল মাটি চাপা আছে তা কেবল এই ছেলেটি ই জানে। ছোট বেলার জিগড়ি কি না। তাই সে চুপ করে বন্ধুর পাগলামি দেখলো৷ অপরদিকে শাশ্বত সব কিছুই চুপ করে দেখছে। কষ্ট থেকেও একটা ব্যাপার তাকে ভাবাচ্ছে, তা হলো মরার আগে নিখিল কি কিছু বলতে চাচ্ছিলো?

১৫.
নিখিলের মৃত্যুর সপ্তাহ গড়িয়েছে, উমা এক হাতে সকল কার্য করেছে। মেয়েটি একটিবার ও কাঁদলো না। রুদ্র মদ খেয়ে সন্ধ্য অবধি ঘুমিয়েছিলো। উঠে ভেবেছিলো উমা হয়তো এবার কাঁদবে। কিন্তু ভুল উমা অত্যন্ত স্বাভাবিক আচারন করছিলো। রুদ্র তাকে কাঁদাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পাভ হয় না। বরং তাকে অবাক করে উমা বলে,
“বাবার মৃত্যুতে আমার তো করার কিছু ছিলো না। তবে আমার মতো অন্য কোনো মেয়ে যেনো তার পিতাকে না হারায় সেই কাজ আমি করবো।”

ষোড়শী মেয়েটি এক রাতেই বড় হয়ে গিয়েছে। রুদ্র তাকে মদ খাওয়ার কথা চেপে গিয়েছিলো। ভেবেছিল মেয়ে বুঝবে না। কিন্তু উমা তাকে আরোও অবাক করে বলে,
“মদ খেলেই কি স্মৃতি ভোলা যায়? যতসব উছিলা মাত্র। স্মৃতি মোছা এতো সহজ নয়।”

রুদ্রবুমার মাঝে এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারলো না। ভাবলো গ্রাম থেকে দূরে থাকলে হয়তো মেয়েটি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাই আজ কালীগঞ্জ যাবার কথা বলবে সে। উমা তখন কাপড় গুছাচ্ছিলো।
“আমাদের ও বাড়ি যেতে হবে। কাল উপজেলার দিকে যাবো যে। অনেক গোছানো বাকি”
“বেশ, আমি রাজশ্বী আর মাকেও গোছাতে বলে দেই।”

উমার স্বাভাবিক বক্তব্যে অবাক হয় রুদ্র। চোখ কুচিয়ে বলে,
“উনারা কি গোছাবেন?”
“ওহ, আপনাকে বলা হয় নি মা রা এখন থেকে আমার সাথেই থাকবে……
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#২৮তম_পর্ব

রুদ্র উমার মাঝে এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারলো না। ভাবলো গ্রাম থেকে দূরে থাকলে হয়তো মেয়েটি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাই আজ কালীগঞ্জ যাবার কথা বলবে সে। উমা তখন কাপড় গুছাচ্ছিলো।
“আমাদের ও বাড়ি যেতে হবে। কাল উপজেলার দিকে যাবো যে। অনেক গোছানো বাকি”
“বেশ, আমি রাজশ্বী আর মাকেও গোছাতে বলে দেই।”

উমার স্বাভাবিক বক্তব্যে অবাক হয় রুদ্র। চোখ কুচিয়ে বলে,
“উনারা কি গোছাবেন?”
“ওহ, আপনাকে বলা হয় নি মা রা এখন থেকে আমার সাথেই থাকবে“
“তোমার সাথে থাকবে মানে? একটু খোলসা করে বলবে?”
“অবশ্যই, আমি মায়েরা আমার সাথে কালীগঞ্জে যাবেন। আমি তাদের একা ফেলে কালীগঞ্জে যাবো না। রাজশ্বী, গোপালের ভবিষ্যতটাও দেখতে হবে। মা একা তাদের কিভাবে পালবে? তাই এই সিদ্ধান্ত”

