#একই_সুতোয়_বাঁধা
পর্ব-৭
সপ্ত শীখা
— এই পুষ্প। তুই এরকম খ্যাতের মত থাকিস কেন রে ? এরকম তেলতেলে চুল, মুখে হাতে সবখানে তেল মেখে ঘুরিস কেন ? এত কিউট তুই দেখতে… জানিস একটু স্টাইলিশ ভাবে চললে কত ভাল্লাগবে তোকে ?
— আমি পর্দা করে চলি নিরু…
— সে তো আমিও চলি রে বাবা। পর্দা করলে কি একটু পরিপাটি থাকা নিষেধ ? তুই যদি সুন্দর করে চুল কাটিস বা মুখের পরিচর্যা করিস… সেটা তো নিজের জন্যই করবি। আর তো বাহিরের কেউ সেটা দেখতে আসছে না ! শোন পুষ্প… পর্দা করার জন্য বরং তোর এই খ্যাতপনা ঢাকা পড়ছে। তুই যদি পর্দা না করতি এতদিনে তোকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করত।
পুষ্প জবাব দিতে না পেরে বিবর্ণ মুখে ফ্যাকাসে হাসি হাসল। সত্যি… নিরুর কথাটা ঠিক। এখানে এসে সে পর্দায় আবৃত থাকে বলেই কেউ ওর তেল জবজবে চুল আর পরিচর্যাহীন ফাটা রুক্ষ ত্বক দেখেনি। এখানের মেয়েগুলো কি সুন্দর চুল আর মোলায়েম চামড়া নিয়ে ঘোরে ! এই যে নিরু… পুষ্পর মতই পূর্ণ পর্দা করে। তবুও ওর বোরখা বিহীন চেহারার চটক আছে খুব।
— শোন পুষ্প পাগলি। এখনকার ছেলেগুলা কে দেখেছিস ? এদেরই কেউ একদিন আমাদের বর হবে। আমরা তো অবশ্যই দ্বীনদার ছেলে বিয়ে করব। কিন্তু তুই ই বল… কোন ছেলে না চায় তার বউটা তার জন্য সেজেগুছে থাকুক ? তোর বর দিনশেষে এসে তোর এই তেলা মাথা আর ফাটা ঠোঁট দেখলে তার রোমান্স উড়ে চলে যাবে।
— ওমা তাই নাকি রে ! এই নিরু… তুই ঠিকই বলতেছিস তো ! বেশরীয়তি কথাও তো বলিস নাই। আমার আম্মাও বলে মেয়েমানুষ একটু নিজের যত্ন নেস না… আচ্ছা নীরু ! আমি তো চুলে সপ্তাহে দুইবার শ্যাম্পু দেই… তেল ও লাগাই… আর কি যত্ন করব বল তো ? আমার তো এগুলাই বেশি বেশি লাগে !
— পুষ্প তুই এগুলা কি বল্লি… হাসতে হাসতে মারা যাচ্ছি রে ! এইগুলা নাকি সাজ ! হাহ হাহ হা !
— নীরুউউউউউ
— সরি… শোন ছাগল। তোকে ফেসপ্যাক শিখিয়ে দেব একটা। আর তোর চুলের গোছ তো মাশাল্লাহ ভাল। কয়েকটা হেয়ার প্যাক ও বরং… কিন্তু তার আগে চুলে একটা সুন্দর কাট দিয়ে আনি চল। নিজের কাছে নিজেকে সুন্দর লাগার তৃপ্তিই আলাদা !
— না রে থাক। আম্মা ভাব্বে মেয়ের পাখনা গজাইছে। থাক বাদ দে…
— আন্টিজি কো হাম ম্যানেজ কারেঙ্গে। আভি দেখো…
নীরু ছুটে পুষ্পর মায়ের কাছে গেল এবং দুই মিনিটে তাকে মানিয়ে নিয়ে টাকা এনে পুষ্পকে জোর করে বগলদাবা করে ছুটল পার্লারে।
পুষ্পর এই শহরের বাসায় এসে তিন বছর এর উপরে হয়ে গেছে। এখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে । গ্রামে যেতে মন উদ্বেল হলেও বাবা জরুরি কাজে বাইরে থাকায় হচ্ছে না যাওয়া। নীরুই পুষ্পর বেস্ট ফ্রেন্ড এখানে। এই তিন বছর নিজের মত থাকলেও এখন নীরুর পিড়াপিড়িতে পুষ্প নিজেকে ভিন্ন আঙ্গিকে সাজাতে রাজি হয়েছে।
💚💚💚💚💚
— এই সায়ন শালা ! তুই কই ?
— আরে আসতেছি তো। এত হাইপার হস ক্যান ?
— আরে শালা তুই যে আজকে সাইকা রে প্রোপজ করবি ভুইলা গেছস ? শালা… মাইয়া আধা ঘন্টা হয় ওয়েট করতেছে। নীলা ভুজুং ভাজুং দিয়া আটকায় রাখছে। আয় তাত্তাড়ি !
সায়ন এখন বিশ বছরের তরুণ। আগের মুখচোরা ভাবখানা এখনো আছে ওর… তবে শহুরে বন্ধুবান্ধব এর প্রভাবে বেশ অনেকটা আধুনিক হয়েছে ও। ঢাকা ভার্সিটিতে ফার্মাকোলজি থার্ড ইয়ারে পড়ে সায়ন। এই ক বছরে বার দুই গ্রামে গেলেও পুষ্পর দেখা পায়নি ও। মন থেকেও অনেকটাই মলিন হয়ে এসেছে পুষ্প। তার বদলে এসেছে সাইকা।
সাইকা। সায়নের ভালবাসা। ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হওয়া কেতাদুরস্ত সাইকা কে ওদের ফ্রেশারস এর দিনেই খুব ভাল লেগেছে সায়নের। কিন্তু মুখচোরা স্বভাবের জন্য আজ তিন মাস ধরে কেবল চোরা চোখে দেখেই যাচ্ছে ও। কিছু বলার সাহস হয়ে ওঠেনি। শেষে বন্ধুরাই বলতে গেলে আজকের এই মিটিং টা ফিক্স করিয়েছে সায়নের ফ্রেন্ড রাজের গার্লফ্রেন্ড প্লাস সাইকার বান্ধবি নীলার মাধ্যমে।
ভার্সিটিতে উঠেই সায়ন একটা ছিমছাম মেসে সিট নিয়েছে। আর জ্বালাতে চায়নি মামা মামি কে। আর নিজেরো তো স্বাধীনতার ব্যাপার আছে !
প্রপোজ করবে বলে তো রাজি হল চাপে পড়ে… কিন্তু কি বলবে ও সাইকা কে ! ও যা লাজুক… ক্লাসের মেয়েদের সাথেই কথা কম বলে। সেখানে সাইকা তো জুনিয়ার… তার উপর ক্রাশ ! মুখ আটকে যাবে শিওর…
💚💚💚💚💚
— ও মাই গড পুষ্প ! তোকে জাস্ট অসাম লাগছে তুই কি বুঝতে পারছিস ! জাস্ট লুক এট দ্য মিরর !
পুষ্প লাজুক হাসি হাসল। সত্যি ওকে অসাধারন লাগছে। আর লাগবে নাই বা কেন ! নীরু নানা ব্ল্যাকমেইল করে টাকা এনে পুষ্পকে হেয়ার কাট… হেয়ার ট্রিট্মেন্ট আর মুখেও ফেসিয়াল করিয়েছে। একেবারে জেল্লা ছড়াচ্ছে আজ পুষ্প !
— পুষ্প তুই দেখি ফুলপরী হয়ে গেলি ! ইশ কেন যে আনতে গেলাম তোকে পার্লারে ! এখন নিজেরই হিংসা হচ্ছে আমার।
— হয়েছে নীরু আর কত ফুলাবি ! আচ্ছা আমার কি সপ্তায় সপ্তায় এইসব করাতে হবে ! যত গুচ্ছের টাকা ফেলা কেবল!
