#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ০৯
ইশান কোনো মেঘ জমেছে। মনে হচ্ছে এইবার কালবৈশাখী ঝড় উঠবে। সোঁ সোঁ করে বাতাস বয়ছে। সেই বাতাসে পূর্ণার লম্বা চুল থেমে থেমে উড়ছে। বিছানার পাশে নিচে ফ্লোরে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুজে কান্না করছে পূর্ণা। লম্বা চুলগুলো চারদিকে পড়ে আছে। আর তার কান্না আর তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার উপরে কোনো প্রেতাত্মা ভর করেছে। পরিবেশটা কেমন গা ঝমঝম। পূর্ণার হাতে রক্তাক্ত ভাঙা ফুলের টব। সামনেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে স্টিফেনের নিথর দেহ। পূর্ণা একটু পর পর গুনগুন করে কাঁদছে। তার শরীর অশার হয়ে আসছে। মাথার মধ্যে ভো ভো আওয়াজ হচ্ছে। শরীর মৃত মানুষের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।।ভয়ে পূর্ণার সারা দেহ থরথর করে কাঁপছে। মনে হয় পৌষের শীতেও কেউ এইভাবে কাঁপে না। পূর্ণা মুখ তুলে একবার স্টিফেনের হায় স্পর্শ করে দেখে। হাতটা ধরার পর পূর্ণা ছিটকে দূরে সরে যায়। কী ঠাণ্ডা। এমন ঠাণ্ডা জিনিস সে কখনো ধরেনি। পূর্ণা তাল সামলাতে পারছে না। সবকিছু কেমন ঘোলাটে। চোখের সামনে স্টিফেনের লাশ। পূর্ণা স্পষ্ট বুঝতে পারছে স্টিফেন মরেছে। তার দেহ ঠাণ্ডা বরফের ন্যার হয়ে গিয়েছে। পূর্ণার মাথা কাজ করে সে ঠাস হয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। জ্ঞান হারায় পূর্ণা।
_______________________________________
কিছুক্ষণ আগের ঘটনা।
পূর্ণা মেঝেতে বসে কাঁদছে। স্টিফেন লোলুপ দৃষ্টি তে তাকিয়ে তার দিকে এগুচ্ছে। সব শেষ আর বাঁচার রাস্তা নেয়। স্টিফেন পূর্ণার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে। পূর্ণা গগন বিদারী এক চিৎকার দিয়ে উঠে। স্টিফেন পূর্ণার গালে হাত রাখলে পূর্ণার মনে পড়ে তার মায়ের কথা। শত শত পুরুষ তার মায়ের শরীরে আঘাত করেছে। তার দুর্বল মা অসহায় ছিলো তাই কিচ্ছু করতে পারেনি। কিন্তু তার মা তাকে তো দুর্বল করে বড় করেনি। তাহলে আজ কেন সে দুর্বল হয়ে পড়ছে। নারী যেমন দুর্বল তেমন নারীই প্রলয় কারীণি। স্টিফেন পূর্ণার গাল ধরে নিজের কাছে আনলে। সে অগ্নিচোখে তার দিকে তাকায়। স্টিফেন হেসে দিয়ে বলে,
– ওমা ভয় পায়ছি।
পূর্ণা স্টিফেনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তবে এইবার স্টিফেন পড়ে যায়নি উল্টো সে আরও জোরে চেপে ধরে পূর্ণাকে। পূর্ণা মনে মনে আল্লাহকে স্বরণ করে। তারপর স্টিফেনে অন্ডকোষে জোরে এক লাথি দেয়। স্টিফেন চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়ে। পূর্ণা ভাঙা টপ স্টিফেনের দিকে ছুড়ে মারে। ভাঙা কাঁচের টুকরো স্টিফেনের গলায় গিয়ে লাগে। স্টিফেন গলা কাটা মুরগির মতো মাটিতে পড়ে দাপাচ্ছিল। স্টিফেন পূর্ণার হাত খামচে ধরে তারপর তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে পেটে লাথি দেয়। পূর্ণা মা বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। স্টিফেন পকেট থেকে ছুড়ি বেড় করে। সেটা দেখে পূর্ণা ভয় পায়। তবে মুখে সেই ভাব আনেনি। সে স্টিফেনের পায়ে লাথি মারে স্টিফেন পড়ে যায়। পড়ে যায় তার হাতের ছুড়ি। পূর্ণা সুযোগ কাজে লাগায়। স্টিফেনের হাতের ছুড়ি নিয়ে স্টিফেনের গলায় বসিয়ে দেয়। বুকের মধ্যে গুনে গুনে দশবার আঘাত করে। স্টিফেনের চোখদুটো উল্টে যায়। মুখ দিয়ে রক্ত আসে। পূর্ণা এখনো উত্তেজনায় ঘামছে। লম্বা চুলগুলো হাওয়ায় উরছে। কিন্তু পরেক্ষণেই যখন সে বুঝতে পারে স্টিফেনের কোনো আওয়াজ নেয় সে ভয় পেয়ে যায়। মুখ চেপে ধরে কান্না করে। বার বার বমি করে। অবস্থা একদম নাজেহাল হয়ে যায়। সে ভাবতেও পারেনি তার দ্বারা কখনো মানুষ খুন হবে। পূর্ণা খুন করেছে। আপনারা ঠিকই বুঝেছেন পূর্ণা খুন করেছে। সে নিজেও মানতে পারছে না সে খুন করেছে। ঘরটা রক্তে একাকার হয়ে গিয়েছে। নিজের শরীরটাও দুর্বল লাগছে। স্টিফেনের আঘাতে সেও ব্যথিত।
________________________________________
বর্তমান।। ঝুমুর বাইজি, আহির আর কৌশিক বসে ড্রিংকস করছিলো। হঠাৎ আহির বলে,
– খালা প্রায় রাত শেষ হতে চললো। স্টিফেন সাহেব এখনো বের হলো না।
ঝুমুর বিশ্রি হাসি দিয়ে বলে,
