#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_২
#নিশাত_জাহান_নিশি
“আপনাদের মেয়ে স্টোর রুমে আছে। যান, গিয়ে দেখে আসুন।”
হনহনিয়ে রুমে ঢুকে পড়ল রাফায়াত। ডানে বায়ে তাকানোর প্রয়োজনটুকুনিও বোধ করলনা। নির্দ্বিধায় ভেতর থেকে দরজার খিলটা আটকে দিলো সে। মাথায় দু’হাত রেখে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। কিয়ৎক্ষণ নীরবতায় নিজেকে ধাতস্থ করে আচমকাই সে দেঁতো হাসল! কোনো অংশে তাকে রহস্যময় চরিত্রের বহিরাংশের কেউ মনে হচ্ছেনা! তৎক্ষনাৎ সে চোয়াল উঁচিয়ে মিনিমিনিয়ে বলল,,
“তোমার সুখে থাকার দিন ফুরিয়ে আসছে অয়ন্তী! সবে তো রাফায়াতের এন্ট্রি হলো! তাও আবার হাই ভোল্টেজের এন্ট্রি! যে এন্ট্রিতে তুমি একাই কপোকাত! আরও কত কী দেখার বাকি আছে অয়ন্তী জানেমান! জাস্ট ওয়েট এণ্ড ওয়াচ মাই সুইট এণ্ড কিউট বেইব।”
পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়ল রাফায়াত। বিছানায় ধপাস করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। মনে জমানো সমস্ত কুবুদ্ধিগুলো আরও একবার রচনা করতে লাগল। খোলা মনে সর্বনাশা সব দুষ্টু চাল জড় করতে লাগল! কীভাবে অয়ন্তীকে হাতের মুঠোয় আনা যায় সেই চিন্তায় বেখবর হয়ে উঠল! যাকে হাতে মারা না যায়, তাকে ভাতে মারা যায়। তার সাথে হওয়া প্রতিটা অন্যায়ের শোধ সে হাতে না মেরে কৌশলে মারবে! যা কেউ টেরও পাবেনা।
৩.
ড্রয়িংরুমে অয়ন্তীকে সবাই চতুর্পাশ থেকে ঘিরে ধরেছে! সবার মুখে কেবল একই প্রশ্ন স্টোররুমে সে গেল কীভাবে? ঐ বদ্ধ ঘরে সে একলা একা কী করছিল? প্রত্যেকের তোপের মুখে পড়ে অয়ন্তী একের পর এক গ্লাসে চুমুক দিয়ে কেবল পানিই গিলে যাচ্ছে! একে তো সত্যি কথাটা সে সবাইকে মুখ খুলে বলতে পারছেনা! কারণ তার সোজাসুজি খোলা দরোজা দিয়ে রাফায়াতের বিধ্বংসী মুখখানি দেখা যাচ্ছে! সেই গরম চোখ, জাদরেলের মত মুখভঙ্গি! খাটের কর্ণারে একদম অয়ন্তীর মুখোমুখি বসে রাফায়াত টেনিস বল খেলছে! বলটা উপর থেকে নিচে নিক্ষেপ করছে আর তেজস্বী চক্ষু দ্বারা ইশারায় অয়ন্তীকে শাসাচ্ছে! ভয়ে পুরোপুরি গুটিয়ে পড়েছে অয়ন্তী। হেঁচকি তোলার জোগাড় প্রায়! গতকাল রাতের মত আবার না মাথা টাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায় সেই ভাবনাতেই অস্থির সে! দ্বিতীয়ত অয়ন্তীর বলা মিথ্যে কথা কেউ বিশ্বাসও করছেনা! কারণ, শুধুমাত্র ঘুম পেয়েছে বলেই এত বড়ো ঢিঙি একটা মেয়ে স্টোররুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে? এ ও কী সম্ভব? অলৌকিক ঘটনা বলে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছেনা! বর্তমানে অয়ন্তীর ঘাবড়ানো অবস্থা দেখে অয়ন্তীর মা “নাফিজা বেগম” ইশারায় সবাইকে জায়গা থেকে সরে যেতে বললেন। মেয়ের সাথে তিনি একান্তে কথা বলবেন বলে মনোস্থির করলেন। ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে শুনিয়ে অয়ন্তীর থেকে সত্যি কথাটা বের করবেন বলে ভাবলেন। নাফিজা বেগমের ইশারা বুঝে সবাই এক এক করে জায়গা থেকে সরে দাঁড়ালো। এক কোণায় সবাই গিয়ে জড় হলো। কেবল আলিজাই ঠায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। কারণ, সত্যিটা সেও জানতে চায়। সত্যিটা পুরোপুরি না জানা অবধি তার অপরাধবোধ একটুখানিও কমছেনা। দুঃশ্চিন্তায় জর্জরিত হতে হবে। গলা ঝাঁকালেন নাফিজা বেগম। অয়ন্তীর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,
“কী হয়েছে রে মা? তোর কি সত্যিই ঘুম পেয়েছিল বলে স্টোররুমে ঘুমিয়ে পড়েছিলি? এত বড়ো একটা বাড়ি রেখে?”
