#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১৫
গোধূলি বিকেল। সূর্যটা ডুব ডুব। এখনো ডুবে যায়নি। সূর্যের হলদে আলোয় সবকিছু মায়াবি লাগছে। এমনি এক মায়াবি বিকেলে সমুদ্র পাড়ে পাশাপাশি হাটছে পূর্ণা আর রাফাত। পূর্ণা খালি পা সে সমুদ্রের পানিতে পা ভেজাচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছু পানি রাফাতের মুখে ছিটিয়ে মারছে। রাফাত পূর্ণার বাচ্চামো দেখে মুচকি হাসছে। এমনি একটি বিকেলে হাটার শখ ছিলো পূর্ণার যা আজ রাফাত পূরণ করতে পেরেছে। এজন্য সে বেজায় খুশি। পূর্ণা শাড়ি পড়েছে নীল শাড়ি। নীল শাড়ি আর সূর্যের হলদে আলোতে পূর্ণাকে অপসরীর মতো লাগছে। তার সাদা শরীর চারদিকে আলো করে তুলছে। রাফাত মুগ্ধ হয়ে শুধু পূর্ণাকে দেখছে। সাগর গর্জে বড় বড় ঢেউ পাড়ে আছরে পড়ছে। হঠাৎ পূর্ণা রাফাতের হাত ছেড়ে দিয়ে বলে আমি ফুচকা খাব। রাফাত হেসে বলে,
– এখন?
– হুম এখন চলো না আমরা ঐ দিকে যায়।
রাফাতের হাত ধরে বায়না করে। রাফাত পূর্ণার হাত শক্ত করে ধরে বলে,
– চলো যায়।
তারপর দুজনে হাটতে হাটতে একটি ফুচকার দোকানের সামনে আসে। পূর্ণা ফুচকা দেখে পাগল হয়ে যায় লোভ সামলাতে পারে না। তাই দ্রুত বলে,
– মামা দু প্লেট ফুচকা দিন না।
রাফাত না ছিটকে বলে,
– আমি কিন্তু খাবো না।
পূর্ণা গাল ফুলিয়ে বলে,
– কেন?
– তুমি খাও আমি দেখি তোমাকে।
পূর্ণা রাফাতের নাক টেনে বলে,
– কেন দেখে মন ভরে না।
রাফাত গুনগুনিয়ে বলে,
– নয়ন ভরে দেখি তোমায়। তবু বুঝি দেখার শেষ নাই।
পূর্ণা খিলখিল করে হাসে। পূর্ণার ঐ হাসির দিকে রাফাত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ফুচকাআলা মামা ফুচকা দিলে পূর্ণা ফুচকা খেতে শুরু করে। পূর্ণা ফুচকা খাচ্ছে আর চোখ মুখ কুচকাচ্ছে যা রাফাতকে আরও দূর্বল করে তুলছে পূর্ণার প্রতি। রাফাত কলারটা ঠিক করে বলে,
– এই মেয়ে আমাকে জ্বালিয়ে মারছে। একে তো রূপ দিয়ে ভস্ম করছে। এখন আবার আকার ইঙ্গিতে হৃদয় হরণ করছে। হায়রে এইবার বুঝি দম আটকে যাবে।
পূর্ণা এইসবের কিছুই শুনতে পায় না। সে রাফাতের দিকে ফুচকা নিয়ে বলে,
– নাও হা করা খুব মজা একটা খেয়ে দেখো।
– এই না আমি খাব না।
কিন্তু পূর্ণা নাছর বান্দা সে জোরজবরদস্তি রাফাতের মুখে ফুচকা ঢুকিয়ে দেয়। রাফাত খুব কষ্টে ফুচকা খায়। তারপর পূর্ণা আরও একটি ফুচকা রাফাতের মুখের সামনে ধরে। রাফাত হা করে খেতে নিলে ফুচকা টা পূর্ণা নিজের মুখে পুড়ে নেয়। রাফাত হা হয়ে পূর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে। পূর্ণা প্লেটটা ফুচকা ওয়ালাকে দিয়ে রাফাতকে বলে,
– বিলটা দিয়ে দাও।
কথাটা বলে পূর্ণা চলে যায়। আর রাফাত বিল দিয়ে দৌড়ে পূর্ণার পিছে আসে। আর ওকে হেচকা টান দিয়ে বলে,
– খুব আমাজে আছো হুম। নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছো নাকি।
পূর্ণা রাফাতকে ছাড়িয়ে বলে,
– যে আমার প্রেমে আগে থেকেই ডুবে আছে তাকে আর কী ডুবাবো।
রাফাত পূর্ণার আরো কাছে এসে বলে,
– আমিতো আরও গভীর যেতে চায়। যতটা গভীরে গেলে তোমাকে ছাড়া সব ফাকা ফাকা লাগবে।
পূর্ণা রাফাতকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর হাসতে হাসতে বলে;
– পাবলিক প্লেসে ড্রামা করেন।
রাফাত বালিতে পড়ে যায়। তার পাঞ্জাবি বালি দিয়ে তলিতে গিয়েছে। সে পূর্ণা দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– তবে রে দাড়া।
রাফাতের এমন কথায় পূর্ণা দৌড়ে পালায়। তার পেছন পেছন রাফাতও দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে পূর্ণা হাপিয়ে যায়। চোখ মেলে তাকায় পূর্ণা। ঘামছে সে। হাপাচ্ছেও খুব। চারপাশ অন্ধকার। চোখ বলিয়ে শুধু একজনকেই খুজছে। কিন্তু সে কথায়। এত অন্ধকার কেন? কোথায় আছে সে। আলো জালায় না কেন? হঠাৎ পূর্ণার মনে পড়ে সে জেলখানায় আছে। এখানে সব সময় অন্ধকারই থাকে। আলোর দেখা মিলে না। পূর্ণার বুক চিড়ে নিঃশ্বাস আছে। এতক্ষণ যা দেখলো সব স্বপ্ন ছিলো। ঘুমের রাজ্য তার কাছে রাফাত এসেছিলো। তাকে ছুয়েছিলো। তার সাথে আনন্দের সময় পার করেছে। ইসস যদি স্বপ্ন টা সত্যি হতো। খুব ভালো স্বপ্ন ছিলো। পূর্ণা কাঁদে। ঝরঝর করে পানি পড়ে তার দুচোখের গভীর পুকুর থেকে। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতটা আবার তাজা হয়ে উঠে। মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে রাফাতের হাস্যজ্জৌল মুগশ্রী। পূর্ণাবতি ডাক। কত সুন্দর করে ডাকে রাফাত। ঘোর লাগনো ডাক তার। যেনো কন্ঠে আছে ধনুক ছোড়া তীর। যেই তীর তার বুকে এসে বিধে। বুকের ভেতরটা এফোর ওফোর করে দেয়। পূর্ণা এখনো কাঁদছে। তার কান্নার আওয়াজে পাশের কয়েদি জেগে যায়। পূর্ণার পাশে এসে বসে। তার মাথায় হাত রেখে। পূর্ণা আবারো ভুল ভাবে। সে ভাবে রাফাত। সে মেয়েটিকে জরিয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– রাফাত আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রাফাত আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমার বুকে একটু ঠায় দেও আমায়। একটু আগলে রাখো। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। এই অন্ধকার আমায় গিলে খাচ্ছে। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না রাফাত। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই কোন দহনে পুড়ছি আমি। কোন বন্ধনে তুমি আমায় বাধলে। এই বাধন ছেড়ার ক্ষমতা যে আমার নেয়। আমি কি করবো বলে দাও বলে দাও প্লিজ। বাস্তব জগতে তুমি কল্পণার জগতে তুমি ঘুমের ঘরে তুমি। সর্বত্র তুমি আমি কীভাবে বাঁচি তোমারে ছাড়া।
মেয়েটি পূর্ণার মাথায় হাত রেখে। নিচু স্বরে ডাকে,
– বোন।
পূর্ণা থেমে যায়। তার কান্না থেমে যায়। সে মেয়েটিকে ছেড়ে দেয়। বড় বড় চোখ করে মেয়েটির দিকে তাকায়। সে আবারও ভুলে গিয়েছে সে জেলে। এখানে কোনোভাবেই রাফাত আসতে পারে না। পূর্ণা মেয়েটিকে বলে,
– সরি।
মেয়েটি পূর্ণার হাত ধরে বলে,
– কোনো বেপার না। তোমার কষ্ট দেখে আমার ভেতর পুড়ে যাচ্ছে। জীবনে অনেক খুনি দেখেছি কিন্তু তোমার মতো কাউকে দেখিনি। একজন খুনি কখনো কাউকে এত ভালোবাসতে পারে। তুমি সত্যি অন্যরকম বোন। তুমি যে বাধ্য হয়ে খুন করেছো তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অনুতপ্তের আগুনে পুড়ছো। আবার ভালোবাসার বিরহে জ্বলছো। আল্লাহ্ তোমার ভেতরে শান্তি দিক। আমি জানি না আমার মতো পাপীর ডাক আল্লাহ্ শুনবে কিনা। কিন্তু যদি আমার কথা আল্লাহ্ শুনে তাহলে আমি বলবো আল্লাহ্ তোমায় শান্তি দিক। তোমার ভালোবাসা তুমি অতি শীঘ্রই পেয়ে যাও।
– আপনি খুব ভালো। আমার জন্য আপনার ঘুম ভেঙে গেলো। আপনি ঘুমান আপু।
মেয়েটি কথা বাড়ায় না সে গিয়ে শুয়ে পড়ে। পূর্ণা উঠে দাড়ায়। হেটে এসে লোহার গারদে মাথা ঢেকায়। তারপর সুর ধরে,
– যায় দিন যায় একাকী
তার বিহনে কেমনে বলো থাকি।
যায় দিন যায় একাকী
তার বিহনে কেমনে বলো থাকি।
ভালোবাসা এই অন্তরে
অভিমানে কেঁদে মরে।
ও.এই বুকেতে দুঃখ বেধে রাখি।
যায় দিন যায় দিন একাকী।
আজ বিরহের অক্ষর দিয়ে
মন লিখেছে কবিতা।
সেই কবিতার নাম দিয়েছে
হৃদয়ের কথা।
ভালোবাসা এই অন্তরে
অভিমানে কেঁদে মরে।
ও.এই বুকেতে দুঃখ বেধে রাখি।
যায় দিন যায় দিন একাকী।
হুম..তারি আশায় প্রহর গুনে
দিনে এমনি ফুরাবে।
ও.না পাওয়ার ই মন আকাশে
স্বপ্ন একে যাবে।
ভালোবাসা এই অন্তরে
অভিমানে কেঁদে মরে।
ও.এই বুকেতে দুঃখ বেধে রাখি।
যায় দিন যায় একাকী
তার বিহনে কেমনে বলো থাকি।
যায় দিন যায় একাকী
তার বিহনে কেমনে বলো থাকি।
ভালোবাসা এই অন্তরে
অভিমানে কেঁদে মরে।
ও.এই বুকেতে দুঃখ বেধে রাখি।
যায় দিন যায় দিন একাকী।
পূর্ণা গান শেষ করে চোখ বন্ধ করে চোখের পানি ফেলে। গানের প্রতিটি কথা যেনো তার অন্তরে গিয়ে লেগেছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। মাথা ভন ভন করছে। বুকটা ফাকা ফাকা লাগছে। মনে মনে ভাবছে স্বপ্নটা যদি আর একটু দীর্ঘ হতো। তাহলে হয়তো সে আরও কিছুক্ষণ রাফাতের নিকট থাকতে পারতো। পূর্ণার গানে সকল কয়েদিরা জেগে গিয়েছে। সকলের চোখে পানি। পূর্ণার ব্যথায় তারাও ব্যথিত। এতটুকু একটা মেয়ে কত যন্ত্রণাই না বুকে নিয়ে খুরে বেড়াচ্ছে। পূর্ণার পাশের মেয়েটি এসে পূর্ণাকে শুয়িয়ে দেয়। তারপর মাথায় হাত রেখে বলে,
– তুমিও ঘুমাও বোন আর কেঁদো না। এত কাঁদলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তখন এইখান থেকে বেড়িয়ে ভাইয়ের কাছে যাবে কি করে। শান্ত হও বোন। একটু ঘুমানোর ট্রাই করো।
পূর্ণা ফুপিয়ে কাঁদছে। তার আর সহ্য হচ্ছে না। এই বিরহের যন্ত্রণা সে আর বয়তে পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে। ভালোবাসা কেন এত যন্ত্রণা দেয় কেন? এইসব ভাবতে ভাবতে আর কান্না করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে পূর্ণা ঘুমিয়ে পড়ে।
______________________________________
পাখির ডাক। সূর্য মামা এখনো উঠেনি। তবে পাখিরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনকার নিয়ম অনুযায়ী তারা উঠে ডাকাডাকি শুরু করেছে। যেনো সবাই উঠে পড়ে। ভোর হয়েছে নামাজ আদায় করে। বেশি বেলা করে ঘুমানো যে ঠিক না। পাখিরা তারই ইঙ্গিত বহন করছে। পাখির ডাকে মিহুর ঘুম ভাঙে। আজ শুক্রবার তার ডিউটি নেয়। তবুও তাড়াতাড়ি উঠেছে। কারণ আজ সে চৌধুরী বাড়ি আসবে। এই বাড়ির মানুষের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এক ছেলে হারিয়েছে। আর এক ছেলে প্রেমিকার শোকে পাগল প্রায়। সব দিক নিশ্চয় একা বনুলতা সামাল দিতে পারছে না। মিহু উঠে বিছানা থেকে নামতে নিলে তার ফোন বাজে। সে মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখে রিয়ানের কল। মিহু ভ্রু কুচকে বলে,
– এত সকালে এই বেকুবে কল করছে কেন? কিছু হলো না তো আবার।
মিহু দ্রুত কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে রিয়ান হাপাতে হাপাতে বলে,
– মিহু কোথায় তুমি?
মিহু চিন্তিত হয়ে বলে,
– রিয়ান তুমি হাপাচ্ছো কেন? কি হয়েছে?
– মিহু জলদি গার্ডেনে আসো। তোমাদের বাড়ির কুকুর আমার পেছনে ধাওয়া করছে। আল্লাহ্ বাঁচাও মিহু।
মিহু হাসবে না কাঁদবে বুঝতেছে না। এত সকালে রিয়ান ওদেয বাড়ি কি করে। আর এসেই বিপদে পড়ছে। নিশ্চয় টুলু মুলু ওর পথ আটকেছে। ( টুলু মুলু মিহুদের বাড়ির কুকুরের নাম)
মিহু গায়ে ওরনা নিয়ে দৌড়ে নিচে নামে। মিহুর মা মিহুকে এইভাবে দৌড়াতে দেখে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়ের কি হলো এইভাবে দৌড়াচ্ছে কেন? মিহু দৌড়ে গার্ডেনে যায়। গিয়ে দেখে রিয়ান বেঞ্চে বসে টুলু মুলুকে লেগ পিছ খাওয়াচ্ছে। যা দেখে মিহুর মেজাজটায় বিগড়ে যায়। সে হুঙ্কার দিয়ে বলে,
– রিয়ান এইটা কেমন মজা।
রিয়ানের হাত থেকে লেগ পিছ টা পড়ে যায়।সে ভয়ে দুকদম পিছিয়ে যায়। তারপর টুলু মুলুকে বলে,
– যাহ বাপ ঐদিকে যাহ। আমি তোদের ম্যাডামের সাথে প্রাইভেট টক শেষ করে আসি।
টুলু মুলু যেনো সব বুঝলো ওরা চলে গেলো। রিয়ান ছুটে মিহুর কাছে আসে। মিহু ধাক্কা দিয়ে রিয়ানকে সরিয়ে দেয়। রিয়ান কান ধরে বলে,
– সরি ম্যাম এইবারের মতো মাফ করে দেন।
মিহু উত্তেজিত হয়ে বলে,
– রিয়ান ইউ নো তুমি জানো আমার কতটা টেনশন হচ্ছিলো টুলু মুলু যদি কামড়ে দিতো তখন কী হতো।
রিয়ান একটু অভিনয় করে বলে,
– কি আর হতো হাইড্রোফোবিয়ায় ভুগতাম।
মিহু রেগে রিয়ানকে মারতে শুরু করে,
– ইডিয়েট অসভ্য আমাকে জালাতে খুব ভালো লাগে তাই না। আজ তোমার একদিন কি আমার। তুমি আমায় বললে না কেন তোমার টুলু মুলুর সাথে এখন সম্পর্ক ভালো। বলো কেন বলোনি।
মিহু মারতে মারতে রিয়ানকে ঘাসের মধ্যে ফেলে দেয়। রিয়ান দুহাত দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর ট্রাই করছে কিন্তু সে পারছে না। রিয়ান মিহুর হাত ধরে ওকে নিচে ফেলে দেয় তারপর ওর উপরে উঠে বলে,
– এখন কোথায় যাবেন ম্যাডাম। খুব তো দিচ্ছিলেন।এখন আমি মারি।
– রিয়ান নামো কেউ দেখে ফেলবে। আব্বু চলে আসবে। তখন কিন্তু কেলেঙ্কারি হবে। প্লিজ রিয়ান কথা শুনো।
রিয়ান মিহুর দিকে ঝুকে বলে,
– আগে মনে ছিলো না। এখন কেন এত ভয় শুনি। আর তোমার ঐ খারুজ বাপকে আমি ভয় পায় না।
– আচ্ছা তাই নাকি। ডাকবো আব্বুকে। আব্বুর ভয়ে যে তুমি পেছনের গেইট দিয়ে পালিয়ে এই বাড়ি ঢুকছো তা কি আমি জানি না।
– তোমার বাপ আমার কুচু করবে। শালা খবিশ একটা সারাদিন পিড়া দেয়। একটু শান্তিতে প্রেমও করতে দেয় না।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা গম্ভীর স্বর ভেসে আসে,
– কী হচ্ছে কি এখানে মিহু।
রিয়ান ভয়ে লাফ দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়। চোখের সামনে মাহমুদ সাহেব কে দেখে রিয়ানের প্রাণ টা যেনো বেরুবার উপক্রম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েক।সে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে। আর মিহু সে তো স্টেচু হয়ে গিয়েছে।তার হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গিয়েছে। সে যেইভাবে ওদের দেখছে না জানি তার বাবা এখন কী ভাববে। মাহমুদ সাহেব মেয়ের সামনে এসে রাগী কন্ঠে বলে,
– কী করছিলে তোমরা এখানে।
মিহু আমতা আমতা করে বলে,
– বাপি তেমন কিছু না। তুমি ভুল বুঝছো বাপি।
মাহমুদ সাহেব জোরে মিহুর গালে থাপ্পর মারে। মিহু কান্না করে দেয়। চোখ ভিজে উঠে দার। গাল ধরে সে দৌড়ে ঘরে চলে যায়। রিয়ান মিহুকে ডাকে,
– মিহু।
রিয়ানের ডাক শুনে মাহমুদ সাহেব বলে,
– চুপ বেয়াদব। আর একটা কথাও নয়। তুমি আমার ছাত্র হয়ে আমার মেয়ের সাথে নোংরামি করো। আমার নামে বাজে কথা বলো। এখুনি এখুনি এই বাড়ি থেকে তুমি বেড়িয়ে যাবে।
-স্যার স্যার আপনি ভুল বুঝছেন। আমাকে বলার সুযোগ দিন। আমরা তেমন কিছুই করছিলাম না।
মাহমুদ সাহেব চিৎকার করে বলে,
– এখন কি আমি আমার চোখকে অবিশ্বাস করবো তোমার কথায়। দারোয়ান দারোয়ান।
রিয়ান হাত উঠিয়ে বলে,
– থাক আর দারোয়ান ডাকতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।
– হ্যা হ্যা যাও যাও আমি এখনি তোমার মাকে কল করছি। কি শিক্ষা দিয়ে সে তোমায় বড় করছে তা আমি একটু দেখি।
রিয়ান রেগে বলে,
– খবরদাম আমার মাকে যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলছেন তো আপনার খবর আছে। আমি ভুলে যাব আপনি আমার শিক্ষক।
– রিয়ান। তুমি আমাকে শাসাচ্ছো।
– যেটা আপনি মনে করেন। আর আমি চলে যাচ্ছি মিহুর গায়ে যদি আর একটা হাত আপনি তুলেন তো আপনার হাত আমি ভেঙে দিবো।
মাহমুদ রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
– বেয়াদব। অশিক্ষিত ছেলে। কোনো শিক্ষা নেয়। আমার মেয়েকে আমি মেরে পঙ্গু করে রাখবো তাতে তোমার কি?
– হ্যা আপনার মেয়ে তবে সে আমারও ভালোবাসা। খুব শীঘ্রই বিয়ে করে ঘরে তুলবো বলে দিয়ে গেলাম।
কথাটা বলে রিয়ান চলে যায়। মাহমুদের রাগে শরীর জ্বলছে। সে দ্রুত পায়ে ঘরে আসে। চিৎকার করে বলে,
– মাহমুদা মাহমুদা কোথায় তুমি?
মাহমুদা কাঁপতে কাঁপতে ডাইনিংয়ে আসে। এসে বলে,
– জ্বি ডাকছেন আমায়।
মাহমুদ সাহেব চিৎকার করে বলে,
– আজ থেকে তোমার মেয়ের বাইরে যাওয়া বন্ধ। ওর মোবাইলটা ওর কাছ থেকে নিয়ে নিবে। সব ধরনের যোগাযোগ থেকে ওহ বিচ্ছিন্ন থাকবে। নির্লজ্জ মেয়ে। ওর জন্য লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। শয়তান মেয়ে। ঠিক তোর মতো হয়েছে। যেমন ছিলি তুই।
– কী বলছেন এইসব।
মাহমুদ শাসিয়ে বলে,
– চুপ একদম চুপ। কথা বললে এইখানেই গেড়ে দিবো। যা বলছি তাই কর।
মাহমুদা কাঁপতে কাঁপতে উপরে চলে যায়।ঘরে গিয়ে দেখে মিহু রাগে ফুসছে। মাহমুদা মেয়ের হাত ধরে। মিহু রাগ দেখিয়ে বলে,
– আম্মু বাপি তোমায় আবার বকছে না। ঐ লোক নিজেরে কী ভাবে। সর্বেসর্বা। ওনার মুখোশ আমি সবার সামনে খুলে দিবো। শয়তান লোক একটা।
মাহমুদা মেয়ের মুখ চেপে ধরে বলে,
– হুশ মিহু। এইভাবে বলিস না মা। তোর বাপি শুনতে পাবে। ওনার ক্ষতি আমি চায় না।
– শুধু তোমার জন্য। তোমার জন্য আমি মুখ বুজে আছি। নাহলে ওনাকে আমি গারদে ভরতাম। আমার মাকে উনি কত আঘাত করে। কত মারে। নারী নির্যাতন কেসে আমি ওনাকে ফাসাতাম। বদ লোক একটা। কি দোষ ছিলো তোমার। একটাই তো তুমি বিয়ের পর তোমার বন্ধুর ছেলের সাথে দেখতে গিয়েছিলে। প্রেমিক ও তো ছিলো না জাস্ট বন্ধু ছিলো তাতেঈ এত দোষ।ঐ লোকটার মাও তো তোমায় কম মারেনি আম্মু। তুমি শুধু একবার বলো আমি উনার কিচ্ছা খতম করে দিবো।
মাহমুদা ভয় পেয়ে বলে,
– থাম মিহু আল্লাহর দোহায় লাগি তোর থাম। এইভাব বলিস না। উনি শুনতে পাবে। তখন আবার ঝড় উঠবে। আমার কথা শোন মিহু কয়েকদিন তুই বাড়ির বাহিরে যাস না। তোর মোবাইল টা আমাকে দিয়ে দে।
– কেন দিবো। দিবো না।
– লক্ষী মেয়ে আমার এমনটা করিস না।
– তুমি যাও আম্মু। আমি এগুলোর একটাও শুনবো না।
তখন সেইখানে উপস্থিত হয় মাহমুদ সাহেব। সে রেগে বলে,
– কি করবি তুই শুনবি না। দাড়া দেখাচ্ছি মজা।
কথাটা বলে সে মাহমুদা চুল খামছে ধরে। বল তোর মেয়েকে কথা শুনতে। মিহু চিৎকার করে বলে,
– বাপি প্লিজ আম্মুকে ছেড়ে দাও প্লিজ বাপি।
মাহমুদ কথা শুনে না। সে মাহমুদায় গলা চেপে ধরে বলে,
– তুই শুনবি কি না।
মিহু কি করবে বুঝতে পারে না। এইদিকে মাহমুদার চোখ উল্টে আসে।মিহু উপার না পেয়ে বলে,
– মানবো সব শুনবো তুমি এমন করো না।
মাহমুদ মাহমুদাকে ছেড়ে দেয়। মাহমুদা গলা ধরে বসে পড়ে। কাশতে থাকে। মাহমুদ মিহুর কাছে গিয়ে বলে,
– আমি জানি তো তোর দুর্বলতা কোথায়।কি করলে তুই সব কিছু করতে রাজী হবী।
কথাটা বলে মাহমুদ চলে যায়। মিহু মায়ের কাছে গিয়ে তাকে জরিয়ে ধরে,
– আম্মু।
মাহমুদা মিহু দুজনেই কাঁদতে থাকে।
#চলবে
বিঃদ্র ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১৬
কালে ঘুম থেকে উঠে বনুলতা সবে মাত্র নাস্তা বানাতে কিচেনে গিয়েছে। এমন সময় লেন্ড লাইনের ফোনটা বেজে উঠে। সে উঠে এসে কলটা রিসিভ করতেই কেউ বাজখায় গলায় বলে উঠে,
– ছেলেকে শিক্ষা দিতে পারেন না। কি বেয়াদব ছেলে আপনার। অন্যের বাড়ি এসে মেয়েদের সাথে ঢলাঢলি করে।
বনুলতা ভরকে যায়। সে অবাক হয়ে বলে,
– কে? আমার ছেলের বেপাড়ে এইসব কেন বলছেন। কে আপনি?
– আমি মিসেস বনুলতা চৌধুরী ডা. মাহমুদ সুজন।
– ওহ রিয়ানের স্যার। তা কি করলো আমার ছেলে। এখন তো ওহ পাশ করে গিয়েছে ট্রেনিংয়ে আছে আপনার বাসায় তো যাওয়ার কথা না।
– আহ রাখুন আপনি আপনার ভদ্রতা। আপনি যানেন আপনার গুনধর ছেলে আমার বাসায় এসে কি করছে। আমার মেয়ের ইজ্জতে হাত দিয়েছে।
বনুলতার যেনো পৃথিবী থমকে গেলো। কি বলছে এই লোক তার ছেলে করবে এই কাজ সে যে কল্পনাতেও আনতে পারে না এইসব। কেমন বুকে ব্যথা করছে। ঘামছে সে। বনুলতা দুর্বল কন্ঠে বলে,
– কি বলছেন কি আপনি এইসব।
– হ্যা ঠিকই বলেছি। আপনার ছেলে আসলে জিঙ্গাসা করে নিবেন। ভাগ্যিস আমি দেখেছিলাম নয়তো আজ আমার মেয়েটার কী হতো শুনি। আর হ্যা ফারদার আপনার ছেলেকে যেনো আমি আমার বাড়িতে না দেখি তাহলে কিন্তু রেপ কেসে ফাসিয়ে দিবো কথাটা যেনো মাথায় থাকে।
বনুলতা কিছু বলার আগেই ডা. মাহমুদ কল কেটে দেয়। বনুলতা সোফার মধ্যে ধপ করে বসে পড়ে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। তার এমন অবস্থা দেখে একজন সার্ভেন্ট এগিয়ে আসে। সে বলে,
– ম্যাম কষ্ট হচ্ছে পানি দিবো। একটু পানি খাবেন।
তখনই বাড়িতে ঢুকে রিয়ান। বাড়ি ঢুকে মাকে এই অবস্থায় দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। দৌড়ে মার কাজে আসে। তার কাধে হাত রেখে বলে,
– মম কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার আমায় বলো। যান এখনি পানি নিয়ে আসুন।
বনুলতা রিয়ানের হাতটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,
– ছাড় আমায়। ধরবি না তুই আমাকে তোর ঐ নোংরা হাত দিয়ে।
রিয়ান অবাক হয়ে বলে,
– মম।
বনুলতা কেঁদে দিয়ে বলে,
– কী মম। এই শিক্ষা আমি তোকে দিয়েছে। অন্যের বাড়ি গিয়ে মেয়েদের সাথে ছিঃ আমার বলতেও লজ্জা করছে। আর তুই এই কাজ আমার ছেলে হয়ে কি করে করলি।
রিয়ান থমকে যায়। সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ওহ বুঝেছি ডা. মাহমুদ তোমায় কল করেছিল তাই তো।
– হ্যা করেছিল। তুই ঐ বাসায় গিয়ে কেন অসভ্যতামি করেছিস।
রিয়ান বনুলতার হাত ধরে বলে,
– মম আমি মিহুর কাছে গিয়েছিলাম। আমি কোনো অন্যার করিনি। উনি ভুল বুঝছেন আমাদের। তুমি প্লিজ আমার কথাটা শুনো।
– কিচ্ছু শুনতে চায় না। আমার হাত ছাড় তুই। দূর হো। একজনে ভাইকে মারতে চাইলো। আর একজন খারাপ কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়লো। এই সব দেখাথ আর শোনার আগে আমার মরণ হলো না কেন?
তখনই একটা গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– মম। স্টোপেট মম এইসব কি কথা। কতদিন তোমায় বলেছি এইসব বলবে না। কি করেছে রিয়ান যার জন্য সকাল সকাল এতো কিছু।
বনুলতা রাফাতের দিকে তাকায়। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের চেচানোর আওয়াজ শুনেই সে সদ্য ঘুম থেকে উঠে এখানে এসেছে। বনুলতা রাফাতের কাছে গিয়ে বলে,
– তোর গুনধর ভাইকে জিঙ্গাসা কর। ওর স্যার ডা.মাহমুদ কর করছিলো। ওহ নাকি ঐ বাড়িতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। আমি আর বলতে পারবো না।
রাফাত তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রিয়ানের দিকে তাকায়। রাফাতের এই দৃষ্টি যেনো রিয়ানকে খুন করে দিবে। রিয়ান রাফাতের কাছে গিয়ে বলে,
– বিশ্বাস করো ভাই আমি এমন কিছু করিনি যার জন্য মমের এইভাবে কাঁদবে হবে।
রাফাত গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– আমাকে সব খুলে বল। কী হয়েছে। কোথায় গিয়েছিলি তুই।
তারপর রিয়ান মাথাটা নিচু করে অপরাধীর ন্যায় সব কথা রাফাতকে বলে। রাফাত একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে তারপর বলে,
– কাজটা ঠিক হয়নি রিয়ান। যতই হোক মিহু তোর বিয়ে করা বউ নয়। আর বউ হলেই বা কি একটা প্রাইভেসি থাকা দরকার সবকিছুতে।
– আমি জানি ভাই। কিন্তু তখন যে কি হয়ে গেলো আমি বুঝতে পারিনি। মমকে বলো না আর যেনো না কাঁদে মমের কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। আমার উপরে রাগ করে থাকতে নিষেধ করো। প্লিজ ভাই।
রাফাত গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– মমকে তুই রাগিয়েছিস তুই রাগ ভাঙাবি আমায় কেন বলছিস।
– এইবারের মতো ভাই প্লিজ। মম তোমার সব কথা শুনে।
বনুলতা রাফাতের দিকে তাকিয়ে আছে। একরাতে ছেলেটার কি অবস্থা হয়েছে। রাফাত বনুলতার দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমার জন্য হলেও মাফ করে দাও। ঘটনাটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে।
বনুলতা কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
– যাহ মাফ করে দিলাম।
রিয়ান বনুলতাকে জরিয়ে ধরে বলে,
– আমার মম।
রাফাত হাসে। সে উপরে চলে যায়। বনুলতা রিয়ানকে ছাড়িয়ে বলে,
– যাহ বাদর ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।
রিয়ান ঘরে চলে আসে। অনেক বার মিহুকে কল করে কিন্তু মোবাইল অফ। মোবাইল অফ কেন? রিয়ানের টেনশন হতে শুরু করে ওর খারুজ বাবা আবার কিছু করেনি তো। বনুলতা রিয়ানকে খেতে ডাকে। রিয়ান খেতে বসেও অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছে। তা দেখে বনুলতা রিয়ানের পিঠে থাপ্পর দেয়। রিয়ান আহ বলে উঠে। বনুলতা বলে,
– খাবার সামনে রেখে কি ভাবছিস।
– কিছু না মম।
– বল আমাকে।
– মম মিহুর মোবাইল বন্ধ। আর ওর বাবা যেমন তাতে আমার খুব টেনশন হচ্ছে।
– ওর বাবা কেমন?
– খুবই খারাপ একজন লোক। লোক সমাজে সবাই ওনাকে ভালো জানলেএ উনি ওত ভালো মানুষ না। যদি মিহুর কোনো ক্ষতি করে। যদি মারধর করে।
– এত টেনশন করিস না সব ঠিক থাকবে ইনশাআল্লাহ।
– হুম।
খাওয়া শেষ করে রিয়ান ঘরে চলে আসে। মা তো বুঝ দিলো ঠিকই কিন্তু তার মন তো মানতে চায়ছে না। কি করবে সে। কিছু ভালো লাগছে না ধ্যাত।
_______________________________________
মাহমুদ ভিলা,
মিহু ঘরে বসে রাগে ফুসছে। এই একটা লোক তাদের জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে। শুধু কি তার তার মায়েরও। কেন যে মা বুঝতে চায় না। এই লোকটা কোনোদিনও তাকে ভালোবাসতে পারে না। হঠাৎ মিহুর দরজায় কেউ ঢকঢক আওয়াজ করে। মিহু বলে,
– কে?
– দিদিভাই আমি। তোর দাদু।
– ওহ দাদু আসো।
মিহুর দাদু নুরজাহান বিবি এখনো এই বাড়ির কতৃত্ব ধরে রেখেছে। ডা. মাহমুদ তার খুব বাধ্য। কিন্তু মিহু তাকে সহ্য করতে পারে না। কারণ এই মহিলার জন্য তার মায়ের জীবন দূর্বিষয় হয়ে উঠেছে। নুরজাহান বিবি ঘরে এসে বলে,
– আমার দিদিভাই কি করছে?
মিহু বিছানা থেকে নেমে কাঠখোট্টা গলায় বলে,
– সোজাসুজি বলো কি বলতে চাও।
নুরজাহান বিবির ব্যক্তিত্বে লাগে। সে ধমকে বলে,
– এই মেয়ে এইগুলো কেমনে ব্যবহার।
মিহু কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
– তোমার কাছে শিখেছি। তুমি যেমন আমার মায়ের সাথে করো।
নুরজাহার খেপে উঠে,
– একদম থাপড়ে গাল লাল করে দিবো। বেয়াদব কোথাকার এই শিক্ষা দিয়েছি তোমায়।
– আরে রাখো তো কার সামনে কি বলো। তোমার এইসব হুমকি থামকিতে আমি ভয় পায় না। ভুলে যেও না আমার একজন পুলিশ অফিসার।
নুরজাহানের আর ধৈর্য্য শয় না। সে জোরে মিহুর গালে থাপ্পর মারে। মিহুও কম যায় না সে বাঘিনীদের মতো তেরে এসে বলে,
– এই বুড়ি তোর এই রাগ তুই অন্য কোথাও দেখাবি আমায় না। আমার গায়ে হাত তুললে না এই হাত আমি ভেঙে দিবো। এই হাত দিয়ে তুই অনেককে মেরেছিস। আমার মাকে তুই জ্বালিয়েছিস। আমি তোদের জ্বালিয়ে দিবো।
নুরজাহান রেগে তার ছেলেকে ডাকে,
– বাবু বাবু কোথায় তুই এইখানে আয় দেখে যা তোর মেয়ের কত বড় সাহস হয়েছে। কলিজাডা কত্ত বড় হয়ে গেছে।
মাহমুদ আর মাহমুদা মায়ের ডাকে মিহুর ঘরে আসে। আর এসে দেখে নুরজাহান মিহু দুজনেই রাগে ফুসছে। মাহমুদার বুঝতে বাকি হয় না এইখানে কি হয়েছে। মাহমুদ মাকে জিঙ্গাসা করে কি হয়েছে এইখানে। নুরজাহান সব কথা মাহমুদকে বলে। মাহমুদ সব শোনার পর মিহুকে জোরে থাপ্পর দেয়। লাথি দেয়। মাহমুদা মাহমুদকে আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে বৃথা। মিহু এর বাবাকে সরানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারছে না। মাহমুদা আবারো গিয়ে মাহমুদের হাত ধরে মাহমুদ ধাক্কা দিয়ে মাহমুদাকে ফেলে দেয়। মাহমুদার পরে যায়। মাথা গিয়ে বারি খায় ড্রেসিং টেবিলের কোনার সাথে। সাথে সাথে মাহমুদা জ্ঞান হারায়। ব্লেডিং শুরু হয়। মিহু মাকে এইভাবে দেখে চিৎকার করে উঠে,
– আম্মু।
মিহু মাহমুদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। দৌড়ে মাহমুদার কাছে আসে। মাহমুদার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে কান্না করে দেয় মিহু। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– আম্মু আম্মু চোখ খুলো আম্মু তাকাও আমার দিকে। আম্মু এই আম্মু চোখ খুলো না আম্মু।
নুরজাহান বেগম হা হয়ে দেখছে। সে বলে,
– হায় আল্লাহ্ কি সর্বনাশ হয়ে গেলো।
মাহমুদ নিজের কাজের জন্য এখন নিজেই ভয় পাচ্ছে। কারণ সে জানে মাহমুদার কিছু হলে মিহু তাদের ছাড়বে না। মাহমুদা কথা বলছে না। চোখ খুলছে না। মিহু ডেকেই চলেছে। অশ্রুতে তার চোখ বার বার ভিজে উঠছে। মিহু চিৎকার করে ডাকে,
– রমজান চাচা রমজান চাচা। ( রমজান এই বাড়ির ড্রাইভার প্লাস কাজের লোক।)
রমজান মিহুর ডাকে দৌড়ে উপরে আসে। এসে দেখে মাহমুদার এই অবস্থা। সে অস্থির হয়ে বলে,
– আল্লাহ্ গো আফার কি হইলো।
মিহু কান্না আটকে বলে,
– সুরমা কোথায় ওকে ডাকো। আম্মুকে হাসপাতালে নিতে হবে। আর তুমি গাড়ি বের করো।( সুরমা এই বাড়ির কাজের মেয়ে।)
রমজান দ্রুত নিচে যায়। সুরমাকে উপরে পাঠিয়ে দেয়। সুরমা আসলে মিহু বলে,
– সুরমা আম্মুকে ধর নিচে নিয়ে যেতে হবে।
সুরমাও ভয় পেয়ে যায়। মাহমুদার অবস্থা ভালো না। প্রচুর ব্লেডিং হচ্ছে। রক্তে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। মিহুর শরীর রক্তে ভিজে একাকার। মাহমুদ মাহমুদাকে ধরতে আসলে মিহু হুঙ্কার দিয়ে উঠে,
– খবরদার আমার মাকে স্পর্শ করবে না। পাপী খুনি আপনি। আমার মায়ের কিছু হলে আপনাকে আমি জানে মেরে দিবো। অনেক হয়েছে আর না। মিহু আর চুপ থাকবে না। সুরমা চল।
সুরমা আর মিহু মাহমুদাকে ধরে গাড়িতে বসায়। রমজান গাড়ি স্টার্ড দেয়। মিহু এখনো মাহমুদাকে ডেকে চলেছে কিন্তু কোনো রেসপন্স নেয়। মিহুর কি যেনো মনে হতে সে বলে,
– রমজান চাচা তোমার মোবাইল টা দাও তো একটু।
রমজান তার মোবাইল বের করে মিহুকে দেয়।মিহুকে একটা নাম্বার উঠিয়ে তাতে কল দেয়। দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হয়,
– হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
মিহু কেঁদে দেয়। ওপাশ থেকে আবার বলে,
– কে? কাঁদছেন কেন? মিহু।
মিহু ধরা গলায় বলে,
-হুম রিয়ান।
রিয়ান অস্থির হয়ে পড়ে। সে বিচলিত হয়ে বলে,
– কি হয়েছে মিহু কাঁদছো কেন? সব ঠিক ঠাক আমায় বলো। এই মিহু।
মিহু কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– কিচ্ছু ঠিক নেয় রিয়ান কিচ্ছু ঠিক নেয়। আম্মুকে ওরা মেরে দিয়েছে। আম্মুকে নিয়ে আমি হাসপাতালে যাচ্ছি তুমি প্লিজ আসো।
– ইয়া ইয়া আমি আসছি। তুমি সাবধানে যাও। আর হ্যা ডোন্ড ওয়ারি। কিচ্ছু হবে না শান্ত থাকো। আল্লাহ্ আল্লাহ্ করো।
– হুম।
মিহু কল কেটে দেয়। রিয়ান কোনো রকমে রেডি হয়ে নিচে নামে। রিয়ানকে এমন তারাহুরো করতে দেখে বনুলতা বলে,
– কিরে কি হয়েছে এতো দৌড়ের উপরে আছিস যে?
– মম মিহুর মা অসুস্থ ওনাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে মিহু আমিও সেখানে যাচ্ছি।
– সেকি অবস্থা কি খারাপ নাকি।
– হ্যা মম।
– তাহলে দাড়া আমিও যাবো।
– আচ্ছা আসো।
বনুলতা রিয়ান একসাথে হাসপাতালে যায়। গিয়ে দেখে মিহু দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে কাঁদছে। চোখ দুটো ফুলা ফুলা। মনে হয় খুব কেঁদেছে। সাহসী মিহুকে এইভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে রিয়ানের বুকটা কেপে উঠে। সে দৌড়ে মিহুর কাছে যায়। তার মাথায় হাত রাখে। কারো স্পর্শ টের পেয়ে মিহু বামে তাকায় দেখে রিয়ান। রিয়ানকে দেখে মিহু সহসা তাকে জরিয়ে ধরে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।,
– রিয়না আম্মু। আম্মু ছাড়া আমার আর কেউ নেয় রিয়ান।ওরা কেন এমন করলো। কেন আমার আম্মুকে বার বার আঘাত করে।
মিহুর কান্না রিয়ানের বুকে গিয়ে বিধছে। সে পাগল প্রায়। সে মিহু মাথাটা শক্ত করে তার বুকে চেপে ধরে। তারপর শান্তনা দিয়ে বলে,
– হুশ আন্টির কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এত ঘাবড়াচ্ছো কেন? আল্লাহ্ আছে আন্টির কিচ্ছু হবে না। দেখি আর কাঁদে না। আমি দেখছি তুমি আর কেঁদো না।
মিহু একটু শান্ত হয়। রিয়ান মিহুকে উঠিয়ে পাশের বেঞ্চে বসায়। তখন মিহু খেয়াল করে বনুলতা এসেছে। বনুলতাকে দেখে তার আরও কান্না পায়। বনুলতা মিহুর পাশে বসে। মিহুর মাথাটা নিজের কাধে নিয়ে বলে,
– ভয় পায় না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ্ কে ডাকো। ইনশাআল্লাহ উনি সব ঠিক করে দিবে। আল্লাহ্ রক্ষাকর্তা। তার দাড়া সব সম্ভব। আল্লাহ্ রক্ষা করবে মা। এত ভেবো না তো। এখন আপা কোথায় আছে।
– ওটি রুমে। ওটি চলছে। অনেক রক্ত লাগবে বলছে।
– রক্তের মেনেজ হয়েছে।
– হ্যা কিছুটা বাকিটা রমজান চাচা দেখছে।
রিয়ান বলে,
– আমি ব্লাড ব্যাংকে কল করছি। টেনশন করো না ব্লাড পাওয়া যাবে।
মিহু একটু শান্ত হয়। সে বনুলতার কাধে মাথা রেখে বসে আছে।
_______________________________________
রাফাত নিজের ঘরে বসে বসে পূর্ণার ছবি দেখছিলো আর হাসছিলো। মাঝে মাঝে আবার কিছু ভেবে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে। হঠাৎ দরজায় কেউ নক করে। রাফাত বলে,
– আসুন।
ঘরে আসে রশীদ চৌধুরী। রশীদ চৌধুরীকে দেখে রাফাত দাড়িয়ে যায়। অবাক হয়ে বলে,
– আপনি?
– হ্যা আমি কিছু বলার ছীলো।
– জ্বি বলুন কি বলবেন?
– একটু কী বসতে পারি।
রশীদ চৌধুরীর চোখ মুখে অপরাধীর ছাপ দেখা যাচ্ছে সে অনুতপ্ত। রাফাত বলে,
– বসুন।এর জন্য পারমিশন নেওয়ার কি আছে।
রশীদ চৌধুরী বসলে রাফাতও বসে পড়ে। রশীদ চৌধুরী আমতা আমতা করতে থাকে। আসলে কিভাবে সে শুরু করবে সে নিজেও জানে না। রাফাত বিরক্ত হয়ে বলে,
– যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।
রশীদ চৌধুরী শুরু করে,
– আমায় মাফ করে দিস বাবা। আমার জন্য আজ তোর এই অবস্থা। পূর্ণার মতো এত ভালো একটা মেয়ৃ জেলে। আমার জন্য তোর জীবনে এত কষ্ট।
রাফাত তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সে বলে,
– আমার জন্য আপনাকে না ভাবলেও চলবে। আমি ঠিক আছি। আর বাকি রইলো ক্ষমার কথা। আগে আপনি আমার মায়ের কাছে ক্ষমা চান। আপনি আমার মায়ের সাথে যা করছেন সেগুলো শোনার পর কোনো সন্তান তার পিতাকে ক্ষমা করবে কিনা জানি না। তবে আমি পারছি না।
রশীদ চৌধুরী মাথাটা নিচু করে ফেলে। লজ্জায় এই মুহূর্তে তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। রাফাত আরও বলে,
– আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিবো বাবা বলে ডাকবো সেইদিন। যেদিন আপনি আমার মায়ের ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে পারবেন।সেইদিন যেদিন আপনি আমার মায়ের জীবনের হারিয়ে যাওয়া সুখ শান্তি ফিরিয়ে দিতে পারবেন।সেইদিন যেদিন আমার মা প্রাণ খুলে হাসবে। সেইদিন যেদিন আমার মা আপনাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে। আপনি আছেন এই বাড়িতে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেয়। আপনি থাকুন আমার মা চায় তাই থাকুন। আমার মায়ের হয়তো আপনার প্রতি মহব্বত মায়া এইসব থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আমার নেয়। ছয় বছর বয়সে মায়ের হাত ধরে আপনার বাড়ি ছেড়েছি। মাকে শুধু রাস্তায় রাস্তায় কাঁদতে দেখেছি। একটু ঠাই পাওয়ার জন্য আমার মা কত জনের দুয়ারে গিয়েছে। কেউ রাখেনি আমার মাকে। সেদিন জবা মা না থাকলে হয়তো আমাদের শিয়াল কুকুরে খেতো। আপনার ভাগ্য ভালো এত কিছুর পরও এই বাসায় থাকতে পারছেন।তার জন্য শুকরিয়া জানান। আর এই ঘর থেকে বের হন। আপনার উপস্থিতি আমার শরীর জ্বালিয়ে দেয়। ঘেন্নার শরীর রি রি করে। নাও গেট লস।
ছেলের করা এত অপমানে রশীদ চৌধুরীর চোখে পানি চলে আসে। সে বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুঝতে মুঝতে ঘর থেকে বেড়িয়ে চলে যায়। ভেতরটা তার পুড়ে যাচ্ছে। নিজের করা একটা পাপের শাস্তি তাকে তিলে তিলে মারছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। এইভাবে স্ত্রী সন্তানের কাছে বার বার অবহেলিত হওয়াটা তার পক্ষে আর মানা সম্ভব না। কষ্ট হচ্ছে খুব তার। কেউ তার সাথে ভালো করে মিশে না। আগে রিয়ান একটু মিশতো ইদানিং সেও কাছে আসছে না। রশীদ চৌধুরী সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যায়। চিৎকার করে উঠে সে। একজন সার্ভেন্ট দ্রুত এগিয়ে আসে। এইটা হচ্ছে রশীদের বিসস্ত সার্ভেন্ট মুক্তার। মুক্তার এসে রশীদ চৌধুরীকে ধরে উঠায়। পায়ে ব্যথা পেয়েছে সে অনেক। মুক্তার বলে,
– স্যার খুব ব্যথা পায়ছেন।একটু সাবধানে হাটবেন তো।
রশীদ বুকে হাত দিয়ে বলে,
– যেই ব্যথা এইখানে আছে তার থেকে এই ব্যথা অনেক সামান্য রে মুক্তার অনেক সামান্য।
কথাটা বলে রশীদ খুরাতে খুরাতে ঘরে চলে যায়।সিড়ির শেষ পর্যায় এসে পড়েছে বিধায় বেশি ব্যথা পায়নি। মুক্তার একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
– আজ আসুক বনুলতা ম্যাডাম সব বলবো তাকে। রাফাত স্যারের এইভাবে বাপের সাথে ব্যবহার করা ঠিক হয় নাই। এতে আমার চাকরি থাকুক বা না থাকুক। আজ আমি বলুম ই বলুম।
#চলবে
বিঃদ্র ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ।