এক প্রহরের খেলা, পর্ব:২৪+২৫

#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

২৪||

চোখ মেলতেই সামনের সবকিছু ঝাপসা ঠেকলো। চোখের পাতা এতো ভারী যে খোলা রাখতে অসুবিধে হচ্ছে। বন্ধ করলেই ঘুম এসে যাচ্ছে। কিন্তু ইন্দ্রিয়গুলো সে তুলনায় অনেকটাই সজাগ। রুমের ভেতর কারো ফিসফিসানী শুনতে পেলাম। কিন্তু চোখ মেলে দেখতে ইচ্ছে করছে না।
শরীরটা অসাঢ় লাগছে সাথে হালকা ব্যথা বোধ। দীর্ঘক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলে যেরকম ব্যথাবোধ হয় অনেকটা সেরকম। আপনা থেকেই বাম দিকে কাত হয়ে হেলে গেল মাথাটা। চোখটা অবচেতনেই খুলে গেলো। আর তখনই চোখে পড়লো আম্মুকে। তাকিয়ে রইলাম আম্মুর দিকে। আহ্, কতদিন পর আম্মুকে দেখলাম। তারপর আপনা হতেই পাশের জনের দিকে চোখ পড়লো আমার। খুব চেনা মনে হলো ওকে। তবে মাথায় বেশী চাপ দিতে হলো না। চিনতে পারলাম। ওটা নায়লা। নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, ‘ নায়লা এখানে যেন কেন।’ পরক্ষনেই মনে হলো,নায়লা তো আমার বন্ধু। এজন্যেই নায়লা এখানে। ভাবনা এলো, নায়লাকে কী আম্মুকে চেনে ? উত্তরটা নিজেই খুঁজে নিলাম। না চেনার কী আছে। আর তখনই অদ্ভুত প্রশ্নটা এলো মনে এলো , আচ্ছা, আমার কী বিয়ে হয়েছিলো? নায়লার সাথে? ও কী আমার বউ ? বিয়ে হলে তো ও তো আমার বউই হবে । স্মৃতির পাতা ওল্টাতে শুরু করে দিয়েছি ইতোমধ্যেই। মন বললো, নায়লাই তো সেদিন ট্রে তে করে নাস্তা নিয়ে এসেছিলো! বেশিদিন আগের কথা নয়। এই তো সেদিন। ওটা কী আসলেই নায়লা ছিলো ? নায়লার সেদিনের মুখটা ভাবতে চেষ্টা করলাম। ভাসা ভাসা মনে পড়তেই মিলিয়ে গেলো চেহারাটা। লম্বা বেণী। ধণুকাকৃতির গোল গলার আধাভেজা কামিজ। নাহ্, নায়লা তো ফতুয়া জামা পড়ে। ওটা সম্ভবত নায়লা ছিলো না।
ভাবতে গিয়ে মনে হলো চোখ সহ পুরো মাথাটা ব্যথা করছে। মেয়েটার চেহারা মনে করতে পারছি না।
মাথার উপর চাপ দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে পড়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। আর তখনই আম্মুর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।
কোমল স্বরে ডাকছেন তিনি, ” ঋভূ….! ঋভূ বাবা ! আব্বু…..? ও বাবা….!”

আহা, এতো আদরের ডাক। সাড়া না দিয়ে পারা যায় না। আমিও থাকতে পারলাম না। সামান্য চেষ্টা করতেই চোখটা খুলে গেলো। আম্মাকে দেখলাম ঝুঁকে আছে আমার মুখের ওপর। আমি ঠোঁট নাড়াবার চেষ্টা করলাম। চড়চড় করে উঠলো ঠোঁটের উপরটা। মনে হচ্ছে কথা বলতে গেলেই ফেটে যাবে ঠোঁটটা। তারপরেও উচ্চারণ করলাম, ” মা….” বলে।
আম্মার চোখে খুশির ঝিলিক। আমার শতেক পাইপের নল এড়িয়ে মাথায় গালে হাত বুলাবার চেষ্টা করলেন তিনি। একই সাথে টপটপ করে চোখ থেকে জল ঝরছে তার। আমি ফের চোখ বন্ধ করতেই পরিচিত কণ্ঠের ডাক শুনলাম। ঋভূ ঋভূ করে ডাকছে কেউ। চোখ নায়লাকে দেখলাম। নায়লা। আমার একসময়ের সহপাঠী। আমার বান্ধবী। একই সাথে মনে পড়লো নায়লা রাগী আর গোঁয়ার। নায়লার সাথে আমার পরিচয় ইকোনোমিক্সর ক্লাসে। হ্যাঁ, ঠিক। আমার মনে পড়ছে। আমি নিজেই তো ইকোনমিক্সের তুখোড় ছাত্র ছিলাম। নায়লা আমার কাছে প্রায়ই পড়া বুঝতে আসতো। তারপর একদিন ও আমাকে বলে বসলো,” প্রেম করবি আমার সাথে ? ”
-” আমিও বোকার মতো হ্যাঁ করে দিলাম। তারপর থেকেই আমরা একসাথে। ”

-” চিনতে পারছো আমায় ? ” নায়লা তাকিয়ে আছে হাসিমুখে। সামান্য মাথা নাড়লাম। যার অর্থ হ্যাঁ না দুটোই হতে পারে। বললাম,” তুমি নায়লা।”
-” গুড। এই তো পেরেছো । এখন বলো তো, কেমন লাগছে তোমার ? ”
-” ভালো। ” ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলাম আমি। কথা বলতে বড় আলসেমি লাগছে আমার। কেবলি মনে হচ্ছে কী যেন একটা ভুলে যাচ্ছি। কী যেন একটা মনে পড়ছে না।

