#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৪৩+৪৪
#WriterঃMousumi_Akter
স্যার খাতা দিয়ে দিয়েছেন অথচ ছোঁয়া এখনও পৌঁছায়নি।তন্ময় বারংবার ওর বাম হাতটা উঁচু করছে আর ঘড়ি দেখছে।চোখ-মুখ কেমন শুকিয়ে এসেছে।তন্ময়কে রেখে আমি, মৃন্ময়,দ্বীপ কেউই ভেতরে যেতে পারছি না।আজ থিওরিতে লেখা অনেক।ছোঁয়ার পথে কোনো বিপদ হলো কি না সেই চিন্তা হচ্ছে আমাদের সকলের।আমাদের হলে ডিউটিরত স্যার আমাদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জোরে ধমক দিয়ে বললেন,
“পরীক্ষা শুরু আর তোমরা বাইরে কেন?”
আমি তন্ময়ের কাঁধে হাত রেখে বললাম, “যা তন্ময়,ছোঁয়া চলে আসবে আর ও এলে তোকে আমি জানাব।”
তন্ময়, মৃন্ময় আর দ্বীপ একই হলে পড়েছে।ওদের পাশের রুমে আমরা।সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথম রুমে আমাদের সিট তারপরের রুমে তন্ময়দের সিট।তার সাইডে আরও দুইটা রুম তারপরেই ওয়াশরুম।মাঝে মাঝে ছোঁয়ার যখন ম্যাথের কোনো সূত্র বেঁধে যায় তখন ও বাইরে যায়। ওয়াশরুমের নাম করেই বাইরে যায়।তখন তন্ময়দের রুমের সামনে দিয়েই যেতে হয়।ছোঁয়াকে বেরোতে দেখলেই তন্ময় ও বের হয়।ছোঁয়া যেটা পারে না তন্ময় ভালো ভাবে সেটা বুঝিয়ে দেয়।তাছাড়া এমনও হয় অকারণে ওঁরা দু’জন ৫ মিনিটের জন্য বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে আসে।ছোঁয়া বাইরে গেলেই আসার সময় চকলেট মুখে পুরে হাসি মুখে আসে আর আমার জন্যও চকলেট নিয়ে আসে।কারণ তন্ময়ের প্যান্টের পকেটে টাকা না থাকলেও ছোঁয়ার জন্য চকলেট ঠিকই থাকে।তন্ময়ের থেকে চকলেট পেলেই ছোঁয়া আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।ছোঁয়ার চাহিদা কম।তন্ময়ের সাথে থেকে দামি কোনো জিনিস ওর পছন্দের সেটা কখনোই বলেই না।ঘনঘন তন্ময়কে বলবে ২-৪ টাকার চকলেটের নাম।যা ওর খুব পছন্দের।ভুলেও কিটক্যাট বা অন্য চকলেট বা অন্য খাবার কিছুর নামই বলবে না।তন্ময় এনে দিলেও খুব রা’ গ করে।আবার কোনো না কোনোভাবে তন্ময়ের টাকা ও পুষিয়ে দেয়।ছোঁয়ার যে দামী কিছু পছন্দ নয় তা নয়।ও তো আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে নয়।ছোটো বেলা থেকেই ডুপ্লেক্স বাড়ি দেখেছে,নিজেদের গাড়িতে চলাফেরা করে এসব থাকা সত্ত্বেও আমাদের সাথে সাধারণ ভাবে মিশতে পারে।যে মিষ্টি দেখতে ছোঁয়া!তন্ময়ের সাথে মানায়ও খুব।ছোঁয়ার যখন ওশানের সাথে রিলেশন ছিল বন্ধু হিসাবে তন্ময়কে যত সাপোর্ট ছিল সব করত।যেমন ইচ্ছা করে দুই সেট বই কিনে বলত “তন্ময় তোর কি বই কেনা হয়ে গিয়েছে,বাবা এক সেট বই কিনে এনেছে ঢাকা থেকে।আমি আবার এখান থেকে কিনলাম।বাবা আবার কবে ঢাকা যাবে জানি না।শুধু শুধু ঘরে পড়ে থাকবে।কিছু মনে না করলে তুই নিবি প্লিজ।”তন্ময়ের জন্মদিন এলে একসাথে কতগুলা শার্ট প্যান্ট, গেঞ্জি কিনে দিয়েছে।বন্ধুত্বের মাঝে ছোঁয়া-তন্ময় যেমন ঝ’ গ’ ড়া করেছে তেমন পারফেক্টও ছিল।
পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে অলরেডি আধাঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে।এখনও ছোঁয়া এসে পৌঁছাল না।দুশ্চিন্তায় আমার নিজেরই কিছু ভালো লাগছে না।না জানি তন্ময় কী করছে!আমার ফ্রেন্ডদের কারো কিছু হলে আমার ভালো লাগে না।ভীষণ বিষন্ন লাগে।আজ তো ছোঁয়ার বিয়ে।বাড়িতে কী কিছু টের পেয়েছে না কি অন্য কারণ!মনের মাঝে অশান্তি লাগছে।মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হবে।কিন্তু কী হবে?টাইম চল্লিশ মিনিট পার হয়ে গিয়েছে।এখনও প্রথম পৃষ্টা ফাঁকা পড়ে আছে। কী লিখব মাথায় আসছে না।ছোঁয়ার ফোনই বা অফ কেন?কিছুই তো ভাবতে পারছি না।কোনো রকম এক পৃষ্ঠা লিখতে না লিখতেই আবার ছোঁয়ার কথা মনে হলো।এরই মাঝে হলে ডিউটিরত স্যার বললেন,
“এখানে এম এম কলেজের স্টুডেন্ট আছো না?”
অনেকেই এক সাথে উত্তর দিল, “জি স্যার আছি।”
‘একটা ব্যাড নিউজ আছে তোমাদের জন্য।’
আবারও অনেকেই উত্তর দিল, “স্যার কী হয়েছে?”
‘রোশান স্যার আছে না তোমাদের?’
রোশান স্যারের কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই আমি ছোঁয়ার ভাবনা থেকে বেরিয়ে স্যারের দিকে তাকালাম।এই স্যার হঠাৎ রোশান স্যারের নাম নিলেন কেন?স্যার কী বলতে চান সেটা শোনার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম।বার বার ঢোক গিলছি আর জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছি।
সবাই আবারও একই সাথে উত্তর দিল,
“জি স্যার।”
‘উনার বয়স কম আর হ্যান্ডস্যাম তাই না? ‘
‘জি স্যার।’
‘উনার বাইক এ’ক্সি’ ডে’ ন্ট হয়েছে।হসপিটালে নেওয়া হয়েছে।’
উনার বাইক এ’ক্সি’ডে’ ন্ট হয়েছে কথাটা কানে পৌঁছাতেই সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল আমার।বুকের মাঝে বাড়ি মেরে উঠল।আমি সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম।চোখে-মুখে একটা ভ* য় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।সেকেন্ডের মাঝে বুকের মধ্যে হু হু করে উঠল।চোখ পানিতে টইটুম্বর হয়ে গেল।নোনা পানি টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ল।আমাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে ক্লাসের সবাই আমার দিকে তাকাল।হলে ডিউটিরত দুজন স্যারও তাকালেন।আমার চোখ মুখের অস্বাভাবিক অবস্থা আর কান্নারত অবস্থা দেখে সবাই সন্দিহান ভাবে তাকাল।আমি তড়িৎ বেগে রুম থেকে বেরোনোর চেষ্টা করতেই স্যাররা আমাকে আটকালেন আর বললেন,
“কী হয়েছে,তোমাকে এমন লাগছে কেন?”
