একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব -৬৭

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৬৭
#WriterঃMousumi_Akter.

ওশান ইদানীং রেগুলার তরীর বাসার আশেপাশে ঘুর ঘুর করে। কিন্তু তরী দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায়। মন থেকে কেউ একবার উঠে গেলে তার জন্য অনুভূতি কাজ করে না। তরীর বিষয়টাও আজ সেরকম। ওশানের শত চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে। তরীর সমস্ত অনুভূতি জুড়ে আজ মৃন্ময়। কিন্তু এখনও সেটা অপ্রকাশিত। বোধহয় একটু লাজুক প্রকৃতির জন্য কিছুই প্রকাশ করতে পারছে না।

এরই মাঝে ছোঁয়ার হঠাৎ পেইন শুরু হয়েছে। এখন তো লেবার পেইন ওঠার কথা নয়। হঠাৎ করে খিঁচুনি শুরু হয়ে, পেইন উঠে গেল। তন্ময় দ্রুত হসপিটালে নিয়ে গেল ছোঁয়াকে। খবর পেয়ে সেখানে আমরা সবাই ছুটে গেলাম। ছোঁয়ার স্যালাইন চলছে। মা-বাচ্চা উভয় বাঁচবে কি না সন্দেহ। ডাক্তার এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছে না আর প্রচুর টাকারও প্রয়োজন। তন্ময় ছোঁয়াকে বাঁচাতে নিজের কিডনি দিতেও দু’বার ভাবছে না। প্রয়োজনে সে কিডনি বিক্রি করে ছোঁয়ার চিকিৎসা করবে তাও ছোঁয়াকে সুস্থ চাইছে। ডাক্তারকে বলে দিয়েছে যত টাকা লাগে লাগুক ছোঁয়ার চিকিৎসায় যেন কোনো ত্রুটি না হয়। ছোঁয়ার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমার কাছে মনে হলো– ছোঁয়ার মা বাবাকে খবর দেওয়া উচিত।
বারান্দায় এসে ফোন কানে দিয়ে দেখি নিচে তরী দাঁড়িয়ে আছে। ছোঁয়ার খবর শুনে হসপিটালে ছুটে এসেছে। আমি ছোঁয়ার মায়ের কাছে খবর পৌঁছিয়ে দিলাম। তারা আসবে কি না জানি না।

তরীর পথ আটকে দাঁড়াল ওশান। তরী প্রচন্ড বিরক্ত মুখে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াল। বোঝা যাচ্ছে রাগে ফেটে যাচ্ছে। ওশান আচমকা তরীর পায়ের নিচে বসে পা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দাও তরী। প্লিজ তরী, আমাকে একটা সুযোগ দাও। তরী আমাদের বাচ্চার কথা ভেবে আমাকে একটা সুযোগ দাও। রোহান মা-বাবা ছাড়া কীভাবে থাকবে? ওর জীবনে মা-বাবা দুজনেরই প্রয়োজন। একদিন না তুমি আমায় ভালোবাসতে সেই ভালোবাসার কথা ভেবে না হয় তুমি আমাকে আরেক বার ভালোবাসার চেষ্টা করো।’

‘ছেলের মা-বাবা দু’জনের প্রয়োজন সেটা অনেক আগে ভাবা উচিত ছিল। রোহানের এখন বাবার প্রয়োজন নেই। আর জীবনে যেন আমার সামনে না আসা হয়।’

তরী পা ঝাড়া মেরে হসপিটালের দিকে রওনা হলো। তরীর সাথে মৃন্ময়ও ছিল। মৃন্ময় তরীর পাশে সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘কী ভাবছ?’

‘কোন বিষয়ে?’

‘ওশান, ফিরে যাবে ওর কাছে?’

‘হ্যাঁ, যাব।’

‘সত্যি যাবে?’

‘হুম।’

সত্যি?

‘হুম।’

‘কেন?’

‘বলব কেন?’

‘আচ্ছা যা তুই! কে নিষেধ করছে যেতে?এখনি যা।’

‘তুই তুই করছেন!’

‘করলে কী পাপ হবে? তুই না আমার থেকে বয়সে ছোটো, তুই বললে সমস্যা কী?’

‘তাই বলে তুই বলবেন!’