পরবর্তী এক ঘন্টার মধ্যে ডাক্তার সহ বাবা, প্রীতি, রবিন এসে দেখা করে গেলো । কিন্তু মনের তৃষ্ণা মিটলো না। অবচেতন মনটা এমন কাউকে খুঁজছে যাকে সে মনে করতে পারছেনা। আসলে সে জানেই না যে, কাকে খুঁজছে । খোলা জানালার দিকে তাকালাম। জানালা দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে আমার বিছানায়। আজ আমাকে কিছুটা আধশোয়া করে বসানো হয়েছে। একটু আগেই আমার মাস্কটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ডাক্তার বলে গেছেন। আগামী কয়েক ঘন্টা স্যাচুরেশন নাম্বার ঠিক থাকলে নাকেরটাও খুলে ফেলবেন। আমি চির অভ্যেসবশত: আলতো হাতে নিজের চুলগুলোয় হাত বুলালাম। আর ঠিক তখনই ধাঁ করে বিদ্যুত চমকের মতো মনে পড়ে গেলো একটা ভয়াবহ মুহূর্তের কথা। যে মুহূর্তে আমাদের বাসটা পড়ে যাচ্ছিলো। আমি তখন বাসের ভেতর ছিলাম। বাসের ভেতরের সমস্বরের চিৎকারে পরিবেশটা তখন নরকতূল্য মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আমি তো সেখানে একা ছিলাম না। আমার শার্ট খামচে ধরে রেখেছিলো একজন। আমার খুব আপন কেউ। কিন্তু এতো দুরের কেন মনে হচ্ছে ওকে ! সে হঠাৎ ছিটকে সরে গিয়েছিলো আমার বুক থেকে। আর সে ছিলো একটা মেয়ে….! ”
-” ওহ্….!” মাথাটা হঠাৎ চাপ দিয়ে ব্যথা করে উঠলো আমার। মনে হলো ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছিনা। কয়েকবারের চেষ্টাতেই হাঁপিয়ে উঠলাম।
একটু জোরের সাথেই ডাকলাম, ” মা ! আম্মা ? ”
আমার ডাক শোনামাত্রই আম্মা ছুটে এলো। আমাকে অস্থির হতে দেখে দ্রুত ডাক্তার ডাকতে বললো। আমি তখন সমানে গা মোচরাচ্ছি। পায়ের কাফ মাসলগুলো যেন খিঁচ ধরে গেছে। পা গুলো সবেগে শূণ্যে ছুঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। হয়ত ছুঁড়ছিও। বলতে পারবো না। কেবল বুঝতে পারছি, সমস্ত শরীরে এক নিদারুণ অস্বস্তি। তার একটু পরেই টের পেলাম কয়েকজন মানুষ আমাকে নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করে দিয়েছে। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা। একসময় বিষম ক্লান্তি এসে গ্রাস করলো আমাকে। ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যাবার আগে অজান্তেই ডাকলাম, ” রুমু…!”

=====

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বা বেহুঁশ ছিলাম তা বলতে পারবোনা। তবে এবার আর চোখ খুলতে বেশী বেগ পেতে হলো না। চোখ মেলার সাথে সাথেই একে একে মনে পড়ে গেলো সবকিছু। মনে পড়লো নিজের দুর্ভাগ্যের কথা। মনে পড়লো ঝিনেদা থেকে বাসে করে ঢাকা আসছিলাম আমরা। আমি আর রুমকি। হ্যাঁ, রুমকি। আমার হঠাৎ পাওয়া ভালোবাসা। যাকে খুঁজে ফিরছিলাম এক জীবন ধরে। আর সে মিলে গিয়েছিলো কোন এক কঠিন অবসরে। তখন আমি বোকার মতো নায়লার এ্যাফেয়ারকে প্রেম ভেবে নিজেকে উৎসর্গ করতে বসেছিলাম। ঠিক সেরকমই একটা দ্বিধামনস্ক মুহূর্তে আমার সাথে রুমকির পরিচয়। পরিচয় তো নয়, সোজা বিয়ে। মাত্র কয়েক ঘন্টার পরিচয়েই ধরে সোজা বাসরঘরে। আমি তখন কঠিন ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি নায়লার কথা বলার জন্য। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেরাতে আমরা গল্প করে কাটিয়েছিলাম। গল্পের কথক ছিলো রুমকি একা আর আমি ছিলাম মুগ্ধ শ্রোতা। ভাবনাটা কলজে খামচে ধরলো আমার।
সভয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, ” রুমকি কোথায় এখন ? সে কি তবে মারা গেছে ? আর কোনোদিন ঐ জোড়া দাঁতের হাসি আমি দেখতে পাবো না ? আপনা হতেই চোখটা জলে ভরে এলো। বুকটা ভেঙ্গে আসতে চাইলো আমার। সম্ভবত আমার দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। আমি টের পাইনি। কারণ অনুভূতিগুলো সব এখন রুমকির স্মৃতিচারণে ব্যস্ত। তখনি নায়লার কণ্ঠ পেলাম।
-” কাঁদছো কেন ঋভূ ? ” কোমল সুরে বলছে নায়লা। সেদিকে তাকিয়ে নিজেকে কোনমতে সামলে নিলাম। রুদ্ধশ্বাসে বললাম, ” রুমকির কী খবর নায়লা ? ও কেমন আছে ? ও তো আমার সাথেই ছিলো। ওর কী অবস্থা নায়লা ?” ভয় পাওয়া গলার বললাম ।

নায়লা খানিক থমকে গিয়ে বললো, ” রুমকির কথা এখনও মনে আছে তোমার ? সে তো তোমার জীবনের এক কালো অধ্যায়। বিয়ে করে একটা মাসও গত হয়নি এরই মধ্যে কত দুর্ঘটনা ! আঙ্কেলের স্ট্রোক, প্রীতির বিয়ে ভাঙ্গা, তোমার আমার ভুল বোঝাবুঝি, সর্বোপরি এই ভয়ংকর রোড একসিডেন্ট। এরপরেও মেয়েটার নাম উচ্চারণ করো কিভাবে ? ধরে নাও, রুমকি মরে গেছে। ব্যস, কেচ্ছা শেষ।” শেষ লাইনটা যেন আমাকে চাবুকের মতো আঘাত করলো। মনে পড়লো রুমকির ব্যপারে নায়লার আচরণগুলো। রাগে কষ্টে কথা বন্ধ হয়ে এলো আমার। ধরে নাও মরে গেছে কথাটার মানে কী ? এটা কী ধরণের কথা !
ক্লান্ত স্বরে বললাম, ” আম্মুকে ডাকো।” নায়লা আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, কী বলবে আমাকে বলো। আমি তো তোমার সামনে আছি। তোমার এতোবড় বিপদ দেখে থাকতে পারিনি। ঠিকই চলে এসেছি। চেয়েও অকৃতজ্ঞ হতে পারিনি।”
-” কেন এসেছ সেটাও বলো? ” রাগে মুখ দিয়ে আপনা হতেই উচ্চারিত হলো আমার। নায়লা বিস্মিত।
সে আহত স্বরে বললো, ” কেন এসেছি তুমি বোঝো না ? ”
-” না বুঝিনা। এবার আমার আম্মাকে একটু ডেকে দাও প্লিজ।”
-” দেবো, তার আগে বলো। তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো ? ”
-” কিসের ক্ষমা ? ”
-” সেদিন তোমার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তোমাকে অপমান করার জন্য ক্ষমা। সত্যি বলতে সেদিন রুমকির সতীন হতে বলায় মাথাটা চড়ে গিয়েছিলো তাই ব্রেকাপ করে ফেলি। কিন্তু আজ তোমার…!”
-” কিন্তু আজ আমি তোমাকে ফিরিয়ে নেব কে বললো ? ”
-” ঋভূ, আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি ঋভূ।”
-” ভুল। এটা কোনো ভালোবাসা ছিলো না। আমরা পরস্পরকে মোটেও ভালোবাসিনা। ভালোবাসা এমন হয় না। এটা একটা এ্যাফেয়ার ছিলো যা আমরা দুজনেই বোঝার মতো কেবল বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। তারপরেও সম্পর্কের দায় এড়াতে চাইনি বলেই তোমাকে প্রস্তাব করেছিলাম। বাট ইউ ইগনরড মি।”