– আরে টাটকা মাল পায়ছে ছাড়বার কি মনে চায় এত তাড়াতাড়ি। করুক যা করবার মন চায়।
কৌশিক বলে,
– খালা বেপারটা আমার কাছে অন্যরকম লাগছে। বেশকিছুক্ষণ ধরে ঐ ঘর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না। সব ঠিক ঠাক আছে তো।
– তুই কি কয়বার চাস। ঐ বাচ্চা মায়ইয়া স্টিফেনরে মারবো।
– দেখো তেমন কিছু না। তবে আমার মনে হয় খোঁজ নেওয়া দরকার।
– আচ্ছা আমি দেখতাছি দাড়া। ঐ ময়না কই তুই এইখানে একবার আয় দেহি।
সতেরো আঠারো বছরের একটি মেয়ে কোমর ঢুলাতে ঢুলাতে এইদিকে আসে। বেনিটা নাড়তে নাড়তে বলে,
– আমারে ডাকছো খালা।
– হো ডাকছি পূর্ণার ঘরে গিয়া দেখতো। ওরা কি করে।
– আচ্ছা দেখবার লাগছি।
ময়না আবারো আগের মতো করে যেতে থাকে। পূর্ণার ঘরের সামনে এসে দরজা খুলে দেয়। তারপর যা দেখে সেটা দেখে সেই চিল্লিয়ে বলে,
– আল্লাহ গো খালা। স্টিফেন সাহেবরে মায়রা হালায়ছে।
কথাটা বলে ময়না দৌড়ে সেখান থেকে ঝুমুর বাইজির কাছে যায়। আর পূর্ণার কারো কন্ঠের আওয়াজে জ্ঞান ফিরে। সে দেখে দরজা খোলা।বাইরে চেচামেচি হচ্ছে। সে বুঝতে পারে ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গিয়েছে। তাই সে ওরনা দিয়ে মুখ ঢেকে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। ঝুমুর বাইজি সহ আহির কৌশিক সবাই ঘরে এসে দেখে পূর্ণা নেয়। স্টিফেন লাশ হয়ে পড়ে আছে। তার সারা শরীর রক্তে মাখা। যাওয়ার আগে পূর্ণা যেই ছুড়ি দিয়ে স্টিফেনকে মেরেছে সেই ছুড়িটা নিজের সাথে করে নিয়ে যায়। ঝুমুর চিল্লিয়ে বাইজি পাড়ার লোক একসাথে করে। সবাইকে বলে পূর্ণাকে খুজে বের করতে। একটি ছেলে উঁচু পাচিরে উঠে দেখে পূর্ণা কতদূর গেছে। সে দেখতে পায় পূর্ণা এখনো বাড়ির গেট পাড় করতে পারেনি। তাই সে চিৎকার করে বলে,
– খালা ঐ যে ছেড়ি। বড় গাছের বুগোলে। ঐ তোরা ওরে ধর।
পূর্ণা চিৎকার শুনে উপরে তাকায়। দেখে একটা ছেলে এইদিকে তাকিয়ে আছে। সে সাথে সাথে পিছে তাকায় দেখে কতগুলো ছেলে এইদিকে আসছে। পূর্ণা কামিজ খামচে ধরে। ওরনাটা বেধে নেয়। হাতের ছুড়িটা কোমরে ওরনার সাথে আড়াল করে রাখে। তারপর দৌড়ে মেইন রাস্তার দিকে যায়। আকাশে বিদুৎ চমকাচ্ছে। বাতাসে বড় বড় গাছগুলো মাটিতে উপরে পড়তে চাচ্ছে। যেকোনো সময় বৃষ্টিও পড়তে শুরু করবে। পৃথিবীর মানুষের সাথে যেনো প্রকৃতিও খেলা শুরু করছে। পূর্ণা প্রাণপনে দৌড়ে পালাচ্ছে। আজ কোনো প্রাকৃতিক ঝড় মনে প্রভাব ফেলতে পারছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়। পূর্ণার ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে। লম্বা চুল গুলো এখন আর উরছে না। পূর্ণার দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু পিছনে বিপদ। পূর্ণা মেইন রোডে উঠে যায়। মেইন রোডে উঠার পর সে দেখে দুইটা বাইক তার পেছনে আসছে। সে বুঝতে পারে সব শেষ। বাইকের সাথে তো আর সে দৌড়ে পারবে না। একটা বাইক তার কাছাকাছি এসে হকিস্টিক দিয়ে পিঠে বাড়ি দেয়। পূর্ণা উপুর হয়ে রাস্তায় পড়ে। আকাশ ফুলে ফেপে উঠছে। যেনো তারাও বিরোদ জানাচ্ছে পূর্ণার সাথে যেনো কিছু না হয়। পিচ ঢালায় রাস্তাত পূর্ণা পড়া আছে। মা বলে চিৎকার করছে। পূর্ণা উঠার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। হঠাৎ জোরে বজ্রপাত হয়। পূর্ণা কেপে উঠে। বাইক থেকে দুটি ছেলে নেমে আসে। পূর্ণাকে ধরে বসায়। পূর্ণা বৃষ্টির ফোটার কারণে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। তবুও কষ্ট করে সামনে থাকা ব্যক্তির দিকে তাকায়। ছেলে দুটি আর কেউ নয় আহির আর কৌশিক। পূর্ণা এইবার হেসে উঠে। পিঠের যন্ত্রণা তাকে কাবু করতে পারছে না। তার থেকে বেশি কাবু করছে মনের যন্ত্রণা পূর্ণা। পূর্ণার এমন হাসি দেখে আহির পূর্ণার চুল খামচে ধরে বলে,
– এইভাবে হাসছিস কেন? জানিহ এখনি তোকে খুন করে গায়েব করে দিতে পারি।
পূর্ণা আহিরের মুখে থুতু দেয়। আহির রেগে পূর্ণার গালে চড় বসায়। পূর্ণা রাস্তায় পড়ে যায়। পাঁচ আগুনের দাগ বসে যায় গালে। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়া শুরু করে। পূর্ণা আবার উঠে বসে। তারপর কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
– বিশ্বাসঘাতক। নিজের ভাইকেও ছাড়লি না।
কৌশিক হাসতে হাসতে বলে,
– আমার ভাই আমি কাটবো মারবো যা ইচ্ছে তাই করবো তোর কি?