নির্লিপ্ত চিত্তে কথা গুলো বললো উমা। রুদ্র উমার এরুপ আচারণে শুধু অবাক ই হলো না, খানিকটা বিরক্ত ও হলো। উমার নিজের মা হলে হয়তো রাজীও হয়ে যেত সে, কিন্তু রতী উমার সৎ মা, শুধু তাই নয় রতীর চেয়ে স্বার্থপর খুজে পাওয়া ভার। সেই লোভী নির্দয় নারীকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে হলো না। রুদ্র ঈষৎ বিরক্তি মাখা গলায় বললো,
“যদি পালতে সমস্যা হয়, আমি না হয় মাসে মাসে তাদের কিছু টাকা দিয়ে দিবো। রাজশ্বী এবং গোপালের পড়াশোনা, রাজশ্বীর বিয়ের সব খরচ না হয় আমি ই দিবো। কিন্তু তাদের আমাদের সাথে কালীগঞ্জে নেবার কোনো মানেই হয় না। মা-বাবাকে কি উত্তর দিবো? একেই তোমার পড়াশোনার জন্য কম যুদ্ধ তো আমাকে করতে হচ্ছে না। তাদের মতের বিরুদ্ধে আমরা কালীগঞ্জ যাচ্ছি। সেখানে এই উটকো ঝামেলার কোনো মানে নেই। আর লোকে কি বলবে? কখনো দেখেছো মেয়ের বাবা-মাকে শ্বশুর বাড়ি থাকতে? অহেতুক মানুষ কথা রটাবে। সাহায্য অন্য ভাবেও করা যায়”

রুদ্র এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো, উমা হাতের কাজ থামিয়ে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। কিছুক্ষন চুপ থেকে বরফ শীতল কন্ঠে বললো,
“আচ্ছা, এই লোক কি বলবে বা ভাববে কথাটা না বললে কি নয়? শ্বশুরের মৃত্যুতে মাল খেয়ে যখন টাল হয়ে পড়ে ছিলেন তখন কি পরোয়া করেছিলেন? তবে এখন কেনো? আর মেয়েদের জন্য আলাদা নিয়ম কেনো? কেনো ছেলেরা তার মা-বাবার পাশে না থাকলে সমাজ বলে কি পাষন্ড ছেলেটি, বৃদ্ধ বিধবা মা এবং ভাই বোনকে ছেড়ে আলাদা থাকে। আর মেয়ে যদি সন্তানের দায়িত্ব ও পালন করতে চায় তখন বলে উঠে লোকে কি ভাববে? টাকা দিয়ে দিলেও তো হয়। বিয়ের পর বাবা-মার প্রতি দায়িত্ব পালন করলে লোকে কি ভাববে! কন্যা সম্প্রদান করে দিলে কি সত্যি মেয়ের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? কনকাঞ্জলীর পর মেয়ের কোনো ঋণ থাকে না? সে মেয়ে বলে তার ভাই বোনের প্রতি কি আদৌও কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারবে না? ব্যাপারগুলো কি হাস্যকর না!”

উমার কথা শুনে থমকে যায় রুদ্র। উমার শান্ত চাহনীতে নিজের ষোড়শীকে যেনো কোথাও হারিয়ে ফেলেছে। সেই ভীত, সঙ্কিত উমাটি আজ নেই। আজ এক নির্জীব শক্ত পাথর দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রের সামনে। এবার খানিকটা দমে রুদ্র। কিঞ্চিত বিনয়ী স্বরে বললো,
“তুমি ভুল বুঝছো উমা, আমি কিন্তু বলি নি দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। আমি বলছি দায়িত্ব বিভিন্নভাবেও পালন করা যায়। আর তোমার মায়ের গুনের তো শেষ নেই, মা হবার মতো যোগ্যতাও তার নেই। তোমার উপর কম অত্যাচার তো সে করে নি। আস্ত একজন লোভী মহিলা। তাকে নিয়ে এতো মাতামাতির কি খুব দরকার?”
“বাবাও তো অনেক কিছুই করেছেন, তাই বলে কি বাবাকে ছেড়ে দিতে পারবেন আপনি? পারবেন না তো? তাহলে আমাকে এই প্রশ্নটি করার কি মানে? আপন মায়ের মুখখানাও আমার মনে নেই, মা বলতে আমি এই না্রীকেই চিনে এসেছি। আজ তাদের এখানে ছেড়ে এতো দূরে কিভাবে যাই বলুন তো? আপনার মত না থাকলে আমি জোর করবো না। আমি তো জোর করার কেউ নই ও, বাড়ি আপনার, টাকা আপনার; সুতরাং সিদ্ধান্ত ও আপনার। পরজীবি মানুষের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে এমনটা বাধ্যবাধকতা নেই। আমি আসছি, দেখে আসি গোপালটা খেয়েছে কি না”

বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো উমা। রুদ্র খানিকটা আহত হলো, উমার ভালোর জন্য ই সে রতীকে তার থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছে। কিন্তু উমা সেটা বুঝতেই চাচ্ছে না। উপরন্তু তাকেই ভুল বুঝছে। সে তো একটিবারের জন্য গোপাল কিংবা রাজশ্বীর ব্যাপারে অমত জানায় নি। উমার বোন হিসেবে সকল দায়িত্বের পালন সে করতে রাজী। তবে কেনো উমা তাকে বুঝে না, কেনো বারে বারে তাকেই পৃথক করে দেয় নিজের থেকে।

নিজ রুমে একা একা বসেছিলো রতী। নিখিলের সকল জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে স্টিলের ট্রাংকে রেখে দিয়েছে সে। ট্রাংকটির চাবিখানা নিজের বালিশের তলে রাখলো সে। মানুষটা নেই, অথচ দিনগুলো কেটেই যাচ্ছে। কিছুই আটকে থাকে না কারোর জন্য। শুধু মানুষটির জায়গাতাই ফাঁকা। এমন সময় উমার আগমন ঘটে সেই রুমে। শান্ত গলায় বলে,
“আসবো মা?”

রতী চোখ মুখে নেয় আচলে। ভাঙ্গা গলায় বলে,
“আয়”

উমা ভেতরে এসে তার পাশে বসে। রতী ধীর কন্ঠে বলে,
“কিছু বলবি?”
“তুমি তো জানো আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি। সেজন্য কালীগঞ্জ যেতে হবে। আমি চাচ্ছিলাম, তোমরা যেনো আমার সাথে যাও।“
“এ ভিটে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।“

স্পষ্ট কন্ঠ রতী কথাটা বলে দেয়। উমা অবাক কন্ঠে বলে,
“আমার সাথে যেতে আপত্তি আছে তোমার?”
“আমাদের এখানে মেয়ের বাড়ির পানিটুকু খাওয়া বর্জিত সেখানে তোর বাড়ি কেনো থাকবো বলতো?”
“ছেলে হলেও এভাবে ফিরিয়ে দিতে?”
“হয়তো না, কারণ সে ছেলে। এটাই নিয়ম উমা। আর তোর বাড়ি কি ভরসায় থাকবো বলতো? জামাই এর খোটা শুনে এই বয়সে থাকার ইচ্ছে আমার নেই। গতবারের ভুলখানা আবার করতে চাই না। আর আমি চাই না আমার গোপাল সারাটাজীবন রুদ্রের টাকায় বড় হোক। তুই যদি কামাই করতি হয়তো আপত্তি হতো না। আগের অবস্থা আর এখন তো এক নয় উমা। তখন তোর বাবা জীবিত ছিলেন, এখন সে বট গাছ টুকু নেই। সামনে রাজশ্বীর বিয়ের ব্যাপার ও আছে।“
“আমি কিন্তু গোপাল এবং রাজশ্বীর সুন্দর ভবিষ্যতটা ভেবেই বলেছিলাম। কালীগঞ্জের ভালো স্কুলে গোপাল পরতো। রাজশ্বীর পড়াশোনাটাও হতো।“
“জানি, তুই ওদের নিয়ে অনেক ভাবিস। কিন্তু আমি পরজীবি হয়ে থাকতে পারবো না। তুই চিন্তা করিস না, তোর বাপের দোকান টা ভাড়া দিয়ে দিবো। পশ্চিমের জমিগুলো বেঁচে দিবো। তাতে যা পয়সা পাবো, আমাদের তিনজনের চলে যাবে। আমার ভাইরাও তো আছে। ঠিক চলে যাবে। আমাদের নিয়ে এতটা ভাবিস না। যদি সমস্যা হয় তখন না হয় তোর থেকে চাবোক্ষনে। কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে জিদ করিস না। তোর শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে তোর কোনো সম্মান থাকবে না। অহেতুক কথা শুনতে হবে।“
“তুমি সত্যি কি এসব নিয়ে ভাবো?”
“নাহ, ভাবি না। কিন্তু এখন ভাবতে ইচ্ছে হয়। তোর বাপটা তো উপর থেকে দেখছে। লোকটা অহেতুক কষ্ট পাবে। মানুষটা তো গোবেচারা। এসব ছলছাতুরি বুঝে না। তাই তাকে কষ্ট দিতে চাই না।“