-” আজ আমি নিজেই সেই প্রস্তাব গ্রহন করতে চাই। রুমকি বেঁচে ফিরুক বা না ফিরক। …!” বলেই থেমে গেলো নায়লা। কিন্তু ততক্ষণে আমার অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে। আমি বললাম, ” কী বললে তুমি ? ইউ মিন টু সে, রুমকি বেঁচে আছে ? ভালো আছে ? ”
নায়লা আমতা আমতা করে বললো, ” না মানে। না থাকার সম্ভাবনাই….!”
-” আচ্ছা, আমার আম্মুকে ডাকছো না কেন তুমি বলোতো ? তোমাকে তো বেশ কয়েক বার বলেছি যে আম্মুকে ডাকো।”
-” আগে আমাদের কথা শেষ হোক তারপর! ‘

নায়লার কথা শেষ হবার আগেই আমার অক্ষত হাতটা দিয়ে মিটসেফে রাখা গ্লাসটা ধরেই ছুঁড়ে মারলাম টাইলসের দেয়ালে। গ্লাস ভাঙ্গার শব্দে ছুটে এলেন আম্মু। নায়লা তখন হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি আম্মুকে দেখেই আমার বাম হাত বাড়িয়ে দিলাম। আম্মু প্রায় ছোঁ মেরে আমার হাত ধরে আমার কাছে এলেন, ” কী হয়েছে বাবা ? গ্লাস ভাঙ্গলো কী করে ? ”
আমি সে কথার জবাব না দিয়ে বললাম, ” আম্মু রুমকী কোথায়? ”
আম্মু থেমে গেলেন। বোকার মতো একবার নায়লার দিকে তাকিয়ে তারপর আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ” শুনলে তুই কষ্ট পাবি বাবা।”
-” কষ্ট পাবো ? কেন ? রুমকি কী মারা গেছে মা ? ”
-” না, এটা সঠিক জানিনা। তবে তোর বাবা বললো, যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে একজন মাত্র মহিলা৷ ছিলেন । আর ঐ মহিলার লাশও নাকি ওর আত্মীয়রা নিয়ে গেছে। বাকি সব মহিলা জীবিত। সে হিসেবে হয়তো রুমকি বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু তোর বাবা ওকে দেখেনি। তোর তখন অবস্থা এতো বেশী খারাপ যে তোর বাবা আর ডানে বামে তাকাবার সময় পায়নি। তোকে নিয়ে ঢাকা ছুটে এসেছে।”
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে। মা এখনও আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে কীসব বলে চলেছেন। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা। রুমকি এখন তাহলে কোথায় ? কী অবস্থায় আছে।

পরদিন ডাক্তার এসে দেখে গেলেন। আমার পালস বিপি স্যাচুরেশন সব কিছু চেক করে মনে হলো তিনি সন্তুষ্ট। নাক থেকে অক্সিজেনের পাইপ খুলে আমার দিকে তাকালেন।
-” ব্রিদিং এ কোনো প্রবলেম হয় ? ”
-” অজান্তেই স্বাভাবিকের চেয়ে দুবার শ্বাস বেশী টানলাম। হালকা চাপ পড়লো বুকে। মাথা নাড়লাম আমি। বললাম, ” সামান্য।”
শুনে ওটা জায়গামতো বসিয়ে দিয়ে বললেন,
-” ওটা এক্সারসাইজ করে ঠিক করতে হবে। আপাতত আমি ফ্লো কমিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এটা থাকবে। বিকেলে নার্স এলে এটা খুলে দেবে। তখন কেবিনের বারান্দায় হাঁটবেন দশ মিনিট। লম্বা করে শ্বাস নেবেন না। ছোট ছোট শ্বাস নেবেন ফেলবেন। ফুসফুসের ওপর বেশী চাপ দেবার দরকার নেই। বাই দা ওয়ে, আপনি কী নামাজ পড়েন ? ”
– ” জি, তবে এই কদিন পড়িনি।’
-” আজ পড়বেন। আর সিজদায় একটু বেশী সময় থাকার চেষ্টা করবেন। এসময় ফুসফুস খুব ভালো অবস্থায় থাকে। সম্পূর্ণ সংকুচিত হয় বলে পুরো বাতাসটা সে টেনে নিতে পারে। ইটস আ গুড প্রাকটিস ফর ব্রিদিং।”
-” আমি জার্নি করতে পারবো কবে ডক্টর?” মরিয়া হয়ে বলে ফেললাম কথাটা। ডাক্তার বিস্মিত। চেঁচিয়ে ইঠলেন প্রায়।
-” পাগল হয়েছেন ? আপনার মাথার আঘাতটা বেশ গুরুতর। আমরা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। থ্যাঙ্কস গড যে আপনার সেরেব্রাম অক্ষত আছে। তবে এটা ঠিক প্রচন্ড ঝাঁকি খেয়েছিলেন আপনি।”
-” আমাকে ঝিনাইদহ যেতে হবে ডক্টর। টু ফাইন্ড মাই ওয়াইফ !” ডাক্তারের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বললাম।
-” ওহ নো নো….এখন তো একদম না। জার্নির ধকল নেবার মতো ফিজিকাল কনডিশন এখন আপনার নেই।”