পূর্ণা হুঙ্কার করে বলে,
– রাফাতের গায়ে একটা আচড় লাগুক। সব কয়টাকে খুন করবো আমি।
পূর্ণার এমন রূপে দুজনেই কেঁপে উঠে। এতদিন পূর্ণার বাচ্চা বাচ্চা মুখ দেখে এসেছে তার। আজ এমন প্রলয়কারী রূপ দেখে সত্যি একটু হলেও ভয় পেয়েছে। ভয়ঙ্কর হলেও সত্য পূর্ণা স্টিফেনকে খুন করেছে। কৌশিকে হকিস্টিক দিয়ে পূর্ণার পায়ে বাড়ি মেরে বলে,
– সুযোগ দিলে তো খুন করবি।
পূর্ণা বাড়ি খেয়ে পা ধরে চিৎকার করে উঠে। আবারো বজ্রপাত হয়। এইবার খুব কাছে কোথাও ই বজ্রপাত হয়েছে। পূর্ণা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
– প্রকৃতি প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আমার মনে সাহস দিচ্ছে তোরা আমার কিচ্ছু করতে পারবি না। ইয়া আল্লাহ্।
কথাটা বলে পূর্ণা কোমরে গোজা ছুড়িটা বের করে আহিরের পিঠে বসিয়ে দেয়। অর্তকিত হামলার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না। তাই তার পিঠটা অনেকটা দেবে কেটে যায়। সে পিঠ ধরে বসে পড়ে। কৌশিক পূর্ণার হাতের ছুড়ি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। পূর্ণা প্রাণপনে সেটা আটকানোর চেষ্টা করছে। ছুড়ি কেড়ে নেওয়ার এক পর্যায় ছুড়িটা এসে লাগে পূর্ণার হাতে সে ব্যথায় মাগো বলে কেঁদে দেয়। কৌশিকে পূর্ণাকে তুলে নিয়ে যেতে চাইলে হঠাৎ বড় কোনো গাড়ির আলো তাদের চোখে পড়ে। আহির কৌশিক পূর্ণাকে ছেড়েই সেখান থেকে পালায়।পূর্ণা গাড়িটির দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়। তারপর রাস্তায় ঢুলে পড়ে।গাড়ি থেকে একটি ছেল বেড়িয়ে আসে। হাতে তার ছাতা। সে পূর্ণার কাছে এসে তার মুখে লাইট মারে। তারপর বলে,
– ও মাই গড পূর্ণা।
ছেলেটি আর কেউ নয় রিয়ান। সে পূর্ণাকে পাজা কোলে করে নেয়। নিজের গাড়িতে বসিয়ে ড্রাইভ করে হাসপাতালের দিকে রওনা হয়। গাড়িতে রিয়ানের সাথে আরও একজন ছিলো রিয়ানের প্রেমিকা মিহু। মিহু পূর্ণার হাতের খতস্থান রুমাল দিয়ে চেপে ধরেছে। কিন্তু কিছুতেই ব্লেডিং থামছে না। আসলে রিয়ান বাড়ি থেকে দুদিনের জন্য মেডিকেলের কাজে চট্রগ্রাম গিয়েছিল।বাড়ি এসে শুনে রাফাত পূর্ণা নিখোঁজ। তার মায়ের সেকি কান্না। আমার ছেলে মেয়েকে এনে দে। তাই রিয়ান আর দেড়ি না করে মিহুর কাছে যায়।মিহু একজন পুলিশ অফিসার। মিহুকে সব ঘটনা খুলে বলে। সে রাফাতের ফোন ট্রেক করে। ট্রেক করার পর জানতে পারে রাফাতের ফোন তাদের বাড়ির কোথাওই দেখাচ্ছে। কিন্তু কোথায় সেটা এখনো কেউ খুজে বেড় করতে পারেনি। এইদিকে অনেক রাত হওয়ায়। রিয়ান মিহুকে ড্রোপ করতে যাচ্ছিল। আর মাঝেই পূর্ণাকে পায়। বর্তমানে তারা এখনো হাসপাতালের করিডোরে আছে। রিয়ান পূর্ণাকে তার সিনিয়র একজন স্যারের কাছে এডমিট করিয়েছে। তিনি জানায় পূর্ণার শরীরের অনেক মারের দাগ। পিঠে পায়ে কেউ শক্ত কিছু দিয়ে বাড়ি দিয়েছে। গালেও চড়ের দাগ।কথাটা শোনার পর রিয়ান টেনশনে পড়ে যায়। সে স্পষ্ট দেখেছিলো ঐখানে আরও দুজন লোক ছিলো তাদের দেখে পালিয়েছে। মিহু সব শোনার পর বলে,
– রিয়ান পূর্ণার লাইফ রিস্ক আছে। কেউ ওকে খুন করতে চায়। তাই ওকে আমরা খুজে পেয়েছি এইটা আপাতত কাউকে বলার প্রয়োজন নেয়। আমার মনে হয় পূর্ণা বলতে পারবে রাফাত ভাই কোথায় আছে। আগে ওর জ্ঞান ফিরুক।
– তুমি বাড়ি যাবে না মিহু।
– না আগে কেসটা তো দেখি। এইখানে অনেক রহস্য আছে রিয়ান। যা আমরা খালি চোখে দেখতে পারছি না। আমার মনে হয় পূর্ণার জ্ঞান ফেরাটা জরুরি।
– হুম। তুমি কি পূর্ণার কাছে যাবে।
– চলো যাওয়া যাক।
ভোর বেলা। আকাশে এখনো মেঘরাশি দৌড়াদৌড়ি করছে। বাতাসের বেগটা একটু কমে এসেছে। কিন্তু বৃষ্টি নেয়। কাঁদার গন্ধে চারপাশ ঘিরে আছে। মিহু পূর্ণার পাশে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে আছে। রিয়ান সোফার শুয়ে আছে। পূর্ণা আস্তে আস্তে চোখ খুলছে। জানালা দিয়ে হালকা বাতাস কেবিনের মধ্যে ঢুকছে। সেই বাতাস পূর্ণার মুখে বাড়ি খাচ্ছে। পূর্ণা পরিস্থিতি বুঝে উঠার আগে উঠে বসতে নিলে হাতে টান খায়। ব্যথায় আহ করে উঠে। সে বুঝতে পারে হাতে কেনলা লাগানো। সে হাসপাতালে আছে। হাতে ব্যান্ডেজ করা। শরীরটা কেমন ব্যথা করছে। পূর্ণার আহ করার আওয়াজে মিহুর ঘুম ভাঙে। সে পূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে,
– উঠে গিয়েছো।
পূর্ণা চোখের সামনে সাদা শার্ট কালো জিন্দ পড়া একটি মেয়েকে দেখতে পায়। সে ভালোভাবে মেয়েটিকে দেখে মনে করার চেষ্টা করে সে কি মেয়েটাকে কখনো দেখেছে। মিহু পূর্ণার সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
– কি ভাবছো।
– ভাবছি আমি কি আপনাকে চিনি।
– নাহ। তুমি আমায় চিনো না তবে আমি তোমাকে চিনি।
কথাটা বলার সাথে সাথে রিয়ান এসে পূর্ণার সামনে দাড়ায়। পূর্ণা রিয়ানকে দেখে বলে,
– রিয়ান ভাই।
– হ্যা আমি পূর্ণা। কাল রাতে আমি তোমাকে সেভ করেছি। কতগুলো ছেলে তোমাকে আঘাত করছিলো।
রিয়ানের কথায় পূর্ণার কালকের রাতের ঘটনা মনে পড়ে। মনে পড়ে রাফাতের কথা রাফাত বন্দি পড়ে আছে চৌধুরী বাড়িতে। সে রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমি ঠিক আছি। আপনি বাড়ি এসেছেন কবে?
