এক প্রহরের খেলা, পর্ব:৯

0
309

#এক_প্রহরের_খেলা

মোর্শেদা হোসেন রুবি

{কপিপেস্ট করবেন না}

৯||
ঘন ঘন ভাইব্রেশন আর রিং টোনের শব্দে একসময় ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেল আমার। কনুই এর ভরে সামান্য উঁচু হয়ে মোবাইল হাতে নিলাম। ঘুমের রেশ পুরোপুরি কেটে গেল স্ক্রিণে রুমকির নাম দেখে। কয়েক সেকেন্ড স্থির থেকে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললাম, ” জি, বলেন।”
ওপাশে রুমকি নিরব। হয়ত আমার সম্বোধনের ধরণটা পছন্দ হয়নি। তাৎক্ষণিক ভাবে কোন জবাব এলো না। তারপরই ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। মনটা ছটফট করে উঠল আমার।
দ্রুত সম্বোধন পরিবর্তন করে বললাম, ” আরে ? কাঁদছো কেন…? রুমু…? ”
-” আপনি তখন ফোন ধরেন নি কেন ? আমার ফোন কেটে দিয়েছেন আপনি। এত রাগ করেছেন আমার উপর ? ”
-” আরে পাগল। আমি রাগ করে তো ফোন কাটিনি। ঘুমের ঘোরে কী করেছি নিজেই জানিনা। কিন্তু তুমি আমাকে না বলে চলে গিয়ে কী কাজটা ঠিক করেছ ? ”
-” কী করব বলুন। আপান দেরী করতে চাইলেন না। এদিকে আম্মুর খবর পেয়ে আমি মন খারাপ করছিলাম বলে বাবা আর আম্মা দুজনেই ফোর্স করলেন আপানের সাথে যাবার জন্য। সবমিলিয়ে আমাকে আসতে হয়েছে। কিন্তু আপনিই বা এত দেরী করলেন কেন।”
-” সে অনেক কথা। ” আড়মোড়া ভেঙ্গে চিৎ হলাম। ঘুর্ণায়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-” আমার এক বন্ধুর মা হাসপাতালে। ওনাকে ব্লাড দিতে হল। সেখান থেকে ব্যাক করতে গিয়ে যা দেরী। তোমার আম্মুর কথা বলো, কী অবস্থা উনার ? ”
-” আম্মুর শরীরটা একটু বেশীই খারাপ ঋভু। আজ সন্ধ্যায় ওনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব ঠিক করেছি। এপয়েন্টমেন্ট নেয়া হয়েছে। ”
-” তুমি নাহয় সাথে যাও। বাবা হয়ত সেভাবে গুছিয়ে বলতে পারবেন না।”
-” হম, আমিই যাব ঠিক করেছি। সেটা বলার জন্যই ফোন দিচ্ছিলাম আপনাকে। কারণ না জানিয়ে যাওয়াটা তো ঠিক হত না।” বলে রুমকি নিরব হয়ে গেল। আমি হেসে বললাম,
-” অথচ আমার সাথে দেখা না করেই চলে যাওয়া ঠিক মনে করলে।”

রুমকি কোন জবাব দিলো না একথার। আমি মৃদুস্বরে ডাকলাম, ” রুমু..? ”
-” উঁম…?”
-” এখন কী করব আমি ? ”
-” এখন তো ফজরের টাইম। উঠে ফ্রেশ হয়ে অযু করে মসজিদে যাবেন। আর কী করবেন? ”
-” আমি সেটার কথা বলিনি। কথা ঘুরাও কেন ? গতরাতে কী কথা হয়েছিল আমাদের ? ওখানে গিয়ে সব ভুলে বসে আছ ? ”
-” জি না। কিছুই ভুলিনি। আমি বুধবারেই চলে আসব, আর আপনি এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। বাবা বলে দিয়েছে।”
” যদি না আসি ? ”
-” তাহলে থেকে যাব এখানে। কোনদিন ফিরে যাব না। ”
-” এই নাকি তোমার আমাকে ধরে রাখা। আমি তোমার কাছে না গেলে তুমি আসবেনা ? যদি কোন কারণে আমি না আসতে পারি তাহলে কোনদিনই আসবেনা ?”
-” আমি ঠিক সেকথা মিন করিনি। আচ্ছা, যান। আপনি আসুন বা না আসুন আমি ফিরে আসব। কাউকে না পেলে একাই রওনা দেব।”
-” একদম মাইর খাবা কিন্তু। খবরদার একা কোথাও যাবা না। আমি গিয়ে নিয়ে আসব তোমাকে।”
-” সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে যেতে হবে..!”
-” সেটা তো আম্মা থাকছে। ”
-” হম তা ঠিক। ইয়ে, একটা কথা বলতে চাই ঋভূ।”
-” বলো। ”
-” আমি এখানে বেশিদিন থাকতে চাচ্ছিনা।” রুমকির স্বরে দ্বিধা ফুটল।