আমি হাউমাউ করে কেঁদে বললাম,
“উনার কী হয়েছে?আমি উনার কাছে যাব।”
তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়লাম।কাঁদতে কাঁদতে বেসামাল হয়ে পড়লাম।
এক স্যার আরেক স্যারের দিকে তাকালেন।পরীক্ষার্থীরা সকলেরই চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম।সবার মাঝে দারুণ কৌতুহল।সবাই সন্দেহবশত একজন আরেকজনের মুখের দিতে তাকাচ্ছে।পাশের রুম থেকে অনেকে বেরিয়ে এসেছে কান্নার আওয়াজ শুনে।সবার মাঝে শুরু হলো তুমুল সমালোচনা।কেউ কেউ বলছে স্যার আর স্টুডেন্টের মাঝে নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে।ইয়ং স্যার আর সুন্দরী ছাত্রী হলে এসব কোন ব্যাপারই না।একেকজনের একেক মন্তব্য।চারদিকে কানাঘুঁষা শুরু হয়েছে।কারো উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় আমি নেই।
স্যার বললেন,
“পরীক্ষা শেষ করে যাও।”
এরই মাঝে তন্ময়, মৃন্ময় আর দ্বীপ এসে উপস্থিত হলো।আমাকে এইভাবে কাঁদতে দেখে ওঁরাও বেশ উত্তেজিত হয়ে আমাকে এসে ধরল আর বলল,
“এই সারাহ! কী হয়েছে?এইভাবে কাঁদছিস কেন?”
‘আমি উনার কাছে যাব।এক্সি”ডেন্ট হয়েছে উনার!’
সবাইকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে নিচে নামতে শুরু করলাম।কেউ কিছুই বুঝতে পারল না কী ঘটনা।আশে পাশের রুমের স্যাররা এক জায়গা হয়ে বললেন, “কেউ কিছু জানো ঘটনা কী?মেয়েটা নিজের পরীক্ষা রেখে রোশান সিদ্দিকীর কথা শুনে ছুটে গেল কেন?”
কেউ কিছু জানে না তাই কেউ উত্তর দিতে পারল না।বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হলো।মৃন্ময় বলল,
“তন্ময়-দ্বীপ আমার খাতা জমা দিস আমি সারাহ’র সাথে যাচ্ছি।যেভাবে ছুটেছে ওর-ই এক্সিডেন্ট হবে।”
‘আমরাও আসছি, পরীক্ষা আর দেব না।’
হলের স্যার বললেন, “এমন বন্ধুত্ব চোখে দেখা যায় না।একজনের জন্য বাকি কেউ পরীক্ষা দিচ্ছে না।কিন্তু রোশান সিদ্দিকীর সাথে কী রিলেশন মেয়েটির?”