– কাল আর আসার পর মমের মুখে থেকে সব শুনি। দা ভাই নিখোঁজ তুমি নিখোঁজ। তোমাকে তো পেলাম কিন্তু দা ভাই কোথায়।
পূর্ণা জোরে শ্বাস নেয়। উঠে বসার চেষ্টা করে। মিহু তাকে সাহায্য করে। মিহু পূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে,
– পূর্ণা আমি একজন পুলিশ অফিসার। কাল রাতে যখন তোমাকে হাসপাতালে আনা হয়।তখন ডাক্তার বলে তোমার শরীরে থাকা আঘাতের কথা। তোমাকে এইভাবে আঘাত করেছে পূর্ণা সত্যি বলো। কোনো ভয় নেয় আমি তোমাকে সাহায্য করবো।
পূর্ণা মনে করে সে খুন করেছে। পুলিশ যদি জানে সে খুন করেছে তাহলে সে বাহিরে ঘুরতে পারবে না। সে তার রাফাতকে উদ্ধার করতে পারবে না। তারমধ্যে কোনো প্রমাণ নেয় এইসবের।কৌশিক রিয়ানের আপন ভাই আদরের ভাই এইসব কোনো কিছু সে বিশ্বাস করবে না। তাই সে বলে,
– ওরা আমায় রেপ করতে চেয়েছিলো। বাধা দিয়েছি বলে মেরেছে। কিন্তু আমি জানি না রাফাত ভাই কোথাও।
মিহুর তীক্ষ্ম দৃষ্টি বুঝে যায় পূর্ণা মিথ্যে বলছে কিন্তু কেন? রিয়ানের জন্য। হয়তো এমন কিছু কথা আছে যেটা সে রিয়ানের সামনে বলতে চাইছে না। মিহু রিয়ানকে বলে,
– রিয়ান নিচে গিয়ে আমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসো। পূর্ণা তো বললো সে কিছু জানে না। তাহলে আর সময় লস করে কি লাভ যাও।
রিয়ান মিহুর কথায় চলে যায়। মিহু পূর্ণার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– মিস পূর্ণা এইবার সত্যি টা বলুন। কোন কথা আপনি চেপে যাচ্ছেন। আপনি যদি সত্যি না বলেন তাহলে আমরা ধরে নিবো আপনি শত্রুপক্ষের সাথে আছেন।
পূর্ণা ভাবে সে পাপ করেছে শাস্তি তার প্রাপ্য। আবার তার একার পক্ষেও রাফাতকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কারো সাহায্য দরকার। তাই সে মিহুর হাত ধরে বলে,
– আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন তাহলে আমি সব বলবো।
– কেন সাহায্য করবো না। অবশ্যই করবো। তুমি নির্ভয়ে বলো পূর্ণা।
পূর্ণা গলাটা ঝেড়ে বলে,
– রাফাতে ছোট ভাই কৌশিক রাফাতকে আটকে রেখেছে।
মিহু চমকে বলে,
– হোয়াট আমি বিশ্বাস করি না।
– আমি জানি আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তবে কথাটা সত্য। ওহ আর রিয়ান ভাইয়ের বন্ধু আহির ওরা দুজনে আমাকে আর রাফাতকে আটকে রেখেছিলো।
– খোলোসা করা বলে।
তখন পূর্ণা সব কথা মিহুকে খুলে বলে। মিহু শোনার পর অবাক হয়ে বলে,
– তোমার মতো একটা বাচ্চা কাউকে খুন করছে।
পূর্ণা চোখ বন্ধ করে পানি ফেলে বলে,
– দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নারী রুখে দাড়ায়। আমিও তাই করেছি। ঐ ঝুমুর বাইজিকে না ধরলে অনেক মেয়ের জীবন এইভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। আপু আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি রাফাতকে উদ্ধার করার পর আমি নিজে আপনার কাছে আত্মসমাপণ করবো। আমাকে শুধু কিছু দিনের সময় দিন।
– তোমার লাইফ রিস্ক আছে পূর্ণা। ওরা তোমাকে পেলে খুন করবে। আমি তোমাকে একা ছাড়তে পারিনা।
– আমি একা যাচ্ছিও না। আপনি আমার সাথে থাকবেন। আজ রাতে আমরা ঐ বাড়ি যাব। কৌশিকের ঘর দেখবো।
– আচ্ছা যাব।
– কিন্তু আমি বেঁচে আছি কাউকে বলবেন না। আর রিয়ান ভাইকে এখনোই কিছু বলতে যাবেন না।
– ঠিকাছে বলবো না। কারণ রিয়ান কিছুই বিশ্বাস করত চাইবে না। তাই না বলেও বুদ্ধিমানের কাজ।
– আচ্ছা। তাহলে এই কথাই রইলো।
– হুম।
#চলবে
বিঃদ্র ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ।
রিচেক দেয়নি তাই কিছু ভুল থাকতে পারে।#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১০
চৌধুরী বাড়ি
বনুলতা মেঝেতে বসে চিৎকার করে কান্না করছে। তার পাশে বসে তাকে শান্তনা দিচ্ছে তার বড় বোন জবা বেগম। সাবা সাবার মা সালমা বেগমও এসেছে। সবাই বনুলতার পাশে বসে আছে। রশীদ চৌধুরী চিন্তিত মুখ নিয়ে সোফায় বসে আছে। সাবা বনুলতাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বলে,
– মামী মনি দা ভাই ভালো আছে তো।
ওর কান্নায় যেনো বনুলতা আরও ভেগে পড়ে। সে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। এই সময় বাড়িতে প্রবেশ করে রিয়ান আর মিহু। রিয়ানকে দেখে বনুলতা দৌড়ে রিয়ানের কাছে যায়। আঁচল পেতে বলে,
– রিয়ানরে আমার ছেলে মেয়েরে আইনা দে। আমি আমার সন্তান হারাতে পারবো না। তোর মায়েরে দোয়া কর রিয়ান।
মিহু এসে বনুলতাকে ধরে। সে বনুলতার মাথাটা তার বুকে রেখে বলে,
– মামনি আপনি কাঁদবেন না প্লিজ। রাফাত ভাই পূর্ণাকে খুব দ্রুত খুজে পাওয়া যাবে।
বনুলতা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে বলে,
– খবরদার আমারে মামনি বলবা না। এই ডাক টা শুধু পূর্ণার জন্য বরাদ্দ।
মিহু বনুলতার বাচ্চামো দেখে হাসে। সে বলে,
– ঠিকাছে তাহলে আমি মা বলি।
বনুলতা এতকিছুর মধ্যেও ছেলের দিকে তাকায়। রিয়ান মাথা চুলকে জায়গা ত্যাগ করে। বনুলতা ম্লান হেসে বলে,
– এমন সময় এই বাড়ি আসলে মা। আমি কিছুই করতে পারলাম না।
মিহু বনুলতাকে সালাম করে বলে,
– কিছু করতে হবে না মা। আমি আপনাদের সাহায্য করতে এসেছি। আমি অফিসার মিহু। রাফাত ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার কেসটা আমি দেখছি।
– ওমা তুমি পুলিশ।
– জ্বি মা।
– আমার ছেলে মেয়ে কবে বাড়ি আসবে?
