একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব -৫৭+৫৮

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫৭
#Saji_Afroz

সময় পার হতে থাকে। আজরা এখন নয় মাসের গর্ভবতী। এই ন’টা মাস ইনতিসার তার জীবনে অনেকবার ফিরে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আজরা এতে রাজি হয়নি। ইলারা জামানের সঙ্গে সে দেখা করতে আসলেও নিজেকে রুম বন্দী করে রেখেছে আজরা। এদিকে ইনতিসার আজরাকে আবারও নিজের করে ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠে।
বাসায় এসে আজরাকে না পেলেও প্রায়ই তাকে পথে দেখতো ইনতিসার। বেশিরভাগই সাদের সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়ার সময়। কিছুদিন আগেও দেখলো তাকে।
আজরা নিজের পেটে হাত রেখে হেঁটে গাড়িতে উঠেছে। গর্ভবতী হওয়ার পর আজরার সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে গেল। আজও আজরাকে দেখে আরেকবার মুগ্ধ হলো ইনতিসার। সাদের সঙ্গে শপিংমল এ এসেছে সে। নতুন বাচ্চার জন্য শপিং করতে ব্যস্ত তারা। তাদের পিছু নিয়েছে ইনতিসার। আজরা তোয়ালে থেকে শুরু করে বাচ্চাদের সমস্ত জিনিসপত্র কিনছে। ইনতিসার খেয়াল করলো সব জিনিসই দু’টো করে নিচ্ছে সে। আর তাকে এসব পছন্দ করতে সহায়তা করছে সাদ।
আজরা জামা কিনতে গেলে সাদ তার দিকে কয়েকটা ফ্রক বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এইগুলা নিন। সুন্দর!
-কিন্তু আমার ছেলে নাকি মেয়ে হবে তা জানিনা।
-তবুও নিয়ে রাখুন।
-নাহ। এমন কাপড় নেব যাতে ছেলে মেয়ে সবাই পরতে পারে।
এই বলে আজরা অন্য কাপড় দেখতে শুরু করে। কিন্তু সাদ ঠিকই সেই মেয়ের জামা গুলো গোপনে কিনে নেয়। এই দৃশ্য দেখে মৃদু হাসলো ইনতিসার। সাদের জায়গায় সে হলে ঠিক এমনটাই করতো। বরং সে ছেলে-মেয়ে দুজনেরই কাপড় নিয়ে রাখতো। আফসোস! এই সুন্দর একটা সময়ে আজরার পাশে থাকার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে সে।
শপিং থেকে বেরিয়ে নিজ ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো ইনতিসার। পথিমধ্যে পুরনো এক বন্ধুকে দেখতে পায়। যে কিনা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে চায়। ইনতিসার তাকে থামিয়ে বলল-
কথা না বলেই চলে যাচ্ছিস?
আশেপাশে তাকিয়ে শারীফ বলল-
আমার স্ত্রী চায়না তোর সঙ্গে আমি কোনো সম্পর্ক রাখি।
-কেন?
-কারণ তুই বউকে ঠকিয়েছিস। তোর সাথে মিশলে যদি আমিও এসব শিখি!
বলতে বলতেই শারীফের বউ এসে হাজির হলো। সে বলল, তুমি এখনো এর সঙ্গে কথা বলো?
শারীফ আমতাআমতা করে বলল, নাহ! হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।
ইনতিসার বলল, ভাবী আমার উপরে রেগে আছেন কেন এত?
-আপনাদের মতো মানুষকে যদি সবাই অবহেলা করতে পারতো তবে দুনিয়াতে এসব পাপ কর্ম অনেকাংশেই কমে যেত।
এই বলে শপিংমল এর দিকে এগিয়ে যায় মেয়েটি। শারীফ বলল, আসলেই ভাই! জঘন্যতম কাজ করেছিস তুই। অন্তত বাবা হবি জানার পরে সবটা ঠিক করার চেষ্টা করতি?
এই বলে শারীফও চলে যায়। ইনতিসার হতাশ হয়ে বসে পড়ে গাড়িতে। নিজের জমানো টাকা থেকে পুরাতন একটা গাড়ি কিনেছে সে। মা এর দেওয়া ফ্ল্যাটে থাকে। একটা কোম্পানিতে চাকরি করছে। এইভাবে কাটছে সময় এখন!
আজ ছুটির দিন বলে অফিস নেই। তাই শপিংমল থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় আসলো সে। দরজা খুলে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো। মাথাটা ধরে এসেছে। এক কাপ কফি বা চা হলে মন্দ হত না। কফি বা চা এর কথা মনে হতেই আজরার কথা মনে পড়লো। সে কিভাবে যেন বুঝে যেত, ইনতিসারের কখন চা বা কফি খেতে ইচ্ছে করছে।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কফি বানালো ইনতিসার। রাতের খাবারটাও বানিয়ে রাখবে ঠিক করে। কিন্তু আর ইচ্ছে হয় না। আবারও ডিম আর ডাল দিয়ে এই বেলা চালিয়ে নেবে ভাবলো। প্রতিবারই এমনটা হয়। ডিম, ডালই চলে প্রায়। কারণ সে রান্না পারে না। এখন বুয়া রেখে বা বাইরে থেকে খাবার এনে টাকা নষ্ট করতে চায় না সে। ফ্রিজ থেকে বাশি ডাল বের করে নেয় ইনতিসার। কত আলিশান ছিল তার জীবন! না খেলেও টেবিলে থাকতো হরেক রকমের খাবার। তার ভুলের জন্যই আজকের এই অবস্থান। এই ভুল শোধরানোর কোনো কী উপায় নেই!