‘প্রেমিকা তো আর না যে তুমি তুমি বলব।’

‘আচ্ছা মনে থাকবে।’

‘এই শোনো তরী, আর তুই বলব না; আপনি বলব। এইবার বলো, যাবে ওর কাছে?’

‘কী মনে হয়?’

‘বুঝতে পারি না তোমাকে?’

‘আমার চোখের দিকে তাকান।’

‘তাকাতে সাহস পাই না।’

‘আজ তাকান।’

‘তাকিয়েই আছি তাও কিছু বুঝছি না।’

‘সব কথা সব সময় মুখে বলা যায় না।
নারীর চোখের ভাষা না বুঝলে পুরুষ তুমি ব্যর্থ, ভীষণ ব্যর্থ। কীসের পুরুষ মানুষ তুমি?’

‘আমি যা ভাবছি, তুমি কি তাই বোঝালে?’

‘আপনি কী ভাবছেন বুঝব কীভাবে?’

‘ইউ একসেপ্ট মি।’

‘তবুও বোঝে না গাঁধা। আবার এত বছর একটা মেয়ের পিছে ঘুরছে।’

_____________
কিছুক্ষণের মাঝে একটা কালো প্রাইভেট কারে ছোঁয়ার মা-বাবা এসে হাজির হলো।মানুষ দুইটা কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে প্রবেশ করল। দীর্ঘদিন পর আজ তারা একমাত্র মেয়ের মুখ দেখবে। ছোঁয়ার মা-বাবাকে দেখে বেশ ভালো লাগল। তন্ময় ছোঁয়ার হাত ধরে বসে ছিল। ছোঁয়ার মা-বাবাকে দেখে হাত ছেড়ে দিল। ছোঁয়া ভাবতেই পারেনি ওর মা-বাবা আসবে। কিছু মুহূর্ত থাকে ভীষণ আদুরে, ভীষণ ভালোবাসাময়। দীর্ঘদিনের রাগ-অভিমান ভুলে একমাত্র মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিল ছোঁয়ার মা-বাবা। ছোঁয়া যেন অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেল মা-বাবাকে পেয়ে।মা-বাবা আর মেয়ের অনেক ইমোশনাল মুহূর্ত কাটল। সন্তানের অসুস্থতায় কি কোনো মা-বাবা রাগ-অভিমান করে থাকতে পারে। ছোঁয়া সেই তখন থেকে বাবার বুকে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। এ যেন দীর্ঘদিনের আকুলতা মা-বাবাকে কাছে না পাওয়ার। ছোঁয়ার এই অসুস্থতার পিছনে মেইন কারণ-ই ছিল বাবা-মাকে কাছে না পাওয়া। মানুষ বলে না, শুধু ভালোবাসার মানুষ হলেই সুখী হওয়া যায়; আর সে চিন্তা থেকেই মা-বাবাকে রেখে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যায়। এই সিদ্ধান্তটা জীবনের সব থেকে বড়ো ভুল। মানুষের জীবনের প্রথম ভালোবাসা হলো মা-বাবা। সেই প্রথম ভালোবাসার দোয়া না থাকলে দ্বিতীয় ভালোবাসায় পুরোপুরি সুখী হওয়া যায় না।মোটেও যায় না। ছোঁয়া দীর্ঘদিন মানসিক কষ্টে ভুগেছে। বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে সুখে থাকলেও মা-বাবার ভালোবাসার অসুখ তাকে তাড়া করেছে। আজ যেন মানসিক শান্তি খুঁজে পেল।

তন্ময় কী করবে বুঝতে না পেরে কেবিন থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়াল। ছোঁয়ার বাবা হাত টেনে ধরে বললেন,
‘তন্ময় কোথায় যাচ্ছো বাবা?’

তন্ময়ের মাথাটা নিচু। অপরাধী কন্ঠে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিন। অনেক কষ্ট দিয়েছি আপনাদের।’

‘আচ্ছা বাইরে চলো জামাই-শ্বশুর মিলে চা খাই। আমার নাতি-নাতনি আসবে এর চেয়ে আনন্দের কী আর কিছু আছে?’

তন্ময় যেন ভীষণ অবাক হলো। যদিও ছোঁয়ার বাবার সাথে তন্ময়ের আগেও কথা হয়েছে। চেনা-জানা আছে। তন্ময় ভ’য়ে ভ’য়ে ছোঁয়ার বাবার সাথে বাইরে গেল।

তন্ময় আবার বলল,
‘আঙ্কেল আমাকে ক্ষমা করে দিন।’

‘কীসের জন্য ক্ষমা করব?’

‘আপনাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য।’

‘কীসের কষ্ট? তুমি আরও আমাদের শান্তি দিয়েছ। তোমার প্রতি তো রা’গ ছিল না। রা’গ ছিল এক অমানুষের প্রতি। আজ আর সেসব বলব না। তবে তোমার সাথে ছোঁয়া ছিল এটা অনেকটা নিশ্চিন্ত করেছে আমাদের।’

‘রা’গ ছিল না?’

‘কীভাবে রা’গ থাকবে? এত কিছুর পরেও তুমি আমার মেয়েকে গ্রহণ করে আগলে রেখেছ, এটার জন্য তোমাকে কী বলব জানি না। আমি পরে সব জেনেছি। আসলে মেয়েটা বড্ড বোকা। একবার পারত না বাবার সাথে সব শেয়ার করতে, তাহলে কী এত কিছু পোহাতে হতো? বোকা মেয়েদের কপালে এমনই হয়।’

‘আঙ্কেল আমি অনেক বার ক্ষমা চাওয়ার জন্য ফোন দিয়ে দিয়ে কেটে দিয়েছি।’

‘আবার আঙ্কেল, বাবা ডাকো আমাকে।আমার তো ছেলে নেই। তুমি আর ছোঁয়াই আমার সব।’

‘আসলে আঙ্কেল আমি যে সিসুয়েশনে বিয়েটা করেছিলাম সেটা ছাড়া ছোঁয়াকে বাঁচানো সম্ভব হতো না; তবুও নিজের কাছে অপরাধী আমি। আমার ব্যাক্তিগত সাজেশন এটা কোনো মেয়েরই উচিত নয় মা-বাবার এত ভালোবাসা উপেক্ষা করে একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া। এটা বাবার হৃদয় ছিদ্র হয়, তীব্র ব্যাথা হয়, যন্ত্রণা হয়। আপনার এই যন্ত্রণা আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছি।’

‘তন্ময়, পৃথিবীর সব ছেলে তোমার মতো নয়। আমার মেয়েকে আমার থেকে তুমিই বেশি ভালোবাসো। তা না হলে আমি যেখানে এত কিছুর পরে আশ্রয় দিইনি সেখানে তুমি আমার মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছ।’

‘আপনার থেকে বেশি ভালো আমি কোনদিনই বাসতে পারব না।’

ছোঁয়ার বাবা তন্ময়ের মায়ের সাথে সালাম বিনিময় করে বিনয়ের সাথে কথা বললেন।দু’টো পরিবারের মুখেই হাসি ফুটল।

ছোঁয়ার প্রেশার কমেছে, সিজারের জন্য ওটিতে নেওয়া হলো। ঘন্টা খানিক পরে ডাক্তার ফুটফুটে একটা মেয়ে শিশু এনে তন্ময়ের কোলে তুলে দিল। তন্ময় ছোঁয়ার বাবার কোলে তুলে দিল। একে একে সবাই কোলে নিলে আমিও কোলে নিলাম। রোশান স্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আপনার কী ইচ্ছা হয় না এমন একটা আদুরে বাবুর বাবা হতে?’

‘এমবিএটা শেষ হোক তোমার। আমাদের বেবি হবে, কোনো এক নির্জন প্রহরের ভালোবাসায়।’

‘আমি আর ফ্যামিলি প্ল্যানিং ফ্ল্যানিং করব না, বুঝেছেন? আমার একটা বেবি চাই।’

‘আল্লাহ দিলে হবে।’

ছোঁয়ার বেবি হওয়ার ১০ দিন পরে ছোঁয়ার বাবা বিশাল বড়ো একটা অনুষ্ঠান করলেন।তন্ময়কে শ্রেষ্ঠ জামাই বলে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

চোখের সামনে যেন একটা সুন্দর সুখী পরিবার দেখতে পেলাম। এতদিনের কষ্ট তাদের এবারই সার্থক হলো।

চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here