বনুলতার কন্ঠে বেকুলতা। মিহু দৃঢ় কন্ঠে বলে,
– চলে আসবে খুব শীঘ্রই। আমি খুজে বেড় করবো।
মিহু রশীদ চৌধুরীকে সালাম করে। তারপর সবার সাথে সোফায় বসে বলে,
– আচ্ছা মা আপনার আরেক ছেলে কোথায়?
– কৌশিক।
– জ্বি মা।
– ওহ তো বাসায় নেয়। কলেজ থেকে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছে।
– ওহ আর জবা আন্টির ছেলে আহির।
জবা কড়া গলায় বলে,
– এখন কি তুমি আমার ছেলেকে সন্দেহ করছো নাকি।
– দেখুন আন্টি আমি সন্দেহ করছি না। আমি শুধু জানতে চায়ছে এই বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য কোথায় আছে। হয়তো তাদেরও বিপদ হতে পারে। এই সময় সবাই একসাথে থাকা ভালো। আচ্ছা রাফাত ভাইয়ের কি কোনো শত্রু ছিলো।
রিয়ান এসে সোফায় বসে বলে,
– আমার ভাইয়ের কোনো শত্রু ছিলো না।
মিহু তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রিয়ানের দিকে তাকায়। যার অর্থ যদি কেউ কিছু বুঝে তো তোমার খবর আছে। আসলে হাসপাতালে যখন পূর্ণা সবকিছু মিহুকে বলছিলো তখন সবকথা রিয়ান শুনে ফেলে। আর শোনার পর বলে তার ভাই কোনো দোষ করতে পারে না। আহির কৌশিককে পূর্ণা ফাসাচ্ছে। পূর্ণাকে বার বার খুনি বলে প্রস্টিটউট বলে। পূর্ণা খুব কান্না করে।অপমান বোধ করে। শেষে মিহুর কড়া কথায় রিয়ান চুপ হয়। মিহুর এক কথা আমি কেসটা দেখছি সো আমার কথাই শেষ কথা। রিয়ান চৌধুরী তুমি যদি তোমার ভাইকে সুস্থ অবস্থায় চাও তাহলে আমার কথা শুনো।
মিহুর কথায় রিয়ান চুপ হয়ে যায়।সুযোগ দেয় পূর্ণাকে নিজেকে প্রুভ করার।
______________________________________
বাইজি গৃহ
ঝুমুর বাইজি হাতে রিভালবার নিয়ে পর পর দুটি সুট করে সামনের দিকে। সাথে সাথে দুজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আরও পাঁচ ছয়জন তার পা ধরে বলে,
– খালা এইবারের নাগাল মাফ কইরা দাও। কথা দিবার লাগছি ঐ ছেমড়িরে ধইরা লইয়া আহুম।
তখন ঐখানে আহির আর কৌশিক আসে। আহিরের পিঠে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। কৌশিক ঝুমুর বাইজির হাত থেকে রিভালবারটা কেড়ে নেয় তারপর লোকগুলোকে চলে যেতে বলে। ঝুমুর বাইজি কৌশিকের উপর বাঘিনীর মতো ঝাপিয়ে পড়ে। কৌশিক ঝুমুর বাইজির হাত ধরে তাকে থামিয়ে বলে,
– খালা খালা শান্ত হও তুমি। কেন এমন করছো।ভুলে যাচ্ছো কেন তোমার হাই প্রেশার। খালা আমার কথা শুনো খালা।
ঝুমুর ঠান্ডা হয়। সে আসনে বসে বলে,
– কৌশিক আমার পূর্ণারে চাই। এহহোন চাই। ঐ কু*ত্তা*র বাচ্চা আমার বড় কাস্টমাররে খুন করছে। আমি ওরে পাইলে কুটিকুটি করে কাটুম।
আহির বসে বলে,
– খালা কেন ভুলে যাচ্ছো রাফাত আমাদের কাছে।
তৃষ্ণার্ত কাক যেমন পানি পেয়ে খুশিতে তার চোখ চিকচিক করে ঠিক তেমনি ঝুমুর বাইজির চোখ চিকচিক করছে। সে বাকা হাসি দিয়ে বলে,
– পাখি স্বেচ্ছায় খাঁচায় আয়বো। টোপ তো আমারই হাতে।
কথাটি বলে ওরা তিনজনে একসাথে হেসে উঠে।
______________________________________
গভীর রাত। তিন জোড়া পা ধীরে ধীরে চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করছে। একজনের পরনে সুতি থ্রী পিজ মুখটা ওরনা দিয়ে বাধা। আরেক জন সাদা শার্ট আর জিন্সে আছে। আর একজন পাঞ্জাবি পড়ে আছে। দরজার সামনে এসে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে তারা। মানুষগুলো আর কেউ না পূর্ণা, রিয়ান, মিহু। দরজা খুলে তিনজন সোজা উপরে চলে যায় কৌশিকের ঘরে। পূর্ণা কৌশিকের বিছানার দিকে তাকিয়ে বলে,
– খাট টা সরাতে হবে।
অনেক কষ্টে রিয়ান, পূর্ণা, মিহু খাট টা সরায়। কিন্তু খাট সরানোর পর পূর্ণা অবাক কন্ঠে বলে,
– একি দরজা কোথায়?
