#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি
২১||
বিবেক জিনিসটা মাঝেমধ্যে বড় যন্ত্রনাদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। কখনো এমন হয় এর অস্তিত্বই টের পাওয়া যায়না আবার কখনও একেবারে সরব হয়ে ওঠে। এই মুহূর্তে বিবেকের দংশন একটু বেশীমাত্রায়ই অনুভব করছেন জাহানারা। এটা সত্যি যে তিনি রুমকির উপর রাগ। ভীষণ রাগ। কারণটাও কারো অজানা নয়। সেই ছোটবেলা থেকেই এই মেয়েটাকে আজাদের বউ বানাবার ইচ্ছেটা মনে পুষে রেখেছিলেন। ফলে মেয়েটাকে ছেলের বউ করে ঘরে আনার জন্য চেষ্টার ত্রুটি ছিলোনা তার। সুযোগ পেলেই নানান ছুতোনাতায় ডেকে আজাদের সামনে ভিড়িয়ে দিয়েছেন। ইচ্ছে করেই আজাদকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার নাম করে ওর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন রুমকিকে। কখনও এক কাপ চা হাতে ধরিয়ে পাঠিয়েছেন। ঘরে ক্ষীর রেঁধে ওকে খাওয়ানোর সময় তাতে চিনিপড়া গুলে দিয়েছেন। আদর দেখিয়ে আজাদের আধাখাওয়া কলা বা ডিমটা টুপ করে রুমকির মুখে গুঁজে দিয়েছেন। কার কাছে যেন শুনেছিলেন এঁটো খেলে নাকি জুড়ি বাঁধে। কিন্তু কোনো টেকনিকই কাজে দেয়নি। সেই মেয়ে নিমকহারামের মতো গিয়ে বিয়ে করেছে এক শহুরে ছেলেকে। সেও কিনা লুকিয়ে লুকিয়ে। কত্ত বড় পাজি মেয়ে। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি যে তার বিয়ের কথা চলছে। তিনি টের পেলে অবশ্যই লুকিয়ে ওদের দুটোকে কলেমা পড়িয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। চেয়েছিলেন ভাই নিজেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে বাধ্য হয়ে রাজী হোক। তা তো হয়ই নি বরং উল্টো মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে। জাহানারার এতোদিনের সব পরিশ্রম পন্ড করেছে আব্দুল্লাহ। রাগ হবেনা কেন ? তবে এটা সত্যি, যত রাগই হোক তিনি কোনোও দিনও চাননি যে রুমকি বাস একসিডেন্ট করে মরে যাক। এটা তার চাওয়ায় কখনোই ছিলো না। বরং আজ সকালে আজাদের মুখে খবরটা শোনার পর থেকে বিবেক নামক অনুভূতিটা গ্যাসট্রিকের মতো জ্বালাপোড়া তৈরী করেছে। চাইলেও একে এড়ানো যাচ্ছেনা। কিন্তু সংবাদটা সরাসরি গিয়ে ভাইকে দেবার মতো সাহসও পাচ্ছেন না জাহানারা। ছেলের মাথায় ভুত চাপলেও তার মাথায় তো চাপেনি। তিনি ভালো করেই জানেন, গত পরশু দিনের ঘটনাকে নিয়ে তার ভাই আজাদকেই সন্দেহ করে বসে আছেন। সেখানে তিনি যদি গিয়ে রুমকির বাস একসিডেন্টের খবর দেন তাহলে সহজেই তিনি সন্দেহ করবেন যে এটা মিথ্যা বা তার কোনো সাজানো ঘটনা। বিশ্বাস তো করবেই না উল্টো বলবে, তুই জানলি কী করে। তারপর আজাদের সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। পরে দেখা যাবে খামোকাই ছেলেটাকে নিয়ে টানাটানি পড়েছে। মাঝখান থেকে কাজের কাজ কিচ্ছু হবেনা। ঐ দিকে রুমকিদের কী অবস্থা কে জানে। তিনি ভালোই বুঝতে পারছেন যে দ্রুত কারো সেখানে যাওয়া দরকার। সংবাদটা চেপে যাওয়াও মোটেই ঠিক হবে না। বিবেক বলছে যত দ্রুত সম্ভব ঋভূর আত্মীয়দের কাছে খবরটা পৌঁছানো দরকার কিন্তু কী উপায়ে তা মাথায় আসছেনা।
বারকয়েক পায়চারীর পর সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে হঠাৎ ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিজেই বেরিয়ে পড়লেন জাহানারা। তবে আব্দুল্লা ভাইয়ের বাসায় নয়। সরাসরি রুমকির দাদী শ্বাশুড়ীর কাছে গেলেন তিনি। বুড়ি বয়স্ক হলেও যথেষ্ট বিচক্ষণ। তাকে গিয়ে কৌশলে কথাটা বলা যেতে পারে। তাতে যদি বোঝে ভালো নয়তো তার পক্ষে আগ বাড়িয়ে আজাদের কথা বলা সম্ভব হবেনা। তার দায়িত্ব খবর পৌঁছানো তিনি সেটুকুই শুধু করবেন। বাকিটা ওদের ব্যপার।
জাহানারা সরাসরি গোলবানু চাচীর ঘরেই দরজা নক করলেন। গোলবানু চাচীকে তিনি ছোটবেলা থেকেই চেনেন। তবে আব্দুল্লা ভাইয়ের সাথে খাতির থাকায় জাহানারা সবসময় সরে সরেই থেকেছেন। দুর থেকেই বেশীরভাগ কথা হতো, কুশলাদি বিনিময় হতো, এর বেশী তারা কেউই এগোয়নি। না জাহানারা না গোলবানু চাচী। কিন্তু এবারের পরিস্থিতিটা ভিন্ন। কারো জীবন মরণের প্রশ্ন এটা। না বলে পারা যাচ্ছেনা।
সাতসকালে জাহানারাকে দেখে বেশ অবাকই হলেন গোলবানু বিবি। অভ্যাস মত ফজরের নামাজের পর হালকা নাস্তা সেরে দ্বিতীয় দফার ঘুমটা দিতেই যাচ্ছিলেন তিনি। অসময়ে অনাকাঙ্খিত জনকে দেখে তিনি যথেষ্টই অবাক হলেন তবে স্বভাব সূলভ ভাবেই চট করে কোন মন্তব্য করলেন না। জাহানারা নিশ্চয়ই এমনি এমনি আসেনি। নিশ্চয়ই বড় কোনো কারণেই এসেছে। কারণ আব্দুল্লাহর সাথে তার পরিবারের যতটা ঘনিষ্টতা, জাহানারার সাথেও ততটাই দুরত্ব। তাছাড়া রুমকির ব্যপারে এদের মা ছেলেকে নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি। এতোকিছুর পর আজ আবার কী চায় সে ! গোলবানু নিরবে তাকিয়ে রইলেন। জাহানারা ঘরে ঢুকে সালামের ভঙ্গি করলে গোলাবানু মাথা নাড়লেন তবে বসতে বললেন না। জাহানারা খানিক ইতস্তত করে বলে উঠল, ” চাচী কেমন আছেন ?”