প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে ডাক্তার চলে গেলেন। নায়লা তখনও রুমের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে।
আমি আম্মুকে বললাম, ” মা আমি একটু একা থাকতে চাচ্ছি। ”
-” আচ্ছা, তুই বিশ্রাম নে। আমরা বারান্দায় যাচ্ছি।” বলেই আম্মু বেরিয়ে গেলেন। নায়লা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সেও বেরিয়ে গেলো। আমি মনে মনে হতাশায় ভেঙ্গে পড়লাম প্রায়। বুকের ভেতর এক অশান্তির দাবানল অথচ আমি কী নির্বিকার মুখ করে বসে আছি। এক লহমার জন্য মনে হলো সব ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে যাই রুম থেকে। কারো কোনো বাধা না মেনে। একটা সময় বাংলা সিনেমায় দেখতাম, নায়করা হাসপাতালে পড়ে থাকতো। আর জ্ঞান ফিরলেই স্যালাইন ছিঁড়ে, ক্যানুলা টেনে খুলে ফেলে এক বজ্র হুঙ্কারে চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে পড়তো নায়িকাকে উদ্ধার করতে। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে যেন ঐ ভূমিকায় দেখতে পেলাম আমি। তাদের মর্মবেদনা আজ নিজ মরমে উপলব্ধি করতে পারলাম যেন। তবে এটাও সত্যি, এতো বড় একটা কষ্টকে তারা কোনোদিনই কষ্টদায়ক করে উপস্থাপন করতে পারেনি বরং পুরো ব্যপারটাকে হাস্যকর করে ফেলতো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় কাত হলাম। কষ্ট আর হতাশায় আকণ্ঠ ডুবে যাবার আগ মুহূর্তে অস্ফুটে কেবল এতোটুকুই বলতে পারলাম, ” রুমকি। কোথায় তুমি? ভালো আছো তো রুমু।” একইসাথে অন্তর নিংড়ানাে দু’আ করলাম, ইয়া আল্লাহ। আমার রুমুকে যেখানেই রাখো। সুস্থ রেখো। সম্মানের সাথে রেখো।”

চলবে….