মিহু পূর্ণার কথায় বলে,
– আসলেই তো। পূর্ণা তোমার ভাস্যমতে এখানে দরজা থাকার কথা।
রিয়ান হেসে বলে,
– শুধু সময় লস। চলো মিহু।
পূর্ণা মিহুর হাত ধরে বলে,
– এক মিনিট।
পূর্ণা যেখানে দরজাটা ছিলো সেখানে গিয়ে হাত রাখে। কেন জানি মনে হচ্ছে দরজাটাকে লুকানো হয়েছে। ঐ পাশে রাফাত আছে মন বলছে। হঠাৎ পূর্ণা কিছুর ঘ্রাণ পায়। সে দেয়াল শুকতে থাকে। পূর্ণা বলে,
– এইটা কিসের গন্ধ। পূর্ণা ভালো ভাবে ঘ্রাণ নিয়ে দেখে রঙের গন্ধ। তারমানে এখানে নতুন রঙ করা হয়েছে।
সে রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– রিয়ান ভাই বাড়িতে কি নতুনে রঙ করা হয়েছে।
– কোথায় না তো।
পূর্ণার যা বোঝার বুঝে ফেলে। সে দৌড়ে মিহুর কাছে আসে তারপর বলে,
– আপু এইখানে দরজা আছে। আই এম সিউর। ওরা দরজা লুকানোর জন্য নতুন করে এইখানে রঙ দিয়েছে। তুমি একটা রড আনো আমি আস্তর ভাঙবো।
– কি বলছো পূর্ণা। বাড়ির সবাই জেগে যাবে।
– কেউ জাগবে আমি যতদূর জানি এই ঘর সাউন্ড প্রুফ। আমাকে রাফাত বলেছে।
রিয়ান বলে,
– হ্যা কৌশিকের ঘর সাউন্ড প্রুফ।ওর বেড হেবিড আছে চব্বিশ ঘন্টা লাউট মিউজিক শোনা।তাই বাড়ি তৈরির সময় ওহ ভাইকে বলছিলো ওর ঘরে সাউন্ড প্রুফ সিস্টেম করতে। তাছাড়া ওহ এইটাও বলেছিল ওর ঘরের ডিজাইন ওহ নিজে বলে দিবি।
মিহু বলে,
– আচ্ছা এই কথাটা তো তুমি আগে বলো নি।
– এতে বলার কি আছে।
পূর্ণা বলে,
– কথা বাড়িয়ে লাভ নেয়। যা করতে হবে তাড়াতাড়ি।
– ওকে রিয়ান রড নিয়ে এসো।
রিয়ান গিয়ে একটা রড নিয়ে আসে। তারপর দেয়ালে আঘার করলে কিছু আস্তোর ভেঙে আসে। তারপর দেখি যায় কালো রঙের দরজা। মিহু বলে,
– দরজা ভাঙো।
রিয়ান দরজা ভাঙে। ভাঙার পর তারা সিড়ি দেখতে পায়। তিনজন সিড়ি বেয়ে নিচে নামে। নামার পর পূর্ণা রাফাতকে খুজে,
– কোথায় রাফাত। এইখানেই তো পড়ে ছিলো।
মিহু পূর্ণা কাধে হাত রেখে বলে,
– পূর্ণা কুল। ওরা যেহেতু বুঝে গিয়েছে আমরা এইখানে আসবো।তারমানে রাফাত ভাইকে ওরা সরিয়ে দিয়েছে।
পূর্ণা পাগলের মতো রাফাতকে খুজতে থাকে। একটার পর একটা ঘর খুলে দেখে। সে এক ঘরে থেকে গোঙাোর আওয়াজ পায় পূর্ণা। সে ঐ ঘরের সামনে গিয়ে বলে,
– রিয়ান ভাই এই দরজাটা ভাঙো।
পূর্ণার ডাকে রিয়ান মিহু দৌড়ে পূর্ণার কাছে আসে। রিয়ান দরজা ভাঙার জন্য পা তুললে।দরজাটা ওপাশ থেকে খুলে যায়। ওরা তিনজনে অবাক হয়ে সামনে তাকায়। সামনে রাফাতের মাথায় বন্দুক ধরে দাড়িয়ে আছে কৌশিক আর আহির। তার পাশেই চেয়ারে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে ঝুমুর বাইজি। পূর্ণা চিৎকার করে বলে,
– রাফাত।
রাফাত আধো আধো চোখে পূর্ণাকে দেখে। ওর শরীরে বসে থাকার মতো শক্তি নেয়। গত দুদিন ধরে ওর শরীরে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করা হচ্ছে যেটা ওকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছে। রাফাত একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। রাফাতের এই অবস্থা দেখে পূর্ণার ভেতরটা মুচড়ে উঠে। তার চোখে পানি জমে উঠে। রিয়ান অবাক হয়ে বলে,
– কৌশিক ভাইয়ের মাথায় তুই রিভালবার ধরেছিস।
কৌশিক একটু অভিনয় করে বলে,
– ওহ ওহ আমার বড় ভাই। আল্লাহ্ আমি তার মাথায় রিভালবার ধরেছি।হাই হাই কি করে ফেলেছি। তুমি বাঁচাও খোদা।
তারপর হেসে দিয়ে বলে,
– তুমি কি ভাবছো রিয়ান ভাই আমি এমনটা করবো। কখনোই না। ঐ বাড়িতে কখনো আমার কদর ছিলো। ঐ বাড়িতে আমি কখনো আম্মুর আদর পেয়েছি। সব সময় আম্মু রাফাত রিয়ান রাফাত রিয়ান করতো। আম্মুর কাছে আমার কোনো দাম ছিলো না। আমি একটু ভালোবাসা পাওয়ার আসায় দিনের পর দিন অপেক্ষা করতাম। কিন্তু আম্মু আমায় অবহেলা করতো।তাই সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আম্মুর আদরের সন্তানদের আমি কুটি কুটি করবো।
রিয়ান চিল্লিয়ে বলে,
– কৌশিক।
– আরে চপ।গলা নামিয়ে এইটা ঝুমুর বাইজির আস্তানা এইখানে শুধু ঝুমুর বাইজি গলা উচিয়ে কথা বলে আর কেউ না।( কৌশিক )
রিয়ান এইবার নিজের রাগ ধরে রাখতে পারে না। সে কৌশিকে কলার চেপে ধরলে। কৌশিক বলে,
– ভাইয়ের জীবনের প্রতি মায়া থাকলে কলার ছাড়।
ছোট ভাইয়ের মুখ থেকে তুই সম্মোধন শুনে রিয়ান সরে আসে। বুকের মধ্যে কেউ যেনো হাতুরি পিটা করছে। চোখদুটো ছলছল হয়ে উঠে। রিয়ান দুকদম পিছিয়ে বলে,
– আম্মু নাহয় একটু কম আদর করেছে। কিন্তু কৌশিক আমাদের আদর টাও কি কম ছিলো ভাই। আমি ভাই তোকে কি ভালোবাসিনি। তোকে আদর করেনি।