উমা চুপ করে থাকলো। বুকের কোনে ব্যাথা করছে। এক চিনচিনে ব্যাথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তাহলে তুমি যাবে না? আচ্ছা আলাদা বাড়ি নিলেও যাবে না?”
“যেদিন নিজে কামাই করবি, আমি সেদিন যাবো। তখন লোভ করলেও সেটা তোর পয়সা হবে।“

ম্লান হাসি হেসে রতী কথাটা বলে। একজন মানুষের মৃত্যু সবাই কে কোনো না কোনো ভাবে বদলায়। বদলেছে উমা, বদলেছে রতীও। সময় ই সবকিছুর মলম, সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই বদলায়। উমা আর বসে রইলো না। ধির কন্ঠে বললো,
“ঘুমিয়ে পড়ো। কাল ও বাড়ি চলে যাবো। সকালে উঠতে হবে। আসি”
“আয়”

উমা আর অপেক্ষা করলো না। রতীর ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো। কালচে আকাশের বুকে হাজারো তারার মেলা বসেছে। তারা দেখতে ভালোই ঠেকছে। ছোট বেলায় ঠাম্মা বলতো,
“মরলে তারা হয়ে যায় মাইনশ্যে”

উমার মনে হলো তার পিতাও হয়তো আকাশের এক কোনে লুকিয়ে আছে। উমা ধীর স্বরে বললো,
“আমি একদিন নিজ পায়ে দাঁড়াব বাবা, তুমি চিন্তা করো না। এই তিনজনকে আমি দেখে রাখবো।“

১৬.
কালীগঞ্জে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে উমা এবং রুদ্র। ভ্যান এসেছে, কাপড়ের ট্রাংক গুলো তোলা হয়েছে। উমা সকলকে গড় করে প্রনাম করলো। লক্ষী দেবী না চাইতেও বললেন,
“দীর্ঘায়ু হও, সুখী হও”

রুদ্র লক্ষী দেবীকে জড়িয়ে বললো,
“আসি মা, আমি একখান মোবাইল ফোন কিনে পাঠিয়ে দিব। তারপর যোগাযোগ করবো প্রতিদিন”
“না গেলে হয় না?”
“না মা, সম্ভব না”

লক্ষী দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অভিনব সিংহ কিছু বললেন না। রুদ্র এবং উমা বেড়িয়ে গেলো। লক্ষী দেবী ধীর স্বরে বললো,
“দূগগা, দূগগা”

রুদ্ররা চলে গেলো, সেই মূহুর্তে দীপঙ্কর ছুটে এলো। হাফতে হাফতে বললো,
“জ্যেঠু, ফোন এসেছে গুদামে……………
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#২৯তম_পর্ব

রুদ্ররা চলে গেলো, সেই মূহুর্তে দীপঙ্কর ছুটে এলো। হাফতে হাফতে বললো,
“জ্যেঠু, ফোন এসেছে গুদামে। ইউনিয়ন পড়িষদের অফিস থেকে।”

দীপঙ্করের কম্পিত কন্ঠে ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে অভিনব সিংহ এর৷ এমন আন্দাজ তিনি করেছিলেন কিন্তু এতো দ্রুত তা বাস্তবে রুপান্তরিত হবে বুঝে উঠতে পারেন নি। অভিনব সিংহের কপালে চিন্তার রেখা ভাসমান। তাকে গভীর চিন্তায় মগ্ন দেখে লক্ষী দেবী প্রশ্ন করে উঠে,
“কিছু হয়েছে কি?”