#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

২৫||
মেয়েকে বুকের সাথে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলেন রুমকির মা। রুমকিও ছোট্ট কিশোরীর মতো লেপ্টে রইলো মায়ের বুকের মাঝে। যেন কত বছর পর মা’কে ফিরে পেয়েছে সে। মা মেয়ের মিলনদৃশ্যে চোখের জল ধরে রাখতে পারেন নি বাবা আব্দুল্লাহ। তিনি খাটের অপর পাশে বসে ঘনঘন চোখ মুছে যাচ্ছেন। তিনজনের এই নিরবতার মাঝেই নিজেদের অনেক কথা বলা হয়ে গেছে তাদের। একসময় লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ খুললেন আব্দুল্লাহ হুজুর ।
-” আমি তো অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রে মা। থানা থেইকে যখন বললো, আমাগের কোনো আত্মীয় গেছে তোরে আনতি। সেই তখনই চিন্তায় পইড়ে গেসিলাম। আমি বলি, এ আবার কুন ফেউ। পরে নুরুদ্দিন ভাই সাহস দিলে সেখানে গেলাম। গিয়ে তো আল্লাহর রহমতে তোরে পেয়ে গেলাম।”
-” হ্যাঁ, আব্বা। আপনারা আসার আগের দিন রাতেই একজন গিয়েছিলো আমাকে নিতে ! সে ওখানে সবাইকে পরিচয় দিচ্ছিলো আমার আত্মীয় বলে।” বলতে বলতে রুমকি মা’কে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। ওর নাকের পাতা সামান্য ফুলে উঠতে দেখা গেলো এবার। কঠিন স্বরে বললো, ” পরে বুঝলাম, এটা তোমার বোন পো’র লোক। আজাদ ভাই একটা লোক পাঠিয়েছিলো আমাকে নিতে। ”
-” কস কী ? আজাদের লোক ছিলো ঐটে ?”
-“হ্যাঁ , আব্বা। লোকটা তো সেটাই বললো। আমি প্রথমে তার সামনে যাইনি। কোহিনুরকে দিয়েই খবর পাঠিয়েছি যে কোনো গায়ের মাহরামের সাথে দেখা করবো না। পরে কোহিনুরের বাঁকা বাঁকা কথা শুনে বুঝলাম ওকে হয়ত কিছু টাকা পয়সা দেয়া হয়েছে। কারণ মহিলা আমাকে বোঝাতে বদ্ধপরিকর ছিলো। সে নানা ভাবে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিলো যে আমি যদি ঐ লোকের সাথে না যাই তাহলে পুলিশ আমাকে জেলে ভরে রাখবে অথবা মহিলা শোধনাগারে দিয়ে দেবে তখন সেটা নাকি আরো মানবেতর জীবন হবে আমার। তারপরেও আমি সাফ জানিয়ে দেই যে, আমি অপরিচিত কারো সাথে যাবো না। আর সে আজাদের লোক হলে তো আরো যাবো না। পরে মহিলা রাগ করে সরে যায়।”
-” খুব ভালো করেছিস ওর সাথে না গিয়ে। আমি শুধু আজাদের শয়তানিটা চিন্তা করি। ওরে সামনে পাইলে এইবার আমি লাঠিপেটা করব। হারামজাদা ছোটকাল থাইকেই জ্বালিয়ে আসতিসে। এ তো আল্লাহর রহমত যে আমরা সময়মতো পৌঁছে গিইসি। নাইলে পরে গেলে কী যে হতো।”
-” না আব্বা। আপনারা না আসলেও আমি ঐ লোকের সাথে যেতাম না। ঐ মহিলার টোনেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে সে সহজ মানুষ না। কারণ প্রথম দিনই টের পেয়েছি যে আমার হাতের দুটো আংটিই গায়েব। একটা ছিলো আমার বিয়ের আগের। ওটা খোলা সহজ ছিলো না। সবসময় পড়ে থাকতে থাকতে আঙ্গুলে চেপে বসে গিয়েছিলো। কসরত করে খুলতে হতো। ঐটাও সে খুলে নিয়েছে। আপনা হতে খুলে পড়ার আংটি ওটা না। তখনই যা বোঝার বুঝে নিয়েছি আব্বা। লোভী মানুষের ঈমান মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে যায়। ঐ মহিলা উপকার করলে কী হবে আব্বা। তার লোভটা বড্ড বেশী। তাই লিটন সমাদ্দার নামের চামচাটা যেন তাকে দিয়ে অন্যভাবে চেষ্টা করতে না পারে সে কারণেই স্থির করেছিলাম মহিলাকে লোভ দেখাবো। আমার নিজের জমানো যে টাকাগুলো আছে তার সবটাই আমি ওকে দিয়ে দেবো বলে ভেবেছি। তবু যেন সে আমাকে লিটনের হাতে তুলে না দেয়। এসব পরিকল্পনা করার সময়েই তোমরা চলে এলে।” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রুমকি।
কিছুক্ষণ নিরব থেকে মুখ নামিয়ে বললো,
-” একটা সত্যি কথা বলবেন আব্বা ? ”
-” কী কথা মা ? ”
-” রূপমের অবস্থা কী অনেক বেশী খারাপ?” রুমকির কণ্ঠে বিষন্নতা। ব্যথা বিধুর কাতরতা।
আব্দুল্লা হুজুর কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন, ” হ। অনেক খারাপ ছিলো। তাই বইলেই তো তোর শ্বশুর তোরে ফালায়ে থুয়ে ছেলে নিয়ে দৌড় দিসে। ”
-” আমি রূপমের কাছে যাবো আব্বা।”
-” কী দরকার মা। তুই সাইধে কেন যাবি ? তোর শ্বশুর তোর জন্যে একটা ফোন দিসে না খোঁজ নিয়েছে ? ওরা নিজে থেইকে না আসলি পরে তো আমি তোরে যাইতে দেব না মা।”
-” এটা কেমন কথা বলেন আপনি? ” রুমকির মা তেতে উঠলেন। এতোক্ষণ নিরবই ছিলেন তিনি। এবার সরব হলেন।
– ” মেইয়ে বিয়ে দিসি আমরা সেখানে। তারে ঘরে আটকায়ে থুইবেন কী করতে। আজাদ আবার কেওয়াজ বাধালে তখন কী করবেন? ”
-” এইবার কেওয়াজ বাঁধালি পরে ওর খবর আছে। এবার আর ওরে ছাইড়ে দেবো না আমি। কিন্তু রুমিরে যাইতি দিবো না। তারা নিজে থাইকে আইসে মেয়ে নিয়ি যাবে। আমার মেইয়ে পানিতে পড়ে যায় নাই। তার ছেলের দাম আছে, আমার মেয়ের দাম নাই ? আগে জামাইরে সাইরে উঠতে দ্যাও। সে নিজেই খোঁজখবর করবে। তাছাড়া রূমকির এভাবে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। মহিউদ্দিনের কাছে আমি এটা আশা করিনি। ও আমার সাথে যেটা কইরেছে এটা আমি ওর কাছ থাইকে মোটেই আশা করিনাই।” আব্দুল্লাহ হুজুরকে অস্থির দেখালো। ওরা মা মেয়ে দুজনেই থেমে গেলো। এরপর আর কথা আর বেশী এগুলো না। আব্দুল্লাহ উঠে চলে গেলেন।
রুমকি ব্যথিত চোখে বাবার চলে যাওয়া দেখলো। বোঝা যাচ্ছে ছেলেবেলার বন্ধুর আচরণ তাকে প্রচন্ড কষ্ট দিয়েছে। এজন্যই অভিমানাহত তিনি। কিন্তু তার অভিমান যে রুমকির জন্য জান নিয়ে টানাটানির অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রুপম হাসপাতালে আছে শোনার পর থেকে পাখি হয়ে উড়ে ওর কাছে চলে যেতে মন চাইছে। কিন্তু বাবার জন্য আটকা পড়ে গেছে ও নয়তো আজ রাতেই বাবাকে নিয়ে রওনা দিয়ে দিতো। আচ্ছা, রূপম কেমন আছে এখন ? সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস পড়লো রুমকির। রূপমের কথা মনে পড়ছে। ভীষণ রকম উদাস হয়ে যাচ্ছে মনটা ।

======

হালকা একটা ঝাঁকুনি লেগে তন্দ্রা টুটে গেলো আজাদের। কখন যে চোখটা লেগে গিয়েছে টেরই পায়নি সে। রাত তিনটার দিকে ফ্রেশ হয়ে দুজনেই শুয়ে পড়েছিলো। ভ্রমনের ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন ছিলো দুজনেই। ঘুমিয়ে পড়তে দেরী হয়নি।

চোখ মেলে কয়েক সেকেন্ড সিলিং ফ্যান দেখলো আজাদ। মনে পড়লো সে এখন অনেকটা নিরাপদ জায়গায় সরে এসেছে যা ওর শত্রুদের ধারণার বাইরে। এখন ওকে খুঁজতে হলে নতুন করে খোঁজ আরম্ভ করতে হবে। কিন্তু এবার আজাদ ওদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে এবার আর আম্মাকে ফোন দেবেনা সে। বলা যায়না ফোন ট্যাপ করেও রাখতে পারে। আর না করলেও আম্মাকে বিশ্বাস নেই। কোনো না কোনো ভাবে খবর ঠিকই লিক করে দেবেন উনি। আর শুধু একটা কলই করবে আজাদ। এস. আই আজিমকে। না পেলে মামুনকে। সেখান থেকে জানবে রুমকির বর্তমান অবস্থা। ব্যস্, তারপর কয়েকদিনের জন্য ডুব দেবে তার নবপরিণীতাকে নিয়ে। তখন শুরু হবে আসল হানিমুন। অদিতিকে জানাবে আজাদ আসলে কতোটা প্রেমিক পুরুষ। গত কয়েকদিন বেচারী যে আজাদকে পেয়েছে সে এক ছন্নছাড়া । আজ থেকে সে পাবে প্রেমিক আজাদকে। যে ভালোবাসতে জানে, ভালোবাসা শেখাতে জানে।

দু চোখ মুদে গভীর একটা শ্বাস ফেললো আজাদ। সারা শরীরে এক আরামদায়ক আলস্য। পা দুটো টানটান করে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গতেই সমস্ত শরীর মন একসাথে রোমাঞ্চিত হলো। মন আপনা হতেই গেয়ে উঠলো, ” এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।”
মুচকি হেসে পাশ ফিরে অদিতিকে নিজের কাছে টানার জন্য হাত বাড়িয়েও থমকে গেলো। অদিতির জায়গাটা খালি। কিছুটা চমকে গেলো তারপর হতাশ হয়ে পাশ বালিশটাকে আঁকড়ে ধরেই তাতেই মুখ ডুবিয়ে পড়ে রইলো খানিকক্ষণ। বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে ওভাবে পড়ে থাকার পর হঠাৎ মুখ তুলে বাথরুমের দরজার দিকে তাকালো আজাদ। বিরক্তির চিহ্ন কপালে। কী আশ্চর্য, অদিতি কী করছে এতোক্ষণ ওখানে ? ফের মুখ গুঁজে চোখ মুদে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা চললো। এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। উঠে বসে ডাক দিলো, ” অদিতিইই….?”