আমি সাথে সাথেই বললাম,
-” আমিও চাইনা তুমি বেশিদিন ওখানে থাকো। আজ এক রাতেই আমি কাহিল হয়ে গেছি। পরের দিন কিভাবে থাকব ভাবতে পারছিনা।”
-” ফোনে কথা বলবেন আমার সাথে।”
-” হম, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর চেষ্টা আরকী।”
-” ঘোল খাওয়া ভাল। খারাপ না।”
-” কিন্তু মাথায় ঢালা নিশ্চয়ই ভাল না। তুমি বিহীন একেকটা রাত আমার জন্য পাহাড় সমান।”
-” সবর করতে শিখুন। এতদিন কেমন করে ছিলেন ? ”
-” এতদিন যেভাবে ছিলাম তাকে বেঁচে থাকা বলে না রুমকি। টিকে থাকা বলে। কৈশোরের উদ্দীপনা স্কুল বেঞ্চের শান্ত পরিবেশে মিটতো না ! সেই উদ্দমী মনটার দরকার পড়ত একটি খোলা মাঠের, যেখানে দাপিয়ে বেড়ানো যায়। যেদিন ছুটে বেড়াতে পারতাম সেদিন স্বতস্ফুর্ত মন নিয়ে বাড়ী ফিরতাম। তারুন্যে এসে টের পেলাম মাঠ খেলাধুলা আর আড্ডার পাশাপাশি সম্পূর্ণ অচেনা একটা তৃষ্ণার জন্ম নিয়েছে বুকের ভেতর। যা কোন খেলা আড্ডা বা গান, নাটক সিনেমা মিটাতে পারছে না বরং গানটান শুনলে বুকটা আরো হু হু করে উঠত। যৌবনের দিনগুলোতে উদাসী বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে একদিন পিপাসার প্রথম টানে যা পান করলাম তা মনের পিপাসা কিছুটা নিবারণ করলেও তৃষ্ণা পুরোপুরি মেটাতে পারল না। তারপরেও পিপাসার টানে বারবারই ছুটে যাওয়া। তোমার কাছাকাছি যাবার পর বুঝতে পারলাম মনের পিপাসা আসলে এতদিন মিটেইনি বরং দমন হয়ে রয়েছে। অনেকটা পানির পিপাসার্তকে ঝাঁঝালো কোল্ড ড্রিঙ্কস পান করিয়ে দিলে যা হয় আরকি। আমিও বেকুবের মত গত কয়েকটি বছর ধরে ঝাঁঝাল ড্রিঙ্কস পান করে চলেছি পানির তৃষ্ণা মেটাতে আর ঐদিকে আমার প্যারেন্টস কখনও আমার জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করার কথা ভাবেনি যা পান করলে আমার তৃষ্ণা পুরোপুরি মিটত। গতরাতেই প্রথম টের পেলাম, তুমি ছিলে আমার এক জীবনের কাঙ্খিত শীতল জলাধার । যার শীতল ছায়াতেই মন শান্ত হয়ে গেছে। যদিও আকন্ঠ ডুব দেবার সুযোগটা আর পেলাম না। আর আজ যখন জানলাম তুমিই আমার গন্তব্য। সেই তুমি দুরে চলে যাচ্ছ তখন আমার মনের অবস্থাটা কী হয়েছিল একবার ভাবতে পারো ?” থেমে গেলাম আমি।

রুমকি বলল, ” আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করেছি অনেকক্ষণ। বিশ্বাস করুন। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে বাধ্য হয়ে নায়লাকে ফোন করেছি। কিন্তু সে আমাকে জানাল আপনি আসতে পারবেন না। তাই…!”
-” তুমি নায়লাকে ফোন করেছিলে ? ” বিস্ময়ের মাত্রা চরমে উঠল আমার।
“ওর ফোন নম্বর পেলে কোথায়? আর আমাকে ফোন না দিয়ে নায়লাকে ফোন দিলে কেন? ”
-” আপনার কল বিজি দেখাচ্ছিল। তাছাড়া আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। বাসও ছেড়ে দেবে, তাই বাধ্য হয়েই !”
-” কী বলেছে নায়লা..? ” আমার হঠাৎ কেমন যেন সন্দেহ হল। মন বলছে নায়লা রুমকির সাথে ভাল ব্যবহার করেনি। কিন্তু রুমকি সরাসরি উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গিয়ে বলল,
-” আমি শুনেছি, কাউকে বিচার করতে হয় তার বন্ধুকে দিয়ে। আপনার মন-মননের সাথে তার মিল পাইনি আমি। আপনি বেশ অন্যরকম মানুষ।”
-” কিন্তু সে কী বলেছে তোমাকে সেটা বলো না।’
-” এটা শোনা জরুরী না ঋভূ। আমি তো কেবল আমার পরামর্শ টুকুই দিলাম।” বলে থেমে গেল রুমকি। তবে উত্তরটা জানা হয়ে গেল আমার। নায়লা রুমকির সাথে তার স্বরূপ দেখাতে দ্বিধা করেনি। রুমকি না বললেও ওর দীর্ঘশ্বাসে সেটা স্পষ্ট। ইতস্তত করে বললাম,
-” দেখ রুমকি, নায়লা আমার ক্লাসমেট ছিল। একসাথে পড়াশোনা করতে গিয়ে বন্ধুত্ব থেকে সঙ্গী হবার মানসে পরস্পরকে বেছে নিয়েছি। আমি ওর প্রেমে পড়িনি। প্রেম আমাকে টেনে তার উপর পড়তে বাধ্য করেছে। ঐ যে বললাম, তৃষ্ণার্ত। একজন পথহারা পথিক এরচে বেশী আর কী করতে পারে ?”
-” আসলে এসব প্রসঙ্গ এখন অবান্তর। তবু আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলব, বিশুদ্ধ পানির অভাবে পথিকের সবর করাটাই যৌক্তিক। রুচিশীল ব্যক্তিরা কখনো ঘোলা জলে তৃষ্ণা মেটায় না। না পাবার সময়টুকু সিয়াম সাধনা করে দুনিয়া আর আখেরাত উভয় জগতেই লাভবান হয়। জীবন নিয়ে আর যাই হোক জুয়া খেলা যায় না।”