কথাটা বলতে গিয়ে রিয়ানের গলা ধরে আসে। কৌশিক রিয়ানকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলে,
– ঐ বাড়িটা রাফাত চৌধুরীর। তাই অলয়েস তার কথা শুনে চলতে হয়। আমি কৌশিক চৌধুরীর রাফাত চৌধুরীর হাতের পুতুল হতে পারবো না। তাই ওর সম্পত্তি নিজের নামে করার জন্য ওকে এইখানে আটকে রেখেছি। কিন্তু বেটা মরে যাচ্ছে তাও শই করছে না।
মিহু রিয়ানকে ধরে উঠায়। আহির রিয়ানের কাছে এসে বলে,
– বাহ পুলিশ নিয়ে এসেছিস।
রিয়ান আহিরের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
– তোরা সবাই জা*নো*য়া*র।
– ঠিক বলেছিস হিংস্র পশু।
কথাটা বলে ওরা হেসে উঠে। পূর্ণা দূরে থেকে সব দেখছে। আর ভাবছে এই মানুষগুলোকে সে বিশ্বাস করেছিল। শুধু কি সে রাফাত রিয়ান ভাই সবাই। কিন্তু এরা কিসের মর্যাদা দিলো। পূর্ণার বুকটা হা হা করে উঠছে। রাফাতের ঐ মুখশ্রী সে দেখতে পারছে না। ঝুমুর বাইজি উঠে দাড়িয়ে বলে,
– আহ অনেক হয়েছে রঙ তামাশা। এখন আসল কাজ কর। এই তিনটারে বাধ ঐ চেয়ারের সাথে।
ঝুমুর কথাটা বললে। মিহু পেছন থেকে রিভালবার বের করে ঝুমুরের দিকে তাক করে বলে,
– এক পা এগোবি তো শেষ করে দিবো।
আহির মিহুর কাছে এসে হেসে বলে,
– মিহু তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমাদের কাছে রাফাত আছে। তোমাদের একটা ভুল স্টেপ রাফাতকে শেষ করে দিবে।
আহির রাফাতের চুলগুলো খামচে কথা গুলো বললো। পূর্ণা তা দেখে চিৎকার করে বলে,
– নাহ। আহির তুমি রাফাতের কিছু করবে না।
পূর্ণার কন্ঠে বেকুলতা। এর সাহসী একটা মেয়ে প্রিয় মানুষের এই অবস্থা সহজেই ভেঙে পড়েছে। ঝুমুর পানের পিক ফেলে বলে,
– আমি তো জানতাম। মাইয়াগো দুর্বল জিনিস কি? তাই তো রাফাতকে আটকাই রাখছি। তুই ধরা দে রাফাতরে ছাইড়া দিমু।
পূর্ণা চোখদুটো ছোট ছোট করে বলে,
– আগে ছাড় পরে আমি আসবো।
– উহুম দুজনে একসাথে।
পূর্ণা জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
– ওকে।
কৌশিক রাফাতকে নিয়ে দরজার দিকে আসছে। আর পূর্ণা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দুজন পাশাপাশি হতেই দুজনে থেমে যায়। কৌশিক পূর্ণার পাশে ছিলো। পূর্ণা কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বাকা হাসি হাসে। কৌশিক পূর্ণার হাসির মানে বোঝার আগে পূর্ণা কোমরে গোজা ছুড়ি দিয়ে কৌশিকের হাতে আঘাত করে। কৌশিক চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে রাফাত মাটিতে পড়ে যায়। পূর্ণা রাফাতকে ধরে ফেলে। আহির রিভালবার বের করে সুট করতে নিলে মিহু আহিরের হাতে সুট করে আহির ব্যথায় বসে পড়ে। ঝুমুর বাইজি পালানোর চেষ্টা করলে কতগুলো পুলিশ এসে ওদের ধরে ফেলে। মিহু অনেক আগেই তার ফোর্স রেডি করে রেখেছিলো। ঝুমুর শাসিয়ে বলে,
– কাউকে ছাড়ুম না। সব কয়টারে খুন করুম। আমারে তোরা চিনস না।
মিহু ধমক দিয়ে বলে,
– সাট আপ।
আহির, কৌশিককেও পুলিশ নিয়ে যায়। পূর্ণা রাফাতের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বারবার ডাকছে,
– রাফাত রাফাত চোখ খুলো। তাকাও আমার দিকে আমি আমি তোমার পূর্ণাবতি তোমার কাছে এসেছি। এইভাবে থেকো না। চোখ খুলো রাফাত।
পূর্ণা কাঁদছে। রাফাতের হুশ নেয়। রিয়ান এসে রাফাতের পালস চেক করে। তারপর বলে,
– ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে নিতে হবে।
রিয়ান রাফাতকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। সাথে মিহু পূর্ণাও যায়। এতক্ষণে বাড়ির সবাই জেনে গিয়েছে। রাফাতকে আটকে রেখেছিলো কৌশিক আর আহির। যা শোনার পর বনুলতা একবারে ভেঙে পড়ে। আরও বেশি ভেঙে পড়ে এইটা শুনে ওরা নষ্ট পল্লির সাথে জড়িত ছিলো। হাসপাতালের করিডোরে এখন দাড়িয়ে আছে বনুলতা, রশীদ চৌধুরী, রিয়ান, মিহু, পূর্ণা, সাবা,জবা বেগম, সালমা বেগম, সালমা বেগমের স্বামী। বনুলতা হাউমাউ করে কাঁদছে। কখনো আবার জ্ঞান হারাচ্ছে। জবা বেগম নিজের ছেলের প্রতি ধিক্কার জানাচ্ছে। আবার কষ্টে বুকটা হু হু করে উঠছে। রশীদ চৌধুরী খামোশ হয়ে বসে আছে। যখন শুনেছে ঝুমুর বাইজির নাম তখন থেকে সে চুপ। বনুলতা পূর্ণাকে বুকে নিয়ে বসে আছে। পূর্ণা কিচ্ছু বলছে না চুপ করে বসে আছে। যেনো শোকে শোকে সে পাথর হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ সেইখানে পুলিশ আসে। মিহু এগিয়ে যায়। একটা ছেলে বলে,
– ম্যাম ঝুমুর বাইজির আস্তানায় একটা লাশ পাওয়ার গিয়েছে। লাশটা কোনো বিদেশীর।
আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি উনি গত মাসে অস্ট্রেলিয়া থেকে বিডিতে এসেছে।
– আচ্ছা। নাম কি?