সাড়া না পেয়ে নিজেই উঠে গিয়ে বাথরুমের দরজায় টোকা দিলো। আর তখনই টের পেলো দরজাটা আসলে খোলা। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দরজাটা হালকা ধাক্কা দিতেই হাট করে খুলে গেলো সেটা। বাথরুম খালি। বোকার মতো কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে পুরো রুমের দিকে তাকালো সে। বারো ফুট বাই চৌদ্দ ফুটের মাঝারি রুমটাতে একটা খাট আর টেবিলটা ছাড়া আর কিছুই নেই । দেয়ালে একটা আলমারি বসানো আছে যেটা ওরা নিজেরাই খোলেনি। কারণ ওতে রাখবার মতো কিছু ওদের কাছে নেই। তাছাড়া ওরা কোনো লাগেজও আনেনি সাথে। কুয়াকাটায় কেনা হালকা কাপড়ের ব্যাগটায় ওর দুটো হাফ প্যান্ট ছাড়া আর কিছু নেই। ওটা বিছানার ওপরেই পড়ে আছে এখনও। তাহলে অদিতি কোথায় ? অদিতি নিশ্চয়ই ঐ আলমিরাতে লুকিয়ে নেই ? আনমনেই সেদিকে তাকালো আজাদ। হতবিহ্বল পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো । মাথা যেন কাজ করছে না ওর। অদিতি তবে গেলো কোথায় ? আর সে ওকে না বলে যাবেই বা কেন। এখানে তো কাউকেই চেনে না সে। তাছাড়া এই সাত সকালে ওর বাইরে যাবার এমন কী দরকার পড়লো । কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলো আজাদ। চুলে হাত বোলালো। কিছুই বুঝে আসছে না ওর।

ওরা এখন আছে চট্টগ্রামের একটা অখ্যাত রেস্তোরায়। গতকাল মাঝরাতেই ওরা চট্টগ্রাম এসে পৌঁছেছে। আজাদের ইচ্ছে ছিলো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাতেই রাঙামাটির বাস ধরবে। কিন্তু অদিতিই জানিয়েছিলো যে ওর কিছু পার্সোনাল সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাতেই রওনা দিলে ওর সমস্যা হবে। কাজেই রাতটা কোথাও কাটিয়ে সকালে যেন রওয়ানা দেয় আজাদ। অবশেষে ওর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েই চট্টগ্রামের এই হোটেলটা তে উঠেছে আজাদ। খুবই সস্তাদরের হোটেল। কিন্তু আজাদের জন্য ভালো। সামান্য ভয় ছিলো অদিতিকে নিয়ে কিন্তু মেয়েটা এবার আর নাট সিঁটকায়নি। চুপচাপ শান্ত ভঙ্গিতে ওর সাথে রুমে এসেছে। বোরকা নিকাব খুলে বাতাসে হ্যাঙ্গারে মেলে দিয়েছে তারপর চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। আজাদ ধরেই নিয়েছিলো যে জার্ণির কারণে হয়তো ক্লান্ত তাই বেশী ঘাঁটায়নি। এখন মনে পড়লো মেয়েটা গতকাল বাস থেকেই অস্বাভাবিক রকম শান্ত হয়ে ছিলো। বিশেষ করে শেষবারের কথোপকথনের পর। তার মানে কী অদিতি ঐ কথাটায় রাগ করেছে? কই, আজাদ তো টের পায়নি। বরং ওকে নিরব দেখে নানা ভাবে ওর মন বোঝার চেষ্টা করেছিলো সে। কিন্তু মেয়েটা কোনোভাবেই ওকে কিছু বুঝতে দেয়নি। বরং স্বাভাবিক ভাবেই ওর প্রতিটা কথার উত্তর দিয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হয়তো অদিতি ওর কথায় কষ্ট পেয়েছে। কারণ আজাদ রুমকির ব্যপারে ঐ কথাটা ওভাবে সরাসরি বলে ফেলেছে। আজাদের ভাবা উচিত ছিলো অদিতি ওর স্ত্রী। প্রেমিকা নয়। আর স্ত্রী হিসেবে অদিতির রাগ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আজাদ তো এটা ইচ্ছে করেই করেছিলো। কারণ ওকে রাগাতে ভালো লাগছিলো ওর। মনে মনে ভেবে রেখেছিলো, একটা জায়গায় থিতু হবার পর আয়েশ করে ওর মান ভাঙাবে। কিন্তু অদিতি যে এতোটা রেগে যাবে বুঝতেই পারেনি আজাদ।
মনটা হঠাৎই হু হু করে উঠলো ওর। কী মনে হতেই ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে দরোজা খুলে নিচে কাউন্টারে নামলো সে। সেখানে খোঁজ নিতেই জানতে পারলো, একজন বোরকা পরিহিতা মহিলা সকাল বেলায় বাইরে গিয়েছে। কোন রুমের বোর্ডার জানতে চাইলে মহিলা আজাদের রুমের নাম্বার বলেছে আর জানিয়েছে যে রুমে তার স্বামী ঘুমিয়ে আছে। সে একটা বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে যাচ্ছে।