রুমকি থেমে গেল। আমি ফের জানতে চাইলাম, ” নায়লা তোমাকে কী বলেছে আমাকে একটু বলবে ? ”
-” কখনোই না। তার যা ইচ্ছে বলুক। আমি সেটাকে ধরে বসে নেই। বসে থাকলে আপনাকে ফোন করতাম না। নায়লার কথা শুনেই দমে যেতাম।”
-” কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি? রাগ করতে পারবে না কিন্তু।”
-” বলুন।”
-” আগে প্রমিজ কর রাগ করবে না।”
-” প্রমিজ।”
-” ওকে। স্রেফ কৌতুহল থেকেই জানতে চাইছি এটা। আচ্ছা, তুমি তো বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার মত বোকা বা আবেগী নও। কিন্তু একটা সময় এই একই ভুল তুমিও করেছিলে। আমি নাহয় সবর বা রোজার বিষয়টা জানতাম না। কিন্তু তুমি তো জানতে। তাহলে তুমি কেন সবর না করে ভুল করলে ? ” বলবো না ভেবেও বলে ফেললাম। রুমকি কোন জবাব দিল না একথার। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে আমিই ত্রস্তে ক্ষমা চাইলাম।
-” তুমি কিন্তু একটু আগে বলেছিলে যে তুমি রাগ করবে না।”
-” আমি রাগ করিনি। কিন্তু আমি মনে করি, আপনার জানা উচিত কেন আমি আজাদের ফাঁদে পা দিয়েছিলাম। ”
রুমকি থেমে গেল। সাথে আমিও..! তবে ওকে কথাগুলো বলার সুযোগ দিয়ে নিরব রইলাম।
রুমকি মৃদু স্বরে বলতে লাগল, ” বিয়ের রাতে আমি আসলে আপনাকে সবটা খুলে বলিনি। আজাদ….আজাদ আমার ফুপাত ভাই।” বলে রুমকি থামল। এবার আমার পালা। বুকের ভেতরের কলজেটাকে কেউ যেন খামচে ধরল হঠৎ। আজাদ নামের ছেলেটা কী তবে রুমকির বাল্যপ্রেম ?
কিছু না বলে নিরব রইলাম আমি। রুমকি বলে চলল,
-“সে আমার আপন ফুপুর ছেলে। অল্প বয়সের দুর্বলতা থেকেই তার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ছিলাম আমি। একটা সময় তার কথা বিশ্বাস করে বসি আর…!”
-” থাক্, আর শুনতে চাচ্ছিনা। আমার নামাজের দেরী হয়ে যাচ্ছে।” বলে রুমকির প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন কেটে দিলাম। কেন বলতে পারব না। রুমকির মুখে আজাদের নামটা শুনতে অসহ্য বোধ হচ্ছিল আমার।

বিছানায় মোবাইল ছুঁড়ে দিয়ে উঠে বাথরুমে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে অযু নামাজ সেরে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার বা রুমকির জীবনে যা’ই ঘটে থাকুক না কেন এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি হতে দেব না। নায়লা কিংবা আজাদ আমাদের এক জীবনের আবেগ। আর সাময়িক আবেগে পুরো জীবন চালানো যায় না। আমরা দুজনেই ভুল সময়ে ভুল মানুষকে নির্বাচন করেছিলাম আর মানুষ ভুল থেকেই শেখে। রুমকিকে আমি আজাদের ব্যপারে আর কোন প্রসঙ্গ টানতে দেব না। আর আমিও নায়লার সাথে সরাসরি কথা বলে এবার সম্পর্কের একটা পরিণতি টানব। কারণ রুমকি নায়লাকে সহ্য করার উদারতা দেখাতে পারলেও নায়লা রুমকিকে সহ্য করতে পারবে না। তাছাড়া আজ ভাগ্যচক্রে রুমকি আমার স্ত্রী। আর এটাই সত্য। কোন পুরুষের উচিত নয় তার স্ত্রী’কে অন্যের কাছে ছোট করা। আমিও রুমকিকে খাটো হতে দেব না। তবে রুমকিকে নিতে যাবার আগেই আমি নায়লার সাথে কথা বলব। তারপরেই রুমকিকে ফিরিয়ে আনব আমার জীবনে।

জীবনের রোজনামচার এলোমেলো পাতাগুলো এবার এক সুতায় গাঁথার সময় এসেছে। আজই নায়লার সাথে দেখা করে ক্ষমা চাইব। প্রয়োজনে ওর গালি বকা যা শোনার শুনব। তারপর কাল সোজা চলে যাব ঝিনাইদহে, রুমকির কাছে। ওকেও সামলে নেবার জন্য সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেব যেন এক জীবনের ভুল গুলো শুধরে নিতে পারে। তারপর দুজনের নতুন জীবনের গন্তব্যে যাত্রা করব। আর সে অভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা হবে মসৃন আর আলোকিত।