– স্টিফেন। ঝুমুর বাইজির রেকর্ড বের করে দেখলাম উনি স্টিফেনের সাথে মেয়ে বাহিরে পাঠিয়ে দিতো।
– আচ্ছা। খুনটা কে করেছে ঝুমুর বাইজি।
– নো ম্যাম ঝুমুর বাইজি বলছে পূর্ণা।
মিহু পূর্ণার দিকে তাকায়। পূর্ণা মিহুর চাহনি দেখে উঠে আসে। বনুলতা পূর্ণার হাতটা ছাড়তে চায়নি। পূর্ণা অনেক বুঝিয়ে উঠে এসেছে। আইসিইউ থেকে ডাক্তার বেড়িয়ে আসলে মিহু বলে,
– আমি আসছি।
পূর্ণার এইদিকে না এসে ডাক্তারের কাছে যায়। রিয়ান বলে,
– স্যার আমার ভাই কেমন আছে।
– আলহামদুলিল্লাহ্ উনি এখন ভালো আছে। এখন ঘুমোচ্ছে।
সবাই শুকরিয়া জানায়। পূর্ণা আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া জানায়। বনুলতা পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– আল্লাহ্ মুখ তুলছে পূর্ণা। তুই আমার বুকে ফিরে এসেছিস এখন রাফাতও আসবো।
কথাটা বলে বনুলতা পূর্ণার কপালে চুমু খায়। মিহু পূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে,
– সময় হয়েছে আমাদের যেতে হবে।
মিহুর কথায় সবাই অবাক চোখে মিহুর দিকে তাকায়। রিয়ান বুঝতে পারে মিহু কেনো এইসব বলছে। সে মিহুর হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
– না মিহু।
মিহু হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে,
– আইন আইনের পথে চলে রিয়ান আবেগ দিয়ে চলে না। আইনের চোখ বাধা। পূর্ণা তুমি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছো।
পূর্ণা বনুলতাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের হাতদুটি উঠিয়ে বলে,
– এ্যারেস্ট মি। আমি প্রস্তুত। আমার রাফাত ঠিকাছে এখন আমি যেতে পারি। এরপর দেড়ি হয়ে গেলে ওর সামনে দিয়ে আমি থানায় যেতে পারবো না মিহু আপু।
শেষের কথাটা পূর্ণা কেঁদে দিয়ে বলে। বনুলতা পূর্ণাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বিষ্ময় নিয়ে বলে,
– কি করেছিস তুই পূর্ণা। ওরা কেন তোকে নিয়ে যাবে।
পূর্ণা মাথা নিচু করে কাঁদছে। মিহু সবাইকে বলে,
– পূর্ণা স্টিফেন নামের একজনকে খুন করেছে। যে ওকে রেপ করতে চেয়েছিলো।
বনুলতার বুকটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে। সে পূর্ণাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
– নাহ আমার মেয়ে খুন করতে পারে না। ওর মত শান্ত মেয়ে এত বড় ভয়াবহ কাজ করতে পারে না। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।
পূর্ণা বনুলতাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
– কোন ভুল হচ্ছে না মামনি কথাটা সত্যি। মামনি আমি যাচ্ছি আমার রাফাতকে দেখে রেখো। ওহ যে আমায় বলতে পাগল। তুমি ওর খেয়াল রেখো। আমি হয়তো আর নাও ফিরতে পারি।
বনুলতা পূর্ণার হাত শক্ত করে ধরে পাগলের মতো বলে,
– তোর কিছু হবে না কিচ্ছু না। আমি তোকে কোথাও যেতে দিবো না। আমি আমার মেয়েকে কোথাও যেতে দিবো না। কেন এসেছো তোমরা। পূর্ণা আমি বলে দিলাম তুই কোথাও যাবি না।
পূর্ণা খুব ইচ্ছে করছে এই মায়ের বুকে মাথা রেখে সারা জীবন কাটাতে কিন্তু এইটা তো সম্ভোব না। পূর্ণা কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ওদের এই কাহিনি দেখে সবাই কাঁদছে। পূর্ণা বনুলতার হাত ছাড়িয়ে বলে,
– যাই মামনি। চলো আপু।
কথাটা বলে পূর্ণা আর এক পাও দাড়ায় না। পেছন ফিরে তাকায় না। বা হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যায়। পূর্ণার পেছন পেছন মিহুও ওহ তার ফোর্স চলে আসে। বনুলতা ফ্লোরে পড়ে চিৎকার করে কাঁদছে বার বার বলছে,
– রিয়ান রিয়ান রে ওরা যে আমার মেয়েটারে নিয়ে গেলো। আমার রাফাতকে আমি কি জবাব দিবো। ওরা নিয়ে আয়। আমার রাফাত যে ওরে ছাড়া নিঃশ্ব। আল্লাহ্ আমার মেয়েরে আমার বুকে ফিরায় দাও।
বিলাপের এক পর্যায় বনুলতা অজ্ঞান হয়ে যায়। রিয়ান মাকে ধরে বলে,
– মাহ।
#চলবে
বিঃদ্র ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ।