#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_১০
#নিশাত_জাহান_নিশি
“এই ব্যথাটা তো রাদিফের দেওয়া কষ্টের চেয়ে বেশী কিছুনা তাইনা?”
আচম্বিতেই অয়ন্তীর হতবিহ্বল দৃষ্টি পড়ল রাফায়াতের রহস্যময় দৃষ্টিতে। ক্রমশ সেই অবাক করা চাহনি অয়ন্তীর কৌতূহল, উদ্দীপনা এবং জিজ্ঞাসায় পরিণত হলো। মুখের জবান অতি দ্রুত চলতে লাগল তার। জড়তা ভুলে গড়গড় করে বলল,,
“কী বললেন আপনি? রাদিফ? রাদিফ ভাইকে আপনি চিনেন?”
মাথা নুইয়ে নিলো রাদিফ! অয়ন্তীর কাঁটা ছেঁড়া জায়গাটিতে তুখোড় মনোযোগ দিলো। টপটপ করে এখনো র’ক্ত ঝড়ছে কাঁটা অংশটি থেকে। বন্ধ হওয়ার নামই নিচ্ছেনা। অধীর হয়ে উঠল রাফায়াত। কীভাবে র’ক্ত পড়া বন্ধ করবে সেই চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। মেয়ে মানুষ এত ব্যথা সহ্য করতে পারে নাকি? দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে হয়ত ভেতরটা। অয়ন্তী এখনো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে রাফায়াতের দিকে। উত্তরের অপেক্ষা তাকে এতোটাই বিভোর করে রেখেছে যে তাকে ঘিরে রাফায়াতের এত শত অস্থিরতা তার চোখে পড়ছেনা! উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে রাফায়াত আরিফকে তার কাছে ডাকল। ভদ্রভাবে হেঁটে আরিফ রাফায়াতের মুখোমুখি দাঁড়ালো। মাথার চুল টেনে রাফায়াত আরিফকে বলল,,
“এক্ষুণি একটা স্যাভলন আর একটা ব্যান্ডেজ এনে দে।”
কোঁমড়ে হাত গুজল আরিফ। কপাল কুঁচকে হঠকারি গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“মাথা টাথা কি খারাপ হয়ে গেছে আপনার ভাই? এত রাতে আমি স্যাভলন আর ব্যান্ডেজ কোথায় পাব?”
“কেন? তুই না বলেছিলি এলাকায় তোর অনেক পাওয়ার? সেই পাওয়ার খাঁটিয়ে এনে দে!”
“ভাই সবাই এখন ঘুমে। ঘুমন্ত মানুষদের উপর আমি কেমনে পাওয়ার খাঁটাই বলেন? বিবেক বুদ্ধি তো আছে আমার নাকি?”
“পারবি না সেটা বল। শুধু মুখে মুখেই বড়ো কথা! আমার এলাকা হলে এখন দেখতিস। চুটকির মধ্যে কীভাবে স্যাভলন আর ব্যান্ডেজের ব্যবস্থা করে নিতাম! পাওয়ার খাটানোর জন্য এলেম লাগে বস এলেম। সেই এলেম তোর মধ্যে নেই। কথায় আছে না? “যত গর্জে তত বর্ষে না!”
শরীরে হিট ওঠে গেল আরিফের! দাঁতে দাঁত সংঘর্ষ হলো তার। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে সে একরোঁখা গলায় বলল,,
“আপনি আমার এলেমে প্রশ্ন তুলছেন ভাই! এখন আমি কী করি দেখুন! আমিও দেখিয়ে দিব ভাই, এলাকা আমার। পাওয়ার আর এলেম দুইটাই আমার আছে।”
হনহনিয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো আরিফ। অতিরিক্ত জেদ চেপে বসল তার মাথায়। চাপা হাসল রাফায়াত! আপন মনে বিড়বিড় করে বলল,,
“এই জেদটাই আমি তোর মধ্যে দেখতে চেয়েছিলাম আরিফ!”
ইতোমধ্যেই অয়ন্তী ঝট করে রাফায়াতের হাত থেকে তার পা টা সরিয়ে নিলো। হালকা করে পা টা নিচে নামিয়ে সে পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। ব্যথায় ঈষৎ কুঁকিয়ে ওঠে সে থম মেরে বসে থাকা রাফায়াতের দিকে তাকালো। গরম চোখে শুধালো,,
“বলুন আপনি কে? রাদিফ ভাইকে আপনি চিনেন কীভাবে?”
বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো রাফায়াত। অয়ন্তীর প্রশ্নবিদ্ধ চোখে নিশ্চল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে সে এদিক-ওদিক তাকালো। প্রসঙ্গ ঘুরানোর পায়তারা খুঁজছে সে! এটাই সঠিক সময় নয় অয়ন্তীর সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার! রাফায়াত চাইছে অয়ন্তী নিজেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করুক। চাইলেই হয়ত সব সম্ভব। অয়ন্তীর কাছে সে খোলা বইয়ের মত। যা চাইলেই পড়া যায়। পুনরায় রাফায়াত অয়ন্তীর দিকে তাকালো। নরম স্বরে বলল,,
“আলিজার মুখ থেকে শুনেছিলাম রাদিফের কথা।”
“মিথ্যে বলছেন আপনি। রাদিফ ভাইয়ার সাথে যখন আমার পরিচয় হয় তখন আমি আলিজাকে চিনতামও না। আমাদের তখন দেখাও হয়নি, পরিচয়ও হয়নি। তাছাড়া আমি কখনো আলিজাকে রাদিফ ভাইয়ার কথা বলিনি! বলার প্রয়োজনও মনে করিনি।”
থতমত খেয়ে গেল রাফায়াত। অতিসত্তর অয়ন্তীর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। থমথমে গলায় বলল,,
“আলিজা হয়ত কোনোভাবে রাদিফের কথা শুনেছিল। সেই শোনা কথা থেকেই আমাকে বলেছিল। বাই দ্যা ওয়ে। এসব প্রসঙ্গ বাদ দাও এখন। তোমার পা টা কীভাবে ঠিক করা যায় সেই চিন্তা করো।”
নির্ভেজাল দৃষ্টিতে অয়ন্তী রাফায়াতের নুইয়ে রাখা আতঙ্কিত মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইল। কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে এই মুখের আড়ালে? কেন এই মুখখানি তাকে এত মোহমায়ায় জড়িয়ে রাখছে? কেন এই স্নিগ্ধ মুখখানির দিকে তাকালে তার হারানো অতীত মনে পড়ে যায়? কেন সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটির কথা মনে পড়ে যায়? আড়চোখে রাফায়াত অয়ন্তীর দিকে তাকালো। আচম্বিতেই এক গাল হেসে বলল,,
“আমি কিন্তু রাদিফ না ওকে? সো এভাবে আমার দিকে তাকানোর কোনো মানে হয়না! তাছাড়া এই মাঝরাতে সুন্দুরী মেয়েরা এভাবে আবেদনময়ী দৃষ্টিতে তাকালে ছেলে মানুষদের কিন্তু মাথা ঠিক থাকেনা!”
অবিলম্বেই চক্ষুজোড়া সংযত করে নিলো অয়ন্তী। মাথা নুইয়ে মন খারাপের রেখা টানল। আক্ষেপের স্বরে বলল,,
“ইশশ! যদি একটা ম্যাজিক হয়ে যেত। এই রাফায়াতই যদি রাদিফ ভাই হতো! কিন্তু তা তো এই জন্মে সম্ভব নয়। তাদের চেহারার মাঝে তো অনেক পার্থক্য!”
চাপা শ্বাস ছাড়ল রাফায়াত। অয়ন্তীর নুইয়ে রাখা মুখশ্রীতে বেদনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মনে মনে অভিসন্ধি কষিয়ে বলল,,
“যদি! যদি তুমি আমাকে চিনতে পারতে অয়ন্তী! মুখের গঠন বদলে গেলেই কি মানুষটা বদলে যায়? তার আচার-আচরণ, কথাবার্তার ধরণ, তার ভেতর বাহির, অনুভূতি সব বদলে যায়?”
ইতোমধ্যেই আরিফের আগমন ঘটল দুজনের মধ্যে। ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি। হাতে স্যাভলন আর ব্যান্ডেজ! রাফায়াতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বেশ এলেম দেখিয়ে বলল,,
“কী ভাই? বলেছিলাম না আমার এলেম নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না? দেখেছেন তো? আমার এলেম কতটা? এসব ছোটো খাটো কাজ তো আমার বাঁ হাতের খেলা!”
আরিফের কথায় পাত্তা দিলো না রাফায়াত। ছোঁ মেরে আরিফের হাত থেকে স্যাভলন আর ব্যান্ডেজটা কেড়ে নিলো। অয়ন্তীর ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও রাফায়াত জোরপূর্বক অয়ন্তীর কাঁটা পায়ে স্যাভলন লাগিয়ে দিলো। ব্যান্ডেজটা পায়ে ভালো করে পেঁচিয়ে অয়ন্তীর ব্যথায় কুঁকানো মুখশ্রীতে তাকালো। শান্ত স্বরে শুধালো,,
“আর ইউ ফাইন অয়ন্তী? ব্যথা লাগছে এখনো?”
“কেন ডেকেছেন সেটা বলুন? রাতে-বিরাতে আমাকে ডিস্টার্ব করতে এসেছেন?”
কথা বাড়াতে চাইলনা রাফায়াত। প্রসঙ্গ পাল্টাতে অস্থির হয়ে উঠল। দ্বিধায় জড়াতে লাগল। মাথা চুলকে বলল,,
“আচ্ছা তুমি বাসায় যাও। কাল দেখা হচ্ছে।”
প্রতিউত্তরে অয়ন্তীকে কথা বলার সুযোগ দিলোনা রাফায়াত। আরিফের কাঁধে হাত রেখে হাঁটা ধরল রাস্তার পাড় ঘেঁষে। রাগে গাঁ রি রি করে উঠল অয়ন্তীর! পেছন থেকে রাফায়াতকে ডেকে মৃদু চিৎকার করে বলল,,
“ই’ডি’য়’ট রাফায়াতের বাচ্চা! আমাকে আ’হ’ত করে, রাতে-বিরাতে আমাকে রাস্তায় ডেকে এনে এখন কোনো কারণ না বলেই ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে যাওয়া হচ্ছে? ওকে ফাইন মিঃ ব’দের হাড্ডি! আপনাকে আমি দেখে নিব। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি ওকে?”
রাগে গিজগিজিয়ে অয়ন্তী খোঁড়া পা নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। মাথা ঘুরিয়ে রাফায়াত এবার পিছু ফিরে তাকালো। অয়ন্তীর যাওয়ার পথে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মুখশ্রীতে বিরহের ছাপ তার। ইশশ! আর একটুখানি যদি অয়ন্তী থেকে যেত! আরিফও মাথা ঘুরিয়ে রাফায়াতের দিকে তাকালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“হলোটা কী ভাই? আসলেন আবার চলে যাচ্ছেন। ভালো করে বাত চিতও হলোনা! তাহলে আসলেনটা কেন শুনি?”
আরিফের মাথায় গাড্ডা মারল রাফায়াত। কেমন যেন বিদঘুটে হাসল। অধীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,
“তুই বুঝবিনা রে চাঁদ! যেদিন আলিজাকে মন থেকে ভালোবাসতে পারবি সেদিন বুঝতে পারবি!”
নিশ্চুপ হয়ে গেল আরিফ। মাথা চুলকে বলল,,
“তাহলে কি সত্যিই আমার আলিজাকে ভালোবাসা উচিৎ?”
,
,
জুসের স্ট্রু মুখে নিয়ে ক্যান্টিনে বসে আছে অয়ন্তী! তার পাশেই স্যান্ডুইচে কামড় বসালো আলিজা। জুসটা অয়ন্তী খাচ্ছে কম তবে নাড়াচাড়া করছে বেশী। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। নিজের খেয়ালে ব্যস্ত। আড়চোখে আলিজা অনেকক্ষণ ধরে অয়ন্তীকে প্রত্যক্ষণ করছে। এবার তার মুখ খুলে কিছু বলার সময় হয়ে এসেছে। নীরবতা ভাঙল আলিজা। মুখে খাবার নিয়ে অস্পষ্ট গলায় অয়ন্তীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“এই কী রে? কী হইছে তোর? খাচ্ছিস কম ভাবছিস বেশী। তা ভাবছিসটা কী তুই হ্যাঁ?”
“তোর রাফায়াত ভাইকে নিয়ে ভাবছি!”
“মানে?”
স্ট্রু থেকে মুখটা সারালো অয়ন্তী। চেয়ার টেনে এনে আলিজার গাঁ ঘেঁষে বসল। চোখে-মুখে তার বিশদ তৎপরতার ভাব। বেশ গুরুত্ব সহকারে আলিজাকে বলল,,
“শোন? তোর রাফায়াত ভাইয়ার সমস্ত ডিটেইলস আমার চাই। জানা-অজানা সব ডিটেইলস। অনেককিছুই লোকটা আমাদের কাছ থেকে আড়াল করছে। যা তুই, আমি এবং আমরা কেউ বুঝতে পারছিনা!”
“মানে? কী বলতে চাইছিস তুই?”
“রাদিফ ভাইয়ার ব্যাপারে আমি কখনো তোকে কিছু বলেছিলাম?”
“রাদিফ ভাইটা আবার কে?”
“আমার কলেজের সিনিয়র ভাই ছিল! তখন আমি চট্টগ্রামে থাকতাম। সে এক লম্বা কাহিনী। আমার ফ্যামিলির বাইরে এই বিষয়টা কেউ জানত না। কিন্তু কাল রাতে হুট করে তোর রাফায়াত ভাই রাদিফ ভাইয়ের কথা বলে উঠল! এবার তুই বল? তোর রাফায়াত ভাই ঐ রাদিফ ভাইয়ার ব্যাপারটা কীভাবে জানল?”
ইতোমধ্যেই ঘটে গেল হুলুস্থুল কাণ্ড! বিক্ষুব্ধ অবস্থায় আরিফ একটা ছেলের কলার ধরে ছেলেটাকে টেনে হেঁছড়ে এনে ক্যান্টিনে আলিজার মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো! ঘাবড়ে ওঠা আলিজার মুখশ্রীতে আরিফ তার গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আলিজার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,
“এই ছেলেটাই কী তোমাকে ফোনে ডিস্টার্ব করত? তোমাকে বাজে বাজে মেসেজ সেন্ড করত?”
তাজ্জব বনে গেল আলিজা! আরিফের এই আমুল পরিবর্তন তাকে ভাবাতে লাগল। অয়ন্তীর তো মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলো! এসব কী দেখছে কী তারা? কী হচ্ছেটা কী এসব? দিনের বেলাও তারা দিবা স্বপ্ন দেখেছে না তো? কম্পিত গলায় আলিজা কিছু বলার পূর্বেই আরিফের পেছন থেকে হঠাৎ রাফায়াতের আবির্ভাব ঘটল! চোখে কালো চশমা পড়ে হিরোদের মত তুখোড় ভাব নিয়ে রাফায়াত তার শার্টের কলারটা ঝাড়ল। মুখে কালো মাক্স লাগানো তার! চোখ দেখেই মানুষটাকে চিনতে বেশী বিলম্ব হলোনা অয়ন্তী এবং আলিজার! তেড়ে এসে রাফায়াত ক্ষুব্ধ হয়ে থাকা আরিফের কাঁধে হাত রেখে বলল,,
“আরে ভাই জিজ্ঞেসটা করছিস কী? শিওর না হয়েই আমরা নিশ্চয় এই ছেলেটাকে ধরিনি! তোর গার্লফ্রেন্ডকে ডিস্টার্ব করেছে সে। এবার এর পরিণাম তাকে বুঝিয়ে দে।”
#চলবে…?