— আরে না। এটা প্রথম তাই করিয়ে দিলাম যেন তুই একটু শিখিস কিছু আর জড়তা কাটে। বাট ইউ আর লুকিং সিমপ্লি এডোরেবল !
— থ্যাঙ্কিউ… নাও স্টপ।
— সত্যি পুষ্প… তোর বর তোকে বাসর রাতে খেয়েই না ফেলে ! যা কিউট হচ্ছিস দিন দিন !
সায়নের কথা আচমকা মনে ভেসে উঠতে মন বড় খারাপ হয়ে গেল পুষ্পর। এই “বর” শব্দটা শুনলেই ওর মাথায় সায়ন ছাড়া আর কারো চিন্তা আসে না। আর চিন্তাটা আসলেই কান্না চাপা মুশকিল হয়ে পড়ে। কেন যে এতটা কান্না পায় !
বাসায় এসে দৌড়ে বাথ্রুমে ঢুকে খানিক কেঁদে নিলো পুষ্প। প্রায় চার বছর এর বেশি হয় দেখা নেই সায়নের সাথে। নিশ্চয়ই ভুলে গেছে পুষ্পকে… নইলে কি আর আসত না !
কিন্তু পুষ্প যে ভুলতে পারে নি ! বরং সায়ন ওর মনে আরো পাকাপোক্ত ভাবে গেড়ে বসেছে। ও যে সায়ন কে ভালবাসে সেটা ওর বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল। তাই খুব হাস্যকর ভাবে প্রকাশ পায় ব্যাপারটা।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময় এক বৃষ্টির রাতে পুষ্পর সায়নের কথা ভীষণ মনে পড়ছিল। আর অদ্ভুত ভাবে হু হু করে কান্না চলে আসে ওর। বালিশে মুখ চেপে কাঁদছে এসময় দাদি বুঝে ফেলেন। মাথায় হাত বুলাতে থাকেন স্নেহময় আঙ্গুলে।
— কান্দ ক্যান দাদু ?
— জানিনা
— কাউরে মনে পড়তেছে ?
— হু
— কেডা ?
— ………
— সায়ন ?
— হ্যাঁ…
— কান্দে না দাদু। আল্লাহ চাইলে ও শিগগির আইব।
— দাদি… আমার এত কান্না পাইতেছে কেন ? খুব বেশি কষ্ট লাগতেছে…
— কেন তা এখনো বুঝ নাই পাগলি ? তুমার মন খানা যে অর কাছে তাই।
লজ্জায় লাল হয়ে স্থির পড়ে থাকে পুষ্প। উপলব্ধি করে… ব্যাপারটা আসলেই সত্য। কেবলি এই ভালবাসার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে ও। আর এরকম স্বর্গীয় অনুভূতি আর নেই আর তাও বুঝল। কি ভীষ্ণ কষ্টের সাথে মিষ্টি একটা সুখ !
💚💚💚💚💚💚
— ইয়ে… সা-সাইকা…
— ভাইয়া কিছু বলবেন ?
— আ… হ্যাঁ… সাইকা আমি…
— বলেন না ভাইয়া…
— আ… আমিই…
রাজ ক্ষেপে চেঁচিয়ে উঠল।।
— সাইকা এই ছাগল বলতে চায় যে হি লাভস ইউ।
— হ্যাঁ হ্যাঁ তাই।
— তাই ? সেটা নিজের মুখে বলতে পারছেন না ? কি আশ্চর্য !
— আ… আই… লাভ ইউ… সাইকা। এটা তোমার জন্য।
সাইকা হাত বাড়িয়ে গোলাপ টা নিতে সায়নের মনে হল জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন টা আজই। খুশিতে সারা ক্যাম্পাস লাফাতে মন চাইছে ওর। সাইকা এক্সেপ্ট করেছে ওর ভালবাসা !!