-” ভালো। তুমি ? ”
-” এই তো আপনাগের দোয়া। চাচী, একটা কথা শুনলাম। সেটা বলতেই আসছি। আপনাকে ছাড়া আর কাউকে বলার মতো পেলাম না। খবরটা আমি নিজেই জানলাম সকালে। প্রথমে বিশ্বাস করিনি। এখন মনে হচ্ছে ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে তো মহাবিপদ। ”
-” কী খবর ?”
-” কথাটা আমি আমাদের বুয়ার মুখে শুনলাম। ওর ছেলেটা হলো গিয়ে আপনার বাসের হেলপার। তো খবরটা সেই দিলো। ” বলতে গিয়ে জাহানারার মনে হলো তিনি খেই হারিয়ে ফেলছেন। গোলবানু তীক্ষ চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। অবশেষে সেই চাহনী উপেক্ষা করে জাহানারা বলেই ফেললেন একসিডেন্টের কথাটা। তবে আজাদের বদলে নাম দিলেন বুয়ার ছেলে কামালের। গোলবানু কিছুক্ষণ নিরব থেকে বিস্ময়াহত স্বরে বললেন, -“এইসব কী কইতিছো জাহানারা ? ”
-” হ্যাঁ, চাচী। বুয়ার ছেলে বললো, একটা বাস ঢাকা যাবার কালে একসিডেন্টে পইড়েসে। সে নাকি আপনার নাতিরে দেখছে। আপনাগের রূপম তো মাঝেসাঝে আসতো এদিকে। কামাল তারে চেনে। কামাল বললো, সে রূপমকে দেখছে ঐখানে। শুনে আমার মনটা খচ করে উঠলো। সেকারণেই আমি আপনারে বলতি আসলাম। সত্যিই কী , রুমকি ঢাকায় রওনা দিয়েছে চাচী ? ”
গোলবাণু জবাব দিলেন না। টাল খেয়ে পড়ে যাবার আগ মুহূর্তে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন তিনি। জাহানারা বলে চললো, ” চাচী, আপনি আবার এটা ভাইবেন না যেন আমি কৌশলে রুমকির খবর নিতে আসছি। একসিডেন্ট তো একটা হইসে বড় সড়কে। এখান থেকে যাবার পথে। আপনি একটু বড় ভাইরে খোঁজ নিতি কন চাচী। তাহলেই জানা যাবে ! কথাটা জেনেছি বলেই বলতে আসলাম নাইলে তো আপনারা জানবেনও না। এতোটা পাষাণ তো আর আমি না।” বেশ সতর্কতার সাথে কথা শেষ করলো জাহানারা। গোলবানু চাচীর দিকে তাকালো। কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হলো তিনি এ জগতে নেই। হাত পা সমানে কাঁপছে তার। টের পেয়ে জাহানারা দ্রুত তাকে ধরতে গেলে তিনি কোনমতে বড় ছেলের নাম উচ্চারণ করতে করতেই বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তার ঐরকম স্বরের ডাকে ঋভুর বড়চাচী দ্রুত ঘরে ঢুকলেন। ঘরে ঢুকে সব শুনে তিনি নিজেও দিশেহারা হয়ে পড়লেন। ছুটে গেলেন সংবাদটা স্বামীকে দিতে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সংবাদটা পুরো এলাকায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো । আব্দুল্লাহ খবর শুনে তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলেন থানায়। সংবাদের সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে পুরো ঘটনাই শুনলেন। আহত নিহতের লিষ্ট চেক করলেন। তারপর ঐ পায়েই ছুটলেন উপজেলা সদর হাসপাতালে। সেখানে মেয়ের জামাইকে পেলেও পুরো হাসপাতালে রুমকির নাম নিশানা খুঁজে পেলেন না। তাঁর কান্না আর আহাজারিতে হাসপাতাল প্রাঙ্গন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো।
======
পনের বিশ মিনিটের কথা বলে প্রায় এক ঘন্টা পর ফিরলো আজাদ। অদিতি ততক্ষণে রেগে কাঁই। ওর রাগের কারণটা ছিলো মুলতঃ ভীতি থেকে। ভয় কেটে যাবার পর সাধারণত রাগ চড়ে যায়। অদিতির দশাও তেমনই। সে আজাদকে ফিরতে দেখেই রীতিমত চেঁচিয়ে উঠলো।
-” আমি কী জানতে পারি আমাকে এতো সকাল সকাল ঘুম ভাঙিয়ে তৈরী হতে বলার মানে কী ? আপনি পনের/বিশ মিনিটের কথা বলে গিয়েছিলেন। এখন ক’টা বাজে ?”
অদিতির আক্রমনাত্মক ভঙ্গি দেখে আজাদ হেসে ফেললো। তার হাসির কারণ হলো অদিতির ফের তুমি থেকে আপনিতে চলে যাওয়া। তার মানে মেয়েটা সত্যিই রেগে আছে।
আজাদ কপট আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে দু’ হাত তুলে বললো, ” আমি জানি, তুমি টেনশনে পড়ে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি সত্যিই একদম স্যরি। তবে কেন দেরী করেছি তার সবটা শুনলে রাগ হাওয়া হয়ে যাবে। আমাকে থ্যাঙ্কস দেবে। ছুটে এসে জড়িয়েও ধরতে পারো। চাইলে আরেকবার…..!”