শুকনো ঢোঁক গিলল অয়ন্তী! মাথা উঁচিয়ে তার মায়ের দিকে তাকালো। মুখ খুলে সত্যিটা বলতে গেল অমনি রাফায়াত তার হাতে থাকা বলটি দরজায় সজোরে নিক্ষেপ করল! সঙ্গে সঙ্গেই কেঁপে উঠল অয়ন্তী। দৃষ্টি ঘুরিয়ে কম্পিত চোখে রাফায়াতের দিকে তাকালো। অমনি রাফায়াত লেলিহান চোখে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। আর এক মুহূর্তও দেরি করলনা অয়ন্তী। রাফায়াতের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। কাঠ কাঠ গলায় তার মাকে বলল,,
“সত্যিই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মা। তুমি তো জানোই গতকাল থেকে আমার শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছিলনা। উপরে খুব হৈ-হুল্লোড় হচ্ছিল। কিন্তু আমার একটা নিরিবিলি জায়গার প্রয়োজন ছিল। তাই ঘুমানোর জন্য আমি স্টোর রুমটাকেই বেছে নিয়েছিলাম।”
এই পর্যায়ে এসে অয়ন্তীকে অবিশ্বাস করার মত সাধ্য হলোনা নাফিজা বেগমের! কেমন যেন মিথ্যেটাকেও সত্যি সত্যি মনে হলো। অয়ন্তীর অসহায় মুখখানি দেখে তাই মনে হলো। অবিলম্বেই মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন তিনি। মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে বললেন,,
“কাল রাত থেকে তোর ভাইয়া তোকে ফোনে পাচ্ছিলনা। বলেছিলাম আলিজাদের বাড়িতে আছিস। তাই আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু আজ সকাল থেকেই সে অস্থির হয়ে উঠেছে। তুই তো জানিস অনিক তোর প্রতি কতটা পজেসিভ। মূলত অনিকের জন্যই তোকে আমাদের খুঁজতে বের হওয়া! না হয় তো আমরা এখনও নিশ্চিন্তেই থাকতাম তুই আলিজাদের বাড়িতে আছিস।”
“আমি ভাইয়ার সাথে পরে কথা বলে নিব আম্মু। প্লিজ এখন বাড়ি ফিরে চলো।”
অয়ন্তীর কথায় আলিজা দ্বিমত পোষণ করল। খরখরে গলায় অয়ন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
“তোর আজ কোথাও যাওয়া হচ্ছেনা অয়ন্তী। তুই আজ এই বাড়িতে আমার সাথেই থেকে যাবি। কেকটা অবধি খাসনি তুই! কতটা খারাপ লাগছে বল? আমি এত শত বুঝিনা। আজ রাতে খেয়েদেয়ে একদম বাড়ি ফিরবি।”
বাড়ির সবাই আলিজার কথায় সহমত পোষণ করল। বাড়ির সবাই বলতে এখানে আলিজার মা-বাবা, ছোটো বোন, চাচা-চাচী, বড়ো ভাই এবং ভাবী আছে। খুব সাজানো-গোছানো, সুখী, সুন্দর একটা পরিবার। সবাই নাফিজা বেগমকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সকালের নাশতা করিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আপত্তি থাকা সত্ত্বেও রয়ে গেল শুধু অয়ন্তী। বুকে ধুকপুকানি নিয়ে অয়ন্তী দৌঁড়ে এসে প্রথমে আলিজার রুমে ঢুকল। বিছানায় আলিজার মুখোমুখি বসে কড়া গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“ঐ ছেলেটা কে রে?”
আলিজা চোখ ঘুরালো। ভ্রু যুগল উঁচিয়ে বলল,,
“কোন ছেলেটা?”
“ঐ যে নতুন ছেলেটা। টেনিস বল নিয়ে খেলছিল।”
“ওহ্ আচ্ছা তুই রাফায়াত ভাইয়ার কথা বলছিস?”
“হ্যাঁ ঐ রাফায়াত। কী হয় তোদের?”
“আমার খালাতো বোনের দেবর হয়। এক সপ্তাহ হলো আমাদের বাড়িতে এসেছে।”
“কিন্তু কেন এসেছে? তাও আবার এত দূরের আত্নীয়! তাছাড়া আমি আমার বাপের জন্মে দেখিনি ছেলেরা এতদিন এক জায়গায় বেড়াতে।”
“আর বলিসনা। সে অনেক কথা। সাইকোটা এখানে বেড়াতে এসেছে নাকি? এসেছে তো গাঁ ঢাকা দিতে!”
“মানে?”
আলিজা বিছানায় খুব আরাম করে বসে যেই না কাহিনী টান দিতে যাবে অমনি ড্রয়িংরুম থেকে আলিজার বড়ো ভাইয়ের ডাক এলো। অফিসের কিছু প্রয়োজনীয় ফাইল আফনান আলিজার কাছে রেখেছিল। সেগুলো এক্ষণি খুঁজে দিতে। তাড়াহুড়ো করে আলিজা বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। অধীর গলায় অয়ন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
“তুই একটু বস। আমি ভাইয়াকে ফাইলগুলো বুঝিয়ে দিয়ে আসছি।”
অয়ন্তী মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। আলিজা দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম পরিত্যাগ করল। স্বস্তির শ্বাস ফেলে অয়ন্তী যেইনা গাঁ থেকে ওড়নাটা খুলে বিছানায় গাঁ এলাতে গেল অমনি রাফায়াতের আগমন ঘটল রুমে! হনহনিয়ে রুমে প্রবেশ করে রাফায়াত ভেতর থেকে দরজাটা আটকে দিলো! ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অয়ন্তী হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোটর থেকে তার চোখ দুটো বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কী মহা জ্বালা। এই আপদ আবার এই রুমে কী করছে? হাত-পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেল অয়ন্তীর। পিছু ঘুরে রাফায়াত ঝড়ের বেগে এসে অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। নাক টেনে রক্তিম চোখে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,,
“তুমি এখন আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে হেল্প করবে ওকে?”
গতকাল টিউব লাইটের টিমটিমে আলোতে রাফায়াতের মুখটা অয়ন্তী স্পষ্টভাবে না দেখলেও জানালার গ্রীল ভেদ করে আসা রঙিন রোদের আলোতে রাফায়াতের অতি রঞ্জিত মুখখানি তার দু’চোখে স্পষ্ট। কী স্নিগ্ধ সুন্দর মুখখানি তার। অতিরিক্ত সুন্দর বলেই হয়তো রাগ করলে মুখটা একদম টুকটুকে লাল হয়ে যায়! এত মায়া মুখখানিতে যে অপলক তাকিয়ে থাকতেই মন চায়! রাফায়াতের বলা কথার দিকে কোনো ধ্যান নেই তার। সমস্ত ধ্যান শুধু রাফায়াতের পুলকিত মুখখানি জুড়ে! রাগী ভাব মিইয়ে তার ঠোঁটের কোণে হাসি যেন ফুটি ফুটি করছে। অয়ন্তীর এহেন নির্লিপ্ত মোহভরা চাহনি দেখে রাফায়াতের মুখে কঠেরতার ছাপ দেখা গেলেও মনে মনে সে পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়ছে! আপন মনে অভিসন্ধি কষিয়ে বলছে,,
“মিস অয়ন্তী। আমি জানি আপনি আমার উপর ফিদা হয়ে উঠছেন! আর আমি এটাই চাই বিশ্বাস করুন! আপনি আমাকে মনপ্রাণ দিয়ে বসুন। আপনার সবটুকু উজাড় করে আমাকে ভালোবাসুন! তখনই তো খেলাটা জমবে ভালো! রাফায়াত নিজেকে গাঁ ঢাকা দিতে নয় বরং খেলাটা যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকেই শুরু করতে এসেছে!”
জায়গা থেকে নড়েচড়ে দাঁড়ালো রাফায়াত। অয়ন্তীর আরও একটু সন্নিকটে দাঁড়িয়ে তুড়ি মেরে অয়ন্তীর ধ্যান ভাঙার চেষ্টা করল। ব্যগ্র চাহনিতে রুক্ষ গলায় বলল,,
“হ্যালো, এক্সকিউজ মি। শুনতে পারছেন আমার কথা? বুকে ওড়না কই হ্যাঁ? সেম্পলগুলো আমাকে দেখানোর জন্যই কি ওড়না পড়েননি?”
ভড়কে উঠল অয়ন্তী। রাফায়াতের দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দৃষ্টি নিচে নামিয়ে বুকের দিকে তাকিয়ে দেখল বুকে সত্যিই ওড়না নেই! জিভ কেটে অয়ন্তী লজ্জায় পিছু ঘুরে নিলো। মাথায় গাড্ডা মেরে চোখ বুজে বিড়বিড় করে বলল,,
“ছিঃ। এ আমি কী করলাম? ওড়না ছাড়াই ঐ বেশরম ছেলেটার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিলাম? হাউ শেইমলেস মি।”
খাটের উপর থেকে ওড়নাটা হাতে তুলে নিলো অয়ন্তী। তাড়াহুড়ো করে বুকে জড়িয়ে নিলো ওড়নাটি। পিছু ঘুরে বেশ উড়নচণ্ডী ভাব নিলো। নাকটা খাঁড়া করে রাফায়াতকে শাসিয়ে বলল,,
“কী বললেন আপনি হ্যাঁ? আমি সেম্পল দেখিয়ে রেখেছি?”
“তা নয়তো কী? পরপুরুষের সামনে এভাবে কেউ উ’লু’ঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়?”
“উ’লু’ঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছি মানে? আপনার মত ব’দ’লোক আমি আর দুটো দেখিনি। তাকাচ্ছিলেন কেন আমার দিকে হ্যাঁ? বেশরম চোখদুটো নিচে নামিয়ে রাখতে পারেননি?”
বাঁকা হাসল রাফায়াত। অয়ন্তীর বুকের দিকে তাকিয়ে নির্লজ্জ গলায় বলল,,
“উফফ! চোখের সামনে এমন লোভনীয় জিনিস দেখলে চোখ নামিয়ে রাখা যায় নাকি? বাই দ্যা ওয়ে, আমাকে হেল্প করবে কীনা বলো?”
“না পারবনা। কী পেয়েছেন কী আপনি আমাকে হ্যাঁ? দেখা হওয়ার পর থেকেই আমাকে যেভাবে পারছেন সেভাবেই ইউজ করছেন। কতদিনকার চেনা আমি আপনার হুম?”
“কথা প্যাঁচানো আমার পছন্দ নয় ওকে? বলো আমাকে হেল্প করবে কিনা? এই বাড়ি থেকে বের হতে চাই আমি। মুক্তভাবে শ্বাস নিতে চাই। যেভাবেই হোক তুমি আমাকে এখন এই বাড়ি থেকে বের হতে হেল্প করবে। তোমার শহরটা আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে। না হয় কাল রাতে যে কাজটা অসম্পূর্ণ রেখেছিলাম সে কাজটা এখন করব!”
#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৩
#নিশাত_জাহান_নিশি
“কথা প্যাঁচানো আমার পছন্দ নয় ওকে? বলো আমাকে হেল্প করবে কিনা? এই বাড়ি থেকে বের হতে চাই আমি। মুক্তভাবে শ্বাস নিতে চাই। যেভাবেই হোক তুমি আমাকে এখন এই বাড়ি থেকে বের হতে হেল্প করবে। তোমার শহরটা আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে। না হয় কাল রাতে যে কাজটা অসম্পূর্ণ রেখেছিলাম সে কাজটা এখন করব!”
বিস্ময়ের চরম শীর্ষে পৌঁছে গেল অয়ন্তী। ম’গের মু’ল্লুক পেয়েছে নাকি এই ছেলে তাকে? যেভাবে খুশি সেভাবেই তাকে হুমকি-ধামকি দিয়ে যা নয় তা করানো যাবে? এতটাই স’স্তা নাকি সব? অয়ন্তীর মুখমণ্ডলে প্রখর রুক্ষতার ছাপ ফুটে উঠল। বদমেজাজী ভাব আকাশ ছুঁতে লাগল। নাক ফুলিয়ে চোঁয়াল উঁচিয়ে বলল,,
“শুনুন মিস্টার রাফায়াত। অনেক হয়েছে আপনার এসব ফা’ল’তু ম’স্তা’ন’গিরি। আমার সাথে এসব থার্ডক্লাস, মিনিংলেস কার্যকলাপ করতে আসবেন না। এসব ফা’ল’তু থ্রে’ড দেওয়া তো দূরে থাক! কাল সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছিলাম কারণ, কাল আমার পাশে কেউ ছিলনা। কিন্তু আজ সবাই আমার পাশে আছে। যদি আস্তে করেও একটা আহ্ করে চিৎকার দিইনা? তবে কিন্তু বাড়ি শুদ্ধু লোক ছুটে আসবে এই ঘরে। হাতে নাতে ধরবে আপনাকে। গতকালের প্রসঙ্গটাও কিন্তু আস্তেধীরে ওঠে আসবে তখন। কী করবেন তখন আপনি হুম? কী করবেন?”
ফিক করে হেসে দিলো রাফায়াত! হাসতে হাসতে পেটে তার হাত চলে গেল। হাতের কাটা অংশটিও তক্ষণি কোনোভাবে অয়ন্তীর হিংস্র নজরে পড়ে গেল। মানবতার খাতিরে হলেও অয়ন্তীর মনে অবিলম্বেই কিঞ্চিৎ মায়াবোধের জন্ম নিলো! ভারী আজব লোক তো। কালরাতে হাতটা কেটেছে অথচ এখনো অবধি কোনো মেডিসিন লাগায়নি? এত পাষাণ, নিষ্ঠুর, বর্বর প্রকৃতির কেন এই লোকটি? ক্ষত জায়গায় আঘাত লাগেনা তার? নিজের প্রতি কি কোনো যত্ন নেই তার? এই লোকটা আদো রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ তো নাকি? এই দিকে রাফায়াত হাসতে হাসতে দলা মোচড়া হয়ে গেল! ঠাট্টার স্বরে বলল,,
“গবেট একটা! কালরাতে তোমার সাথে কী ঘটেছে না ঘটেছে এসবের কী কোনো প্রুফ আছে তোমার কাছে? নেই তো! তাহলে? তাহলে কীসের এত গ’লা’বা’জি হ্যাঁ? আর এখন তো আমি তোমাকে কিছু করবনা! যদি ঠাণ্ডা মাথায় তুমি আমার শর্ত না মানো তবে পরে এর ফল ভোগ করতে হবে! কঠিনভাবে ভোগ করতে হবে। ঠিক কতটা কঠিনভাবে ভোগ করতে হবে তা তুমি কল্পনাও করতে পারছনা মিস অয়ন্তীকা।”
“আবারও হুমকি দিচ্ছেন আমাকে হ্যাঁ? চিনেন আপনি আমার কাজিন ভাইয়াকে? অনিক ভাইকে চিনেন আপনি? যদি আমি একবার ভাইয়ার কাছে মুখ খুলে সবটা বলিনা? তখন কিন্তু আপনার মাথা আর মাথার জায়গায় থাকবেনা! ব’লি হয়ে যাবেন আপনি, ব’লি।”
“হাউ ফানি ইয়ার! এখন কি তুমি তোমার কাজিন ভাইয়ার ভয় দেখাচ্ছ আমাকে? রাফায়াত কাউকে ভয় পায়না ওকে? উল্টো রাফায়াতকে মানুষ ভয় পায়। এতটাই ভয় পায় যে, রাফায়াতের ভয়ে মানুষের প্যান্ট ভি’জে যায়! ডেমো দেখেও এখনো চিনতে পারলেনা এই রাফায়াতকে, না? বাই দ্যা ওয়ে, তোমার ভাইয়াকে যা বলার বলে দিও ওকে? দেখব সে আমার ব’লি কীভাবে করে!”
প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে রাফায়াত হনহনিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলো! গতকাল রাতের সেই রগচটা ভাবটা আবারও তার মুখমণ্ডলে চড়া হয়ে উঠল। হিংস্র সাপের ন্যায় ফোঁস করে শ্বাস ছাড়তে লাগল। যাওয়ার সময় দরোজায় সজোরে এক লাথ মেরে গেল! সঙ্গে সঙ্গেই অয়ন্তী কেঁপে উঠল। রাফায়াতের যাওয়ার পথে তাজ্জব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমন উচ্ছৃঙ্খল কেন এই লোকটা হ্যাঁ? তবে কি লোকটা আসলেই গু’ন্ডা, মা’স্তা’ন, সন্ত্রাসী টাইপ কিছু? হাবভাব এবং কথাবার্তার ধরণ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে! অস্থিরতা কাজ করতে লাগল অয়ন্তীর মধ্যে। রাফায়াতের আসল পরিচয়টা জানার জন্য তার মনটা উসখুস করতে লাগল। এবার শুধু আলিজার ফেরার পালা। প্রথম থেকে শেষ অবধি সে আলিজার মুখ থেকে সব শুনবে। সেই অবধি সময় কাটানোর জন্য ঘরময় একটু পায়চারী করা যাক। লোকটা সম্পর্কে আরও একটু ভাবনা-চিন্তা করা যাক। মিনিট পাঁচেক বাদে আলিজা ধীর পায়ে হেঁটে রুমে প্রবেশ করল। অয়ন্তীকে পিছু ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখে আলিজা শুষ্ক গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী রে? তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
তাৎক্ষণিক পিছু ঘুরে তাকালো অয়ন্তী। আলিজাকে দেখামাত্রই উৎসুক হয়ে পা বাড়িয়ে আলিজার মুখোমুখি দাঁড়ালো। অধীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“আচ্ছা বল না ঐ ছেলেটার আসল পরিচয় কী? কেনই বা ঐ ছেলেটা এই বাড়িতে গাঁ ঢাকা দিতে এসেছে বল?”
“আরে আরে! তুই এত অস্থির হচ্ছিস কেন ইয়ার? কিছু হয়েছে কী?”
“আগে বল তো! পেের বলছি কী হয়েছে।”
ব্যস্ত হয়ে উঠল আলিজা। দ্রুত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“এই? রাফায়াত ভাই কি তোর সাথে উল্টো-সিধা কিছু করেছে?”
“বললাম তো পরে বলছি। আগে বল ছেলেটার আসল পরিচয় কী?”
অয়ন্তীকে ডিঙিয়ে আলিজা খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসল। অয়ন্তী পিছু ঘুরে দাঁড়াতেই আলিজা তার পাশের জায়গাটায় হাত রেখে অয়ন্তীকে ডেকে বলল,,
“বস। বলছি।”
দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে অয়ন্তী আলিজার পাশ ঘেঁষে বসল। আগ্রহ নিয়ে আলিজার মুখের পানে তাকিয়ে রইল। অয়ন্তীর দিকে একটুখানি ঘুরে বসল আলিজা। রুদ্ধশ্বাস ফেলে বলল,,
“রাফায়াত ভাই কোনো সাধারণ মানুষ নন। ঘো’র’তো’র রা’জ’নী’তি’বিদ। ক্লাস টেন থেকেই রা’জ’নী’তি’র প্রতি তীব্র ঝোঁক ছিল উনার। এরপর এসএসসির পর থেকেই রা’জ’নী’তি’র সাথে পুরোপুরিভাবে জড়িয়ে পড়েন! কলেজ রাজনীতি থেকে শুরু করে এখন আবার ভার্সিটিতে রাজনীতি করছেন। ছাত্রলীগের নেতা টাইপ কিছু হবে হয়ত। এলাকায়ও রাজনীতিবিদ হিসেবে বেশ নামডাক উনার। পুরো মহল্লার মানুষ উনার ভয়ে কাবু হয়ে থাকে। উনি ভালোর সময় ভালো, তো খারাপের সময় য’ম। রোজ এসব মা’রা’মা’রি, হা’নাহা’নি, দা’ঙা’দা’ঙি লেগেই থাকে! জানিস? একবার তো রাফায়াত ভাইয়ার বিরোধী দলের একনেতা রাফায়াত ভাইয়ার বুকেপিঠে অবধি ছু’রি বসিয়ে দিয়েছিল! হায়াৎ ছিল বিধায় বেচারা বেঁচে ফিরেছিল। আন্টিকেও একবার কি’ড’ন্যা’প করে নিয়েছিল উনার শত্রুরা! আঙ্কেলকে তো এখনও রোজ হুমকি-ধামকি শুনতে হয়। আমার খালাতো বোন অর্থাৎ রাফায়াত ভাইয়ার ভাবিকেও রে’প করার চেষ্টা করেছিল ঐ জা’নো’য়া’রগুলো। এতকিছুর পরেও রাফায়াত ভাই রাজনীতি ছাড়তে পারছিলেন না। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া যেনো এখন নিত্যদিনকার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও উনি রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারবেন না! সবার মুখে মুখে উনি শুধু এই জবাবটাই দিতেন। কিন্তু এইবার নাকি খুব বড়ো রকমের কিছু একটা হয়ে গেছে! তবে কী হয়েছে তা জানিনা। কারণ, আঙ্কেল আমাদের কিছু জানায়নি। সপ্তাহ খানিক আগে আঙ্কেল হঠাৎ রাতের অন্ধকারে এসে রাফায়াত ভাইকে আমাদের বাড়িতে রেখে যান। আর বলে যান উনাকে যতটা সম্ভব রুম বন্দি করে রাখতে। ভুলেও যেন বাড়ির বাইরে বের হতে না পারে।”
সমস্ত ঘটনা শোনার পর অয়ন্তী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। শুকনো ঢোঁক গিলে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,
“হায় আল্লাহ! আমি কিনা ঐ গু’ন্ডা’টার সাথে পাঙা নিতে গিয়েছিলাম? না জানি কত বড়ো ক্রি’মি’না’ল এই লোক। কী কী ক্রাইম করে এসেছে এখানে কী জানি! যত দ্রুত সম্ভব আমার এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিৎ। নয়তো কখন ঐ মা’স্তা’ন’টা’র শিকার হয়ে যাই বলা যায়না!”
৪.
রুমের দরজা বন্ধ করে রাফায়াত অত্যধিক রাগ এবং জেদে অনবরত ফুঁসতে লাগল! গাঁ থেকে টি-শার্টটা খুলে বিছানার উপর ছুঁড়ে মারল। শরীর থেকে অঝরে ঘাম বইতে লাগল তার। ক্রমশ তার মেজাজ নিয়ন্ত্রাধীণ হয়ে উঠছে। উদোম শরীরে রাফায়াত ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বুকের ডান পাশে ব্যান্ডেজ করে রাখা কাটা অংশটিতে তাকালো! ব্যান্ডেজটিতে হাত বুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আর্ত আওয়াজে বলল,,
“ব্যথাটা আমার শরীরে নয় অনিক। ডিরেক্ট আমার বুকে এসে লেগেছে! তোর থেকে এই বি’শ্বা’স’ঘাত’ক’তা আমি আশা করিনি অনিক! নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটা ছিলি তুই। এতটাই কাছের ছিলি যে তোর সাথে একটা দিন দেখা না হলে দিনটাই আমার খারাপ যেত! কিন্তু ভাবতে পারিনি জানিস? তুই এভাবে পেছন থেকে আমাকে এত বড়ো আঘাতটা করবি! সরি টু সে অনিক, যারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের আমি ছাড় দিতে জানিনা! বিলিভ মি, তোর বেলাতেও এর ব্যতিক্রম হবেনা!”
জায়গা থেকে সরে দাঁড়ালো রাফায়াত। খাটের উপর থেকে তার সেলফোনটা হাতে তুলে নিলো। তাড়াহুড়ো করে কললিস্ট থেকে কারো নাম্বারে ডায়াল করল। প্রথমবার রিং বাজতেই ঐ পাশ থেকে কেউ ফোনটি রিসিভ করল। পুরুষালী গলায় বলল,,
“হ্যালো রাফায়াত?”
“হ্যাঁ শোন? কাল যে কাজটা করতে বলেছিলাম করেছিলি তো?”
“হ্যাঁ করেছি।”
“ফটোগুলো ঠিকঠাক ভাবে তুলেছিস তো?”
“হ্যাঁ তুলেছি। তুই যেভাবে বলেছিস ঠিক সেভাবেই তুলেছি।”
“ওকে। পিকচার গুলো কুইকলি আমার হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড কর।”
“করছি। আগে বল তুই কেমন আছিস?”
“তোদের থেকে দূরে আছি। এবার ভেবে দেখ কেমন আছি!”
“আমরাও তোকে ছাড়া ভালো নেই রাফায়াত। সত্যিই ভালো নেই। এমন একটা পরিস্থিতি যে আমরাও তোর সাথে দেখা করতেও যেতে পারছিনা।”
“সময় হলে আমি-ই তোদের সাথে দেখা করতে যাব। এখন বল ইয়াদের কী অবস্থা?”
“অবস্থা তেমন একটা ভালো নয়! এজন্যই বেশী ভয়ে আছি। কখন কী থেকে কী হয়ে যায়!”
“শা’লা ম’রু’ক! তাকে মে’রে প্রয়োজনে আমি জেলে যাব। তুই কুইকলি পিকচার গুলো সেন্ড কর আমার হোয়াটসঅ্যাপে। ঐ অয়ন্তীকে সামলে রাখা যাচ্ছেনা! থ্রে’ড দেওয়া ছাড়া হাতে আর কোনো অপশন নেই!”
“আচ্ছা শোন না?”
“বল?”
“প্রিয়া এসেছিল!”
“কু’ত্তা’র বা’চ্চা! কলটা কাট!”
শরীরে হিট এসে গেল রাফায়াতের! চক্ষুজোড়া জল এবং তুখোড় হিংস্রতা নিয়ে রাফায়াত কলটা কেটে দিলো! ফোনটা খাটের উপর ছুড়ে মেরে হাঁটু ভাজ করে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। মাথায় হাত রেখে মৃদু চিৎকার করে বলল,,
“কেন আমাকে ঠকালে প্রিয়া? বল কেন?”
৫.
অন্তর্আত্তা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে অয়ন্তীর! এই বাড়ি ছেড়ে কখন পালাবে সেই চিন্তায় অধীর হয়ে উঠছিল সে। রাফায়াতকে ঘিরে তার মনে অসম্ভব ভয়-ভীতি জন্ম নিতে লাগল। অয়ন্তীর এহেন উদ্ভ্রান্ত অবস্থা দেখে আলিজা ভ্রু যুগল খরতরভাবে কুঁচকালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী রে? কী হয়েছে তোর? এমন উসখুস করছিস কেন?”
হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো অয়ন্তী। ভীতিকর দৃষ্টি ফেলল আলিজার দিকে। ইতস্তত গলায় আলিজাকে বলল,,
“কিছুনা। আচ্ছা আলিজা শোন না? আজ আমি বরং আসছি কেমন? শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছেনা আমার। তাছাড়া অনিক ভাইয়া ওভার ডিসপারেড হয়ে আছে আমার জন্য। কখন বাড়ি ফিরে আসে বলা যায়না। আর বাড়ি ফিরে এসে যদি আমাকে না দেখে তো ভাঙচুর শুরু করবে! তুই তো জানিস অনিক ভাইয়া কেমন?”
“অনিক ভাইয়া তো এখন চট্টগ্রাম আছে তাইনা? তো এখন তোর কীসের ভয়?”
“ভয় আছে। তুই বুঝবিনা। প্লিজ আমাকে বাড়ি যেতে দে।”
আলিজার বারণ সত্ত্বেও বাড়ির সবাইকে এক এক করে বুঝিয়ে শুনিয়ে অয়ন্তী যেইনা বাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ির মেইন গেইটের দিকে পা বাড়ালো অমনি গেইটের সাথে বেশ আয়েশ করে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাফায়াতকে দেখতে পেল সে! নীল রঙের শার্টের কলারটা ঝেড়ে রাফায়াত ব্যগ্র চাহনিতে ঘাবড়ে থাকা অয়ন্তীর দিকে তাকালো। ঠোঁটের আলিজে ফুটে রইল তার কদাচিৎ হাসি। হাতে থাকা সেলফোনটি হেলিয়ে দুলিয়ে রাফায়াত হেয় স্বরে বলল,,
“বয়ফ্রেন্ড থাকা সত্ত্বেও অপরিচিত একটা ছেলের সাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়াটা ইট’স নট ফেয়ার মিস অয়ন্তী! আপনার বয়ফ্রেন্ড যদি ব্যাপারটা জানতে পারে তখন কী হবে বলুন তো?”
#চলবে…?
#চলবে…?