===

আজাদ মুনতাসির। ঝিনাইদহ জেলার একটি অখ্যাত কলেজের দাপুটে ছাত্রনেতা। শুধু কলেজেই নয় তার নিজ এলাকায়ও যথেষ্ট কুকীর্তিমান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত সে। বয়স এখনও ত্রিশের কোঠা পেরোয়নি কিন্তু প্রভাবের জোরে বয়োজ্যেষ্ঠরাও তাকে মুরুব্বি মানে। এর অবশ্য আরেকটা কারণ আছে। আজাদ রাজনীতির সাথে জড়িত বলে অনেকেই ভয় পায় ওকে। আর আজাদও তার ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে অনেকেরই লুটে নেয়া জমি জমা তার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়। বড়ই পরোপকারী মানসিকতার ছেলে বলা চলে। তবে বিনিময়ে তাকে সামান্য কিছু উপঢৌকন হিসেবে লাখ পাঁচ ছয়েক গিফট হিসেবে দিতে হয় এই যা। আর এই গিফট নেয়াটাকে সে মোটেও অনুচিত বলে মনে করেনা। ফলে অনেকেই নিজেদের জায়গা জমির যে কোন ঝামেলা লাগার আগেই আজাদকে হাত করে নেয়। এইতো গতমাসেও প্রতিবেশী মিজান চাচা তার বাড়ীর সামনে মুদী দোকান দেবেন বলে স্থির করলে এলাকাবাসীর আপত্তি জানায় যে এখানে দোকান দেয়া যাবেনা। ফলে এলাকাবাসীর প্রবল বাধার মুখে মিজানুর রহমান দোকানটা দিতে পারছিলেন না। পরে পঞ্চায়েত ডাকা হলে সেখানে স্থির হয় মিজান চাচা আবাসিক এলাকায় কোন দোকানপাট দিতে পারবে না কারণ এটা একটা ঘরোয়া পরিবেশ। বিকেল হলে এলাকার বউ ঝি’রা একটু হাঁটাহাঁটি করে গলির এ মাথা থেকে ও মাথা। দোকানপাট হলে তারা আর সেটা করতে পারবে না। কারণ দোকান মানেই অনেক ধরণের লোকের সমাগম। বাজে আড্ডা। চা পানি খেতে বসবে বখাটের দল। স্কুলগামী মেয়েদের উত্যক্ত করার সুযোগ পাবে তারা। এমন ঘাঁটি এই এলাকায় হতে দেয়া যাবে না। কাজেই দোকানের চিন্তা বাদ। মিজানুর রহমান প্রতিবাদ করে দ্বিতীয় দফা পঞ্চায়েত ডাকেন। আর এবার আজাদকে রাখেন তিনি। আজাদ পঞ্চায়েতে বসেই বলে, বউ ঝি’রা ছাদে হাঁটবে। রাস্তায় কী। বরং এখানে দোকানটা হলে পুরো এলাকাবাসীর মেইনরোড পর্যন্ত দৌড়ানোর ঝক্কি কমবে। তারা হাতের কাছেই সবকিছু পেয়ে যাবে। কাজেই এখানে দোকান হতে কোন বাধা নেই। যে বাধা দিবে তাকে দায়িত্ব নিয়েই বাধা দিতে হবে। ব্যস, সব চুপ। আজাদের একথার পর কেউ আর দ্বিতীয় কথা বলে নি। পঞ্চায়েতে আজাদের মামা ও সহ শরীক হিসেবে আব্দুল্লাহ হুজুরও ছিলেন। তিনি কোন কথা না বাড়িয়ে নিরবে উঠে গিয়েছিলেন সেখান থেকে । কারণ নিজের বোনপোকে ভালভাবেই জানা আছে তার। বেয়াদবের একশেষ। দেখা যাবে মুখের ওপরই আজেবাজে কথা বলে বসেছে। দরকার কী ওর সাথে লাগার। এমনিতে নিজেদের ঝামেলারই তো শেষ নেই। বিশেষ করে তার ছোট মেয়ে রুমকিকে বিয়ের প্রস্তাব মানা করে দেবার পর থেকে ওর বেপরোয়া ভাব যেন আরো বেড়ে গেছে। এতদিন তো তবু রয়ে সয়ে কথা বলত। এখন আর সেটা বলেনা। কাজেই সমঝে চলাই ভাল।