মৃন্ময়,তন্ময় আর দ্বীপ আমাকে ধরে দ্বীপ বলল, “মাথা খারাপ হইছে ছেমড়ি তোর?কী রোশান স্যার রোশান স্যার করিস এত?স্যার এক্সিডেন্ট করেছে ভালো কথা।ম” রে তো যায়নি তাই না?যেভাবে ছুটছিস নিজেই ম’র ‘বি।’
দ্বীপের মুখে এমন কথা শুনে বেসামাল হয়ে দ্বীপকে ধাক্কা মেরে বললাম, “একদম বাজে কথা বলবি না বলে দিচ্ছি।”
মৃন্ময় বলল, “সমস্যা টা কী তোর সারাহ?বুঝলাম স্যারকে তোর ভালো লাগে।তাই বলে তুই এই ন্যাকামোটা করবি?তুই না ম্যারিড এখন?কাউকে তোর ভালো লাগে বলে তার জন্য দুনিয়ার মানুষ এক করে ফেলবি?এমনি ছোঁয়ার চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
‘উনিই তো আমার হাজবেন্ড,আমার বিয়ে উনার সাথেই হয়েছে। আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চল প্লিজ।উনার কিছু হলে আমি বাঁচব না মৃন্ময়।’
আমার মুখ থেকে কথাটা ফসকাতেই ওঁরা তিনজন কেমন থমকে গেল।তিনজনেই যেন অসাড় হয়ে গেল।যেন পাথরের মূর্তির ন্যায়।ওদের জীবনে এমন ধাক্কা অতীতে তো খায়নি ভবিষ্যতেও খাওয়ার চান্স নেই।ওঁরা তিনজনেই অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছিয়ে আমাকে নিয়ে অটোতে উঠল।অটোতে আমি বেসামাল ভাবে কান্নায় ভেঙে পড়ায় ওঁরা আর কোনো প্রশ্ন করল না।২০ মিনিটের মাঝেই হসপিটালে পৌঁছালাম।মৃন্ময়ের কাছে ফোন ছিল।ওর ফোন থেকে উনার নাম্বারে ফোন দিতেই ফোন রিসিভ করল অন্য কেউ,সে জানাল উনাকে যশোর ইবনে সিনা হসপিটালের একটা কেবিনে রাখা হয়েছে।আমি বাজ পাখির মতো ছুটে ১০ নং কেবিনের দরজা খুব জোরে ধাক্কা দিতেই দেখি উনার হাতে স্যালাইন চলছে, মাথায় ব্যান্ডেজ,হাত-পা বেশ ছুলে গিয়েছে।উনার সাথে কলেজের অন্য একজন স্যারও আছেন।আমাকে কাঁদতে কাঁদতে প্রবেশ করতে দেখে উনি বেশ অবাক হলেন।উপস্থিত অন্য যে স্যার ছিলেন ও
উনিও বেশ অবাক হলেন।আমি কিছুই বলতে পারছি না শুধু কেঁদে যাচ্ছি।
উনি বেশ অবাক হয়ে বললেন, “সারাহ তুমি?পরীক্ষা রেখে এখানে?”
উনার কন্ঠ শুনে আমি আরও জোরে কেঁদে দিলাম।
উপস্থিত স্যার কী বলবেন বুঝতে না পেরে টুল ছেড়ে উঠে বললেন,
“বসো বসো, এত ভাবছ কেন? রোশানের কিছুই হয়নি।আমি তোমার জন্য পানি নিয়ে আসি।”
বলেই উনি রুম ছেড়ে বাহিরে চলে গেলেন।যাওয়ার সময় দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে গেলেন।রোশান স্যার আমার হাত ধরে টেনে বেডে বসিয়ে মায়া ভরা কন্ঠে বললেন, “কী হয়েছে তোমার?এইভাবে কাঁদে কেউ?আমার কিছু হলে তুমি ভেঙে পড়লে আমাকে সামলাবে কে?তুমিই তো আমার শক্তি জানো না?”
আমার কান্না থামেনি।কেন যেন কান্না থামাতেই পারছি না।প্রিয়জনের কিছু হলে হৃদয়ে এমন তোলপাড় শুরু হয় বুঝি!
উনার মুখে-কপালে হাত ছুঁইয়ে বললাম, “কীভাবে হলো এসব?আমি খুব ভ’ য় পেয়ে গিয়েছিলাম জানেন?”
উনি আমার হাত ধরে বললেন, “এই পা’ গ ‘ লিটাকে কে খবর দিয়েছে?এই দ্যাখো আমার কিছুই হয়নি।জাস্ট একটু মাথায় চোট,কনুই আর হাঁটুতে।আর কোনো সমস্যা নেই।’
‘যাইহোক আপনি ব্যাথা পেয়েছেন তো।’
‘এই চোটের থেকে বেশি ব্যাথা এখন হচ্ছে কারণ তুমি কাঁদছ!তোমার কান্না আমাকে বেশি ব্যাথা দিচ্ছে।’
‘এইভাবে আমার কান্না আটকাতে পারবেন না।’
‘আচ্ছা কান্না আটকাব না।তুমি পরীক্ষার হল ছেড়ে কেন এসেছ তাই বলো?এটা কিন্তু একদম ঠিক করোনি।খুব অন্যায় হয়েছে এটা।আমি খুব রা’ গ করেছি।তুমি এমন ছেলেমানুষি কীভাবে করলে?পরীক্ষার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রেখে চলে এলে!’
