#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ০২
বিয়ের প্রথম রাতে মনের মধ্যে একরাশ ভীতি নিয়ে বিছানায় বসে আছে স্পৃহা। প্রচন্ড ভয় লাগছে এখন ওর। বিয়েতে রাজি হওয়ার আগে একবারের জন্যও এই সময়টার কথা মাথায় আসেনি। বরং আহিরের ওপর জেদ করে বিয়েটায় মত দিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু এখন ভাবছে, বিয়েটা না করলেই ভালো হতো। অন্তত এই মুহূর্তটার সম্মুখীন হতে হতো না।
স্পৃহার আক্ষেপ-আফসোসের মাঝেই খট করে দরজা খুলে কেউ ঘরে প্রবেশ করলো। স্পৃহা চমকে উঠে সামনে তাকাতেই দেখলো, আদ্র এসেছে। তাকে দেখে শুকনো একটা ঢোক গিললো স্পৃহা। আদ্র ওর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সাথে সাথে কপালে ও ভ্রুর মাঝে হালকা ভাঁজ পড়ল। ভ্রু কুঁচকেই বললো,
-এস ফার এস আই নৌ, বিয়ের প্রথম রাতে মেয়েরা মুখের ওপর এক হাত ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে বসে থাকে। আর এদিকে তুমি এভাবে বসে আছো! বাট আই রিয়েলি লাইক ইট!
স্পৃহা এবার সরু দৃষ্টিতে তাকালো। এতোক্ষনে ব্যক্তিটাকে বেশ ভালোভাবে দেখতে পারলো ও। নরমাল হাইটের উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুঠাম দেহের অধিকারী আদ্র। এক কথায় সুদর্শন বলা চলে। তবে ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটাই সবার আগে চোখে পড়ে। আচ্ছা, ছেলেটা কি সবসময়ই হাসে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো স্পৃহা। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্র ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললো,
-মন ভরেছে?
আদ্রের আকস্মিক প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল স্পৃহা। মুখ ঘুরিয়ে ফেললো সাথে সাথেই। এতোক্ষন ওভাবে তাকিয়ে ছিল ভাবতেই নিজের ওপর রাগ লাগছে ওর। আদ্র হালকা হেসে বললো,
-লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলেন নাকি রাগে, ঠিক বুঝতে পারলাম না মিস, আই মিন, মিসেস স্পৃহা। যাইহোক, ফ্রেশ হওয়ার মুড নেই নাকি আজ তোমার?
স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আদ্র মাথা চুলকে বললো,
-মানে বলছিলাম যে, এসব শাড়ি-গহনা পরে তো রাতে ঘুমাতে পারবে না! তাই ব্……
-আপনি কি সরাসরি কোনো কথা বলতে পারেন না? প্রতিটা কথা এভাবে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলার কোনো মানে আছে?
কথাটা অনেকটা বিরক্তিমিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো স্পৃহা। তবে ওর কথার ধরণটা আদ্রের বেশ লেগেছে। মেয়েটা যে অন্যরকম, তা প্রথম দেখেই বুঝেছিল। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মধ্যে যেমন সংকোচ কাজ করে, ওর মধ্যে সেটা দেখা যায় না। আজ আরও ক্লিয়ার হয়ে গেল।
-আচ্ছা, আর বলবো না।
স্পৃহা আড়চোখে একবার তাকালো আদ্রের দিকে। ওর হাবভাব দেখে আদ্র বুঝতে পারছে, স্পৃহা ওকে কিছু বলতে চাইছে। তাই এগিয়ে এসে স্পৃহার সামনে বসলো। ওর হাতের ওপর হাত রাখতেই স্পৃহা হুট করে নিজের হাতটা সরিয়ে নেয়। আদ্র খানিকটা অবাক হয়ে তাকালো স্পৃহার দিকে। স্পৃহা কম্পিত কণ্ঠে বললো,
-আব্ দেখুন! আমায় স্পর্শ করার আগে আমার আপনাকে কিছু বলার ছিল। আমায় আহির যেভাবে ঠকিয়েছে, আমি আপনাকে সেভাবে ঠকাতে চাই না। তাই আপনি সবটা শুনে সিদ্ধান্ত নিন।
আদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
-ওকে, বলো। কিন্তু এই আহিরটা আবার কে?
স্পৃহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-ভালোবাসতাম ওকে আমি। ইভেন এখনো বাসি।
আদ্র নিজের ভ্রু কুঁচকে রেখেই ঠোঁট সম্প্রসারিত করে হাসলো। বললো,
-বিয়ের পর বউয়ের মুখে শুনতে হচ্ছে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে! এই কপাল নিয়ে জন্মেছিলাম আমি? আমার নাম তো ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখা উচিত! ইন্ট্রেস্টিং!!
স্পৃহা এমন কথা শুনে অবাক চোখে তাকালো আদ্রের দিকে। এমন রিয়েক্ট ও একদমই আশা করেনি। বিস্মিত হয়ে বললো,
-আপনার রাগ লাগছে না আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি বলে?
-হচ্ছে একটু-আধটু আর কি! তবুও মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি এটা বলে যে, সুন্দরী মেয়েদের বিয়ের আগে চার-পাঁচটা প্রেম থাকেই!
স্পৃহা রাগী স্বরে বললো,
-মজা করছেন আমার সাথে?
আদ্র সশব্দে হেসে বললো,
-যাক, তুমি বুঝতে পেরেছো তাহলে যে, আমি মজা করছি। তবে তোমার কথায় আমার খারাপ লেগেছে এটা সত্যি। পাশাপাশি ভালোও লাগছে এটা ভেবে যে, তুমি আমায় অনেস্টলি সত্যিটা বলে দিয়েছো। এবার নেক্সট বলো।
স্পৃহা বলতে শুরু করলো,
-আহির আমার ভাইয়ের কলেজ লাইফের বন্ধু। সেই সুবাদেই ওনার সাথে আমার পরিচয়। উনি প্রথম থেকেই আমাকে ভালোবাসতেন। অনার্সের জন্য আমি ওনাদের ভার্সিটিতেই ভর্তি হয়েছিলাম। তার কয়েকমাস পরেই আহিরের মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে যায়। উনি টপার ছিলেন। সেজন্য ভার্সিটির লেকচারার হিসেবে এপয়েন্টমেন্ট পান। আমি সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই উনি আমায় বলেছিলেন যে, উনি আমায় ভালোবাসেন। অনেক অবাক হয়েছিলাম সেদিন। ওনার পাগলামি, কেয়ার এসব দেখে আমার মনেও অনুভূতি তৈরি হয়েছিল।
স্পৃহার গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আদ্র আঙুল দিয়ে কপাল ঘষে বললো,
-তারপর?
-আহিরকে ফাইনালি ভালোবাসি বলেই দিয়েছিলাম। কিন্তু তার এক সপ্তাহ পরেই আহির অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে। ভাইয়ার মুখে একথা শোনার পর বিশ্বাসই হয়নি। কিন্তু উনি যেদিন আমাদের বাড়িতে নিজের বউকে নিয়ে এলেন, সেদিন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিলো যেন। সেদিনই আহির বলেছিল, উনি আমায় কখনো ভালোই বাসেনি। আমি নাকি ওনার জাস্ট ভালো লাগা ছিলাম!
আদ্র ভ্রু কুঁচকে ফেললো। আহিরের কাজগুলো কেমন যেন রহস্যময় লাগছে ওর কাছে। স্পৃহা নিঃশব্দে কাঁদছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আদ্র বললো,
-এ ব্যাপারে তোমার পরিবারের কেউ কিছু জানে?
-না, শুধু আমার বন্ধুরা জানে। ভাইয়াও জানে না।
-আমায় যা বলার বলেছো। আর কেউ যেন এসব ঘুণাক্ষরেও না জানতে পারে! আমি চাই না, আমার বউয়ের দিকে কেউ আঙুল তুলুক।
স্পৃহা অবাক চোখে তাকালো আদ্রের দিকে। আদ্র শেরওয়ানির বাটন খুলতে খুলতে ওয়াশরুমে চলে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে আবার বললো,
-যেদিন তোমার মনের ঐ ছোট্ট ভুবন জুড়ে শুধু এবং শুধুই এই আদ্র ইশরাক বাস করবে, সেদিনই না-হয় নিজের রঙে রাঙাবো তোমায়! ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।
_____________________
“একা জেগে থাকে এই মন,
নিঃসঙ্গ এ জীবন…
রাত জাগা পাখি ডেকে যায়…
ঘুম আ্…”
-হচ্ছে না, হচ্ছে না। সুর উল্টাপাল্টা করছিস তো! ভয়েসটাও ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে।
প্রণব মুখ দিয়ে বিরক্তিমিশ্রিত শব্দ করে বললো,
-আজ কেন হচ্ছে এমন? রাগ উঠছে কিন্তু এখন, প্রান্তি। আচ্ছা, আরেক বার গাইছি। শোন!
প্রান্তি স্ক্রিপ্টটা হাত থেকে ঝাড়া মেরে ফেলে বললো,
-ধুরর… আর পারবো না আমি। সকাল থেকে কিচ্ছু না খেয়ে তোর রেওয়াজ শুনতে হচ্ছে। এখন আমি খেতে গেলাম।
বলেই উঠে দাড়ালো প্রান্তি। প্রণবকে এখনো বসে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে বললো,
-বসে আছিস কেন, ভাইয়া? চল, ব্রেকফাস্ট করবি।
প্রণব গিটারটা রেখে বললো,
-তুই যা! আমি পরে খাবো।
-তুই না খেলে, আমিও কিন্তু খাবো না বলে দিলাম। এখন ভেবে দেখ, তোর জন্য তোর ছোট বোনটা না খেয়ে থাকলে তোর কেমন লাগবে!
প্রণব ভ্রু কুঁচকে হেসে বললো,
-ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে বরাবরই ওস্তাদ তুই। যা, আমি আসছি।
প্রান্তি চলে যাচ্ছিলো। প্রণব পিছু ডেকে বললো,
-আচ্ছা, শোন!
প্রান্তি ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
-হ্যাঁ, বল।
-মিস্টার চৌধুরী বাড়িতে আছেন।
-ভাইয়া! উনি আমাদের বাবা হন। বারবার মিস্টার চৌধুরী বলে কেন সম্বোধন করিস ওনাকে?
প্রণব তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-বাবা! আসলেই তো! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার বাবা আছেন। আর সারাজীবন ভুলেই থাকতে চাই।
প্রান্তি হতাশা মিশ্রিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল। প্রণব নিজের গিটারটায় একবার হাত বুলিয়ে সেটা গিটারের ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। কাঁধে ঝুলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ডায়নিং রুমে যেতেই দেখলো, মিস্টার চৌধুরী ব্রেকফাস্ট করছেন। নিজের বাবাকে দেখে আর চেয়ার টেনে বসতে চেয়েও বসলো না। পকেটে হাত গুঁজে বেরিয়ে যেতে লাগলো ও। প্রান্তি পেছন থেকে ডেকে বললো,
-ভাইয়া, না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
প্রণব দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই বললো,
-খিদে নেই। অডিশন আছে আজকে। ফিরতে রাত হবে।
-কিন্তু খে…….
-পরিবারের সাথে এক টেবিলে খাওয়া মিস্টার চৌধুরী ডিজার্ভ করে না।
বলেই প্রণব বাইরে চলে যাওয়ায় প্রান্তি আর কথাটা শেষ করতে পারলো না। মিস্টার চৌধুরীর দিকে একবার তাকালো। কিন্তু ওনার কোনো হেলদোল নেই। একমনে খেয়েই চলেছেন তিনি।
গাড়ির ডোর ওপেন করতেই প্রণবের ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখেই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠে।
-চলবে……
[