ম্যানেজারের মুখে সব শোনার পর আজাদ পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেলো এবার। এমনটা যে হবে তা সে কোনোদিনই ভাবেনি। অদিতি ওকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু কোথায় গেলো সে। কিছুই তো চেনেনা সে এখানকার। আর যাবেই বা কোথায় ? এখানে কে আছে ওর। পায়ে পায়ে নিজের রুমে ফিরে এলো আজাদ। হঠাৎ প্রচন্ড রাগ হলো ওর নিজের ওপর। একই সাথে কষ্টও। কী দরকার ছিলো মেয়েটাকে ঐভাবে কথাটা বলার। সবারই একটা নিজস্ব সেল্ফ রেসপেক্ট থাকে। অদিতির মতো মেয়ের সেল্ফ রেসপেক্ট তো আরো চোখা। কতটা আস্থাশীল ভাবলে মেয়েটা ওর মতো একটা বাউন্ডুলেকে সরাসরি বিয়ের জন্য প্ররোচিত করে। নাহ্, অদিতির ব্যপারে একটা বড় ভুল হয়ে গেছে। এটা রুমকি না যে ফিঁচফিঁচ করে কাঁদবে আর ফুলদানী ছুঁড়ে মারবে। রুমকীকে একদিন প্রচন্ড ক্ষেপিয়ে দিয়েছিলো। সেদিন ও পেতলের ফুলদানী ছুঁড়ে মেরেছিলো ওর দিকে। ইস্, অদিতিও নাহয় তাই করতো। না বলে চলে গেলো কেন।
উত্তরটা নিজের মনেই খুঁজে নিলো আজাদ। আসলে অদিতি একটা আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন একটা মেয়ে। আর রুমকিও তাই। এটা আজাদের ব্যর্থতা যে সে দুজনের কাউকেই ধরে রাখতে পারলো না।
অজান্তেই নিজের বাম হাতের তালুতে ডান হাত মুঠো পাকিয়ে প্রচন্ড কিল বসালো। নিজের ওপরই রাগে ফুঁসতে লাগলো সে। অক্ষম এক আক্রোশে তড়পাতে লাগলো বেচারা।

ধপ করে বিছানায় বসে অসহায়ের মতো মোবাইলটা টেনে নিলো। কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা আজাদ। আহ্, একটা ফোনও যদি করতো অদিতি। তাহলে স্যরি বলতে পারতো আজাদ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইলটা সরিয়ে রেখে ভাবতে বসলো । কোথায় যেতে পারে অদিতি। ও কী ওর ওপর রাগ করে ঢাকায় ফিরে গেলো ? নাকি অন্য কোথাও ? একা একটা মেয়ে অন্য কোথায়ই বা যাবে । দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠতে যাবার মুহূর্তেই ফোনটা বেজে উঠল। চমকে উঠে রীতিমত হামলে পড়লো ফোনের উপর। কে করেছে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না। অস্থিরচিত্তে বলে উঠলো, ” হ্যালো অদিতি…?”

-” কী রে শালা *** ? বহুত মৌজে আছিস দেখা যায় ? আর থাকবি নাই বা কেন ? তোর ডানে অদিতি, বামে অদিতি, উপরে অদিতি, নিচে….!”
-” বাপের পুত হলে সামনে এসে কথা বল। মায়ের আঁচলের নিচ থেকে ওরকম হালুম আমি নিজেই ছোটবেলায় বহুত করেছি। এখন আর পোলাপানের সাথে খেলিনা। তোর বাপেরে ফোন দে মামদার পো। আমি তার সাথেই কথা বলবো। ফিউজেজ বাল্বের সাথে আমি কথা বলিনা। শালা পাতি মাস্তান। বাপের নামে কুঁদিস। বাপ ছাড়া ফিউজ তোরা। আজাদ মুনতাসিরের সাথে কুঁদার বয়স হয়নি তোর। অদিতি কোথায় সেটা আগে বল ? ” আজাদের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। কী বলছে ভেবে দেখলো না।
ওপাশে কয়েক সেকেন্ডের নিরবতা। তারপরই লিটন সমাদ্দারের কণ্ঠ শোনা গেলো, ” অদিতিরে নিজের পকেটে ঢুকায়ে এখন আমারে জিগাস অদিতি কই ? শালা বাটপার। পাঁচ লাখ টাকা নিইছিস তো নিইছিস, লগে আমার মামাতো বোনটারেও বগলদাবা কইরেছিস। এহন আবার নখরা দেখানো হচ্ছে ? ”

আজাদ থেমে গেলো। অদিতিকে তাহলে লিটন নিয়ে যায়নি। তাহলে মেয়েটা গেলো কোথায় ? কিছু বলার আগেই শুনলো লিটন সমাদ্দারের চ্যালেঞ্জ।
-” এই শোন। যেটা বলার জন্য তোরে ফোন দিয়েছি। ভয়ের চোটে তো ফোন বন্ধ করে রাখোস। তাই এস আই মামুনের ফোন থেকে তোরে ফোন দিসি। তোর এক আত্মীয় না একসিডেন করে মরিছে গতপরশু ? যার জন্য দিনে তিনবার থানায় ফোন করে গালমন্দ করিস ? ”
-” কে মারা গেছে ? ” আজাদ পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেলো।
-” নাম তো জানিনে সোনা। তবে তোমার যে আত্মীয়ের লাগি দিনে তিনবার ফোন দ্যাও। সে কিন্তুক আমার হাতের নাগালে আছে। ”
-” মানে ? কে হাতের নাগালে আছে ? তুই আমারে ব্লাফ দিচ্ছিস ? তুই ফোন মামুনের হাতে দে। আমি ওর সাথে কথা বলবো।”
-” ওতে কোনো লাভ হবেনা। তুই আমার কাছে শোন্। তোর মামাতো বোন যে স্বামী নে বাসে করি ঢাকা যাচ্ছিলো সেই বেচারী যে একসিডেন্ট কইরেছে তা তো তুই ভালোই জানিস। তবে তোর মামাতো বোন বাঁইচে থাকলেও তার সোয়ামী কিন্তু মইরেছে। বেচারী এখন বিধবা হয়ে গ্রামে পড়ে আছে। এখন তুই সিদ্ধান্ত নে। ফিরে আইসে মামাতো বোইন সামলাবি না নতুন বউ এর পিছন পড়ে থাকবি। তোর মামাতো বোনটারে দেইখিসি রে…! যা টসটসা…!”
-” ঠিক তোর বোনের মতো। তাই না ? ” রাগে বিশ্রী গালি দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো আজাদ।
ঠান্ডা স্বরে বললো, ” তোর কাছে রুমকিকে যেমন লেগেছে বা অদিতিকে যেমন লাগে এখন থেকে আমার কাছে তোর বোনেরে ঠিক তেমনই লাগবে। হাউজ দ্যাট ? অদিতির কাছেই আমি শুনেছি তোর বোনের কথা..!”
-” তুই শালা পাক্কা হারামী। তোরে যে আমি কেমনে মারুম শালা, খালি সামনে আয়। তোরে গর্তের থন বাইর করুম এবার। আর বাইর যদি না হইছিস তো তোর রুমকিরে আমি খাইসি। কসম করি কইলাম। তোরে আজকের দিনটা সময় দিলাম। বাংলাদেশের যে মাথাতেই আছোস, ভালোমানষির মতো সোজা ঝিনেদা চলি আসবি। তারপরে তোর সাথে সামনা সামনি কথা হবে।” বলেই কট করে ফোনটা কেটে দিলো লিটন। হতাশা এবার পুরোপুরি গ্রাস করলো আজাদকে। রাগ সামলাতে ফোনটা আছড়ে ভাঙ্গতে গিয়েও বিছানায় ছুঁড়ে মারলো আর প্রায় সাথে সাথেই বেজে উঠলো ফোনটা।
দ্রুত কিছুটা ঝুঁকে মোবাইলটা বিছানা থেকে তুলে চোখের সামনে আনলো আজাদ। তখনই দেখলো এটাও একটা আননোওন নাম্বার।