-” মোটেও না। আপনি যত বড় নিউজই দেননা কেন, আমার রাগ তাতে কমবে না। আপনি ভয় পাইয়ে দিয়েছেন আমাকে। আপনি জানেন, আপনার কিছু হলে আমি কত বড় বিপদে পড়বো আমি ? ” অদিতির ভেজাকণ্ঠ শুনে আজাদ চট করে ওর দিকে তাকালো। মেয়েটা নিঃশব্দে কাঁদছে। ওকে ওভাবে কাঁদতে দেখে অপরাধবোধে মনটা ভারী হলো আজাদের। এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে বললো, ” এক্সট্রিমলি স্যরি। তুমি এতোটা ভয় পাবে বুঝিনি। বিশ্বাস করো, বাইরে একদম ফালতু সময় কাটাইনি। একটা ট্রলারের ব্যবস্থা করেছি। আজ বেলা বারোটায় ট্রলারটা কক্সবাজারের লাবনী পয়েন্টের দিকে যাবে। সেটাতে করে যাবো আমরা। নৌবিহার বলতে পারো।”
-” আর গাড়ী…?” ভেজা চোখেই তাকালো অদিতি। আজাদকে মনে হলো সে এ জগতে নেই। অদিতি বাধা দিয়ে কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। সবল পুরুষের ভালোবাসার মেঘঘন আহ্বান কোন নারী কবেই বা অগ্রাহ্য করতে পেরেছে। অদিতি কেবল বিড়বিড় করলো, ” গোঁয়ার একটা।” আজাদ তার জবাব দেবার দরকার মনে করলো না।
নাস্তা সেরেই আজাদ ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রুপমের নম্বরে ফোন দিলে সেটা রিসিভ করলেন বড়মামা। আজাদ সামান্য হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ” মামা, রুমকিদের এখন কী অবস্থা ? ”
-” রুমকিদের খবরে তোর দরকার কী। তোর তো খুশি হবার কথা, তাই না ? আমার মেয়েটাকে শান্তি মতো স্বামীর ঘরও করতে দিলি না তুই ! ”
-” মামা, আমি….!”
-” আর কথা বলিস না। তোর কথা শুনে আমার কোনোদিন কোনো উপকার হয়নি। আজও হবেনা। আমি তো আবার আমার মেয়েকে হারিয়েছি।”
-” হারিয়েছেন…?” অস্ফুটে উচ্চারণ করলো আজাদ। ঐ পাশে আব্দুল্লাহ সমানে কাঁদছেন। আজাদ মরিয়া হয়ে জানতে চাইলো, ” মামা, প্লিজ। আমাকে বলুন রুমকির কী হয়েছে ? ওকে হারিয়েছেন কথাটার মানে কী ? ”
-” রুমকিরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে কেউ বলতি পারেনা ওর কথা।”
-” সে কি ? থানায় বা হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছিলেন ? ”
-” রূপমের বড়চাচা সেখানে আছে। এখনও কোনো খবর পাইনি আমি।”
-” মামা, আপনি কাঁদবেন না। আমি থানায় ফোন দিচ্ছি। ওসি সাহেব আমার পরিচিত মানুষ। আমি তার সাথে কথা বলছি। আমার বিশ্বাস রুমকির কিছু হয়নি।” বলে ফোনটা কেটে দিয়েই দ্রুত ওসি সাহেবের নম্বর চাপলো আজাদ। কাঁধে হাত পড়তেই মাথা তুলে দেখলো অদিতির অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানা। আজাদ কেবল ওর হাতটা হালকা চেপে ধরে ছেড়ে দিয়ে ফোনে মনোযোগী হলো।
-” হ্যালো, আজিম ভাই ? ”
-” আজিম ভাই ডিউটিতে । আমি মামুন । ”
-” ওহ্ আচ্ছা। ইয়ে, মামুন ভাই। সকালে কি আপনিই আমাকে ফোন করেছিলেন? ”
-” তা তো বলতি পারবো না। আমি তো অনেককেই ফোন দিয়েছি। এখন কী হইসে, সেটা কন।”
-” কী হয়েছে সেটা আপনি জানেন। গতরাতের বাস দুর্ঘটনার সময় আমার ঘনিষ্ট দুজন আত্মীয় ঐ বাসে ছিলো। যাদের একজনের ফোন থেকে আপনি আমাকে কল করেছিলেন। মনে পড়েছে ? মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই ফোনটা করেছিলেন আপনি। ভোলার কথা নয়।”
-” আচ্ছা, যদি কইরেছি তো হইসে তো। এহন সমস্যা কী ? ”
-” সেই লোক এখন কেমন আছে, যার ফোন থেকে আপনি আমাকে কল দিয়েছিলেন ? তার সাথে একটা মেয়ে ছিলো। তার কী অবস্থা ?
-” সেটা দেখতি হবে। স্ট্যান্ডবাই তো বলতে পারবো না। আপনি এখানে আইসে দেইখে যান। ফোনে ফোনে এতো কথা কওয়া সম্ভব না। ” মামুন নামের এস আই ফোন রাখতে যাবার আগেই শুনতে পেলো আজাদের চড়া কণ্ঠ।
-” এ্যাই শালা মামদার পো। চিনোস আমারে ? শালা দুই টাকার এস আই আর ভাব নেস ওসির। শালা, আমি আজাদ। আজাদ মুনতাসীর। নাম শুনছোস না শোনানোর ব্যবস্থা করুম। আজিম ভাই আসলে আমার এই নম্বরে ফোন দিতে বলবি। আর একসিডেন্টের বাসে আমার দুইজন যাত্রী ছিলো। রূপম আর রুমকি। তাদের ফুল আপডেট জানতে চাই। আমি ঠিক দশ মিনিট পরে ফোন দেবো। পাকা খবর চাই আমার।” বলেই কট করে ফোন কেটে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো ফোনটা।
রাগে গা গরগর করছে ওর। দুহাতের ভরে বিছানায় ঝুঁকে বসে রইলো কয়েক সেকেন্ড। হঠাৎ কী মনে হতে অদিতির খোঁজে ঘাড় ফিরালো। অদিতিকে পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচালো যার অর্থ দাঁড়ায় কী হয়েছে ? তাকিয়ে আছো কেন ? ”
-” আপনি এভাবে গুন্ডাদের মতো করে কথা বলছেন কেন ? কার একসিডেন্ট হয়েছে ? এতো রেগে রেগে কথা বললেন কার সাথে ? ”
-” তার আগে তুমি তোমার সম্বোধন ঠিক করো। একবার আপনি একবার তুমি। যে কোনো একটা স্থির করো। ” আজাদ গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো।
-” তুমিই তো বলতে চাই কিন্তু যেভাবে গর্জে উঠলেন তাতে তুমি বলার সাহস পাচ্ছি না। আপনাকে অনেক দুরের মানুষ মনে হচ্ছে।”
আজাদ হাসতে গিয়েও অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে বললো, ” রুমকির কথা তো জানো। ও ওর হাজবেন্ডকে নিয়ে ঢাকা রওনা দিয়েছিলো। পথে ওদের বাস খাদে পড়ে গেছে। রুমকির কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। পুলিশ আমাকে রুমকির বরের ব্যপারে বলেছে। কিন্তু রুমকির ব্যপারে কেউ কিছু বলছেনা। এটাই আশ্চর্য লাগছে।”
-” সেকি। কী হতে পারে মেয়েটার? ”
-” জানিনা অদিতি। রুমকির কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না আমি। কখনো না।”
চলবে….
#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি
২২||
সকালে মায়ের ফোন পাবার পরপরই ঢাকা থেকে রওনা দিতে চেয়েছিলেন মহিউদ্দিন কাদের। কিন্তু একসিডেস্টের খবরটা সত্যি না মিথ্যা তা যাচাই করে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রওনা দিতে নিষেধ করেছিলেন বড় ভাই নুরুদ্দিন । যদিও রূপমের মা ঐ খবরেই কেঁদে কেটে একাকার করে ফেলেছে তার পরেও বড় ভাইজানের কঠিন নিষেধাজ্ঞা ছিলো, ‘ হুড়মুড় করে এখানে আসার দরকার নেই। তুই নিজেই তো হাফরুগী। পরে তোর কিছু হলে আরেক বিপদ হবে। তুই বরং ওখানেই থাক। আমি তো এখানে আছিই। রুমকির বাবাকে সাথে নিয়ে খোঁজ খবর করছি। রূপমদের খবরটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তোর জার্ণি করে আসার দরকার নেই। আমার ফোন পেয়ে কনফার্ম হলেই তবে রওনা দিস। আমি দেখছি কী করা যায়। তুই এসেও কিছু করতে পারবিনা। বরং ওখান থেকেই আল্লাহকে ডাক।”
বড় ভাইয়ের এহেন কথার প্রতিবাদে বেশী কিছু বলতে পারেন নি মহিউদ্দিন কাদের। নিরব কান্নায় বুক ভাসিয়েছেন। এটা সত্যি, তিনি গিয়ে বিরাট কিছু করে ফেলতে পারবেন না। কিন্তু ঘরে বসে থাকতেও তো মন সায় দিচ্ছেনা। রূপম তার একমাত্র ছেলে। ওর মায়ের বড় আদরের। যদি ওর কিছু হয় তিনি সইলেও ওর মা সইতে পারবে না। ছেলের এমনতর খবর শোনার পর থেকে জায়নামাজেই সিজদায় পড়েছিলো রূপমের মা। এর মধ্যে রুমকির বাবার সাথে ফোনে কথা বলে বেচারার আহাজারি শুনে বুকের পাঁজর গুড়িয়ে গেছে তার নিজেরও। দুপুরের পর পর বিকেলের দিকে যখন বড় ভাইজান ফোন করে জানালেন যে, পাকা খবর পাওয়া গেছে। একসিডেন্ট সত্যিই হয়েছে এবং তাতে রূপম রুমকিও ছিলো। তবে ভয়ের কিছু নেই। রূপমকে পাওয়া গেছে। সে ভীষণভাবে জখম হলেও বেঁচে আছে, এখন বিপদমুক্ত । তার চিকিৎসা চলছে।রুমকির এখনও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে আহত মহিলাদের সবাই জীবিত। এটা শোনার পর মনটা যারপরনাই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তবে কোনো মহিলা মারা যায়নি শুনে স্বস্তি পেয়েছিলেন কিছুটা। এরপরই তিনি সন্ধ্যার বাসে রওনা দিয়েছিলেন। ঝিনাইদহ পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত প্রায় একটা বেজে গেলেও তিনি বিশ্রাম না নিয়ে ঐ পায়েই সদর হাসপাতাল যেতে চাইলেন। তাকে বহুকষ্টে নিবৃত্ত করেন বড়ভাই নুরুদ্দিন। তিনি অাশ্বস্ত করেন, রূপমকে তিনি নিজ চোখে দেখে এসেছেন। সে এখন চিকিৎসাধীন আছে। ডাক্তারদের সাথে আলাদা কথা বলে রূপমের এক্সট্রা কেয়ারের ব্যবস্থাও করে এসেছেন তিনি। এখন চিন্তাই হলো রুমকিকে নিয়ে। যে লোকটার দায়িত্বে মহিলাগুলো আছে তার বাড়ীর খবর থানার কেউ দিতে পারছে না। লোকটাকেও তারা খুঁজে পায়নি যার ফলে তার বাড়ীতে যেতে পারেনি নুরুদ্দিন বা আব্দুল্লাহ হুজুর। তাছাড়া একসিডেন্ট স্থল তাদের গ্রাম থেকে অনেকটা দুরে। মধু নামের ঐ লোকটার বাড়ী সেখানকারই কোনো গ্রামে। লোকটাকে না পাওয়া পর্যন্ত রুমকি পর্যন্ত পৌঁছানো যাচ্ছেনা। ফলে বাধ্য হয়েই অপেক্ষা করতে হচ্ছে। থানা থেকেও তেমন সাহায্য পাওয়া যাচ্ছেনা। সবাই দারুণ ব্যস্ত। সারাক্ষণ লোকজন আসছে যাচ্ছে। ঠিকমতো কথাই বলা যাচ্ছেনা। তবে আশার কথা এই যে, মহিলা যে কয়েকজন আছে তারা সবাই বেঁচে আছে এবং ভালো আছে। তারা আরেকটি ক্লিনিকে স্থানীয়দের তত্ত্বাবধানে আছে। সেখানে একজনই কেবল মারা গিয়েছে যার স্বজনরা তাকে সনাক্ত করেছে। তারমানে রুমকি যেখানেই আছে বেঁচে আছে এবং ভালো আছে।
=====
-” কোহিনূর ? ”
-” জি, বলেন।”
-” মেইয়েগুলোর কী অবস্থা ? জ্ঞান ফিইরেসে? ”
-” চাইর জনের ফিরেসে। আর একজন তো মইরেই গেলো। তার লাশ নিইয়ে গেছে থানার লোকজন আইসে। ”
-” হম…! বাকি চাইর জনের কী অবস্তা ? ”
-” ভালো। দুজন এখনো কিলিনিকেই আছে। তাগো ছাড়েনাই, তয় বাকি দুইজনরে আজ নিয়ে আসিছি। এরা আমাগের বাসাতেই আছে। তবে ঐ মোটা মেইয়েটা মেলা ক্যাওয়াজ করতিসে। বিকট শব্দ করে সেই কান্না। ইটারে সামাল দেওন যাইতেসে না। কতক্ষণ পর পর চিৎকার মাইরে উঠতেসে। কমিনদে আইসে জুটিসে আল্লাহই জানে। গলা তো না যেন মাইক। ”
-” তা তোরে কিডা কইছিলো এই মেইয়েগুলারে বাড়ীতে আনতে ? সবটাতে মাতব্বরী না করলে তোর চলে না নাকি ? থাকতো পইড়ে কিলিনিকে। বাড়ী আনলি কী মনে কইরে? অত দরদ দেখানির কী দরকার পইড়েসিলো শুনি ?”
