#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
[২য় পরিচ্ছেদ]
৩৫.
ইরা’দকে দেখতেই নিদ্র ছুটে চলে গেলো ইরা’দের নিকট। ইরা’দের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে,
–“ফটকি বেগম ভালো না। আমার নৌরি ফুলকে নিয়ে বাজে কথা বলে!”
ইরা’দ রক্তচক্ষু চাহনি নিক্ষেপ করে আছে লতিফার দিকে। লতিফার তো ভয়ে থুঁতনি গলায় গিয়ে ঠেকেছে। নূরজাহান অবাক নয়নে চেয়ে বলে,
–“আমাদের বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলে লতিফা?”
হঠাৎ ইরা’দ ক্ষিপ্ত স্বরে বলে ওঠে,
–“শুধুই বিশ্বাস না চাচী, কথার গোপনীয়তা ভঙ্গ করেছে উনি। ওনার সাহস কী করে হয় নওরির নামে মিথ্যে ছড়ানোর? সাহস কে দিয়েছে তোমাকে? হাউ ডেয়ার ইয়্যু!”
শেষোক্ত ধমকে লতিফার অন্তর কেঁপে উঠলো। হঠাৎ কেঁদে উঠে বলে,
–“মাফ কইরা দেন। আর কখনোই এমন হইবো না!”
–“তোমার মাফ তোমার কাছেই রাখো। আর জীবনেও যদি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখেছি তোমাকে! একটা মিথ্যে ছড়ানোর শা!স্তি হিসেবে তোমার রোজকার শেষ। এখন তোমার ছেলে-মেয়েকে মিথ্যে দিয়েই পেট ভরিও। ডাফার!”
ইরা’দ হনহন করে বেরিয়ে গেলো। লতিফা নূরজাহানের হাত-পা ধরে মাফ চাইলো। কিন্তু নূরজাহান লতিফাকে এড়িয়ে চললো। সেও ভীষণ ক্ষিপ্ত। তবে ইরা’দের মতোন সে ক্ষিপ্ততা দেখাতে চাচ্ছে না বলেই এড়িয়ে চলাকেই শ্রেয় মনে করছে।
———————–
–“হ্যালো, মাহি আপু?”
–“কে? নওরি? উফফ, থ্যাঙ্ক গড তোর খোঁজ আমি পেয়েছি। কেমন আছিস বোন আমার? তোর নাম্বার অফ দেখে কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম জানিস?”
নওরি বারান্দায় বসে আনমনে বাইরে চেয়ে আছে। মাহির প্রত্যেকটি কথা কানে প্রবেশ করতেই বলে উঠলো,
–“তুমি নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলে। আর আমিও ভালো আছি!”
–“যাক, তাহলে ভালো। কিন্তু এই নাম্বার কার? আগের নাম্বার কোথায়?”
নওরি সেসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,
–“আমি বিয়ে করেছি আপু!”
মাহি যেন আকাশ থেকে পরলো। ফোনটা কান থেকে পরতে পরতে বেঁচে গেলো। চোখ বড়ো বড়ো বিস্মিত স্বরে বলে,
–“মজা করছিস?”
–“কেন করব?”
থমকালো মাহি। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকলো সে। অপ্রত্যাশিত খবরে তাঁর মস্তিষ্ক যেন কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে। কী বলবে, কী বলা উচিত বুঝে উঠতে পারলো না। ক্ষণিক সময় পর নিজেকে সামলে বললো,
–“কার সাথে হয়েছে?”
–“নেতা সাহেবের সাথে।”
মাহি আবারও বিষম খেলো।
–“মানেহ?”
নওরি বেশ কিছুটা সময় নিয়ে একে একে সবটা খুলে বললো। সব শুনে কীরকম পতিক্রিয়া জানানো উচিত তা মাহি বুঝে পেলো না। নওরি আবার বলে ওঠে,
–“সিদ্ধান্তহীনতা কাটাতে তোমায় অসংখ্যবার কল করেছিলাম মাহি আপু। কিন্তু তুমি নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলে!”
–“দুঃখিত বোন। আসলে আমার দাদু মা!রা গেছে। তাই গ্রাম থেকে ফিরতে চেয়েও পারিনি!”
মাহির মুখ থেকে এরকম দুঃসংবাদ পেয়ে নওরির মন বিষণ্ণ হলো। নিচু স্বরে বলে ওঠে,
–“স্যরি!!”
–“আরে ইট’স ওকে। তোর কথা বল, ইরা’দ কী ভালোবাসে তোকে?”
এই একটা প্রশ্নে নওরি হঠাৎ লজ্জায় নুইয়ে পরলো। আমতা আমতা করে বললো, “হুম!”
–“এমা! লজ্জা পাচ্ছিস? বাসর টাসর করে ফেললি নাকি?”
–“মাহি আপু প্লিজ! এসব কিছুই না। তুমি বেশি বুঝছো!”
মাহি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। হাসি বজায় রেখে বলে,
–“অল ক্রেডিট গোস টু মি। আমার জন্যেই তো ওই শহরে গেলি, ভালোবাসার মানুষ পেলি। আমি না থাকলে জীবনভর প্রিতমকে সহ্য করতে হতো তোকে।”
—————
রআতে হঠাৎ কল এলো নওরির। নওরির সবে চোখ লেগেছিলো। রিংটোনের শব্দে সে উঠে বসলো। ঘুমের ঘোরে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফোন খুঁজলো। ফোনটি হাতে নিয়ে দেখলো ইরা’দ কল করেছে। ইরা’দকে দেখে নওরির ঘুমের রেশ কিছুটা কমে এলো। তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইরা’দ বলে ওঠে,
–“ডিস্টার্ব করলাম?”
নওরি চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,
–“না, বলুন।”
–“খুব খিদে পেয়েছে। কিছু রেঁধে আনো তো। বউয়ের হাতের রান্না খেতে ইচ্ছে করছে!”
ইরা’দের আবদার শুনে নওরির ঘুমের রেশ এবার পুরোপুরি কেটে গেলো। ফোনে সময় দেখে বললো,
–“এই মাঝরাতে?”
–“ইচ্ছের উপর তো আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। যদি মাঝরাত হয় তাহলে মাঝরাতেই! এছাড়া আমাদের হালাল প্রেম তো মানুষদের আড়ালে এই আঁধার রাতেই করতে হবে। তাই যা বলছি দ্রুত তা করে আনো!”
–“শুনুন…”
ইরা’দ কোনো কথা শোনার আগেই কল কেটে দিলো। এবার নওরি পরলো মুসিবতে। এই মাঝরাতে সে কী রান্না করবে? আগে ওয়াশরুমে ছুটলো ফ্রেশ হতে।
ইরা’দ বারবার হাতের ঘড়ি দেখছে এবং নওরির বারান্দার দিকে তাকাচ্ছে। ইরা’দ বর্তমানে তাদের ছোড় বাগানের এক কোণায় বসে আছে। তাঁর মাথা উপরে আম গাছ। যার ডাল-পালা অনেকটা জুড়ে বিস্তৃত। গাছের ফাঁকফোকর দিয়েই নওরির বারান্দাটা দেখা যাচ্ছে। এখানে বসার কারণ তাঁর মা। তাদের বাসা থেকে আম গাছের নিচে দেখাটা বেশ টাফ। এছাড়া ইরা’দের বেলকনি থেকে অবশ্য নিচটুকু দেখা যায়। কিন্তু ইরা’দ রুমের দরজা লকড করে বারান্দা দিয়ে বাগানে নেমেছে। তাই মৌসুমির তাঁর ঘরে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই।
কিছুক্ষণ পরই নওরি আসলো। হাতে তাঁর প্লেট দিয়ে ঢাকা খাবার। এক বোতল পানি আনতেও ভুলেনি। বউয়ের এরকম যত্ন দেখে ইরা’দ মৃদু হাসলো। নওরি সেই হাসি দেখে নজর ঘুরিয়ে ফেললো। ধীরে ধীরে ইরা’দের কাছে এসে দাঁড়ালো। নওরিকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরা’দ তাঁর পাশে বসার জায়গা করে দিলো। কিন্তু নওরি সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।
–“কী হলো? বসো!”
নওরি ইতঃস্ততা নিয়ে ইরা’দের পাশে বসলো। ইরা’দ অনিমেষ চেয়ে রয় তাঁর নৌরি ফুলের দিকে। নিজেকে সামলে বলে,
–“কী রান্না করেছো দেখি?”
নওরি খাবারের উপর থেকে প্লেট উঠালো। সাদা ভাত এবং পাশে দুই টুকরো ফ্রাইড চিকেন। চিকেন থেকে আলাদা ঘ্রাণ ইরা’দের নাকে এসে বিঁধছে। নওরি চাপা স্বরে বললো,
–“আসলে, এই মাঝরাতে এই রেসিপি ছাড়া আর কোনো রেসিপি মাথায় আসেনি। ভাত রান্না করাই ছিলো, তাই চটপট..”
ইরা’দ হাসলো। সাদা ভাত থেকে নজর উঠিয়ে বলে,
–“তোমায় জানানোর জন্যে বলে দেই তোমার বর শুকনো ভাত খেতে পারে না। তাঁর মাস্ট ঝোল বা অন্যকিছু লাগবেই!”
নওরির এই পর্যায়ে এসে অনুশোচনা বোধ হতে লাগলো। মুহূর্তে-ই মুখ ঘুচে নিচু গলায় বললো,
–“স্যরি!”
–“ইট’স ওকে। তবে আজ অন্যকিছু ট্রাই করতে দ্বিধা নেই। দাও দেখি, খাইয়ে দাও। ডিনার করিনি।”
—————-
ইরা’দ কোনো কাজে বাসায় আসলে দেখতে পায় তাঁর মায়ের পায়ের কাছে লতিফা বসে আছে। লতিফাকে দেখে ইরা’দের মেজাজ চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। থমথমে সুরে বলে,
–“লতিফা খালা এখানে কী করছেন? আমি মানা করা সত্ত্বেও আপনি আমার বাসায় আসার স্পর্ধা দেখিয়েছেন! সাহস তো কম না!”
ইরা’দের এরূপ গম্ভীর কথাবার্তা শুনে মৌসুমি চোখে-মুখে ভীষণ রাগ ফুটিয়ে তুলে বলে,
–“আমার বুয়াকে তুই বের করার কে ইরা’দ? নিজের কাজে যা। লতিফা যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ থাকবে। আমার ইচ্ছাতেই থাকবে!”
ইরা’দ হাত মুঠো করে বলে,”মা..!”
বেশি কিছু বলার পূর্বে সে নিজের রাগ সংবরণ করে নেয়। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। এমতাবস্থায় লতিফা ঘাবড়ে গিয়ে মৌসুমির হাত ধরে বলতে লাগে,
–“মেডাম, আমারে তিন তলার ওই মেয়ের লেইগা সাহেব আমারে কাজ থেকে বাইর কইরা দিছে৷ সে পালাইছে আর আমি তা কইছি দেইখা সাহেবের কী রাগ। আমার কী দোষ কন তো! উলোট পালোট কিছু হইলে তো আমি কমুই!”
লতিফার এই কথাগুলোই যেন যথেষ্ট ছিলো আগুনে ঘি ঢালার মতো। ইরা’দ চেঁচালো,
–“লতিফা!!!”
মৌসুমি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে। যেই মেয়েকে দুই চক্ষে সহ্য করতে পারে না সেই মেয়ের জন্যে লতিফাকে তাঁর ছেলে বের করে দিয়েছে? এ তো পুরোই সহ্য সীমানার বাইরে। মৌসুমি হুংকার ছেড়ে বললো,
–“গলা নিচে নামিয়ে কথা বল ইরা’দ। ভুলে যাস না তোর মা তোর সম্মুখে দাঁড়িয়ে। তুই পরের মেয়ের জন্যে এভাবে চেঁচাবি তাও আমার বাড়িতে! আমি তো কখনো ভাবতেই পারিনি। কে হয় ওই মেয়ে তোর? কিসের এত জ্বালা? হ্যাঁ? সব আজ তুই আমাকে বলবি। কী সম্পর্ক তোর ওই চরিত্রহীনা মেয়ের সাথে!”
–“মা, তুমি কিন্তু এবার সীমা অতিক্রম করছো। নওরি কী তাঁর বাবার বাড়িতেও যেতে পারবে না? তাঁর পরিবারের কাছে যাওয়া মানে-ই কী অন্য ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া? এ কেমন বিবেচনা তোমার মা?”
–“আমি সেসবের ধার ধারি না। এমনকি জানতেও চাই না। সেই মেয়ে আমার পছন্দ না। তাঁর মানে তোর সাথেও কোনো সম্পর্ক থেকে থাকলে তা আজ, এই মুহূর্তে-ই শেষ। আর যদি দেখেছি তোকে তিন তলায় যেতে অথবা মেয়েটার আশেপাশে।”
ইরা’দ মুখ বুজে নীরবে সব শুনে গেলো। তাঁর মা সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। ইরা’দ এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো লতিফার দিকে। এই দৃষ্টির মানে হচ্ছে এই, সে লতিফাকে গোড়ায় গোড়ায় দেখে নিবে। তাঁর আগে তাঁর মায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ভেবেই ইরা’দ হনহনিয়ে চলে গেলো বাইরে। সামান্য এক গ্লাস পানি পর্যন্ত পান করলো না সে। লতিফা ইরা’দের সেই দৃষ্টি দেখে আতঙ্কিত স্বরে মৌসুমির উদ্দেশ্যে বললো,
–“মেডাম! ছোট সাহেব আমাকে যেমনে দেখলো যেন চোখ দিয়েই গিলে খাইবে।”
–“চিন্তা নিও না লতিফা। আমিও দেখি আমি থাকতে ইরা’দ তোমার কী করে? এখন এসব না ভেবে নিজের কাজ করো যাও।”
—————–
–“এই বাসাতে কতদিন ধরে আছো?”
আফিফার এহেম কথাতে নওরি কিছুটা চমকালো। চমকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো আফিফার দিকে। নওরি ধীরগলায় বললো,
–“কেন?”
–“তুষার তোমার খুব প্রসংশা করে। তুই এই, তুমি সেই। জানো তো তুষার কে? আমার ফিয়ন্সে হয়। তাঁর মুখে তোমার নাম শোনাটা আমার কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক লাগবে তাই না?”
নওরি চেয়ে রইলো আফিফার দিকে। আফিফার চোখে-মুখে কেমন রাগ এবং বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। নওরি বেশ শান্ত স্বরে বলে,
–“আমি তো জানি আপনি তুষার ভাইয়ার ফিয়ন্সে। এছাড়া তুষার ভাইয়ার মুখে আমার প্রসংশা থাকবে কেন?”
–“হ্যাঁ, আমারও একই প্রশ্ন। এতদিন যা হয়েছে তাঁর জন্যে তোমাকে সাবধান করতে আসলাম। আগামীকাল তুষার আসবে। তাই ওর থেকে দূরে থাকাটাই তোমার মঙ্গল!”
বলেই আফিফা রান্নাঘর থেকে চলে গেলো। এদিকে নওরি আফিফার কথার আগা – গোড়া কিছুই বুঝলো না। সে বো!কার মতো চেয়ে রইলো আফিফার যাওয়ার পানে!
#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
৩৬.
আজ তুষার সুদূর প্রবাস থেকে স্বদেশে ফিরবে। এজন্যে বাসাতে লেগেছে উৎসব। নূরজাহান একা হাতে ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করছে। খাবারের ঘ্রাণে পুরো বাসা মৌ মৌ করছে। নওরি বসে বসে নূরজাহানের কান্ড দেখছে। ঠোঁট থেকে যেন হাসি সরছেই না তাঁর। নওরি আজ ভার্সিটি যেতে পারেনি। বরং নূরজাহান-ই যেতে দেয়নি। তুষার বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে দুপুর একটায়। এরপর ইমিগ্রেশন-সহ বাকি সব কাজ শেষ হতে হতে কত সময় লাগবে তাঁর কোনো ধারণা নেই। তবে নূরজাহান’রা দেড়টার মধ্যে এয়ারপোর্টে থাকবে। আফিফা নূরজাহানের সাথে কাজে হাত লাগানোর চেষ্টা করছে। নওরি হাতে ফোন নিয়ে চেক করছে বারবার। গতকাল থেকে ইরা’দকে নওরি দেখতে পায়নি। নিদ্র’র থেকে শুনেছে, ইরা’দ কী কাজে নাকি চট্টগ্রাম গিয়েছে। কতদিনের জন্যে তা জানা নেই। নওরি ভীষণ চিন্তিত। একটাবারের জন্যেও কেন ইরা’দ তাকে জানালো না? নওরি ফোন করলেও ফোন বারবার সুইচড অফ বলছে। চাপা নিঃশ্বাস ফেললো সে। নওরিকে একা বসে থাকতে দেখে আফিফা এগিয়ে এলো।
–“ফোনে এত কী দেখছো?”
নওরি হাসার চেষ্টা করে বলে,
–“এক আপুর কল করার কথা ছিলো।”
আফিফা সরু চোখে নওরিকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
–“ওহ!”
নিদ্র এবং ফ্রিশা সারা বাসায় ছুটাছুটি করছে। নিদ্র তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে বারবার একই বাক্য উচ্চারণ করছে,
–“আমার তুষার ভাইয়া আসবে।”
ফ্রিশা কেন দৌড়াচ্ছে সে নিজেই বলতে পারে না। তবে নিদ্রকে দৌড়াতে দেখে সে নিজেও ছুটছে। আজ বৈঠকঘরে সৈকত সাহেবের সাথে সিদ্দিক সাহেব আড্ডা জমিয়েছে। দুই ভাই অনেকদিন পর সব কাজ ফেলে নিজেদের জন্যে সময় পেয়েছে। দুই ভাইয়ের মধ্যেই উচ্ছাস লক্ষণীয়। সকালের দিকে মৌসুমি এসেছিলো নূরজাহানের রান্নায় সাহায্য করতে। যাওয়ার পথে হঠাৎ-ই নওরির সাথে মৌসুমির দেখা হয়ে গিয়েছিলো। নওরিকে দেখে মৌসুমির মুখশ্রী জুড়ে রাগের আভাস ছড়িয়ে গেছিলো। নওরি অবশ্য সেই রাগের কারণ বুঝতে পারেনি তবে সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছিলো যেন তাঁর। মৌসুমিকে নওরি ভীষণ ভয় পায়। সেই সময়ে মৌসুমি কিছু না বলেই চলে গিয়েছিলো।
অবশেষে যোহরের আযানের পরপর সকলে রওনা হয় তুষারকে আনতে। নওরি, মৌসুমি এবং মাজেদা বেগম বাদে সবাই গিয়েছে এয়ারপোর্টে থেকে তুষারকে রিসিভ করতে। ইরা’দ চট্টগ্রামে আছে বিধায় সে যেতে পারেনি। তুষার আসবে, তা জানে কী না সন্দেহ। তুষার ইরা’দের চেয়ে দুই বছরের ছোট। তাও তাদের মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। নূরজাহান নওরিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু নওরি রাজি হয়নি কোনোভাবেই। কারণ, সে বুঝতে পেরেছে আফিফা তাকে কোনো কারণে সন্দেহ করছে। তাই সন্দেহ থেকে বাঁচতে নওরি যায়নি। এছাড়া ইরা’দ নেই। ইরা’দের জন্যে তাঁর হৃদয় বিষণ্ণ। এই বিষণ্ণতায় তাঁর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। সকলে চলে গেলে নওরি তাঁর বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। যার ফলে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সে। সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
ফ্রিশাও নওরির সাথে থেকে গেছে। নওরিকে ঘুমোতে দেখে ফ্রিশাও রুমের এক কোণে চোখ বুজে শুয়ে পরেছে।
নওরির ঘুম ভাঙলো সারিফার ফোনকলে। নওরি ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে কল রিসিভ করলো। ধীরগলায় বললো,
–“হ্যালো!”
–“আপু, আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। তুমি ঠিক আছো তো?”
নওরি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। আশেপাশে তাকিয়ে ঘড়িতে নজর পরলে দেখে সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। নওরির এ-ও মনে পরলো আজ তুষার আসতে চলেছে। সকলে তাকেই রিসিভ করত্র গিয়েছে। নওরি উঠে বসতে বসতে বললো,
–“ঠিকাছে। সাবধানে এসো!”
কল কেটে নওরি ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে মুখ মুছতে মুছতে বারান্দায় চলে গেলো। বারান্দায় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ইরা’দের বারান্দাটা দেখলো। মনমরা হয়ে কিছুক্ষণ বারান্দায় কাটিয়েই ভেতরে চলে আসলো। ভেতরে এসে শুনতে পায় অনেকের সড়গোলের শব্দ। নওরির বুঝতে বাকি নেই যে ওরা সবাই চলে এসেছে। মাথায় ভালোমতোন কাপড় মুড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। বেরিয়ে এসে দেখলো সকলের মাঝে মধ্যমণি তুষারকে ভেতরে প্রবেশ করতে। তুষার দেখতে খুব একটা খারাপ না। বরং সুপুরুষই। তাঁর গা ঘেঁষেই আছে আফিফা। তুষারের হঠাৎ নওরির দিকে চোখ পরতেই নওরি অস্বস্তিবোধ করলো। তুষার কোনোরকমে পায়ের জুতো খুলে সবার আগে এগিয়ে এলো নওরির দিকে। তুষারকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে নওরি বিস্মিত হলো। বাকিরা ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। নওরির দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে তুষার বললো,
–“ফাইনালি আমি তোমার দেখা পেয়েছি। এয়ারপোর্টে আসোনি কেন আমায় রিসিভ করতে?”
নওরি হতভম্ব হয়ে একবার তুষারের দিকে তো আরেকবারে বাকিদের দিকে তাকাচ্ছে। আফিফার চেহারার রং পালটে গেছে। সারা রাস্তা তুষার নওরির কথা-ই বলে গিয়েছে, যা শুনে আফিফা মহা বিরক্ত।
সারিফা হাসি-মুখে এগিয়ে এসে বলে,
–“নওরি আপু কিছুটা অসুস্থ ভাইয়া, তাই যেতে পারেনি!”
অসুস্থতার কথা শুনে তুষার নওরির কপালে হাত রাখতে গেলে নওরি জড়তায়, অস্বস্তিতে পিছিয়ে গেলো। বড়ো বড়ো চোখে তুষারকে দেখে হন্তদন্ত পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
রাতে সারিফা এসেছে নওরির ঘরে গিফট নিয়ে। তুষার তাঁর হাত দিয়ে পাঠিয়েছে। তুষার আসার পর থেকে নওরি ঘর থেকেই বের হয়নি৷ যেই রুম থেকে বের করতে চেয়েছে নওরি অসুস্থতার বাহানা দিয়েছে। সারিফার হাতে কয়েকটা রঙিন কাগজে মোড়ানো গিফট দেখে অবাক হয়ে বলে,
–“এগুলো কী সারিফা?”
–“ভাইয়া আসার সময় সকলের জন্যেই গিফট নিয়ে এসেছে। এগুলো তোমায় দিয়েছে ভাইয়া। তুমি তো রুম থেকে বের হওনি তাই আমাকেই এসে দিতে হলো।”
নওরি বিব্রতবোধ করলো। তাঁর ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে ওদের মাঝে থাকতে। উপরওয়ালা তাকে কোন পরীক্ষায় ফেললো কে জানে? এমন সময়ে ইরা’দও শহরের বাইরে! কী করবে নওরি বুঝে উঠতে পারছে না। নওরি নিচ্ছে না দেখে সারিফা কিছু বলতে নিবে তখনই রুমে প্রবেশ করলো আফিফা। আফিফাকে দেখে সারিফা গিফট রেখে রুমের বাইরে চলে গেলো। আফিফা হঠাৎ বলে ওঠে,
–“গিফট নেয়া হচ্ছে বুঝি? নাও, তুমি তো এখন খুব খুশি আমার ভালোবাসায় আ!গুন লাগিয়ে। ভেরি গুড!”
আফিফা এই বলে নওরির রুম থেকে চলে যেতে নিলে নওরি থামালো তাকে। আফিফা নওরির পিছুডাক শুনে ফিরে তাকালো। নওরির চোখের ইশারায় বললো,
–“এদিকে আসো!”
আফিফা তাচ্ছিল্যের সাথে নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে নওরির বিছানায় বসলো। নওরি আফিফার দিকে শান্ত নয়নে চেয়ে বলে,
–“কেউ তোমার ভালোবাসা ছিনিয়ে নেয়নি আপু!”
–“মজা নিচ্ছো? আমি কিন্তু বলে রাখছি..”
নওরি হঠাৎ আফিফার দুই হাত নিজের মুঠোজোড়ায় আগলে নিয়ে ধীরগলায় বললো,
–“তুমি যেরকম ভাবছো ওরকম কিছুই না আপু। তোমার ভুল ধারণা সব।”
–“তাহলে ঠিক ধারণাটা কোনটা?”
–“তুষার ভাইয়ার সাথে আমার ওরকম কোনো সম্পর্ক নেই যেমনটা তুমি ভাবছো। এখানে আমি পড়তে এসেছি, নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে এসেছি। তুষার ভাইয়ার সাথে ফোনালাপে হাতে গোণা কয়েকবার কথা হয়েছে। এছাড়া সরাসরি কখনোই আমাদের দেখা হয়নি আর…”
নওরির কথার মাঝে ফোড়ন কেটে আফিফা বললো, –“এক্সকিউজ শুনতে চাইনি আমি। মনে রাখবে এক হাতে তালি বাজে না। তাই নিজেকে সাধুও ভেবো না।”
এমন পর্যায়ে এসে নওরি কী করবে ভেবে পেল না। অসহায় অনুভব হলো। আলতো স্বরে বললো,
–“আমি বিবাহিত আপু!”
নওরির মুখে এমন কথা শুনে আফিফা আকাশ ভেঙে পরলো। বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে রইলো নওরির পানে। ততক্ষণে নওরি নজর নিচে নামিয়ে ফেলেছে। আফিফা অবাকমিশ্রিত কন্ঠে বললো,
–“মানে? সত্যি? কী বলছো?”
নওরি মাথা নিচু করে বলে,
–“সত্যি বলছি। জীবনের প্রথম ভালোবাসাই আমার স্বামী। তাই তুষার ভাইয়াকে নিয়ে অন্যকিছুর প্রশ্ন-ই আসে না। তুমি বিশ্বাস করছিলে না তাই জানালাম তোমায়। দয়া করে এই খবর কারো সাথে শেয়ার করিও না। আমি কখনোই তোমাদের মাঝে আসিনি!”
———————-
রাতের বেলায় নওরি ব্যতীত ছোট-বড়ো সকলেই আডড্ডায় বসলো। আড্ডার এক সময়ে নূরজাহান তুষারের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“তোর জন্যে সুসংবাদ আছে তুষার!”
তুষার নূরজাহানের দিকে ফিরে হাসি দিয়ে বলে,
–“কী সুসংবাদ মা?”
নূরজাহান মুচকি হেসে একপলক আফিফার দিকে চাইলো। আফিফা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলেছে! নূরজাহান আফিফার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে,
–“আফিফার সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছি!”
এরকম একটি খবর শুনে তুষার বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চোখ থেকে যেন ফুলকি বেরোচ্ছে। সকলে তুষারের এভাবে উঠে যাওয়া দেখে ভীষণ অবাক হলো। তখনই নওরি খাবারের জন্যে রুম থেকে বেরিয়েছে। তুষার নওরির দিকে তর্জনী তাক করে থমথমে সুরে বলে,
–“আমি নওরিকে ছেড়ে কাউকে বিয়ে করবো না মা। আমার নওরিকে পছন্দ। তুমি তাকেই আমার পাত্রী হিসেবে গ্রহণ করো।”
#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
[২য় পরিচ্ছেদ]
৩৭.
তুষারের এহেম প্রস্তাবে বাড়িতে যেন একপ্রকার তান্ডব চললো। রাত থেকেই নূরজাহান রাগ করে নিজের ঘরে বদ্ধ অবস্থায় পরে আছে। তুষার মাকে ডেকেও খুব বেশি ফায়দা হয়নি। ওদিকে আরেক নতুন ঝড় শুরু হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে কেউ একজন ইরা’দের বিয়ের কথা ছড়িয়ে দিলো। সাথে ছড়ালো ইরা’দের কাবিননামায় সাইন করা মুহূর্তের ছবি। বাড়িতে সবাই তুষারকে নিয়ে মেতে আছে বিধায় কেউ সেই খবর জানতে পারেনি। তবে সেই খবর কোনো না কোনো ভাবে মৌসুমির কান অবধি পৌঁছালো। এই খবর শুনে বিপি হাই করে বিছানায় পরে আছে সে। সিদ্দীক সাহেব মুচকি হাসতে হাসতে মৌসুমির মাথায় আইস ব্যাগটা দিলো। কোনোদিন বিয়ে করতে না চাওয়া ইরা’দ কী না বাপ-মাকে গোল খাইয়ে বিয়ে করে ফেললো। আর তাঁরা কী না এর টু-শব্দও পেলো না। ছেলে তাঁর বড়ো হয়েছে। এতই বড়ো যে লুকিয়ে বিয়ে করেছে সে। এ নিয়ে সিদ্দীক সাহেবের কোনো আক্ষেপ নেই, রাগও নেই। ছেলের প্রতি আলাদা বিশ্বাস আছে তাঁর। এজন্যে বউমা কে, কীরকম হবে সেসব নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় সে।
তবে তাঁর স্ত্রীর অবস্থা দেখে সে হাসছে। যেই মা ছেলেকে বিয়ে দেয়ার জন্যে উঠে-পরে লেগেছিলো সেই মা কী না ছেলের বিয়ের কথা শুনে প্রেশার হাই করে ফেলেছে। এ তো হাস্যকর ব্যাপার। ধাক্কা খাওয়ার কথা সিদ্দীক সাহেবের আর তাঁর পরিবর্তে ধাক্কা খেয়েছে মৌসুমি নিজে। সিদ্দীক সাহেব তো পারছে না খুশিতে পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করতে। মৌসুমি চোখ বুজে বিড়বিড় করে বারবার বলছে,
–“কী হয়ে গেলো এসব! কাকে বিয়ে করলো আমার ছেলে। কেন জানালো না আমাকে? কবে বিয়ে করলো? এই দিন দেখার ছিলো?”
সিদ্দীক সাহেবের পেট ফেটে হাসি আসার উপক্রম। এমন মুহূর্তেও সে হাসতে পারে তাঁর জানা ছিলো না। মৌসুমির অসুস্থতার খবর চাইলেও নূরজাহানকে দিতে পারছে না। সে তো আরেক চিন্তায় কাতর। না জানি কী অবস্থা তিনতলার!
——————
আফিফা নওরির পাশে বসে অনবরত কান্না করেই চলেছে। নওরি আফিফাকে থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। আফিফা নাক, মুখ লাল করে ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
–“কেন হচ্ছে আমার সাথে এসব? তুষার কী সত্যি-ই আমায় ডিজার্ব করে না? কেন দিলে তুমি আমায় তুষারের ক!সম? আমি চাইলেও বলতে পারছি না তোমার বিয়ের কথা। কেন এত অমানবিক হচ্ছো তোমরা আমার সাথে? বলো!”
নওরি জোর করে আফিফাকে নিজ বক্ষে আগলে নিয়ে বলে,
–“এভাবে পাগলামি করিও না আপু। শান্ত হও। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুষার ভাইয়া নিজের ভুল বুঝতে পারবে। নূরজাহান আন্টি ঠিকই রাজি করিয়ে নিবে দেখিও।”
–“তুষারের মনে তো তোমার বসবাস নওরি!”
–“তুষার ভাইয়া মনে হয় না কখনো কাউকে ভালোবেসেছে। আমার প্রতি তাঁর অনুভূতিটা ভাইয়ার সামান্য মোহ। সে হয়তো বুঝতে পারছে না। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ঠিকই বুঝে যাবে। তুমি দয়া করে কেঁদো না আফিফা আপু। পজিটিভ ভাবো। এভাবে হাল ছাড়তে নেই!”
আফিফার চোখ বারবার মুছে দিলেও আফিফার কান্না থামছে না। এই মুহূর্তে নওরি নিজেকে ভীষণ অসহায় অনুভব করছে। মনে মনে ভাবছে,
–“আপনি কোথায় নিদ্র সাহেব? এই পরিস্থিতিতে আপনার সঙ্গ যে আমার ভীষণ দরকার। প্লিজ চলে আসুন, তাড়াতাড়ি চলে আসুন। একা একা আমি আর কত সামলাবো? হিমশিম খাচ্ছি যে!
——-
খুব ভোরে নওরি নূরজাহানের রুমের সামনে গেলো। কম্পিত হাতে দরজায় হাত রাখতেই দেখলো দরজা খোলা। সারা রাত বন্ধ থাকলেও এখন খোলা দেখে ভীষণ চমকালো। নওরি আশেপাশে তাকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে গিয়ে দেখলো সৈকত সাহেব বিছানায় ঘুমোচ্ছেন আর নূরজাহান জায়নামাজে নামাজরত অবস্থায়। মোনাজাতে আছেন তিনি। নওরি বুকে সাহস জুগিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো নূরজাহানের দিকে। নূরজাহানের পাশে সন্তপর্ণে বসলো। নওরির উপস্থিতি বুঝতে পেরে নূরজাহান মোনাজাত শেষ করে ঘাড় বাঁকিয়ে নওরির দিকে তাকালো সে। নওরির চোখ জোড়া হঠাৎ ছলছল করে উঠলো। ধীর গলায় শুধায়,
–“আমায় বিশ্বাস করো তো আন্টি!”
নূরজাহান কিছুক্ষণ অপলক নয়নে চেয়ে রয় নওরির পানে। অতঃপর স্মিত হেসে নওরির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলে,
–“করি। খুব করি!”
নওরি হঠাৎ নূরজাহানের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো। ভাঙা গলায় বললো,
–“বিশ্বাস করো আন্টি। তুষার ভাইয়ার সাথে আমার সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই। তুমি তো দেখো-ই, তোমার চোখের সামনেই তো এতদিন ধরে আছি!”
নূরজাহান নওরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আনমনে বলে উঠলো,
–“খেয়াল করতাম তুষারকে ফোনে দেখলে তুই এড়িয়ে চলতি কিন্তু তখনো বুঝিনি যে এরকম কিছু হয়ে যাবে!”
–“এখন কী হবে আন্টি? আমি মোটেও তুষার ভাইয়াকে বিয়ে করবো না আন্টি। আফিফা আপু অনেক আপসেট!”
–“তুই এই দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাক, তুষারকে আমি সামলে নিবো। আফিফা ঘুমিয়েছে?”
–“হুম। সারারাত কেঁদেছে!”
নূরজাহান পুণরায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–“আমার-ই ভুল হয়েছে, আমি-ই মেয়েটাকে আগে-ভাগে স্বপ্ন দেখিয়েছি। তুষারকে যদি আগেই বলে রাখতাম, তাহলে এরকম ঘটনা ঘটতো না।”
নওরি নীরব রইলো। সংকোচে পরলো বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে। কী করে জানাবে নূরজাহানকে? বিব্রতবোধ করলো ভীষণ। নূরজাহান সত্যিটা জানলে কী হবে? তাকে পর করে দিবে? তাকে খারাপ ভাববে? নওরি তো অনেক সাহস জুগিয়ে নূরজাহানকে সব সত্যি জানাতে এসেছে। তাহলে এখন কেন সব সাহস, মনোবল হারিয়ে ফেলছে? সারা রাত আফিফাকে কাঁতড়াতে দেখেছে সে। ভালোবাসার ব্যথা যে খুব যন্ত্রণাদায়ক। তাঁর চুপ থাকার কারণেই তো মেয়েটা এত কষ্ট পাচ্ছে। নওরি কী করে পাষাণ হবে? নওরি কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। চোখ বুজে আল্লাহ্কে ডাকলো। আল্লাহ্কে স্মরণ করে ভয়ে ভয়ে বলে,
–“একটা সত্যি কথা বলবো আন্টি?”
–“হ্যাঁ, বল!”
নওরি মিনিটখানেক চুপ থেকে বলে,
–“আমি এবং ইরা’দ সাহেব একে অপরকে ভালোবাসি আন্টি!”
নূরজাহানের বিস্ময় যেন আকাশচুম্বী। নওরি শোয়া থেকে উঠে বসলো। নূরজাহানের মুখোমুখি। নূরজাহানের পতিক্রিয়া দেখে নওরি চোখ নামিয়ে ফেললো। মেঝেতে হাতের নখ দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে বলে,
–“সেদিন স্টেশন থেকে আসার সময় ইরা’দ সাহেবের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।”
—————
ইরা’দ বাড়িতে ফিরলো পরেরদিন-ই। ফিরে এসে দেখলো তাদের ফ্ল্যাটে পিনপতন নীরবতা। কোনো কাক-পক্ষীরও শব্দ নেই। ইরা’দ কাঁধের ব্যাগের হাতল ধরে মিনমিন করে বললো,
–“কাহিনী কী? সবাই কী মূর্ছা গেলো নাকি? এত নীরব কেন? চুরি-ডাকাতি হবে তো!”
ভাবতে ভাবতেই ইরা’দ মৌসুমির রুমে গিয়ে উঁকি দিলো। উঁকি দিয়ে দেখতে পেলো মৌসুমি মাথায় আইস ব্যাগ দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আর তাঁর পাশেই আধশোয়া হয়ে ঝিমুচ্ছে সিদ্দীক সাহেব। ইরা’দ কী মনে করে হাসলো। উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
–“মা, আইসব্যাগের বরফ সব তো গলে পানি হয়ে গেছে। আরেকটা আইসব্যাগ এনে দিবো?”
মৌসুমি চট করে তাকালেন। হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসলেন। ছেলের কথাগুলো কান দিয়ে নিঁখুত ভাবেই প্রবেশ করেছে। রাগে ফেটে পরে মাথার আইসব্যাগ ছেলের দিকে ছুঁড়ে মারলো। ইরা’দ হাসত্র হাসতে সরে পরলো। মৌসুমি রাগে গিজগিজ করতে করতে বলে,
–“অ!সভ্য!”
নূরজাহান রুম থেকে বেরিয়ে সকলের জন্যে নাস্তা বানিয়েছে। নওরি তাকে সাহায্য করেছে। মুখ তাঁর ভার। তুষার বেশ কয়েকবার রান্নাঘরে এসেছিলো। তুষারকে লক্ষ্য করলে নূরজাহান তাঁর হাতের খুন্তি তুষারের দিকে তাক করে বলেছে,
–“আর যদি তোকে রান্নাঘরে দেখি তাহলে এই বড়ো অবস্থায় সবার সামনে তোর পিঠে খুন্তি বসাবো। তাই সময় থাকতে এখান থেকে ভাগ!”
তুষারের আর কী করার। মায়ের রাগের কাছে হার মেনে সে চলে গেলো। নওরি মিটিমিটি হাসলে নূরজাহান তাকেও খুন্তি দেখিয়ে বলে,
–“একদম হাসবি না। এত বড়ো কান্ড ঘটিয়েছিস অথচ আমায় জানানোর প্রয়োজন মনে করিসনি! আসুক একবার ইরা’দ। দুটোর একসাথে হাত-পা ভেঙে দিবো!”
নওরি ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো। নূরজাহানের অভিমান সে বুঝতে পেরেছে। ভালোই লাগছে তাঁর শাসন শুনতে। নওরি এই ভেবে স্বস্তি পাচ্ছে যে মা সমান নূরজাহান তাকে ভুল বুঝেনি।
নাস্তার সময় সকলেই একসাথে বসেছে। আফিফাকে জোর করে নিদ্র তুষারের পাশে বসিয়েছে। সেদিকে অবশ্য তুষারের ধ্যান নেই। সে বারবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। মা যে ভয়!ঙ্কর রূপ ধারণ করে আছে। তাকে মানাবে কী করে? নূরজাহান বারংবার আফিফাকে দেখছে। এক রাতের ব্যবধানে মুখটা কেমন শুকিয়ে ফেলেছে। নাস্তার টেবিলে নিদ্র বাদে সকলেই নীরব। এর মাঝে সুযোগ বুঝে তুষার পুণরায় এক কথা বলে ওঠে,
–“প্লিজ মা রাজি হও। নওরিকে তো তুমিও ভালোবাসো। ঘরের মেয়ে ঘরে বউ হয়ে থাকলে ক্ষতি কী?”
–“মে!রে একদম হাড্ডি, থুঁতনি ভেঙে ফেলবো শা**। তোর সাহস তো কম না আমার বিবাহিত বউকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিশ! অনেকদিন মা!ইর খাসনি তাই না? মা!ইরের স্বাদ পেতে চাস?”
®লাবিবা ওয়াহিদ
———————–
~