অভিনব সিংহের স্বম্বিত ফিরে। শীতল কন্ঠে বলে,
” কিছু না, নির্বাচনের ব্যাপার। মেয়েছেলের না বুঝলেও চলবে।”

লক্ষীর কৌতুহল গ্যাস বেলুনের ন্যায় উড়ে যায়। হ্যা, সে মেয়ে মানুষ। তার স্থান কেবল মাত্র হেসেলে। এটাই সমাজের কট্টর নিকৃষ্ট সত্য।

রুদ্র এবং উমা কালীগঞ্জে পৌছে বারোটার দিকে। একটা কালো গেট দিয়ে তাদের ভ্যান প্রবেশ করে অট্টালিকায়। অট্টলিকাটি চেয়ারম্যান বাড়ির ন্যায় বৃহৎ নয়। দোতালা দালান। সামনে বৃহৎ আঙ্গিনা। তাতে একটি তুলসি গাছ বড্ড অবহেলায় পড়ে রয়েছে। উমা তার নিকট দাঁড়ালো। ছোট ছোট চোখে তার নতুন আবাসস্থল দেখতে লাগলো সে। এখন থেকে এই বাড়িতেই হবে উমার নিবাস। বাড়িটি পুরোনো, বেশ পুরোনো। শেষ মেরামত করা হয়েছে গত সপ্তাহে। তাড়াহুড়ো করে রুদ্র শুধু আবাস যোগ্য করেছে বাড়িটিকে। নিচতলা গোছানো হয়েছে থাকার জন্য। দুটি ঘর, বসার ঘর, হেসেল। দোতালাটা এখনো জঞ্জালে গাদা। দোতালার সিড়ি দিয়ে চিলেকোঠায় যাওয়া যায়। এর পর এক বৃহৎ ছাদ। ছাদে পা রেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে উমা। রাজশ্বী এবং গোপালের অসহায় মুখখানা বড্ড মনে পড়ছে। ভাইবোন দুটি আছে যে কি না উমার এই পৃথিবীতে আপন, যার সাথে তার রক্তের টান আছে। অনেকে বলবে, রুদ্র তার স্বামী। রুদ্রই এখন সবচেয়ে আপন। কথাটি সত্য, রুদ্র তার আপন বটে। তবে নিখিলের মৃত্যুর পর থেকে রুদ্রকে আপন বলে কাছে টানতে ভয় হচ্ছে উমার। যেই তার আপন ধীরে ধীরে সকলকেই কেড়ে নিচ্ছে কি না ঈশ্বর। উমার ভয় রুদ্র যদি হারিয়ে যায়। এই ব্যাপার নিয়ে বড্ড তর্কাতর্কি ও হয়েছিলো উমার সাথে তার। প্রথমত রতীদের কালীগঞ্জে আনা নিয়ে তুদ্রের সাথে কথা কাটাকাটি হলো৷ তারপর হলো গতকাল রাতে, রুদ্র যখন তাকে বললো সে এই বছরের নির্বাচনে নিজের নাম দিচ্ছে। অমনি উমা বাধ সাধলো,
“রাজনীতি না করলে কি নয়?”
“বলেছিলাম, এ আমার রক্তে মিশে আছে।”
“আজকাল অবস্থা খুব ভালো নয়। সরকার বদল হবে, দুসরকারের মাঝে দ্বন্দ হচ্ছে। মানুষ গায়েব হচ্ছে, কি দরকার এই ফাসাদে পড়ার!”

উমার ধীর, চিন্তিত কন্ঠে রুদ্র খানিকটা অবাক হলো৷ রুদ্রের মনে হলো উমা এখন সেই মানুষটি হয়ে গিয়েছে যে তার আপন মানুষকে আগলে রাখতে চাচ্ছে। প্রথমে রাজশ্বী এবং গোপাল। এখন রুদ্র। রুদ্র নিজেকে শান্ত রেখে বোঝানোর চেষ্টা করলো উমাকে,
“শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো তুমি, কিছুই হবে না আমার। আর আমি খুব ক্ষমতাবান কোনো পদে যাই নি। সামান্য মেম্বার পদে কার কি সমস্যা?”
“শান্তির জীবনে থাকতে কি খুব সমস্যা? অহেতুক অশান্তিকে কান ধরে আনার প্রয়োজনীয়তা তো নেই। রাজনীতির নোংরামি আপনি ও জানেন। না প্রবেশ করতে চাইলেও করতে হয়। আমি চাই না, আবার কোনো পুলিশ এসে আপনাকে ধরে নিয়ে যাক৷ আপনি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছিলেন।”
“কথা দিয়েছি, কথা রাখবো। তবে রাজনীতি আমি ছাড়ছি না। স্বচ্ছ রাজনীতিও করা যায়। শুধু মস্তিষ্ক শান দিলেই চলে। এতে তোমার আপত্তি হলেও আমার কিছু করার নেই।”

উমা কিছু বললো না। তবে রুদ্র তার বক্তব্যের প্রভাব খেয়াল করলো উমার কার্যে। মেয়েটি আরোও অধিক চুপ হয়ে গেলো। রুদ্র কিছু বললেই তাতে শুধু “হু” তে জবাব দিতে লাগলো। রুদ্রের বুঝতে বাকি রইলো না তার ষোড়শী অভিমান করেছে। তবে রুদ্রের তাতে রাগ হলো না। কারন রুদ্র জানে অভিমান তার ই সাজে যে ভালোবাসতে জানে। তাই ষোড়শীর মান ভাঙ্গানোর দায়িত্ব ও তার ই।

ছাঁদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে উমা। শীতটা এবার খুব জলদি ই পড়ে গিয়েছে। দুপুরেও হিনহিনে শীতল ছোয়ায় কম্পিত হয় শিরা উপশিরা গুলো। চাঁদরটা মুড়ে মিহি রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালোই লাগছে তার। রুদ্র বলেছে খাবার মোড়ের “মায়ের দোয়া” হোটেল থেকে নিয়ে আসবে। তাই হেসেলে যাবার তাড়া নেই উমার। নিজের ঘরের মাঝে এক অন্যরকম টান রয়েছে। মস্তিষ্ক যখন বুঝতে পারে এই নিবাসটি তার একান্ত তখন ই তার স্নায়ুকোষ জুড়ে প্রশান্তির প্রলেপবয়ে যায়। উমার ক্ষেত্রেও সেটাই হলো। এই ভঙ্গুর দোতালা বাড়িতেও সে প্রশান্তি খুজে পাচ্ছে। ছাদের কর্নিশ দিয়ে বাড়ির চারপাশ টা দেখলো সে। অবসর সময়ে কাজ বেড়েছে। ভুতুড়ে বাড়িটাকে বাসস্থল করতে বেশ কাঠখড় পোহাতে হবে তাকে। উমা অনুভব করলো একজোড়া শীতল বেষ্টনী তাকে আগলে রেখেছে। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বললো,
“কেমন দেখলে বাড়ি? একটু নয় বেশ পুরোনো। স্বাধীনতার পূর্বে নায়েবের বাড়ি ছিলো। ব্যাটা ভারত পালালে ঠাকুরদা দখল করেছিলেন। কখনো এখানে থাকা হয় নি, প্রয়োজন হয় নি। সমস্যা নেই, আমি বাদলকে বলেছি। কিছুদিনের মধ্যে এটা থাকার যোগ্য হয়ে যাবে। ভালো লেগেছে?”
“হু”

এতোগুলো কথার বিপরীতে উমা শুধু ছোট করে “হু” বলে৷ খানিকটা ব্যথিত হয় রুদ্র। উমা ভেতরে যেতে নিলে রুদ্র হাতটা টেনে ধরে। রুদ্রের এমন আচারণে অবাক হয় উমা। সরু দৃষ্টিতে তাকালে দেখতে পায়, রুদ্র কাতর দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। উমা স্বাভাবিক চিত্তে জিজ্ঞেস করে,
“কি হলো, হাত টেনে ধরলেন যে?”
“কেনো এমন করছো বলতো? এখনো তোমার রাগ করে নি?”
“আমি তো রাগ করি নি”
“তাহলে এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো?”
“এড়ালাম কোথায়? সম্মতি জানালাম।”
“এমন তো তুমি নও। তুমি কি জানো আমি তোমাকে পড়তে পারি?”

রুদ্রের কথায় মলিন হাসি হাসে সে। এই হাসর মাঝে এক রাশ তাচ্ছিল্যের ছাপ ছিলো। তারপর শান্ত গলায় বলে,
“পড়তে পারেন বুঝি?”
“পাড়ি”
“তাহলে আমাকে কেনো বুঝেন না বলুন তো?”
“বুঝি উমা, কিন্তু এই পথে আমি অনেক দূর এগিয়ে গেছি। এখন ফেরার পথ নেই। যুদ্ধে যোগদানকারী সৈনিক ফিরতে পারে না। হয় সে মৃত্যবরন করে নয় বিজয়ী হয়। কথাটা জানা আছে নিশ্চয়।”

উমার ঠোঁটজোড়া ঈষৎ কেঁপে উঠলো। বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা করছে। রুদ্রের কথা শুনে চোখটা জ্বলে উঠে উঠে। কথাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে তার। নিখিলের মৃত্যুকে মানিয়ে নিলেও কেনো যেনো রুদ্রের কথাটা তার হজম হলো না। রুদ্র এবার এগিয়ে এলো। ষোড়শীর মুখশ্রী আলতো হাতে তুললো। তার রক্তিম ঝাপসা আখিজোড়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“অহেতুক ভয় পাচ্ছো।”
“আমার আপন জনের পরিমান স্বল্প। আমি এই তিনটে মানুষকে হারাতে চাই না। এই বিশাল ধরণীতে একা থাকার সাহস আমার নেই।”
“এতো ভীতু হলে চলে, প্রতিটা মানুষ একাই আসে, তাকে একাই যেতে হয়।”
“এসব বইবাক্য না বললে নয়?”
“সত্য বললাম”
“ভালো লাগে না এই সত্য শুনতে।”

উমার চোখ দিয়ে এক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রুদ্র, আলতো ঠোঁটের পরশ ছোয়ালো চক্ষুজোড়ায়। আবেশ বুঝে গেলো পল্লব৷ কপালে কপাল ছুয়ে বললো,
“রাগ করো না লক্ষীটি, আমি তোমার মনোঃবস্থা বুঝি। আমি জানি তুমি রাজশ্বী এবং গোপালের জন্য চিন্তিত। ভয় পাচ্ছো, কেউ তাদের ক্ষতি করে দিবে। কিন্তু বিশ্বাস করো এমন কিছু হবে না। তোমার ভাই বোনকে কেউ ছুবে না। আমি সেই ব্যাবস্থা করে দিয়েছি।”

উমা অবাক নয়নে তাকালো রুদ্রের দিকে। যে ভয়টা সে পাচ্ছিলো সেটা আন্দাজ করে নিয়েছে রুদ্র। রুদ্র মুচকি হেসে বলে,
“বলেছিলাম না, তোমাকে পড়তে পারি আমি।”
“সেদিনের জন্য ক্ষমা করে দিবেন। একটু বেশি বলে ফেলেছিলাম।”
“যাও ক্ষমা করলাম। চলো এবার ক্ষেতে চলো। আমার বের হতে হবে।”
“চলুন”

উমা স্মিত হাসি হাসলো। রুদ্রের মনে প্রশান্তির ঢেউ খেলে গেলো। যার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা তার মনে শান্তির দ্বীপ জ্বালে তাকে কিভাবে বলি দিবে রুদ্র?

দু দিন পর,
শাশ্বত চেয়ারে বসে রয়েছে। সামনে থাকা গোলাকার পেপার ওয়েটটির দিকে তার নজর। ঠোঁটের কোনায় বিস্মিত হাসি। আজ সকালে খবর পেয়েছে এবার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অভিনব সিংহ দাঁড়াচ্ছে না। অথচ রুদ্র মেম্বারের পদে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা তাকে শুধু বিস্মিত ই করে নি, বিনোদন ও দিয়েছে। বাপ ছেলে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে কিন্তু সংগোপনে। এখন তার সামনে একটা প্রশ্ন, প্রশ্ন টা সহজ। সে কার হয়ে লড়বে এবং কার বিপক্ষে লড়বে! নাকি সে সমাজবাদী পার্টির মতো দুজনের বিরুদ্ধে লড়বে। শাশ্বত গভীর চিন্তায় মগ্ন ঠিক সেই সময় একখানা খাম দিয়ে যায় পিয়ন। খাদি খামটা দেখে খানিকটা অবাক হয় শাশ্বত। অবাক কন্ঠে বলে,
“কে পাঠিয়েছে মন্সুর মিয়া?”
“জানি না স্যার”

পিয়ন চলে গেলে খামটি খুলে শাশ্বত। খামটি খুলতেই হাসির প্রলেপ বিস্তৃত হয় তার। সে বুঝে গেছে কার পাল্লা ভারি………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here