-” দরদের কী আসে এইখানে ? মানুষ মানুষের জন্যি করবে না তো কী পশুপাখি আসি করবে ? ”
-” তোর দরদের খবর আমার চে ভালো আর কেউ জানে না কোহি। অহন খোলাসা করি ক তো দেহি কত টাকার জিনিস গুছাইছিস ? ”
-” কী বইললে ? ” কিছুটা চমকে উঠলেও রাগ দিয়ে সেটাকে ঢেকে দিলো কোহিনূর।
-” কি বলসি সিডা তুই ভালোই জানোস কোহি। ”
-” বাজে কথা বলবানা কইয়ে দিচ্ছি। আর আমি কী করি না করি সিডা দিয়ে তুমি কী করবা? যেখান থেইকে যা আনি তা তো সব সংসারেই ঢালি। তোমার এতো খবরে দরকার কী! ”
-” আমার কী দরকার সিডা কোন কথা না। কথা হচ্ছে, যেমন করি ঘরে আইনেছিস তেমন করি সেবা কর। এগের যত্ন করবি ঠিকমতন। এস. আই সাব জানতে চাইলে তারি বলতি হবে তো। সন্ধ্যার পর আমি থানায় যামু। ওসি সাব লোকমুখে খবর পাঠাইসে। আমারে যাতি কইসে।”
-” তাইলে ঐ বড় গলার বেডিরে তুমি সাথে করি নিইয়ে যাও পারলে। বেটি অসহ্য করি ফেলতিসে। কাইন্দে কাইট্টে বাড়ী মাথায় করতিসে। এরে আমি বাড়ী আইনে মস্ত বড় ভুল কইরেসি মাগোহ। একেতো ভিখিরী ঘরের। তার উপরে দাপট কী। গলায় একখান চেইন পড়িসে ফুটানি মাইরে। চারআনাও হবি কিনা সন্দেহ আছে। জ্ঞান ফিরেই কয় আমার চেইন কনে ! কেমুন সিয়ানা পাগল বুইঝিছো ? অথচ ঐ বোরকা পড়া মেইয়েটার হাতে দুইটা আংটি ছিলো। দুইটাই এক্কেরে খাসা। ভারী ভারী আর পাত্থরটাও মনে হয় দামী। তার কোনো কথা নাই আর এই মুটকির দাপট কত। ঐ মেইয়ের তার আংটি একবারের জন্যিও খুঁজে নাই। যেন জানতো ঐটা হারাবে। ” কোহিনূর তথ্য পেশ করার মতো করে বললো।
-” ওওরে বাবারে, তুই তো তালি ভালো ব্যবসা কইরেছিস দেহা যায়। মেলা ট্যাহার মালিক হইয়ে গেছিস। কিন্তু কোহি, কামটা কী ঠিক হলো? ”
-” বেঠিকের কী আছে ? তাগের জান বাঁচাইসি। সিডার দাম দিতে পারবে তারা ?আমি তো আর কাইড়ে নেই নাই। আমি না নিলি অন্য কেউ নিতো। জিনিস তাগের খোয়া যাইতোই। এহন এসব কথা ছাড়ো আর সদাই আনি দাও। মনুর ওষুধ লাগবো আইজ। তুমি তো সদরে যাবাই। ঐখান থাকি আনি দাও। শিগগীর যাও।
-” যাইতেসি। তয় আমার মনে হয় গহনা রাখাটা ঠিক হয় নাই। তাগের গহনা তাগের ফিরায়ে দিলিই ভালো করতি।”
-” চুপ করো তো। সবটাতে কথা কতি আসবানা। এজন্যেই তোমারে কিছু কইতি চাইনা। কাম কাজে ঠনঠনাঠন। আইসেচে উপদেশ কপচাইতে। ”
মুখ ঝামটে সরে পড়লো কোহিনুর। তাকে এখন কাজে যেতে হবে। গত কাল নানান ঝামেলার কারণে চেয়ারম্যান বাড়ীতে যেতে পারেনি। আজ না গেলে চেয়ারম্যানের বউ খুব রাগ করবে এটা নিশ্চিত। তাছাড়া যে দুজন মহিলা তার জিম্মায় আছে তারা দুজনই এখন অনেকটাই সুস্থ। নড়েচড়ে খেতে পারছে। এদের একা রেখে যাওয়া যায়। তবে এদের একজন কথা বললেও অপরজন কোনো কথা বলছেনা এই যা। অবশ্য কথা না বললেও তার কিছু করার নেই। সে তো তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য যা করার তা করেছেই। এর বেশী আর কী করবে। তাছাড়া গহনা যে সে’ই নিয়েছে তার তো কোনো প্রমান নেই। কাজেই তাকে সন্দেহ করেও কোনো লাভ নেই। কোহিনুর মরে গেলেও স্বীকার করবেনা একথা। বরং বোকার মতো মধুকে বলে ভুল করেছে সে। এখন মধু ঝামেলা করলে ওকে অন্য পথ ধরতে হবে। তবে আগে ঝামেলা হোক তখন দেখা যাবে। আগে ভাগে ক্যাচাল করে লাভ নেই।
কোহিনুর ছেলেকে নাস্তা খাইয়ে দিয়ে কাজে যাবার প্রস্তুতি নিলো। মহিলা যে দুজন তার ঘরে আছে তাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করেই বললো, ” আমি কাজে যাচ্ছি। তোমাগের কিছু দরকার পড়লে আমার ছেলেটারে বলতি পারো। তাছাড়া তোমাগের বাসার থন এহনো কেউ যোগাযোগ করে নাই। তোমাগের আরো অপেক্ষা করতি হতি পারে। তবে সিটা কতদিন বলতি পারিনা।”
কোহিনুর দেখলো বোরকা পড়া মেয়েটা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। আর অন্যজন শুনেই হাউমাউ করে সারিগান শুরু করে দিলে কোহিনুরের মেজাজ চটে গেলো। সে ঠিক করলো আজ কাজ থেকে ফিরে রাতেই এই মহিলা দুটোকে থানায় পাঠিয়ে দেবে। এই প্যারা আর নেবেনা সে। অন্তত ঐ মোটা মহিলাকে তো একদম না।কানের পোকা নাড়িয়ে দিচ্ছে সে। সাথের মেয়েটা যে কী করে ওকে সহ্য করছে সেটাই আশ্চর্য।
কোহিনুর বোরোতে যাবার মুখেই থমকে দাঁড়ালো। একজন কনস্টেবল এসে দাঁড়িয়েছে তার দোরগোরায়। সাথে স্থানীয় এক লোক। সম্ভবত সেই বাসা দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। কোহিনুর যা ধারণা করেছিলো তাই হয়েছে। থানার লোক খুব স্বাভাবিকভাবে তার ঠিকানাটাই আগে খুজবে। তারপরই ক্লিনিকবা অন্য কিছু ।কারণ সবাই দেখেছে সে বোরকা পড়া মহিলাটাকে কিভাবে ভ্যানে তুলেছে। এরপর পরই তো বাকী চারজনকে সবুজ ছাতায় পাঠানো হলো। কে বা কারা পাঠিয়েছে কোহিনুর জানেনা তবে পরে মধুর মুখে শুনেছে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বাকি চারজন মহিলাকেও এখানে পাঠানো হয়েছে। যেহেতু একজনকে নিতে দেখেছে তারা।
অস্পষ্ট স্বরে সালাম দিয়ে কিছুটা সপ্রতিভ হয়েই কথা বলতে চাইলো কোহিনুর।
-” মধু তো বাড়ীতে নাই সার। সে হয়তো আপনাগের থানার দিকেই গেসে। তারে সেখানেই পাবেন।” কোহিনুর কনস্টেবলকে কাটাতে চাইলো। মধু বাড়ী নেই। সে আন্দাজে কী কথা বলবে। কিন্তু কনস্টেবল লোকটা ক্ষেপে উঠলো হঠাৎ।
ধমক দিয়ে বললো, ” মধুরে দিয়ে কী করবো আমি ? চাইটে খাবো ? আমি কেবল তোর কাস্টডিতে যে মহিলাগুলো আছে তাদের অবস্থা জানতে আইসিছি ! ”
কোহিনুর মনে মনে মুখ ভেঙচালো। মুখে বললো,” সার, একজন তো গতকাইলকেই মইরে গেসে। লোকজন সেই লাশ নিয়ে থানায় দিয়ে আইসেছে।”
-” সে তো জানি। বাকি চাইর জন ? ”
-” দুজন কিলিনিকে আর দুজন ঘরেই আছে। আইজই কী তাগের নিইয়ে যাবেন সার ? ”
-” না..না, এখন না। পরে। তাদের লোকজন এখনও নিতে আসেনি। আমি নিয়ে কনে রাখবো। জমিদারের দল ফোনে ফোনেই ফুটুনি মারাচ্ছে। যাই হোক, তোরে যেটা বলতি আসিচি। এই চাইরজনের মধ্যি একজন আছে যে খুব বড় মানুষের আত্মীয়। তার দিকে খেয়াল রাখিস। অযত্ন যেনো না হয়। চিকিৎসার প্রয়োজন হলে দৌড় দিয়া সবুজ ছাতায় নিয়ে যাবি। কথা বুইজেছিস? ”
-” জি, সার। তা নাহয় নিলাম কিন্তু কোনজন বড় মানুষ বুঝবো কেমন করি ? এগের আত্মীয় স্বজন কনে। তারা আসে না কেন ?
-” কে কনে আছে এতো খবরে তোর কাম কী। তুই নিজে তাগো দায়িত্ব নিয়েছিস, সেই দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করবি। এগের সবার চিকিৎসা থানা সদরে সম্ভব না বলেই এখানে রাখা। যাই হোক্, আমি গেলাম।” বলেই লোকটা ফিরে এসে বললো,” মধুর তো ফোন নাই। তোর নাম্বারটা আমাকে দিয়ে রাখ। এগের লোকজন আসলে পরে আমি তোরে ফোন দেবোনে। তয় আরেকটা কথা। তোরে নয়তো মধুরে থানায় গিয়ে একটা মুচলেকা দিতি হবে ।”
-” মুচলেকা কিসের সার ? ” কোহিনুরের কণ্ঠে জড়তা দেখা দিলো এবার ।
-” আরে এটা ভয়ের কিছু না। এগের যে তোর কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছি সেটার প্রমানপত্র। একটা ফর্মালিটি বলতি পারিস।”
-” ও আচ্ছা। আরেকটা কথা সার। ইয়ে, কোনজন বড়ঘরের কইতি পারলেন না সার? ”
-” সে তো আমিও জানিনা। ওসি সাব কেবল বইলে দিইসে আজাদ মুনতাসিরের আত্মীয় আছে এখানে। আজাদ মুনতাসিররে তুই চিনবি না। কিন্তু সে লোক বড় মারাত্মক। এই শহরের পিস্তল তার ইশারায় উঠে আর নামে। তার আত্মীয় মেইয়েটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।”
-” তাইলি পরি তো বিপদের কথা। একজন যে মারা গেলো সে নয়তো সার ? ”
-” আরে না…না। সে না। তার লাশ তো তার আত্মীয়েরা সনাক্ত কইরেই নিয়ে গেছে। ঐটা ছাড়া তো আর কোনো মহিলা মারা পড়েনি। যে পাঁচ-ছয় জন মারা গেসে সবাই পুরুষ।”
-” ওহ্…!” বলে কোহিনুরের মুখটা ম্লান হয়ে গেলো। কিছুটা খটকা লাগলো নিজের বিগত কাজের ব্যপারে। এটা ঠিক, তার কিছুটা হাতটানের অভ্যাস আছে। সে সুযোগ পেলেই এর তার জিনিস মেরে দেয়। কিন্তু এটা ছাড়া কারো উপকার বৈ ক্ষতি করে না সে। তাছাড়া সে চুরি করে অভাবে পড়ে। ছিনিয়ে তো আর নেয়না। এরা কী তাকে সন্দেহ করবে ? নাহ্, তা কেন করবে ! ভীড়ের মধ্যে গা থেকে গহনা যে কেউ নিতে পারে। তাকেই সন্দেহ করবে কেনো। নিজেকে সান্ত্বনা দিলো কোহিনুর।
কনস্টেবল চলে গেছে অনেকক্ষণ হয়। কোহিনুরের তবু কাজে যাওয়া হলোনা আজও। সে ঘরে ফিরে এসে মহিলা দুজনকেই মাপতে লেগে গেলো। বিতৃষ্ণার সাথে মোটা মহিলাটাকে দেখলো সে। যেমন বিশাল বপু তেমনি চন্ডাল তার ভাষা। যখন কান্না করে গলা ফাটিয়ে কাঁদে। সে কী বিলাপ। ছিহ্। বেটির ভ্যামরানো লালা নিঃসরনের কান্না দেখলেও কোহিনুরেরই গা গুলায়। অপর মহিলাটা সে তুলনায় বেশ শান্ত। চেহারায় এক অন্যরকম আভিজাত্য আছে। মেয়েটা জ্ঞান ফেরার পর নিজেই হাত দিয়ে টেনে নিয়ে বোরকা পরেছে। তারপর থেকে বোরকা পরেই শোয়া বসা করছে আর নিরবে অশ্রু বিসর্জন করছে কিন্তু কোনো কথা বলছে না। মাঝে দু একবার বিড়বিড় করেছে কিন্তু কোনো হৈ চৈ করেনি বা প্রশ্ন করেনি। বরং আজ সারাটা সকাল পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসেছিলো। সম্ভবত এই মেয়েটাই সেই বড় মানুষের আত্মীয়া। হাসপাতালের দুজনও মধ্যবয়স্কা আর দরিদ্র শ্রেনীর। এর যেমন চেহারা তেমন আচরণ। সবটাই রাজকীয়। ওর হাতে যে দুটো আংটি পেয়েছিলো সে দুটোও মহাদামী। বিক্রির সময় দুলাল ভাই নিজেই বলেছিলো এগুলো বিয়ের আংটি। বিয়েতে মানুষ কেনে। তারমানে মেয়েটা সদ্য বিবাহিত। তার গায়ের বোরকাটাও বেশ দামী। সাথের ব্যাগ, আংটি জুতা সবই নতুন বউদের মতো। ঐ মুটকি মহিলার মতো নয়। ঐটারে দেখতেই তো ভিখিরিদের মতো লাগে। গলায় একটাই চেইন ছিলো সেও সুতার মতো পাতলা। দুলাল ভাই হাতে নিয়েই বলেছে, এসব ওয়ান টাইম গহনা। ভালো দাম মিলবে না। কোহিনুরও বোকা নয়। সে ভুল করেও গহনা হাতে রাখেনি। সাথে সাথেই দুলাল ভাই মারফত বেচে দিয়েছে। কারণ জানে জিনিস হাতে থাকলেই ঝামেলা। ওকে সন্দেহ করার কোনো সুযোগই সে রাখবে না। এবারও দীর্ঘশ্বাস পড়লো কোহিনুরের।
=====
সমাদ্দার পরিবারকে একসাথে থানায় ঢুকতে দেখে এস.আই মামুন নিজেই এগিয়ে গিয়ে সম্ভাষণ জানালো। তারপর তাদের বসতে বললো। সমাদ্দার সাহেব জানালেন তিনি এসেছেন তার ভাগনির ব্যপারে মামলা করতে । কিছুদিন আগে অর্থাৎ কিডন্যাপের দিনই তিনি ওটার জিডি করিয়ে গেছেন।
সব শুনে এস.আই নিজেই খাতা টেনে এজাহার লিখতে বসলেন। লিখতে গিয়েই হোঁচট খেলেন তিনি। মনে পড়লো প্রায় তিন চার দিন আগে এই মেয়ের নামে জিডি করিয়েছিলো সমাদ্দাররা।
এস.আই কলম সরিয়ে সবিনয়ে জানতে চাইলেন , ” স্যার, আপনার ভাগনি কিডন্যাপড হয়েছে আমার যতদুর মনে পড়ে প্রায় চারদিন আগে। সেই জিডি করার পর আপনারা আর কেউ যোগাযোগ করেন নি। আজ চারদিন পরে আপনি এফ আই আর লিপিবদ্ধ করতে চাচ্ছেন। কারণটা কী স্যার ? ”
শাহান কিছু বলতে গেলে সমাদ্দার সাহেব মুচকি হেসে বললেন,” আমাকে কেউ এতো প্রশ্ন করেনা মামুন সাহেব। আমিই সবাইকে প্রশ্ন করি। এটা আপনিই ঠিক করুন কী লিখবেন ! বাই দা ওয়ে, কতদিন হলো এই উপজেলায় আছেন ? সমাদ্দার পরিবার সম্পর্কে খুব কম ধারণা রাখেন বলে মনে হচ্ছে ! ”
এস.আই বিব্রত স্বরে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ” আমি খুবই দুঃখিত স্যার। মানে আমাকে দেরীর কারণটা উল্লেখ করতে হবে তো, সেকারণেই জানতে চাওয়া। কোনো সমস্যা নেই। আমি একটা গ্রহনযোগ্য কারণ লিখে দিচ্ছি। ”
-” গুড, লিখুন। আমি একটু ওসি সাহেবের সাথে কথা বলবো। উনি রুমে আছেন তো ?”
-” জি, স্যার। ওসি স্যার রুমেই আছেন।”
সমাদ্দার সাহেব উঠে ওসির রুমের দিকে গেলেন। শাহানও তার পিছু নিলো। লিটন চুপচাপ বসে এজাহার লেখা দেখতে লাগলো। মাঝেমধ্যেই তার ফোন টুং টুং করছে। এস. আই তাকে চা ঠান্ডা অফার করলে সে হাত তুলে নিবৃত্ত করলো তাকে। এস.আই লেখা শেষ করার আগেই ফোন বাজলো। তিনি সেটা অগ্রাহ্য করেই লিখে গেলেন আরো দু লাইন। সামনে সমাদ্দার পুত্র বসে আছে। ফোন পরে ধরলেও চলবে ভেবে লিখতে গিয়েও থেমে গেলেন তিনি কী একটা কথা ভেবে। তাছাড়া ক্রমাগত ফোনের রিং তার বিরক্তি ধরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে মামলা সাজানো যায় না। তিনি ফোনটা তুলে কানে ঠেকালেন ।
-” জি, থানা সদর থেকে বলছি।
-” সাব ইন্সপেক্টর আজিম ভাইকে চাচ্ছি। ওনাকে দিন।” সকালের সেই দাপুটে কণ্ঠটা। যে নিজেকে আজাদ মুনতাসীর পরিচয় দিয়েছিলো। মামুন দ্রুত বিনয়ের অবতার সেজে বলে উঠলো,
-” আজাদ ভাই, উনার তো আজ হাইওয়েতে ডিউটি। কী দরকার বলার আমাকে বলেন না ।’
-” যদি ভুল না করে থাকি তো আপনি মামুন সাহেব রাইট? ”
-” জি। আজাদ ভাই। আমি তো আপনারে প্রথমেই চিনে ফেলেছি।”
-” যাক্, চিনেছেন তাহলে ! এবার বলুন, আমার রিলেটিভের অবস্থা এখন কেমন ? তার প্রপার ট্রিটমেন্ট হচ্ছে তো। ”
-” আজাদ ভাই। আপনাকে সেদিন চিনতে পারিনি বলে ওভাবে বলেছি। এখনও মাইন্ড করে আছেন ভাই। আসলে কাজের সুবাদে তো কতশত লোকদের সাথে ডিল করতে হয়। তাই…..! যাই হোক, আপনি গতকাল সকালে ফোন করার পর আমি নিজে স্পটে গিয়ে খবর নিয়ে এসেছি। আপনার আত্মীয়াকে আমি আইডেন্টিফাই করতে পারিনি বটে তবে তিনি যে বেঁচে আছেন এবং ভালো আছেন সেটা নিশ্চিত জেনেই আপনাকে কল ব্যাক করেছিলাম। আসলে কী আজাদ ভাই, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থান সংকুলান হচ্ছিলো না বলেই আমরা মহিলা ক’জনকে স্থানীয় লোকদের জিম্মায় সবুজ ছাতাতেই রেখেছি। পুরো বাসের যাত্রীদের মধ্যে মহিলা মারা গেছে একজন। তাকে তার আত্মীয়রা এসে সনাক্ত করে লাশ নিয়ে গেছে। কাজেই চিন্তামুক্ত থাকেন। আপনার রিলেটিভ সহী সালামতে আছে। আপনি এবার নিশ্চিন্ত হন ভাই। আর আপনার আত্মীয়দের বলেন তারা যেন এসে মেয়ে নিয়ে যায়। সারাদিনে তাদের কাউরে তো চোখে দেখলাম না।”
-” তারাও হয়তো আপনাদের খোঁজেই হন্যে হয়ে ঘুরছে। একটু কো অপারেট করেন ভাই।”
-” কী যে বলেন ভাই। সেসব আবার বলতি হবে। আপনার লোকেরে…..কী যেন হয় আপনার? ”
মামুনের প্রশ্নে নিরব রইলো আজাদ। সন্তর্পনে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস চেপে বললো,” ওকে, থ্যাঙ্কস মামুন ভাই। আপনার কথা আমার মনে থাকবে। রাখি।”
রিসিভার স্ক্রাডলে রেখে মুখ ফুলিয়ে বাতাস ছেড়ে ফের কলম ধরতে যাচ্ছিলো এস.আই মামুন । কিন্তু লিটন সমাদ্দারের জন্য পারলো না। সে হাত বাড়িয়ে হঠাৎ খাতার উপরটা ঢেকে ফেলেছে। মামুন বিস্মিত হয়ে তাকাতেই দেখলেন লিটন সমাদ্দারের ছোট ছোট চোখগুলো আরো কুতকুতে হয়ে গেছে। সে বিড়বিড় করে বললো, ” কার সাথে কথা বললেন এতোক্ষণ। কোন আজাদ এটা যাকে এতো তোয়াজ করে ভাই ডাকতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেললেন ? ”
-” আরে, এটা হলো গিয়ে আজাদ মুনতাসীর। কাঞ্চননগরের….!”
-” অলিখিত সম্রাট, রাইট ? ভালো করেই চিনি। তো রাজা বাহাদুরের কী কাজ এখানে ? ” এস.আই এর কথা শেষ হবার আগেই লিটন বাধা দিয়ে বললো।
এস.আই খানিকটা বিস্মিত হয়ে একসিডেন্টের ব্যপারটা সংক্ষেপে খুলে বললো। শুনতে গিয়ে লিটনের চোখজোড়া একেবারে স্থির হয়ে রইলো। বেশ ক্রুর দেখাচ্ছে ওর চোখগুলো। মামুনের কথা শেষ হবার আগেই লিটন গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো, ” কোন বাড়ীতে আছে মেয়েটা ? ”
-” কোন মেয়ে স্যার ? ”
-” আহ্, যার সাথে কথা বলার সময় চারবার ঢোক গিলেছেন। সেই আজাদ মুনতাসীরের রিলেটিভের? ”
-” ম….মধুর বাসায়। কী ব্যপার স্যার ? তাকে চেনেন আপনি ? ”
-” হম। চিনি। তবে মেয়েকে না আজাদ মুনতাসীরকে । এই মেয়ে আমাকে আজাদ মুনতাসীর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। আর আপনি আমাকে পৌঁছে দেবেন এই মেয়ের কাছে। কথা বুঝেছেন না আরো বুঝাতে হবে ? ”
-” কিন্তু স্যার। আপনি তো তার কাস্টডি নিতে পারবেন না। তার রিলেটিভ না আসা পর্যন্ত।”
-” ধরে নিন, আমিই তার রিলেটিভ। এখন কী রিলেটিভিটির প্রমানও দেখাতে হবে নাকি ?”
-” না, মানে…! ”
-” মামুন সাহেব। আপনার কাজ হচ্ছে আহতদেরকে তাদের স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়া। আপনি সেটাই করতে যাচ্ছেন। নিন, এফ আই আর স্থগিত রাখুন আর আমাকে ঐ মেয়ের কাছে নিয়ে চলুন। এটা এফ আই আরের চেয়ে বেশী জরুরী।” বলে লিটন সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালো। এস.আই মামুন কিছুটা বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে বেল টিপে কনস্টেবলকে ডাকলো। তারপর তাকে আদেশ করলো লিটন সাহেবকে মধুর বাড়ী নিয়ে যেতে।”
চলবে…..