একটা প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেল নাবীহা। বেতন মোটামুটি হলেও সে সন্তুষ্ট। অন্তত অভাবে তো থাকতে হবে না!
এক ক্লাসে পড়িয়ে অন্য ক্লাসে আসলো সে৷ বিদ্যুৎ চলে যায়। তবুও তার কাজ থাকে অব্যাহত। ঘামতে থাকে সে। ছোটো সেই বাচ্চাদের পড়ানোর পাশাপাশি তাদের সামলাতে হয়। ঘেমে ভিজে একাকার হয়ে যায় নাবীহা৷ বাচ্চাদের চ্যাঁচামেচিতে মেজাজ খারাপ হওয়ার উপক্রম। আগের কথা ভেবে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললো নাবীহা। এসি রুমে অফিসের কাজ করতো সে। তেমন দিন কী কখনো ফিরে পাবে আর!
ক্লাস শেষে বেরুলো নাবীহা। বারান্দায় একজন মহিলা তাকে দেখে বলল, এই স্কুলে তুমি কী করছ?
নাবীহা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, আমি পড়াই এখানে।
-প্রধান শিক্ষক কী তোমার ব্যাপারে জানেনা! বাচ্চারা কী শিখবে তোমার থেকে? ওদের ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার করে দেবে তুমি।
আরেকজন বলল, কেন আপা?
-আরে এই মেয়ে তো অন্যের সংসার নষ্ট করেছে। কিভাবে সে অন্যদের ভালো শিক্ষা দেবে?
নাবীহা ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলল, আমি ভুল করেছিলাম। যেটা আমি মানছিও! প্লিজ আমাকে বারবার এসব মনে করিয়ে দেবেন না। সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারি না এসবের জন্য।
-কাজ যেমন করেছ ফল তো তেমনি ভোগ করবে বাপু।
অঙ্ক শিক্ষক জাদিদ এই পথেই যাচ্ছেন। এসব কানে আসতেই থামেন তিনি। সেসব অভিবাবকের উদ্দেশ্যে বললেন, উনি যে ভুল করে তা বুঝতে পেরেছেন এমনটা ক’জন পারে বলুন? ভুল করলে তা স্বীকার করার শিক্ষাটা অন্তত তিনি দিতে পারবেন। এটা তো মানেন?
জাদিদ স্যারকে সবাই সম্মান করেন বলে কথা বাড়ালেন না। তারা চলে যান।
নাবীহা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, নিজেকে পরিবর্তন করার জন্য সবার সহায়তা প্রয়োজন। আপনি যেভাবে এগিয়ে এসেছেন সেভাবে সবাই যদি আসতো!
জাদিদ হেসে জবাব দেয়, এসব কেটে যাবে একদিন। তবে অবশ্যই এই পরিবর্তন টাই যেন সবসময় থাকে। ভালো কিছুর মাধ্যমে খারাপ সমস্ত কিছু দূর করা সম্ভব।
জাদিদের কথা শুনে যেন সাহস পেল নাবীহা। তার এই নতুন লড়াই এ জিততে তো তাকে হবেই!

রাতের খাবারের পর আজরার করা বাচ্চার শপিং দেখছে ইলারা জামান। সাদও রয়েছে সঙ্গে৷ তিনি ফ্রক গুলো দেখে বললেন, আজরা মা? বাচ্চার জেন্ডার তো আমরা জানিনা। ফ্রক নিলে যে?
আজরা অবাক হয়ে বলল, আমি নিইনি! কিভাবে এলো এখানে!
সাদ হালকা কাশলে এটা যে তার কাজ তারা বুঝে যায়। ইলারা জামান বললেন, তোর বুঝি মেয়ে বাবু বেশি পছন্দ?
-হু। আজরার দু’টো ফুটফুটে মেয়ে হলে আমি খুশি হব। তুমি কী বলো খালামনি?
-হু। আমার তো মেয়ে ছিল না। তাই আমিও চাইতাম প্রথমে নাতনীই আসুক। কিন্তু এসব আল্লাহ এর ইচ্ছে। তিনি যা দেন তাতে সন্তুষ্ট।
আজরাকে একই প্রশ্ন করলে সে বলল, সুস্থ বাচ্চাই কাম্য।
সাদ মজার ছলে বলল, ছেলে মেয়ে দুটোই যদি হয়ে যায়?
আজরা মিষ্টি একটা হাসি দেয়।
সাদ তার মুখটা মলীন করলে আজরা বলল, কী হলো?
-ছেলের কোনো পোশাক যে নিলাম না?
-আমি যা নিয়েছি তাতে ছেলে মেয়ে দু’জনকেই মানাবে।
-তবে হলোই! এইবার আসুন, আপনার হাসপাতালের ব্যাগে এসব রেখে দিই।
সাদ নিজে আজরার প্রেগ্ন্যাসির সেই আট মাস থেকেই তার হাসপাতালের ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে। তাতে একেক দিন একেকটা জিনিস এনে রাখে সে। এভাবে করতে করতে এখন তার তিনটা ব্যাগ হলো। সাদের একটাই কথা! দু’টো বাচ্চার জন্য তিনটা ব্যাগ খুব বেশি নয়।

ব্যাগে এসব জিনিস রাখা হলে আজরা ঘুমানোর জন্য সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে। উঠার পরেই হঠাৎ তার পেটে ব্যথা করলে কেঁদে উঠে মেঝেতে বসে পড়লো সে। সঙ্গে সঙ্গে ইলারা জামান ও সাদ আসলো। আজরা পেটে হাত দিয়ে চিৎকার করতে থাকলে ইলারা জামান ড্রাইভারকে ফোন দেয়। সাদ কোনোকিছু না ভেবেই কোলে তুলে নেয় আজরাকে৷ ইলারা জামান কর্মচারীদের ডেকে গাড়িতে ব্যাগ গুলো দ্রুত রাখতে বললেন।
খানিকবাদে হাসপাতালে পৌঁছে যায় তারা। আজরার পেটের যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়। সে সাদের হাত ধরে বলল, আমি পারব না! অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি মারা যাব।
সাদ তাকে সাহস দিয়ে বলল, আপনি পারবেন! যন্ত্রণার পরেই যে দু’টো ফুটফুটে মুখ দেখতে পাবেন! তখন সব ভুলে যাবেন।

আজরাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সাদের হাত ছেড়ে দেওয়ার সময় বুকটা কেঁপে উঠলো তার। মনে হচ্ছে আজরা দূরে চলে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। এতদিন তার সঙ্গে সময় কাটিয়ে মনের মধ্যে আলাদা একটা জায়গা তৈরী হয়ে গেল মেয়েটির জন্য।
মেয়েটা সুস্থভাবে তার সন্তানদের নিয়ে ফিরে আসুক। এটা একমাত্র কাম্য!

এদিকে আজরার ড্রাইভারের কাছে সব শুনে হাসপাতালে ছুটে আসে ইনতিসার। ড্রাইভারকে টাকা দেয় সে প্রতিমাসে শুধু আজরার খবর নেওয়ার জন্যে। আজও খবর পেয়ে চলে আসে সে। কিন্তু থাকে আড়ালে। কারণ আজরার পরিবারও এখানে উপস্থিত রয়েছে।
খানিকবাদে একজন নার্স আসে। ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা যায়। সবাই উৎসুকভাবে নার্সের দিকে তাকালো। সে একগাল হেসে বলল, অভিনন্দন! একটি ছেলে ও মেয়ে হয়েছে। উভয়ই ভালো আছে।
সবাই আনন্দিত হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে৷ সাদ ব্যস্ত হয়ে নার্সকে জিজ্ঞাসা করলো, আর আজরা?
-তিনিও ভালো আছেন।
এই কথা শুনেই সাদ মিষ্টি আনতে ছুটে যায় বাইরে। জানেনা এই রাতে মিষ্টি সে পাবে কি না! কিন্তু তার এখুনি মিষ্টির ভাণ্ডার লাগবে।
এদিকে আড়াল থেকে এই খবর শুনে ছলছল করে উঠে ইনতিসারের দুচোখ! কেমন বাবা সে! তার যে জমজ বাচ্চা হবে এটাও সে জানতো না। এটা জানার অধিকারও কী সে রাখেনা!
.
চলবে
.
বিঃদ্রঃ শরীর ভালো নেই, তাই গল্প দিতে দেরী হচ্ছে।#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫৮
#Saji_Afroz

বাসায় এসে ভাংচুর শুরু করে ইনতিসার। আজ হাসপাতালে একটাবার তার সন্তানদের দেখতে যায় সে। কিন্তু কেউ তাকে সন্তানদের দেখতে অনুমতি দিলো না। বরং তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলো। ওদিকে সাদ তার বাচ্চাদের কোলে নিয়ে দিব্যি হেসে চলেছে। সাদের অধিকার কী তার চেয়েও বেশি হয়ে গেল যে সবার সাথে সাথে সাদও তাকে অপমান করলো! আচ্ছা! সাদের এত আগ্রহ কেন এসবে? সম্পত্তির জন্যে? না না! তার নিজের কম নেই। তবে? আজরা!
এটা ভেবে অস্থির হয়ে উঠে ইনতিসার। সাদ কী তবে আজরার প্রেমে পড়লো! নাহ, এটা হতে দেওয়া যায় না। আজরার ইনতিসারের কাছে ফিরে আসতেই হবে। সেটা যেভাবেই হোক।

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল আজরা। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই পাশ ফিরে দেখলো, সাদ তার একটি সন্তানকে কোলে নিয়ে হাঁটছে।
আজরা অবাক হয়ে বলল, আপনি এখানে? আপনি না বাসায় গেছেন?
-সোনা পাখিদের রেখে বাসায় মন বসছিল না। তাই চলে এলাম আবার।

আজরার সঙ্গে ছিল তার মা ও ইলারা জামান। পাশের সিটে আজিজা বানু ঘুমোচ্ছে। ইলারা জামানকে না দেখে তিনি কোথায় জানতে চাইলে সাদ বলল, আমি আসার পর বাসায় গেছেন। খালামনির শরীরটা ভালো লাগছিল না।
-সে কী! কী হলো?
-অস্থির হওয়ার কিছু নেই! ভালোভাবে রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
-হু। কিন্তু আপনি ওকে নিয়ে হাঁটছেন কেন?
-কান্না করছিল। কান্নার শব্দে যদি আপনার ঘুম ভেঙে যায়?
আজরা হেসে বলল, ভাঙলেই ভালো। আরে ওর খিদে পেয়েছে বলে কাঁদছে।
-তাই!
-জি তাই।
আজরার পাশে এসে তাকে উঠে বসতে সহায়তা করলো সাদ। এরপর কোলে তার ছেলেকে দিলো। সাদ বেরুনোর সময় কেঁদে উঠে মেয়েটিও। সাদ আবার এসে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। আজরাকে বলল, আমি সামলে নিচ্ছি।
এই বলে মেয়েকে নিয়ে বেরুলো সে।
সকালে ইলারা জামান আসলে সাদ অফিসের উদ্দেশ্যে বেরুই। যদিও আজ তার মোটেও অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু অফিসের সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো দরকার বলে বের হয় সে।
ইলারা জামানকে আজিজা বানু বললেন, মাঝরাতে উঠে দেখি সাদ বাচ্চাদের সামলাচ্ছে। বড়ো ভালো ছেলে সে।
ইলারা জামান আপনমনে বললেন, আজরার প্রতি টান আছে বলেই তার বাচ্চাদের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে সাদের মনে। এই টান আর ভালোবাসা যেন বাড়তে থাকে ক্রমাগত!

দুপুর হয়ে যায়। ইলারা জামান খাবার আনতে হাসপাতালের উপরে থাকা রেস্টুরেন্টে গেলেন। এদিকে বাচ্চারা ও আজরাকে ঘুম দেখে আজিজা বানু গেলেন ওয়াশরুমে।
এরইমধ্যে আগমন ঘটে ইনতিসারের। এমন নীরব পরিবেশ সে আশা করেনি। একবার আজরাকে ডাকতে চেয়েও ডাকেনি সে। বাচ্চাদের দু-চোখ ভরে দেখে নিলো সে। তাদের রেখে যেতে মন মানছে না তার। হঠাৎ ইনতিসারের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। যাকে কুবুদ্ধিও বলা যায়! এতে করে যদি আজরাকে তার কাছে ফিরতে আবারও রাজি করানো যায়!
আশেপাশে তাকিয়ে মেয়ে বাবুকে কোলে তুলে নেয় ইনতিসার। এরপর হনহনিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায় সে। ইনতিসার চলে যাওয়ার পরেই সেখানে আগমন ঘটে ইলারা জামানের। তার ফোন এলে খাবার গুলো টেবিলের উপরে রেখে কেবিনের বাইরে আসেন তিনি। এদিকে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আজরার। সে পাশ ফিরে দেখলো, পাশের বেডে কেবল তার একটি সন্তান রয়েছে। আশেপাশে তাকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আজরা। আজিজা বানু গোসল সেরে এসেছেন। আজরাকে দেখে বললেন, কী খুঁজছিস?
-বাচ্চা একটা কেন মা?
তিনি টেবিলের উপরে খাবার দেখে বললেন, ইলারা আপা নিয়েছেন হবে। নিশ্চয় কান্না করছিল বলে বাইরে বেরিয়েছেন তোর ঘুম নষ্ট হবে বলে।
-হোক না! কাঁদলে আমায় দেবে।
-তোরও রেস্ট এর প্রয়োজন।
আজরা একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তিনি বললেন, কী হলো?
-মা যতই বলুক তিনি ভালো আছেন। আসলে নেই।
-আমিও বুঝি।
-আমি চাচ্ছি সবকিছু ইনতিসারকে ফেরত দিতে বলব। সে অনুতপ্ত। তারও সুযোগ পাওয়া উচিত জীবনে।
-ক্ষমা করে দিবি? কী চাইছিস!
-আমি করব না। তার মা কে বলব করতে। আমি নিজে কিছু করতে চাই। আমার বাচ্চাদের দায়িত্ব আমি নেব।

ইলারা জামান এসব শুনে ভেতরে আসতে আসতে বললেন, আমার নাতী নাতনী কোনো কষ্ট পাক তা আমি চাইনা। তুমি আমার মেয়ে। সেই হিসেবে ওরা আমার আপনজন। ইনতিসার আগে আপন ছিল। যবে থেকে ওর জন্য আমার আপনজন দূরে সরেছে তবে থেকে সেও পর হয়ে গেছে। এত সহজে আমি তাকে ক্ষমা করব না। করলেও কিছু ফিরিয়ে দেব না। তুমি না চাইলে সেসব নাতী নাতনীর নামে লিখে দেব। এতটুকু অধিকার আমিও রাখি।
ইলারা জামানের কোল খালি দেখে তার সন্তান কোথায় জানতে চায় আজরা। তিনি জানেন না জানালে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই। কেবিনের কোথাও মেয়েকে না পেয়ে নার্স ও ডাক্তারকে ডাকে তারা। সাদও দ্রুত ছুটে আসে এই খবর পেয়ে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হলে ইনতিসারকে দেখতে পেল তারা। যে কিনা মেয়েকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। এই দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারায় আজরা। সাদ ইলারা জামানের উদ্দেশ্যে বলল, আজরাকে সামলান! আমি এখুনি থানায় যাচ্ছি। মনে হয় না ইনতিসার তার ফ্ল্যাটে রয়েছে।

একটা হোটেলে তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে ইনতিসার। আনার পর থেকে প্রচন্ড কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে সে। ইনতিসার তাকে রেখে বাইরে যেতে পারছে না বলে, দুধ ও ফিডারও আনতে পারছে না। কোনোমতে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে শান্ত করলো ইনতিসার।
বাচ্চাটি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলে দুধ আনতে বাইরে গেল সে। দ্রুত ফিরে এসে দেখলো, আবারও বাচ্চাটি কান্না করছে। তার ডায়াপারও বদলানো প্রয়োজন। কিন্তু ইনতিসার ডায়াপার আনেনি। সে আগে দুধ তৈরী করে বাচ্চাকে তা খাওয়ালো। বাচ্চা শান্ত হলে ডায়াপার আনতে বেরুলো। ডায়াপার খোলার পর ভেতরের অবস্থা দেখে মনে পড়লো সে টিস্যু আনেনি। কী আর করার! নিজের পকেটে থাকা শুকনো টিস্যু দিয়েই পরিষ্কার করে ডায়াপার পরিয়ে দিলো সে। এতটুকুতেই ঘাম ঝরে ইনতিসারের কপাল বেয়ে। কিন্তু শেষ এখানেই হয় না! হয় খানিক বাদে যখন বাচ্চার গায়ের রঙ হলুদবর্ণ হতে শুরু করে।
প্রথমে বিষয়টা এতটা গুরুত্ব দেয় না ইনতিসার। ভাবে এটা স্বাভাবিক কোনো বিষয়। সে ভাবতে শুরু করে অন্য বিষয়ে। আর তা হলো, কিভাবে এই বাচ্চাকে হাতিয়ার বানিয়ে আজরাকে হাসিল করা যাবে।

এদিকে মানতাশার কাছে সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে নাবীহা। কী করতে চায়ছে ইনতিসার! কেন সে আজরার মেয়েকে নিয়ে চলে গেল! তার এই কাজে আজরার অবস্থা নিশ্চয় বেহাল হয়েছে। আফসোস! এসবের জন্য নাবীহা নিজেও দায়ী। তাইতো ভুল বুঝার পরেও আজরার সামনে যাওয়ার সাহস তার মধ্যে নেই!

রাত হয়ে যায়। ইনতিসারের কোনো হদিস পায় না তারা। সকলে বাসায় চলে আসে। মেয়ের চিন্তায় ছেলের ভালো করে যত্ন নিতে পারছে না আজরা। সে ঠিক আছে তো! কী করতে চায়ছে ইনতিসার!

এদিকে ইনতিসার খেয়াল করলো মেয়ে বাচ্চাটি জোরে জোরে নি:শ্বাস ফেলছে। সাথে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। এছাড়াও শরীরের হলুদবর্ণ আরও বেড়ে গেছে। এইবার ঘাবড়ায় ইনতিসার। বাচ্চার কান্নাও যে থামছে না! সিদ্ধান্ত নেয় তাকে হাসপাতালে নেওয়ার। এই ভেবে বাচ্চাকে নিয়ে বেরুলো সে। বাচ্চা নিয়ে ড্রাইভ করতে পারবে না বলে গাড়ি ভাড়া করে নিলো। রওনা হলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তাকে নামতে হয়। এদিকে বাচ্চার কান্না হতে থাকে তীব্র। ইনতিসার বাচ্চা কোলে নিয়ে গাড়ি ঠিক করতে অস্থির হয়ে উঠে। ঠিক তখনি নাবীহার কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সে।
-আপনি?
ইনতিসার তাকে দেখে কথা না বাড়িয়ে বলল, প্লিজ ওকে একটু নাও! আমি একটা গাড়ি ঠিক করি।
নাবীহা বাচ্চা কোলে নিয়ে তাকে শান্ত করতে থাকে। বাচ্চাটি শান্তও হয়ে যায়। আজরার মেয়েকে দেখে ছলছল করে উঠে নাবীহার দুচোখ! এভাবে যে আজরার মেয়েকে দেখতে হবে কখনো ভাবেনি।
ইনতিসার গাড়ি ঠিক করে। বাচ্চাকে নিয়ে সেখানে উঠে পড়লে নাবীহাও পাশে এসে বসে পড়ে।
ইনতিসার বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
-আপনি ওকে সামলাতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে? ওকে দেখে মনে হচ্ছে জন্ডিস হয়েছে। আরও আগে নিতে পারলেন না হাসপাতাল?
গাড়ি চলতে শুরু করে। ইনতিসার মেয়ের চিন্তায় কোনো কথা বলতে পারলো না। তারা হাসপাতাল এলে ডাক্তার বাচ্চাকে দেখে জানায়, তার ঠান্ডা লেগেছে। সাথে জন্ডিসও হয়েছে। এখুনি চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
ইনতিসার অনুমতি দিলে বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
নাবীহা বলল, এটা কী করলেন আপনি! হুট করে বাইরের দুধ দেওয়ার কারণে হয়তো ঠান্ডা চলে এসেছে।
আজরাকে খবর দিন।
-না না। ওকে বলা যাবে না!
-এই সময় মা কে প্রয়োজন বাচ্চার!
-বাবা আছে। তাতেই হবে। তুমি প্লিজ কাউকে কিছু জানাবে না।
-এসব কেন করছেন আপনি?
-মেয়ে আমার কাছে থাকলে আজরাও ফিরে আসবে।
-আর মেয়ের কিছু হয়ে গেলে?
নিশ্চুপ হয়ে যায় ইনতিসার।
এরইমধ্যে ডাক্তার এসে জানালো, শিশুর মা কে আনতে। এই সময় ঘনঘন বুকের দুধের প্রয়োজন।
ইনতিসার কিছু না ভেবেই বলল, মা! মা কে তো আনা সম্ভব না।
-কেন?
-না আনলে হয়না?
-বাচ্চার অবস্থা এখনো খারাপ হয়নি। দ্রুত ঠিক করতে হলে মা কে আনুন। আর নাহয় অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
-তাই করুন!

ডাক্তার গেলে নাবীহা এসে বলল, কেন মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছেন? কতকিছু সহ্য করতে হবে এখন মেয়েটাকে!
ইনতিসার কিছু একটা ভেবে বলল, তুমি চুপ থাকো। বিনিময়ে তোমার থেকে যে টাকা পাই সেসব ক্ষমা করে দেব। সাথে যেই জমিটা তোমার নামে নিয়েছিলাম সেটাও চাইব না। আরও দুই লক্ষ টাকা দেব। টাকার প্রয়োজন না তোমার?

একথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায় নাবীহা। ইনতিসার বলল, এই সময়ে আজরা এসব জানলে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবে আর যেটা আমি চাই না। আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম। প্লিজ চুপচাপ বাসায় যাও। টাকা পেয়ে যাবে।

জীবনে সুযোগ নাকি খুব কমই আসে নিজেকে শুধরে নেওয়ার জন্য। নাবীহা একবার ভুল করেছে। আজ ইনতিসারের কথা শুনলে তার পাপ হবে৷ এই ছোট্ট শিশুটার এতবড়ো ক্ষতি সে হতে দিতে পারে না। এই ভেবে আজরার নাম্বারে অনেক দিন পর ডায়াল করলো সে। আজরাকে সব জানিয়ে দ্রুত আসতে বলল এখানে।
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here