আস্তে করে রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই সমস্ত শরীরে হঠাৎ শীতল এক ঝলক বাতাস ছুঁয়ে গেলো আজাদকে। আহা, এ তো সেই জলতরঙ্গের সুর। আজাদ কাঁপা স্বরে বললো।
-” অদিতি তুমি ? না বলে কোথায় গিয়েছো তুমি? ” ছিটকে বেরোলো কথাগুলো।
– ” কী করছিলে ? ” শান্ত কণ্ঠে বললো অদিতি।
-” তার আগে বলো তুমি কোথায়? ”
-” আমি যেখানে থাকার সেখানেই আছি। তোমাকে বলতে যাবো কেন। তোমাকে তো মুক্ত করে দিয়েই এসেছি।”
-” মানে ? ” থমথমে সুরে বললো আজাদ।
-” মানে সহজ আজাদ। পরিস্থিতির ফেরে পড়ে আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছ তুমি। ভালোবেসে যে করোনি তা গত তিনদিনে জানা হয়ে গেছে আমার।”
-” অদিতি শোনো, এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। তোমাকে ভালো না লাগলে এমনিই বিয়ে করিনি। ”
-” আমি কোনো তর্কে যাবো না আজাদ। কেবল এতোটুকু বুঝেছি। তোমাকে আটকে রাখা অন্যায় হচ্ছে আমার। আমার কারণেই তুমি আজ বিপদে। আমি রাঙামাটি পৌঁছে বড়মামাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেব আমার সিদ্ধান্ত। যেটা বলার জন্য তুমিই আমাকে বাসে ফোন সেধেছিলে। মনে পড়ে ? আমি সেটাই করতে যাচ্ছি। মামাকে ফোন করে জানাবো যে ঐ সম্পত্তি আমার চাই না । তাহলেই তোমার সাথে সমাদ্দারদের সব ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে। তবে চেকটা পারলে লিটনকে দ্রুত ফিরিয়ে দিও। এরপর রুমকিকে নিয়ে সুখে থেকো, বাই।”
-” এক মিনিট অদিতি। তুমি এখন কোথায় বলবে ? ” আজাদকে কিছুটা অস্থির দেখালো।
-” একবারই তো বলেছি তোমাকে বলবো না। বলার জন্য তো আর না বলে চলে আসিনি আজাদ ? ”
-” আমি বাসের ভেঁপু শুনতে পাচ্ছি। তারমানে তুমি বাসস্ট্যান্ডে ?”
-” রাখি আজাদ। ভালো থেকো। ”
-” অদিতি প্লিইজ। রাঙামাটি কোথায় যাচ্ছ তুমি ? তুমি তো জানো না, তোমার ঐ আন্টি কোথায় থাকেন।”
-” কে বলেছে জানিনা ! আমি ভালোভাবেই জানি তিনি কোথায় থাকেন। ওটাতো তোমাকে নিজের কাছে ধরে রাখার জন্য মিথ্যে বলেছিলাম। কারণ জানি তুমি আমাকে নামিয়ে দিয়েই ছুট দেবে। তাই কাছে ধরে রাখতে চেয়েছি। তোমার সাথে ভ্রমনের মজা নিতে চেয়েছি। এখন সেই প্রয়োজনটা নেই। আজ থেকে তুমি বাস্তবিকই আজাদ। আজাদ মানে জানো তো, মুক্তি ।”
-” অদিতি প্লিজ। ডোন্ট গো। আ’ম স্যরি।”
-” আমি তোমাকে কোনোদিনও ভুলবোনা আজাদ। কারণ আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। বাই।”

আজাদ কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেলো এবারও। আজাদ তৎক্ষণাৎ কল ব্যাক করলো অদিতির ফোন নম্বরে কিন্তু ধরলো একটা ছেলে। সে জানালো যে মেয়েটা ওর মোবাইল চেয়ে নিয়ে ফোন করেছিলো সে চলে গেছে। আজাদ ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইলো, ” ভাই এটা কোন জায়গা ? ”
ছেলেটা জায়গার নাম বলে সাথে সাথেই বললো, ” ঐ আপা তো বাসে উঠে গেছে। বাস এখন ছেড়ে দেবে।”
আজাদ স্থবির হয়ে ফোন কানে চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। ছেলেটা ‘রাখি সার’ বলে কল কেটে দিলে হতাশ হয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লো সে।
আফসোসের অনলে পুড়তে শুরু করে দিয়েছে পোড়া মনটা। অদিতিও শেষ পর্যন্ত ওকে ভুল বুঝে চলে গেলো। আজাদ ওকে কী করে জানাবে যে ও কতটা ভালোবাসে ফেলেছে ওকে। জীবনের গভীর এক মুহূর্তে নিছক এক প্রহরের খেলায় অদিতি নামের মেয়েটা আজাদকে কতটা স্বপ্নীল করে তুলেছিলো। এক পরিশুদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলো আজাদকে। আজ নিজেরই ছোট্ট একটা ভুলে সেই সব অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here