#একটুখানি_ভালোবাসা
#পর্ব_৪
#মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
আবীর শাদাবের বুকে একনাগাড়ে ছয়টা গুলিই চালিয়ে দিয়েছে। বেচারাকে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ টা পর্যন্ত দিল না।
আবীরকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘- আবীর! আজকাল তোমার মুখের চেয়ে হাত চলছে বেশি। নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করো। এভাবে কথায় কথায় মানুষের উপর গুলি চালানো টা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আবীর কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
‘- ভাইয়া ওর সাহস কত বড়! আপনার মা-বাবাকে তুলে গালি দেয়? ইচ্ছে করছে ওর জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলি।
একটা মুচকি হেঁসে উড়িয়ে দিলাম ব্যপারটা।
‘- যাইহোক লাশ’টা এমন কোনো জায়গায় গিয়ে ফেলে দিয়ে এসো যাতে করে ওর গুণধর বাবা কাল সকালে পেয়ে যায় দাফনের জন্য। বাপ বেটা দু’টোই একই জাতের৷
বেচারা শাদাব। অকালেই প্রাণটা হারালো৷
আবীর শাদাবের লাশ’টা বস্তায় ভরে গাড়িতে তুলে বেরিয়ে গেলো। আমিও সোজা বাড়িতে চলে এলাম। আজ একটু বেশিই ধকল গেলো শরীরের উপর। অফিসে আর যাওয়া হলো না।
বাড়িতে ফিরেই মাধবীলতার সম্মুখীন হতে হলো। ঘরে পা রাখতেই সে আমার হাতে কাগজ ধরিয়ে দিল।
‘- কোথায় গিয়েছিলেন?
আমি পুনরায় তার মুখপানে দৃষ্টিপাত করি।
সে হাত নাড়িয়ে বুঝালো “কোথায় গেছিলাম “।
এমনভাবে বলছে, যেন সে আমার ঘরের বউ।
আমি কোনো হেঁয়ালিপনা না করে তাকে সোজাসাপ্টা বলে দিলাম,
‘- আপনাকে শাদাব নামের কেউ অপহরণ করতে চেয়েছিল নিশ্চয়ই?
শাদাব নামটি শুনতেই মাধবীলতা ভরকে ওঠে।
‘- আরে ভয় পাবেন না। ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি। ওকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আর কোনদিন সে আপনার সামনে আসবে না। যার যেখানে থাকা প্রয়োজন তাকে সেখানেই পাঠিয়েছি। ক্লান্ত লাগছে। পরে কথা বলি?
তাকে পাশকাটিয়ে চলে এলাম ঘরে। গোসল করে কফি চেয়ে পাঠালাম।
কিছুক্ষণ পর সার্ভেন্ট এসে কফি দিয়ে গেলো।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে আবীরকে কল দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করলো।
‘- হ্যাঁ আবীর এখন তুমি কোথায়?
‘- এইতো ভাইয়া লাশ’টাকে একটা নদীর তীরে ফেলে দিয়ে আসলাম!
‘- আচ্ছা সাবধানে এসো।
রাতের খাবার শেষ করে ঘরে এসে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। ম্যানেজার কোম্পানির প্রজেক্টের ব্যাপারে কিছু মেইল করেছে৷ সেটা চেক করছিলাম। কিছুক্ষণ পর কেউ দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। আমার ঘরে আবীর ছাড়া কেউ একটা আসে না। তাই না তাকিয়েই বললাম,
‘- ভিতরে এসো।
ভিতরে প্রবেশের শব্দ পেলাম। তবে এখনো তাকাইনি। আবীর চুপ থাকায় জিজ্ঞেস করলাম,
‘- কিছু বলবে?
কিন্তু কোনো কথা বলছে না। হঠাৎ ল্যাপটপের উপর একটা কাগজ আছড়ে পড়লো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখি মাধবীলতা। এতক্ষণ খেয়ালই করিনি যে আবীর ঘরে এলে তো সে কথা বলত। মাধবীলতা কোমরে দু’হাত দিয়ে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে একটা পুতুল দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।
সোজা হয়ে বসে কাগজের দিকে তাকালাম।
‘- সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, একটিবার চোখ তুলে তাকালেন না। কেমন আজিব মানুষ আপনি। বুইড়া খাটাশ একটা।
ওমা এ’তো দেখি ছোটটার মতোই 🥴😯। পার্থক্য এতটুকুই যে, ছোটটা মুখে বলে দেয় আর সে লিখে বলে দেয়। আমি তো একে শান্ত মেয়ে ভেবেছিলাম। কিন্তু এ তো আরও এক পা এগিয়ে।
‘- আসলে আজ অফিসে যাইনি। তাই ঘরে বসে কাজগুলো দেখছিলাম। আসুন বসুন।
সে এসে বিছানায় বসলো।
‘- কিছু বলবেন?
সে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল। তারপর কাগজে লিখতে শুরু করল। বাপ্রে কতটা দ্রুত লিখছে। মেশিন নাকি?
‘- আরে আস্তে লিখুন। কলমের মাথা ভেঙে যাবে তো।
সে সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। কথা বলতে নিষেধ করছে। কী ভয়ঙ্কর বিষয়!
একটু পর আবার একটি কাগজ সে হাতে দেয়।
‘- আপনি তখন বলেছিলেন না যে নিজের জীবনকে নিজেকেই গড়ে তুলতে হয়? আমিও তাই চাই। পড়ালেখা করে কিছু করতে চাই। আমাকে সাহায্য করবেন?
‘- এইতো অনেক ভালো কথা ভেবেছেন। বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি।
সে আবার কাগজে লিখে দিল,
‘- আমাকে ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ করে দিন। সেই সাথে একটা জব। আমি চাই নিজে কাজ করে আমি আর আমার বোনকে দেখতে।
‘- অনেক ভালো লাগলো আপনার কথা। আপনার ইচ্ছেকে সম্মান জানাই। তবে হ্যাঁ! জবের ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু এখান থেকে কোথাও যাওয়া যাবে না। আমার বাড়িতে থেকেই সবকিছু করতে হবে। বলুন কী বলছেন? রাজি তো?
সে শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে দিল।
‘- আচ্ছা তাহলে এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল সকালে আবীর আপনাকে নিয়ে যাবে আপনার কর্মস্থানে।
সে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। সে চলে যাওয়ার পর আমার ঠোঁটে হাত বুলিয়ে দিলাম। যেখানে মাধবীলতার স্পর্শ লেগে রয়েছে। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে অস্ফুট স্বরে হাসির শব্দ বেরিয়ে এলো।
খুশিমনেই ঘুমিয়ে গেলাম।
পরদিন সকালে নামাজ শেষ করে বাড়িতে আসতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়।
বাড়িতে প্রবেশ করতেই খাবারের গন্ধ নাকে বারি খেতে লাগলো। বেশ কিছু খাবারের গন্ধ পাচ্ছি। খাবারের টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ কয়েকটি পদের খাবার। কিন্তু আমি তো সকালে এসব খাই না। তাহলে রান্না হয়েছে কেনো? বুয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘- এতো খাবার কে খাবে? তুমি জানো না আমি সকালে এসব খাই না? তারপরও কেনো রেঁধেছ?
‘- স্যার আমি রান্না করিনি। সব নতুন ম্যাডাম করেছে।
বুয়ার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। নতুন ম্যাডাম আবার কে?
‘- কী বলছো তুমি? নতুন ম্যাডাম মানে?
তৎক্ষনাৎ সেখানে মাধবীলতা এসে হাত তুলে দাঁড়ায়। তারমানে সে-ই এতগুলো খাবার রেঁধেছে।
আবারও সেই একই কাহিনী। হাতে হারিকেন (মানে কাগজ 🥴)।
‘- আজ আমি রান্না করেছি আপনার জন্য। খেয়ে বলবেন কেমন হয়েছে। সবাই বলে আমার রান্না নাকি অনেক মজার হয়। আর বুয়াকে বকবেন না। উনি আমাকে নিষেধ করেছিল। কিন্তু আমি শুনিনি। এখন খেতে বসুন।
যদিও সকালে আমি ভেজা খাবার খাই না। আজ একটু নাহয় খেলাম।
চেয়ারে বসার সঙ্গেই মাধবীলতা খাবার বেড়ে দিল। বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেলাম।
‘- অনেক ভালো রাঁধেন আপনি। আবীর তুমি ওনাকে নিয়ে নিয়ে যাও। যেভাবে বলেছি সেভাবে করবে।
আমি ঘরে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। কখন ঘুম এসে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে বুঝতেই পারিনি।
ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১২ টা বাজতে চলেছে। গোসল করে সোজা চলে গেলাম অফিস।
অফিসের ভিতরে প্রবেশ করতেই সবাই দাঁড়িয়ে গেলো। শুধু একজন ছাড়া। মাধবীলতা। কারণ সে হয়তো জানেই না এটা আমারই কোম্পানি। সে আমাকে দেখে হায় দিলো। যখন দেখলো সবাই আমাকে সালাম দিচ্ছে তখন কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে।
আমি কেবিনে গিয়ে বসলাম। আবীরকে ইশারা দিয়ে ডাকলাম।
‘- আচ্ছা আবীর নয়নের মায়ের কী খবর? ‘- হ্যাঁ ভাইয়া মোটামুটি ভালো। আপনার কথামতো ওদের ভাঙা ঘরটা মেরামত করিয়েছি। আর নয়নকেও একটা ভালো কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজও করবে।
‘- আচ্ছা তাহলে এখন যাও।
আবীর যেতেই টেবিলে থাকা মুঠোফোনটি বেজে ওঠে।
নানু ভাইয়ের ফোন। রিসিভ করেই সালাম দিলাম,
‘- আসসালামু আলাইকুম নানু ভাই। কেমন আছো?
‘- ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমরা সবাই ভালো আছি। তুমি কেমন আছো নানা ভাই।
‘- ভালো আছি।
‘- অনেকদিন হয়ে গেলো তোমাকে দেখি না। অনেকবার বলেছো আসবে। কিন্তু আসোনি। এবার কোনো কথা শুনবো না। আসতেই হবে। আর যদি না আসো তাহলে তোমার সাথে কথা বলব না। তুমি আসো না বলে তোমার নানা ভাই তোমার উপর অভিমান করেছে।
‘- আচ্ছা আর অভিমান করে থাকবে হবে না। নানাকে ফোনটা দাও।
ওপাশ শুনতে পেলাম,
‘- ওকে বলে দাও যতক্ষণ না পর্যন্ত বাড়ি আসছে ততক্ষণ ওর সাথে কোনো কথা বলব না৷
আমিও কম না,
‘- নানু, ওই বুড়োকে বলে দাও আমিও বাড়ি গিয়েই কথা বলব।
তারপর অনেক কথা বললাম।
আসলে নানু ভাই অনেকদিন হলো ডাকছে। কিন্তু সময়ের অভাবে যেতে পারছি না। কিন্তু এবার এতো করে বলছে। আর থাকা যায় না।
বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে মাধবীলতাকে নিয়ে বাড়ি চলে গেলাম। ড্রয়িং রুমে মিহি পুতুল নিয়ে খেলা করছে।
রাতে খাওয়ার পর মাধবীলতা আর মিহিকে বলি,
‘- কাল আমরা নানু বাড়ি যাচ্ছি। আপনার কী আপত্তি আছে?
মাধবীলতা কপাল কুঁচকে তাকালো।
‘- অনেক বছর হয়ে গেলো তাদের সাথে দেখা করি। আজ অনেক অনুরোধ করল। তাই ভাবলাম কয়েকটা দিন ঘুরে আসি।আপনারাও চলুন। গ্রামাঞ্চল, অনেক ভালো লাগবে। মাঠে মাঠে সোনালি ফসল, নদীর তীরে কাশফুলের মেলা,,,
আর কিছু বলার আগেই মাধবী আমাকে থামিয়ে দেয়।
হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিল,
‘- আমরাও যাব। কিন্তু অফিস?
‘- অফিস এসেও করতে পারবেন৷ আশা করি এই ভ্রমণটি খারাপ হবে না। কেননা শীতকালের ছোঁয়া লেগেছে প্রকৃতিতে। গ্রামাঞ্চলে শীতের সময়টা বেশ উপভোগ করা যায়।
মিহি খুশিতে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। নাচতে নাচতে আমার কোলে উঠে গালে আদর দিয়ে দিলো।#একটুখানি_ভালোবাসা
#পর্ব_৫
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মাধবীলতা আর মিহি’কে ডাক দেওয়ার জন্য বের হলাম। কিন্তু তারা আমার আগেই উঠে তৈরি হয়ে নিয়েছে। আমিও ফ্রেশ হয়ে তৈরি হলাম। এতক্ষণে আবীর সব লাগেজ গাড়িতে তুলে দিয়েছে। আবীর আমাদের স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিলো। আগে থেকেই টিকিট কেটে রাখা হয়েছিল তাই আর সমস্যা হলো না। আবীরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠে পাড়ি দিলাম নানু বাড়ির উদ্দেশ্যে। এতক্ষণ মাধবীলতা’কে লক্ষ্য করিনি। ট্রেনে উঠে আসনে বসার পর মাধবীলতা’কে দেখলাম। ওরা একপাশে বসেছে আর আমি তাদের সামনে। পড়নে তার ধুসর রঙের শাড়ি। মেয়েটা বোধহয় শাড়ি অনেক পছন্দ করে। জানি না মেয়েটাকে কেন এতটা মায়াবী লাগে! আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে মাধবীলতার মুখপানে তাকিয়ে রইলাম।
ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা তিল। মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় কখন যে ট্রেন চলতে শুরু করেছে তা বুঝতেই পারিনি।
এদিকে মাধবীলতাও স্পর্শ’কে নিয়ে ভাবছে।
আজ মানুষটা না থাকলে হয়তো কোন এক রাস্তায় পড়ে থাকতাম আমরা।
মাধবীলতাও কী মনে করে যেন আমার দিকে তাকালো। আমি তখনো তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি।
সে একটা মুচকি হাসি দিল। মাধবীলতা হাসি দেওয়ার সঙ্গেই তার ঠোঁটের কোণে থাকা তিলটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো।
হঠাৎই মুখের সামনে কে যেন তুড়ি বাজিয়ে ধ্যান ভেঙ্গে দিল। কেউ নয়, মাধবীলতা’ই। উফফ! এত সুন্দর একটা মুহূর্ত কেউ এভাবে নষ্ট করে দেয়?
মাধবীলতা হাত নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল “কী দেখছি?
আসলেই কী দেখছি আমি? কেনই বা নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি তার দিকে?
কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে আমতা আমতা করে বললাম,
‘- আসলে কিছু দেখছি। ভাবছি!
আবারও হাত নাড়ালো,
‘- কী ভাবছি?
ধুর কী থেকে কী বলছি আমি। মাথা গেছে আমার।
‘- ভাবছি এটাই! যে শাড়িতে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগে দেখতে।
মনে হয় লজ্জা পেলো। সুন্দর জিনিসের প্রশংসা করতে সমস্যা কী?
এদিকে মিহি বারবার হাই তুলছে।
হঠাৎ মনে পড়লো সকালে আমরা কিছু খাইনি। পরের স্টেশনে খাবার নেওয়া উচিৎ। কিছুক্ষণ পর স্টেশনে এসে থামলো। তাড়াতাড়ি ট্রেন থেকে নেমে রুটি, কলা পেলাম। তাই নিয়ে নিলাম। মিহির জন্য চকলেট নিলাম। সাথে পানির বোতলও। ট্রেনে উঠে মাধবীলতা আর মিহিকে খাবার দিলাম আর বললাম,
‘- এর থেকে ভালো কিছু নেই। এটাই খেয়ে নিন।
তারপর সবাই খেয়ে নিলাম। ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। এবার বাতাস এসে মাধবীলতার এলোমেলো চুলগুলোকে নিজের সাথে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। নাহ এবার আবার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যাবে না। তাহলেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
আসন থেকে উঠে দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ফুরফুরে বাতাসে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।
কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ ভিতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পেলাম। হঠাৎ সবার কী হলো? দেখার জন্য এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম একটা লোক হাতে একটা ছোট ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সবাই ভয় পেয়েছে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মনে মনে বললাম,
‘- এসব কী শুধু আমার সামনেই হতে হয়?
লোকটার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখলাম। আমার দিকে ঘুরতেই বুঝতে পারলাম মাতাল।
‘- কিরে হাতে ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
সে ঢুলতে ঢুলতে বলল,
‘- তুই কে বে? তুই জানিস আমি কে? অত্র এলাকার মাস্তান আমি। পুরো এলাকা আমার ভয়ে কাপে। আর বাচ্চারা আমার নাম শুনলেই প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে।
ওর কথা শুনেই বুঝা যায় মাতাল আস্ত একটা চাপাবাজ 😐। সে ট্রেনে দাঁড়িয়ে এলাকার কথা বলছে। ভাবা যায়?
‘- তুই এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছিস, জানিস?
সে চারিদিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখলো।
‘- আমি কোথায়?
‘- এটা ট্রেন। তুই জানিসও না কোন শহরে রয়েছিস। আর বলছিস কি-না অত্র এলাকার মাস্তান তুই!
‘- তাতে কী হয়েছে। যেখানেই থাকি তাতে তোর কী? আমি এই ট্রেন কিডন্যাপ করব। দেখেছিস আমার হাতে কী আছে? এই ছুরি তোর পেটে ঢুকিয়ে দেবো।
‘- তুই যে ছুরি নিয়ে এসেছিস। এটা দিয়ে কারো হাতের আঙুলও কাটবে না। আবার মারতে চাস।
এবার লোকটা কাঁদতে শুরু করে দিল। আশ্চর্য ব্যপার। কাঁদছে কিন্তু চোখে পানি নেই 😦। মনে হয় ভালোই খেয়েছে আজ।
ধমক দিয়ে বললাম,
‘- ওই কান্না থামা।
সঙ্গে সঙ্গে কান্না বন্ধ।
ওকে দরজার সামনে নিয়ে এলাম।
‘- এবার বল এসব কেনো করছিস?
‘- মনের দুঃখে ভাই মনের দুঃখে।
এমনভাবে হাহাকার করছে, মনে হয় গুপ্তধন হারিয়ে ফেলেছে।
‘- কিসের এতো দুঃখ তোর?
‘- বউ আমারে প্রতিদিন ধরে ধরে মারে। তিনবেলা নিয়ম করে মারে। জন্মের মাইর মারে।
দাঁতে দাঁত চাপ দিয়ে হাসি আটকে রাখলাম। বেচারা। বউয়ের হাতে মাইর খেয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে।
‘- তা বউ মারে কেনো?
‘- কোনো কাজ করতাম না। বউয়ের কাছে মদের টাকা চাইতাম। তাই মারে।
‘- কোনো কাজ না করলে তো বউ মারবেই। আচ্ছা তারপর কী হলো?
‘- একদিন মদ খেয়ে বাড়িতে ফিরে ঘরে গিয়ে দেখি বউ দাঁড়িয়ে আছে। ওর চুলের ঝুঁটি ধরে বললাম,
‘- বউ তোর চুলের বেনি একটা কেনো?
বউ কোনো কথা না বলে মাথায় কিছু ঢেলে দিল। মাথায় হাত দিয়ে দেখি গোবর। বউ পিছন থেকে ঝাড়ু দিয়ে মেরে বলল,
‘- শয়তান গরু তোর বউ হয়? ঠিকই বলেছিস। তুই যেমন গাধা তেমন তোর বউও হওয়া উচিৎ গরু। এই অপমানের পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি।
যে কি-না নিজের বউ আর গরুর মধ্যে পার্থক্য বুঝে না সে আবার অপমানও বুঝে।
মাতালের কিডনি টাচিং গল্প শুনে আমার কিডনি নড়েচড়ে উঠলো 🥴।
মাতালের জীবনের গল্প শুনতে শুনতে পরের স্টেশনে এসে পৌছালাম। সে নেমে গেলো। পিছন থেকে বললাম,
‘- কী হলো এখানে নেমে পড়লে যে! কোথায় যাও?
এতক্ষণ গল্প করার পর ছেলেটাকে আর তুই করে সম্বোধন করতে পারলাম না।
ছেলেটা পিছু ঘোরে উত্তর দিল,
‘- পরের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরব। বউ’টারে ছাড়া ভালো লাগেনা? বের হইছিলাম ধান্দা করতে। কিন্তু আপনার সাথে গল্প করতে করতে ধান্দা করাই হলো না।
এতকিছুর পরেও সে বউয়ের ভালোবাসাতেই আবদ্ধ। মাতালেও বুঝে ভালোবাসার মুল্য কতটুকু।
‘- এদিকে এসো।
সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার কাঁধে হাত রেখে বলি,
‘- তুমিতো সুস্থ-সবল, কর্মঠ! তাহলে নেশা করে নিজের এবং নিজের পরিবারের লোকজনদের জীবন কেন এভাবে শেষ করে দিচ্ছ? আল্লাহ তোমাকে সুন্দর দুটো হাত দিয়েছে। এই হাত দিয়ে কর্ম করে খাবে। তখন আর কেউ তোমাকে অপমান করার সাহস পাবে না। আর না কখনো তোমার বউ তোমাকে মারবে। তুমি বলেছিলে না যে তোমার সন্তানেরাও তোমার কাছে আসে না? কি করে তোমার কাছে আসবে কারন তুমিতো নেশার ঘোরে থাকো। দিন শেষে যখন খালি হাতে বাড়ি ফিরো, তখন তোমার সন্তানেরা অনেকটাই আশা-আকাঙ্খা নিয়ে বসে থাকে, যে আমার বাবা আমার জন্য এটা নিয়ে আসবে, ওটা নিয়ে আসবে। কিন্তু তারা যখন দেখে তুমি খালি হাতে বাড়ি ফিরেছো তখন তারা হতাশ হয়ে যায়। আর অভিমানেরাও তাদের ঘিরে ফেলে।
তুমি যদি তোমার নেশা করার টাকার কথা চিন্তা না করে তোমার মা বাবা, তোমার স্ত্রী, আর তোমার সন্তানের কথা চিন্তা করো, তাহলে দেখবে তুমি নিজেই একটা সুন্দর সমাধান পেয়ে যাবে।
হঠাৎই ট্রেন চলতে শুরু করল। তড়িঘড়ি করে ওয়ালেট থেকে কিছু টাকা বের করে ওর হাতে দিয়ে বললাম,
‘- এই টাকাটা দিয়ে তোমার মা বাবা, স্ত্রী আর সন্তানদের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যেও। সন্তানদের না কাঁদিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করো। এর থেকে বড় সুখ আর পৃথিবীতে কোথাও খুঁজে পাবে না। আর হ্যাঁ এখন থেকে এসব না করে কাজ করে খাবে। নাহলে যদি কোনোদিন তোমার দেখা পাই তাহলে তোমার খবর করে দেবো।
আস্তে আস্তে ট্রেনটি কিছুটা দূরে চলে গেলো। জানি না কতটা বুঝাতে পেরেছি। ছেলেটার মাঝে আমার কথার কোনো প্রভাব ফেলেছে কিনা বুঝতে পারলাম না। হঠাৎই ছেলেটা দৌড়ে আমার কাছে এলো। চোখে স্পষ্ট পানি দেখা যাচ্ছে। সে দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
‘- ভাই আমি আপনাকে কথা দিলাম আজকের পর আর মদ পান করব না। একদম ভালো হয়ে যাব। এখন থেকে কাজ করে খাবো। ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি ফোটাবো।
তার উত্তরে একটা হাসি দিয়ে বললাম,
‘- ভালো থেকো। আর ভালো রেখো পরিবারকে।
আস্তে আস্তে ছেলেটি চোখের আড়ালে বিলিন হয়ে গেলো। হারিয়ে গেলো অচেনা, অজানা সেই ছেলেটি।
পুনরায় চলে এলাম আসনে। বসতেই মাধবীলতা হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল।
‘- কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?
ছেলেটার কথা মনে একটা মুচকি হেঁসে বললাম,
‘- এক পাগলের সঙ্গে ভাব বিনিময় করছিলাম।
আমার কথার মানেটা হয়তো সে বুঝতে পারলো না৷
‘- বুঝতে পারলেন না তো?
সে মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দিল।
‘- আচ্ছা বাদ দিন। বুঝতে হবে না। কিছু কিছু বিষয় অজানা থাকাই ভালো।
সেও আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
আরও কয়েকঘণ্টা জার্নি করার পর গন্তব্যে পৌঁছলাম। ট্রেন থেকে নেমে বাইরে এলাম। সামনে আমার ছোট মামা দাঁড়িয়ে আছে। সে নিতে এসেছে আমাকে। মামাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলাম।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,