আব্দুল্লা আজ সন্ধ্যার পরপরই বাড়ী চলে এলেন। সাধারণত এ সময়টা তিনি বাড়ীতে থাকেন না। মসজিদ লাগোয়া মাদ্রাসার মক্তবখানায় বসে ম্যারাথন আড্ডা দেন তারা কয়েকজন মিলে। খতিব সাহেব, মুয়াজ্জিন সাহেব আর ইমাম সাহেবও থাকেন সেখানে। তাদের সাথে সন্ধ্যেটা মন্দ কাটেনা। কিন্তু আজ আর মজলিশে বসেননি তিনি। কেননা আজ সন্ধ্যায় স্ত্রী’কে নিয়ে ডাক্তারখানায় যাবার কথা আছে তার। সেকারণেই তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরতে হল। এমনিতেও আজ তার বাইরে থাকা হতনা। কারণ গতরাতেই তার আদরের ছোট মেয়েটা ঢাকা থেকে এসেছে। বেচারী মায়ের খবর শুনে স্থির থাকতে পারেনি। গুলবানু চাচীর সাথেই চলে এসেছে সে। তিনি মানা করেছিলেন কয়েকবার যে আসার দরকার নেই তবু মেয়ে শোনেনি। মায়ের অসুস্থতার খবরে কান্নাকাটি করে চলে এসেছে। আর গুলবানু চাচীও তাকে নিয়ে এসেছে।
গুলবাণু চাচী তার নিকটতম প্রতিবেশী। কেবল প্রতিবেশীই নন। এই মহিলা তার মায়ের মতন। আব্দুল্লা ছোটবেলা থেকেই চাচীকে মায়ের জায়গায় পেয়ে এসেছেন। তাঁর নিজের মা ছিল না। চাচী সেই অভাব পুরণ করেছেন। তাঁর তিন ছেলের সাথে আব্দুল্লাহকেও এক ছেলে গণ্য করতেন তিনি। কত শত দিন আব্দুল্লাহ গুলবাণু চাচিদের বাড়ীতে ভাত খেয়ে ওখানেই ঘুমিয়ে থেকেছেন। তাছাড়া গুলবানু চাচীর মেজ ছেলে মহিউদ্দিন কাদেরের সাথে তার শৈশবের সখ্যতা। একই মাদ্রাসায় পড়াশোনা দুজনের। দাখিল পরীক্ষার পর মহিউদ্দিন ঢাকায় পাড়ি জমায় আর আব্দুল্লাহ কিতাবখানায় ভর্তি হয়। তাতেও তাদের বন্ধুত্বে এতটুকু চিড় ধরেনি। এমন কখনো হয়নি যে গুলবানু চাচীর বাসায় ভালমন্দ রান্না হয়েছে আর আব্দুল্লার তাতে ডাক পড়েনি।

মহিউদ্দিন বিয়ে করে ঢাকায় পুরোপুরি থিতু হবার পরেও তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরেনি। বরং গুলবানু চাচীর পরামর্শেই তিনি তার রুমকির বিয়ে মহিউদ্দিনের ছেলে রুপম রিজভীর সাথে ঠিক করে রেখেছিলেন। চাচীর এক কথাতেই রাজী হন তিনি। ফলে ছেলে সম্পর্কে কোন খোঁজখবরই করেননি। করার দরকার মনে করেন নি। আজ সকালে মেয়ের মুখ দেখে মনে হল তিনি পাত্র নির্বাচনে কোন ভুল করেন নি। মেয়ে আসার পর থেকেই ঢাকা ফোন করে স্বামীর খোঁজ নিচ্ছে ক্রমাগত। দৃশ্যটা তার মনে অপার শান্তি যুগিয়েছে। সামান্য ভয় ছিল মনে, এমন হুট করে বিয়ে, দুজনের সমঝোতা হবে তো ! রুমকিকে নিয়ে চিন্তা নেই কিন্তু রূপম শহরের ছেলে। রুমকিকে মন থেকে মেনে নেবে তো। শহুরে ছেলেদের কতরকম ফ্যাকড়া থাকে। রূপমের কী অবস্থা কে জানে। কিন্তু গুলবানু চাচী আর মহিউদ্দিনের আত্মবিশ্বাসের কাছে হার মেনেছেন তিনি। মেয়েটার বিয়ে দিয়ে ফেলেছেন। অবশ্য বিয়ে না দিয়েও কোন উপায় ছিলনা। কারণ রুমকিটাকে নিয়ে একটু বিপদেই ছিলেন তিনি। প্রথমত তার আর আজাদের মায়ের তথা তাদের দুই ভাই-বোনের সম্পত্তির জটিলতা নিরসনে আজাদ তার ছোট মেয়েটাকে টার্গেট করেছিল। কারণ আজাদ যদি রুমকিকে বিয়ে করতে পারে তবে সম্পত্তির ঝামেলা মেটানো সহজ হয়ে যায়। কারণ আজাদের নানু তথা আবদুল্লাহ মা তার অংশের দুই আনা তাদের দুই নাতি অর্থাৎ আজাদ আর রুমকিকে সমান দুই ভাগে ভাগ করে দেবার মৌখিক ওসিয়ত করে যান। কিন্তু আজাদের মায়ের কথা হল, আমার ছেলেকে মা বেশী ভালবাসতেন তাছাড়া সে ছেলে সে বেশী পাবে। রুমকিকে নাকি তিনি কোন সম্পত্তি দেনই নাই। এসব শুনে আব্দুল্লাহ নিজেই সরে আসতে চেয়েছিলেন। অযথা জায়গা জমির লোভ করে লাভ নাই। এটা তো আর কবরে নিতে পারবেন না। তাই তিনি নিজের মেয়ের অংশের দাবী ছেড়ে দেন। কিন্তু তাতেও আজাদের মায়ের মন ওঠে না। তার দাবী হল, হয় না-দাবী নামা দলিল কর নয়ত রুমকিকে বিয়ে দাও। সব মিটে যাক। আব্দুল্লাহ দুটোর একটাতেও রাজী হন নি। ফলে গত পাঁচ বছর ধরে এই বিবাদ চলছে। অপরদিকে আজাদ তার মায়ের পরামর্শে অনেক আগে থেকেই গোপনে তার অল্পবয়সী স্কুল পড়ুয়া মেয়েটাকে ফুসলে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বাগাতে চেয়েছিল। রুমকি নিজেও প্রথমটায় বুঝতে পারেনি আপন ফুপুর চালাকি। প্রায়ই তিনি আদর করে এটা সেটা খাওয়ানোর ছলে রুমকিকে বাড়ী ডেকে নিতেন আর আজাদের সাথে ভিড়িয়ে দিতেন। ফলে অল্পবয়সের কাঁচা মনে আজাদের প্রভাব পড়তে দেরী হয়নি। রুমকিও বোকার মত আজাদের মত বাউন্ডুলেটাকেই পছন্দ করে বসল। পরে তিনি যখন টের পেলেন তখন অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ধমকে তবে মেয়েকে ফেরত আনলেন। তারপরেও আজাদের হুমকি ধমকির শেষ ছিল না। রুমকিকে তুলে নিয়ে যাবার ভয়ও দেখিয়েছিল আজাদ। শেষ পর্যন্ত অবস্থা বেগতিক দেখে একসময় মেয়েকে ঢাকায় বড় মেয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ওখানে থেকেই কয়েক বছর পড়াশোনা করল মেয়েটা। এরপরেও পরীক্ষার ফাঁকে ফোঁকড়ে ঝিনাইদহ এলেই যন্ত্রণা শুরু হয়ে যেত আজাদের। এমনও হয়েছে আজাদ মাঝেমধ্যেই ঢাকা চলে যেত বা দেশে থাকলেও হুটহাট রুমকির রুমে সরাসরি ঢুকে যেত। কঠিন সব ধমকেও কাজ হয়নি। পরবর্তীতে গুলবানু চাচী সব দেখে শুনে নিজেই তার নাতিকে দিয়ে বিয়ের পরামর্শ দেন। এর মধ্যে তিনি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেলে সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগান তিনি। অত পেরেশানির মধ্যেও চাচী নিজেই বুদ্ধি করে রুপমের হাতে রুমকির হাত তুলে দেন। কারণ সেদিন রুপমরা সপরিবারে ঝিনাইদহ এসেছিল চাচীর অসুস্থতার খবর পেয়ে। সেই সুযোগে চাচী তাকে আর মহিউদ্দিনকে ডেকে পরামর্শ দিলেন কাজী ডাক তোরা আর আজই বিয়ে পড়ায়ে দিয়ে একবারে মেয়ে বিদায় কর। চাচী বলেছিলেন, লুইচ্চা আজাইদ্যারে বিশ্বাস নাই।
সেদিন আবদুল্লাহও আর দ্বিতীবার ভাবেন নি। কারণ এটা তো সত্যি যে আজাদের দৌরাত্ম দিনকে দিন যেন বাড়ছিল। ওর জ্বালায় রুমকির ঝিনাইদহে এসেও শান্তি পেতনা। পথে বেরোনো কষ্টকর হয়ে যেত। এই যে তার মেয়েটা গতকাল এখানে এসেছে এটাও তার একদমই ইচ্ছে ছিল না। দু এক বছর না এলে কী হতো। কিন্তু বোকা মেয়ে শুনল না। হুট করে চলে এল মা’কে দেখতে। রুমকি আসার পর থেকেই খুশি হবার বদলে মনে মনে বিরক্ত তিনি। তিনি নিজেই ওকে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে চান। দরকার নেই বেড়ানোর। মা’কে দেখেছে এখন শ্বশুড়বাড়ী চলে যাক। পরিস্থিতি এখনও খুব একটা বদলে যায়নি। মানুষ আজকাল জেদের বশবর্তী হয়ে কী না করছে। পত্রিকায় দেখে ভয় লাগে। আজাদকে বিশ্বাস কী। তার নিজের বোনও তো কম নয়। রুমকির ঢাকা থাকাই ভাল।

আব্দুল্লা বাড়ী ঢুকেই দেখলেন মা মেয়ে দুজনেই বাইরে যাবার জন্য তৈরী। তিনি রুমকির দিকে তাকিয়ে বললেন, ” তুই বোরকা পড়েছিস কেন? ”
-” আম্মাকে আমি নিয়ে যাব ডাক্তারের কাছে তাই। ”
-” না, তোর যাবার কোন দরকার নেই। আমিই যাব সাথে।”
-” আব্বু আপনি তো কোন কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না। আপনাদের জামাইও বারবার আমাকেই নিয়ে যেতে বলেছে।”
-” এখানকার পরিবেশ ভাল না রে মা। তুই আসছিস এটাই তো আমার পছন্দ না। এখন আবার একা ডাক্তারের কাছে যাবি?”
আব্দুল্লাহর কণ্ঠে দ্বিধা। এটা সত্যি ডাক্তারের সাথে তিনি গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। আসল কথাই ভুলে যান কিন্তু মেয়েটাকে যেতে দিতে মন সায় দিচ্ছে না।
-” আব্বু, একটা পরিচিত রিক্সা ডেকে দেন। আপ ডাউনে যাব। রিক্সা ছেড়ে দেব না। সে ওখানে বসে থাকবে যতক্ষণ আমরা ডাক্তার দেখাব। আর আম্মা আর আমি দুজন মানুষ একা হলাম কিভাবে বলেন তো।”
-” তা নাহয় বুঝলাম। তোর শ্বশুড়বাড়ী শুনলে কী ভাববে বল তো। ”
-” কী ভাববে, কিছু ভাববে না। আপনার জামাইই উল্টো আমাকে বলেছে আমাকে তুমিই নিয়ে যেও। ভিজিটও আপনাকে দিতে মানা করছে। বলেছে আমি যেন দিয়ে দেই। আপনি একটা রিক্সা ঠিক করে দেন । দেরী হয়ে যাবে আমাদের। আমার অনুরোধটা রাখেন আব্বু। কাল আপনার জামাই এলে তো আমি চলেই যাব। আজ একদিনের জন্য আম্মুর জন্য এটুকু করতে না পারলে আমি কেমন মেয়ে হলাম ।” বলতে গিয়ে রুমকির গলার স্বর ভারী হয়ে এল। আবদুল্লাহ আর তর্কে মাতলেন না। তাছাড়া মেয়েটা কাল পরশু চলে যাবে শুনে শান্তি লাগছে মনে। একটা নিছক আবদার করেছে। অসুবিধা কী।
কথা না বাড়িয়ে মোহনকে ধরে নিয়ে এলেন আব্দুল্লা হুজুর। মোহন তাদের পরিচিত রিক্সাচালক। তার উপর নির্ভর করা যায়।

====

নাস্তা খেয়ে ধীরে সুস্থে চলে এলাম পিজা প্যালেসে। নায়লাকে সকালেই ফোনে জানিয়ে দিয়েছি যে ঠিক এগারোটার মধ্যেই যেন চলে আসে। নায়লা কথা রেখেছে। আমার ফোন পেয়ে নায়লা আজ দেরী করেনি। সোজা চলে এসেছে পিজা প্যালেসে।
সে এসেই হাসিমুখে বলল, ” যাক্, এতদিন পর তাহলে দিনের প্রথম প্রহরে আমার ডাক পড়ল। নিশ্চয়ই তোমার গাইয়া ভুতটা বাড়ী নেই। ও আসার পর থেকে তো তোমাকে বিকেলগুলোতেই ঠিকমত পাচ্ছি না। আজ একেবারে সকাল সকাল। আহ্, আমার কপাল বুঝি এবার খুলল।” খুশির আতিশায্যে কথাগুলো গড়গড় করে বলে গেল নায়লা। চট করে আমার বগলের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আমার ডান হাতটা নিজের গায়ের সাথে চেপে ধরল।

আজ ও আমার মুখোমুখি বসেনি। পাশে এসে বসেছে। সাধারণত মুখোমুখিই বসে। আজ কেন বসল না বুঝলাম না। আমি তাৎক্ষণিক ভাবে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। ধীরে সুস্থে ওর হাতটা ছাড়িয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে লাইটারে ঠুকে নিলাম। সচরাচর আমি সিগারেট খাইনা। বন্ধুদের পাল্লায় পড়লেই দু চার টান মারি আরকি। তবে আজ ইচ্ছে করেই ধরিয়েছি। নায়লাকে একটা লেসন দিতে চাই আমি। নায়লা অবশ্য মুচকি হেসে এপ্রিসিয়েট করল, ” বাব্বাহ, আজ একেবারে পুরুষালি ইমেজে ? কী ব্যপার ? অবশ্য সিগারেটেই পুরুষদের মানায়। ম্যানলি লাগে। ”
-” যদিও পুরোটাই আলগা ঠাট। যাই হোক, আজ আমি একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি নায়লা। আর এক্ষেত্রে তোমাকে আমার পাশে চাই।”

কোনোরকম ভূমিকা না করে সরাসরি বললাম। নায়লা সচকিত হল এবার। সোজা হয়ে বসল,
-” রিয়েলি ? ওয়াও…! নিশ্চয়ই ঐ গাইয়াটাকে ডিভোর্স দেবে বলে ভাবছ, এ্যাম আই রাইট ? ”

-“উঁহুঁ….! রঙ। আমি তোমাকে বিয়ে করব বলে ভাবছি। তবে রুমকিকে ডিভোর্স দেবার কথা একদম ভাবছি না। বরং যা বলে ফেলেছি তার জন্য আমি স্যরি হয়েছি ওর কাছে ।” বলে সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে আলতো করে পাফ করলাম।
আজ আমাকে খুব স্থির আর আত্মবিশ্বাসী দেখাতে হবে। নায়লার সামনে বেচাল হলে চলবে না । কারণ আজ আমি একটা বড় ধরণের ঝুঁকি নিতে যাচ্ছি।
নায়লা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে রইল কিছুক্ষণ তারপর বলল, বিয়ে…? আজই..? গন ম্যাড ? ”
-” না, গন ওয়েড। ”
আমার বলার ভঙ্গিতে নায়লা খুশি হলনা উল্টো রেগে গেল।
-” ঐ বান্দিরে আগে ডিভোর্স দাও তারপর আমাকে বিয়ের খোয়াব দেখ।” বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেলল নায়লা। বিশ্রী দেখাচ্ছে ওর বাঁকানো মুখটা। মনে মনে অবাক হলাম, আগে কেন নায়লার এসব চোখে পড়েনি আমার ? মানুষ এত অন্ধ হয় কিভাবে ! তবু স্বাভাবিক রইলাম যদিও রুমকিকে বলা কথাটা শুনতে ভাল লাগেনি আমার। মুখোভাব স্বাভাবিক রেখে বললাম, ” ওকে ডিভোর্স দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না নায়লা। কারণ ওকে আমার বাবা -মা, আপান পছন্দ করে ঘরে এনেছে। আর তুমি হচ্ছ আমার পারসোনাল চয়েস। তারা তোমাকে কখনো ঐ বাড়ীতে মেনে নেবে না। তাই আমরা আমাদের মত বিয়ে করে নিজের মত থাকব।”
-” কী বলো এসব। বিয়ে করে আমরা থাকব কোথায় ? আর আমাকে ঐ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব তোমার।”
-” ওকে। সেক্ষেত্রে তোমাকে রুমকির সাথে এক বাড়ীতে থাকতে হবে। এ ব্যপারে তোমার যদি আপত্তি না থাকে তো…!”
-” এ্যাবসার্ড।” রীতিমত চেঁচিয়ে উঠল নায়লা। ” ঐ গাঁইয়া ভুত বহাল থাকাবস্থায় আমি তোমাকে কোনদিনও বিয়ে করব না।”
-” এটাও কী তোমার শর্ত? ”
-” প্রধান শর্ত। শর্ত তো আরো আছে। তার একটা হল, তুমি ঐ ছেমড়িকে তালাক দিবা। কথা শেষ।”
-” ওকে, শুনলাম। বাই দা ওয়ে, রুমকিকে গতকাল ফোনে কী বলেছ তুমি? “হঠাৎ মনে পড়ায় বললাম আমি। নায়লা চোখ বড় বড় করে বলে উঠল,
-” ওহো হো হো…এরই মধ্যে নালিশ সালিশও হয়ে গেছে ? গ্রেট ! ”
আমি স্বাভাবিক রইলাম। ফের বললাম, ” এসব কথা ছাড়। তুমি তাকে কী বলেছ একটু শুনি ?
-” কেন তোমার প্রিয়তমা স্ত্রী বলেনি। বলার তো কথা। এসব খেতু কালচারের মেয়েদের ভাল করেই জানি। খুবই মিন মাইন্ডেড হয় এরা। নিশ্চয়ই লাগিয়ে বাড়িয়ে বলেছে ? কারণ এদের স্বভাব হলো টিপিক্যাল মেয়েদের মত কথা লাগালাগি করবেই। আমি বললে বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, ওকে আমি তেমন কিছুই বলিনি। জাস্ট তোমার লাইফ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছি। দ্যাটস অল। ঐ গাইয়া ভুত…!”
-” আচ্ছা, বারবার গাইয়া ভুত বলছ কেন ? গাইয়া ভুত বিপরীত শব্দ কী জানো ? শহুরে ভুত। তুমি নিশ্চয়ই নিজেকে এমন কোন বিশেষণে ভূষিত করতে রাজী হবেনা ? কারণ রুমকির ঠিক বিপরীতেই তুমি দাঁড়িয়ে আছ। রুমকির তো তবু স্ত্রী’র তকমা আছে।” শান্ত ভঙ্গিতেই বললাম কথাটা। নায়লা ভ্রু কোঁচকাল।
-” কী ব্যপার কী ? তোমার টোন আজ কেমন যেন মনে হচ্ছে ? রুমকি পড়া পানি খাইয়ে দিয়ে গেছে নাকি? ”

মুচকি হাসতে গিয়েও সামলে নিলাম। মনে পড়ল একটি নির্জন প্রহরের কথা। স্বামীকে হাত করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েও মেয়েটা তা হস্তগত করেনি উল্টো আমাকে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে শিখিয়েছে। যেন সাময়িক ভাবালুতায় ভেসে গিয়ে পড়ে আফসোস না করি। শেষে আমি নিজেই ওর কাছে ফিরে যাবার ওয়াদা করেছি। সেদিন ঐ মুহূর্ত থেকে বীর বিক্রমে ফিরতে পারতাম না যদি না রুমকি আমার ঘোর ভেঙ্গে দিত। তার কথাতেই বোঝা গেছে, সে আমাকে সচেতনে চায়, অচেতন আবেগের ঘোরে নয়। আর আমিও তাকে সচেতন ভাবেই চাইতে শুরু করেছি । যদিও সেটা প্রমাণ দিতে পারিনি। শান্ত ভঙ্গিতে বললাম,
-” টোন ফোন না নায়লা। আজ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছি আর সেটা হল, তোমরা দুজনই থাকবে আমার জীবনে। রুমকিকে বাদ দিয়ে আমি কিছু ভাবতে পারছিনা, পারবোও না। আর তুমিও…!”

আমার কথার মাঝখানেই বিস্মিত নায়লা রাগে কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
-” এটা বলার জন্য আমাকে ডাকছস? ”
-” না, আমি এটা বলার জন্য ডাকিনি। আমি তোমাকে এটা জানাতে ডেকেছি যে যদি আমাকে বিয়ে করতে হয় তাহলে রুমকির নামে বাজে কথা বলা চলবেনা কারণ সে আমার অর্ধেক। আর তুমি হবে আমার বাকী অর্ধেক । এই শর্তে যদি রাজি থাক তাহলে আজই তোমাকে আমার মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। কাজেই সিদ্ধান্ত তোমার। নাউ অর নেভার।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here