‘পরীক্ষা না হলেও জীবন চলবে। আর আমি ইম্প্রুভ দিতে পারব।কিন্তু আপনি ছাড়া জীবন চলবে না।’
‘এসো তো কাছে এসো।বুকে একটু তোমার মাথাটা রাখো তো।তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি।তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে শান্তি পাচ্ছি না।’
উনার বুকে মাথা রেখে বললাম, “আপনি অনেক ব্যাথা পেয়েছেন তাই না?”
‘এই সামান্য একটু।রিক্সা সামনে এলো।হঠাৎ কীভাবে যেন পড়ে গেলাম বুঝতে পারলাম না।’
‘এইসব রিক্সাওয়ালারা ঠিক ভাবে চালাতে পারে না।তাহলে চালায় কেন?’
‘এটা জাস্ট এ’ক্সি’ডে’ন্ট।তুমি যে এখানে এসেছ, কীভাবে এলে?’
‘আমার বন্ধুরা আমার জন্য পরীক্ষা দেয়নি।ওঁরা আমাকে নিয়ে এসেছে।’
‘ছিঃ! ছিঃ! নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।আমার জন্য কতগুলো মানুষের ক্ষতি হলো!’
‘আমি কী করব?মাথা ঠিক ছিল না। আর ওঁরাও এটাই ইম্প্রুভ দিয়ে নেবে।ইয়ার লস তো হচ্ছে না।
‘ মানুষ কী ভাববে জানো?মেয়েটা বর পা’ গ’ ল খুব।’
‘ভাবে ভাবুক।যা সত্যি তাই ভাবুক।আচ্ছা এইখানে যে স্যার ছিল উনি কী ভাববেন?’
‘কিছুই ভাববেন না।উনারা জানে তুমি আমার বউ।’
‘কীহ!জানে?আমাকে তো আগে বলেননি।’
‘বললে তুমি লজ্জা পেতে তাই বলিনি।আচ্ছা তোমার বন্ধুরা কই?’
‘মনে হয় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘যাও ডেকে নিয়ে এসো।’
‘আচ্ছা যাচ্ছি।’
বাইরে গিয়ে দেখি ওঁরা কোথাও নেই।অদ্ভুত! গেল কই!কোথাও তো দেখা যাচ্ছে না।ওঁরা কি রোশান স্যারকে দেখে পালাল নাকি!কেবিনে গিয়ে বললাম, “ওদের তো দেখছি না।মনে হয় আবার পরীক্ষা দিতে গিয়েছে।’
‘সেটা করলেই ভালো।’
‘এখানে কতদিন থাকতে হবে?’
‘সন্ধ্যায়ই ফিরে যাব।’
_______________________
সন্ধ্যায় উনাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলাম।উনি হাঁটতে পারছেন না ঠিক ভাবে।হাঁটুতে ব্যাথার জন্য।বাড়িতে প্রবেশ করেই খুব অদ্ভুত লাগল।ওশানের ঘর ফুল দিয়ে সজ্জিত।বাড়ির চারদিক আজ আরও চকচকে।লাল-নীল বাতি জ্বলছে।বরণ ডালা সাজিয়ে শাশুড়ি আর জিনাতের মা সহ শাশুড়ির কিছু ঘনিষ্ট মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বউ বরণের জন্য।বাড়িতে মানুষ ম ম করছে।সব মানুষ বউ দেখবে বলে অপেক্ষায় আছে।উনি আমাকে বললেন, “এখানে যা খুশি হোক তুমি থেকো না প্লিজ।চলো রুমে দরজা লাগিয়ে বসে থাকি।কালই নতুন বাসা নিব।’’
উনার কথার কোনো উত্তর দিলাম না।উনাকে খোঁড়াতে দেখে বেশ কয়েকজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,“কী হয়েছে?”
উনি বললেন, “তেমন কিছু না।”
উনার এই খুঁড়িয়ে হাঁটা নিয়ে একেক জনের একেক রকম প্রশ্ন।এরই মাঝে শাশুড়ি আর মামি শাশুড়ি এসে বললেন, “কী হয়েছে বাবা?”
উনি বেশ বিরক্তর সহিত তাকালেন।উনার চাহনিতে ছিল হিংস্রতা আর তীব্র রা’গে’র বহিঃপ্রকাশ।আমি ভীড় ঠেলে উনাকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম।আমাদের রুমেও বেশ কিছু মানুষ জড় হলো উনাকে দেখার জন্য।বাড়ির পাশের একজন কাকিমা খুবই ভাল মন-মানসিকতার মানুষ। উনি রোশান স্যারকে বললেন, “বাবা তুমি থাকতেও এত কিছু হচ্ছে এ বাড়িতে।তোমার আম্মা কীভাবে এসব প্রশ্রয় দিচ্ছে?”
উনি বললেন, ‘কাকিমা যার যার কর্মের ফল সে সে পাবে।তবে আম্মা যে তার ছেলেকে এত প্রশ্রয় দিচ্ছে একদিন বুঝবে।এসব নিয়ে অনেক বলেছি এখন বলতেও রুচিতে বাঁধে।’
বেশ কয়েকজন কয়েক রকম কথা বলে বেরিয়ে গেল।কেননা উনি রেস্ট নিবেন।আর আমাকেও বলে দিয়েছেন আমি যেন বাহিরে না যায়।ঘরের দরজা লাগিয়ে দিতে বললেন।আমি ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়ে উনার পোশাক চেঞ্জ করিয়ে দিলাম।উনি বালিশ হেলান দিয়ে বসে মাথায় হাত দিয়ে কিছু একটা চিন্তা করছেন।সারাদিন ফোন কাছে নেই।ফোনটা নিয়ে পাওয়ার বাটন চাপতেই দেখি তন্ময়-মৃন্ময়ের অনেক ফোন। তন্ময় হোয়াটস অ্যাপে একটা মেসেজও পাঠিয়েছে।মেসেজটা ছোঁয়া তন্ময়কে পাঠিয়েছে তারই স্ক্রিনশট।মেসেজটা পড়া শুরু করলাম,
তন্ময়,
কিছু মানুষ থাকে জানিস তাদের জীবনটাই অভিশপ্ত।সেই অভিশপ্ত জীবনে সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না।সেই অভিশপ্ত শ্রেণিতে নিজের নামটা আমি নিজেই লিখিয়েছিলাম খুব যত্ন সহকারে।এই দো’ষ কারো নয়।না সৃষ্টিকর্তার না ফ্যামিলির, না ফ্রেন্ডসার্কাল, এই দো’ষ শুধুই আমার।শুধু নিজের জীবনে ভুল মানুষকে সঠিক সময়ে বেছে নিয়েছিলাম আর সঠিক মানুষকে ভুল সময়ে বেছে নিয়েছি বলেই জীবনটা এমন এলোমেলো হয়ে গেল।আমি ভালো মেয়ে নই তন্ময়;খুব বাজে, আর খারাপ একটা মেয়ে।জীবনের একটা বড়ো সত্য তোর কাছে লুকিয়েছিলাম।নিজের কাছে বহুবার গিলটি ফিল হয়েছে।মনে হয়েছে তোকে ঠকাচ্ছি আমি, সারাক্ষণ মানসিক অশান্তিতে ভুগেছি আমি।বারবার বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছে।যদি তুই আমাকে ভুল বুঝিস,আমাকে ছেড়ে যাস।কোন ছেলেই এতকিছু জানার পরে ভালবাসার মানুষের প্রতি পর্যাপ্ত সম্মান আর ভালবাসা ধরে রাখতে পারে না।তোকে হারানোর ভ’য়ে কতরাত ঘুমোতে পারিনি আমি।তোকে হারাব না বলে অনেক চেষ্টা করেছি।ভেবেছিলাম বিয়ের আগে তোর হাতে পা’য়ে ধরে সত্যটা স্বীকার করে মাফ চাইব,তোকে ভিক্ষা চাইব আমার জীবনে।অথচ সেই সময়টাই আমার জীবনে এলো না তন্ময়।কেনো এলো না?মিথ্যা খুব খারাপ জিনিস। যদি সত্যটা তোকে আগেই জানাতাম তোকে হারাতাম কি না জানি না তবে আজ এ দিনটা অন্তত দেখতে হতো না আমাকে।হয়তো আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারতাম।জানি আমি ম’ রে গেলেও তুই আর আমার মুখ দেখতে আসবি না।অবশ্য আসার কথাও না।তোকে আমি ঠকালাম খুব বাজে ভাবে ঠকালাম।
আমি যে জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়েছি,ঠকেছি।আজ ফ্যামিলি থেকেও পরিত্যাজ্য হলাম।মা -বাবার খারাপ সন্তান বলে।এসব আমার পাওনা ছিল। কিন্তু তোর এসব পাওনা ছিল না।তবুও তোকেও ঠকতে হলো।তোর জীবনের একটা বাজে অভিজ্ঞতার উদাহরণ আমি।মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে এত অশান্তি সব ছেড়ে-ছুঁড়ে যদি তোকে নিয়ে কোনো এক নির্জন প্রহরে হারিয়ে যেতে পারতাম।জীবনটা অনেক সুন্দর হতো।কিন্তু কিছুই হলো না। জীবনটা এমন হলো কেন তন্ময়?কেন আমার সাথেই সব খারাপ হয়?কেন বারবার এমন হচ্ছে আমার সাথে?উপর থেকেই কী এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে আমাদের পথচলা এই পর্যন্তই?তোর মতো একটা মানুষকে পেয়েও আমি ধরে রাখতে পারলাম না।তুই বড়ো অবেলায় এসেছিস আমার জীবনে;যখন অনেক কিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।মানুষের কপাল এতটাও খারাপ হয় জানতাম না।
প্রতিটি লাইন লিখতে গিয়ে হৃদয় বিষন্নতায় জর্জরিত হয়েছে আমার।
কী ঘটে গেল আমার জীবনে কোনদিন কারো জানাই হবে না।শুধু উপরে যে আছে সে সব দেখছে।শুধু অনুরোধ,এই খারাপ মেয়ের জন্য নিজের ক্ষ’তি করিস না।আমার চেয়ে তোর মা তোকে অনেক বেশি ভালোবাসে।তার কথা ভেবে অন্তত বেঁচে থাকিস।
আমাদের আর কোনদিন কথা হবে না, দেখা হবে না। আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা নিজের ইচ্ছাতেই নিয়েছি।ফিরে আসা সম্ভব নয়।ওশানের সাথে সংসার করতে যাচ্ছি কি না জানি না, তবে আমাকে যেতেই হবে।
——————অনিন্দিতা খন্দকার ছোঁয়া
চিঠিটা পড়ে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।এর মানে ওশান কোনো ফাঁদে ফেলে ছোঁয়াকে বিয়ে করছে।কিন্তু ছোঁয়া কী আদৌ বিয়ে করবে!আমি যতটুকু ছোঁয়াকে চিনি ও ওশানের মতো ছেলেকে ম’ রে গেলেও বিয়ে করবে না।এমন কী হলো যে ছোঁয়াকে ওশানের সাথে আসতে বাধ্য হতে হলো!আমি কিছুতেই ছোঁয়ার জীবন নষ্ট হতে দিব না।কিছুতেই না।যা কিছু হোক ওশানের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।ছোঁয়া কতটা অসহায় আর নিরুপায় হয়ে ঘৃণিত একটা মানুষের সাথে আসতে বাধ্য হয়েছে।ওর চিঠির প্রতিটা লাইনে ছিল চাপা আর্তনাদ।ওশান কি ছোঁয়া কে কিছু নিয়ে ব্লাকমেইল করছে!নিশ্চয়ই করছে; না হলে কী এমন গোপনীয় কথা থাকবে!আর তন্ময়ই বা কী করছে এখন!ওহ আল্লাহ!এরই মাঝে বাইরে গাড়ির শব্দ হলো।আমি ফোন ফেলে ঘরের দরজা খুললাম।ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কাঁদি।ভেতরটা কেমন যন্ত্রণায় জ্বলে-পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।ছোঁয়া কী পারল না একটা বার আমার সাথে শেয়ার করতে!কেন পারল না?আমি যা ভাবছি সেসব নয়তো!ছোঁয়ার নিজের বিষয় হলেও এতটা ভাবত না।কী হয়েছে ছোঁয়ার সাথে?নিজের মাথার চুলের মধ্যে হাত দিয়ে চুল টানছি জোরে।চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আমার।আমার জীবনের দ্বিতীয় ফ্যামিলি আমার বন্ধুমহল।গাড়ি থেকে ছোঁয়াকে নামিয়ে নিয়ে এলো সাথে ওশানও আছে।ছোঁয়ার মুখটা ভীষণ মলিন আর বিষন্ন দেখাচ্ছে।আজ ওর প্রিয় মানুষটার সাথেই এমন লাল শাড়ি পরে বউ সাজার কথা ছিল।এটা কী হয়ে গেল!
গাড়ি থেকে নামিয়ে ফুল ছড়িয়ে দিয়ে ছোঁয়াকে বারান্দায় আনা হলো।সবাই ওশানের মা-কে দেখিয়ে বলল,
”তোমার শাশুড়ি,সালাম করো মা।”
ছোঁয়া খুব গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকাল শাশুড়ির দিকে।নিচু হয়ে সালাম করতেই কী যে করল কেউ কিছুই বুঝল না।অথচ শাশুড়ি চিৎ হয়ে ঠাস করে পড়ে গেলেন।সবাই শাশুড়িকে টেনে তোলার চেষ্টার করছে।কোমরে দারুণ ব্যাথা পেয়েছেন উনি।শাশুড়ি ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন।মানুষজন সব হা করে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।কেউ বোধহয় জীবনে এমন বউ দেখেনি যে সালাম করতে গিয়ে শাশুড়িকে ফেলে দেয়।
মামী শাশুড়ি বললেন, ”কীভাবে পড়লেন আপা?”
‘ফেলে দিছে আমাকে ফেলে দিছে ময়না।’
‘ছিঃ!এসব কী বলছেন?নতুন বউয়ের নামে এসব কী বলছেন?’
ওশান বলল, ”আম্মা এসব কী বলছ তুমি?”
ছোঁয়া বেশ বিরক্তি ভাব দেখিয়ে বলল, ”এক্সকিউজ মি!আই আম সো টায়ার্ড।”
জিনাত বলল, ”চলো তোমাকে রুমে নিয়ে যাই।রেস্ট নিয়ো।”
‘নো নিড।জাস্ট রুমটা দেখালেই হবে।’
জিনাত বেশ অপমানিত হলো।ইশারায় রুমটা দেখাল।ছোঁয়া হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল।
চলবে?..
(আশাকরি গঠনমূলক কমেন্ট করবেন।হতাশ হবেন না।ভরসা রাখুন সব ভালো হবে।)’