এক শহর প্রেম পর্ব -৩২+৩৩

#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩২
খাবার টেবিলে খাবার খাওয়ার সাথে যুক্ত হয়েছে আড্ডা। আহনাফের মা, ভাবি ও আদিরা খাবার পরিবেশন করছে। হাসি আড্ডাতে ছেলেদের খাবারের পর্ব শেষ হলে ওরা আহনাফের রুমে যায় তারপর আদিরা, আহনাফের মা, ভাবি ও বোন ওরা একসাথে খেয়ে নেয়।
বিকেলের একটু আগে, সূর্যের তেজ আজ অন্যদিনের তুলনায় কম। আহনাফদের ছাদে অনেক গাছ-গাছালি টবে লাগানো আছে। বাড়িটা তিনতলা বিশিষ্ট হলেও উপর ও নিচ তলা ভাড়াতে দেওয়া। বাড়ির পাশে দুয়েকটা বড়ো বড়ো আম ও কাঁঠাল গাছ আছে। ছাদে একটা দোলনাও লাগানো। আদিরা দেখেছিল, আহনাফের ভাবি তার মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন তাছাড়া সে অনেকটাই ক্লান্ত। আহনাফের মাও ঘুমোচ্ছেন। আসরের আজান হতে আরও ঘণ্টাখানেক বাকি। আদিরা টুক করে ছাদে উঠে গেল। অর্ণিকে আসতে বলেছিল কিন্তু অর্ণি ম্যাথ মিলাচ্ছিল বলে আসতে পারেনি। ছাদে গিয়ে গাছে ঝুলে থাকা লেবু, করমচা, আমরুজ এসব ধরে ধরে দেখছিল। বিমোহিত চিত্তে উপভোগ করছিল সব। অন্যদিন রোদের তেজে এসময় ছাদে আসাই যায় না। আদিরা একটা পাঁকা করমচা ছিঁড়ে নিল। গাছগুলো আহনাফদের এটা সে জানে।

হুট করে নিজের চোখের উপর কারও হাতের স্পর্শ বুঝতে পেরে মুচকি হাসল আদিরা। পেছোনে চোখ ধরে রাখা মারসাদ অপেক্ষা করছে আদিরার ভীত কন্ঠস্বর শোনার জন্য। কিন্তু মারসাদকে হতাশ করে আদিরা বলে,

–আপনার স্পর্শ আমায় ভীত করে ঠিক কিন্তু সাথে লাজুকতা ভর করে।

মারসাদ আদিরার চোখ ছেড়ে দিয়ে ওকে নিজের দিকে ঘুরায়। দুজনের চোখে অন্যরকম হাসি। যেন দুজনেই দুজনকে নিজেদের ঊর্ধ্বে অনুভব করতে পারে। মারসাদ আদিরার অবাধ্য চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলে,

–আমার এলোমেলো জীবন গুঁছিয়ে নিও। বড্ড এলোমেলো এই আমি। তোমার পদচারণায় আমার মনের শহরে আরও তোলপাড় হয়েছে। এখন সবকিছু তোমায় ঠিক করতে হবে মনোহারিণী!

আদিরা বিনিময়ে চমৎকার হাসে। তার মনে যা একটু সংশয় কাজ করছিল সেগুলোও খাবার টেবিলে কে*টে গেছে। মারসাদরা সেখানে পুরো ঘটনার বিশদ আলোচোনা করেছিল। মারসাদ বলে,

–একটা দুই রুমের ফ্লাট নিয়েছি। ফ্লাটটা এক মাস ধরে ফাঁকা ছিল। দেয়ালের রঙ করিয়েছিল বলে ভাড়াটে ছিল না এক মাস আর এই মাসেও কেউ উঠেনি। মাসের প্রায় মাঝামাঝি চলে এসেছে তাও প্রয়োজনে যে পেয়েছি ওটাই অনেক। আঙ্কেল-আন্টি, আহাদকে নিয়ে সেখানে ওঠো। বড়ো ফ্লাট পাইনি। বিকেলে মাহি আসবে। মাহি আমাকে ভার্সিটিতেই কতক্ষণ কি*ল, ঘু*ষি দিয়েছে তাকে না জানিয়ে বিয়ে করার জন্য।

এটা বলে মারসাদ হাসতে থাকে। আদিরা বলে,
–আমাকেও এসে কতোগুলা দিবে নয়তো মুখ ফুলিয়ে থাকবে। আচ্ছা, আহনাফ ভাইয়ের সাথে মাহি তো সেইদিনের পরে আর কথাই বলল না। আমি কী মাহিকে কিছু জিজ্ঞেসা করব? আমার মনে হয় মাহি আহনাফ ভাইয়াকে পছন্দ করে।

মারসাদ হতাশ স্বরে বলে,
–তোমার আমার ভাবনা মিথ্যেও হতে পারে। আমি আমার বন্ধুর লুকানো হতাশা অনুভব করতে পারি। তবে সবচেয়ে বড়ো সত্য আমি একজনের ভাই। ভাইয়ের সম্পর্কের সাথে বন্ধুর মতো ভাইয়ের সম্পর্কটা একই ধাঁচের কিছুটা। একটা রক্তের আরেকটা আত্মার। আমি তাই ওদের বিষয়ে কিছুই বলব না। সময় নিক। টাইম কেন হিলস এভরিথিং।

আদিরা কিছু বলল না। মারসাদ এবার কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে বলে উঠে,
–ও আচ্ছা শোনো, তোষক আপাততো একটা অর্ডার দিয়েছি যেটা আজ রাতেই দিবে। উনারা তো ম্যাট্রেসে ঘুমাতে পারবে না। তাই কিনি নি। তবে ম্যাট্রেসটা ভালো হতো। তোমার জন্যও কী তোষক আনব? ম্যাট্রেস আনি? আমার ওটাই ভালো লাগে।

আদিরা বুঝলো মারসাদের ম্যাট্রেস বেশি পছন্দের। তাছাড়া ওরা বিবাহিত তাই এখন মারসাদ চাইলেই আদিরা সাথে এসে থাকতে পারে। আদিরার ম্যাট্রেসে ঘুমানোর অভ্যাস নেই কিন্তু মানুষকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভ্যাস গড়তে হয়। আদিরা মারসাদকে হ্যাঁ বলে দিল। মারসাদ বলল,

–তাহলে নিচে চলো। তোমার ননোদিনী একটু পরেই চলে আসবে। আমিও বিকেলে বেরিয়ে যাব। তুমি আজকে রাতটা এখানেই থাকো। আমরা পাঁচ বন্ধুও রাতে এখানে থাকব। তোমার বাবা-মা মনে হয় আসতে আসতে অনেক রাত হবে কারণ ওরা এখনও রওনাই করেনি। ঝামেলা মিটিয়ে রওনা করবে। আর কী কী নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস লাগবে বলে দিও।

আদিরা কিয়ৎ ভাবে। তারপর বলে,
–নিত্য প্রয়োজনীয় কিছুই লাগবে না এখন। আপনি তো আমার মাকে চিনেন না। সে আমাকে যদি মেসে উঠার জন্য হাড়ি-পাতিল, কড়াই, প্লেট সব একটা একটা করে দিয়ে দেয় তাহলে নিজেরা আসার সময় নিশ্চয়ই নিয়ে আসবে। আপনাকে অযথা খরচ করতে হবে না। এমনিতেও ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া অনেক। আমি ভাবছি ভাড়া আমি দিব। কারণ ওরা আমার বাবা-মা। আমার দায়িত্ব বেশি।

মারসাদ আদিরাকে বাধা দিয়ে বলে,
–ওয়েট ওয়েট। কী বললে তুমি এসব! তুমি আমার বউ। তোমার সবকিছুর দায়িত্ব আমার। আর তোমার বাবা-মায়ের জন্য এটুকু আমি করতে পারব না?

আদিরা মুচকি হেসে মারসাদের হাত ধরল। মারসাদ ভ্রুঁ কুঁচকে আদিরার দিকে তাকিয়ে আছে। আদিরা বলে,
–আমি আপনার বউ তাই একমাত্র আমি আপনার দায়িত্ব হতে পারি কিন্তু আমার বাবা-মায়ের দায়িত্ব আমি নিতে চাই। আর আপনি তো আমার বাবাকে আমার দেনমোহর দিয়েই দিয়েছেন। আমার খুব ইচ্ছে আমার বাবা-মাকে আমি নিজের উপার্জনে রাখব। আপনি রাগ না করে আমার দায়িত্ব নেন আর আমি আমার পরিবারের। দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিলে কোনো কিছুই বোঝা মনে হবে না।

মারসাদ তো আদিরার বলা, “আপনি তো আমার বাবাকে আমার দেনমোহর দিয়েই দিয়েছেন।” ওখানেই আটকে আছে। আদিরাকে তো সে বলেনি। মারসাদের হতভম্ব মুখশ্রী দেখে আদিরা হেসে বলে,

–এটাই ভাবছেন তো আমি দেনমোহরের ব্যাপারে কিভাবে জানলাম? সকালে পুলিশ ওখানে যাওয়ার পর মা আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল তারা ঠিক আছে আর জিজ্ঞেসা করেছিল, দেলোয়ার আমাকে কিছু করেছে কীনা? তখন আমি বিয়ের কথাটা বলে দিয়েছি। মা তখন আমাকে দেনমোহর দিয়ে কর্জ চুকানোর কথা বলেছে। দুপুরে তো আপনি বললেনই কীভাবে সব ঠিক করেছেন। এরপর আমি বুঝতে পারলাম, আপনি কীভাবে বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়েছেন।

মারসাদ এবার আদিরার গাল দুটো টেনে দেয় তারপর বলে,
–দেখেছ, কতো বুদ্ধিমান আমি! শ্বশুর-শাশুড়ির মন জয় করে নিয়েছি আগেই।

মারসাদ আদিরাকে নিজের প্রশস্ত বুকের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গন করল। হঠাৎ হাসি রোলে আদিরা ও মারসাদ একে অপরের থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল। ছাদের দরজার কাছে মারসাদের চার বন্ধু, আহনাফের ভাবি, মাহি, অর্ণি, রিন্তি ও সাবিহা দাঁড়িয়ে হাসছে। মাহি তীক্ষ্ম নজর দিয়ে মারসাদদের দিকে এগিয়ে এসে বলে,

–একে তো না জানিয়ে বিয়ে করেছিস! আবার এখন লুকিয়ে লুকিয়ে দিনের আলোয় খোলা ছাদে বাসরও করছিস! দাভাই তুই দিন দিন লজ্জাহীন হয়ে যাচ্ছিস সাথে আমার ভোলাভালা বান্ধুবীটাকেও বানাচ্ছিস।

মারসাদ মাহির মাথায় ঠোকা দিয়ে বলে,
–এই বা*চাল! তুই কখন এলি? এলি যখন ছাদে কেন এলি! ভাই-ভাবি নতুন বিয়ে করেছে একটু রোমান্স করবে না! নিজে লজ্জাহীন হচ্ছিস আর দোষ দিচ্ছিস আমাদের।

মাহি হা করে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে মারসাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফের ভাবি এসে হাসতে হাসতে বলে,

–ভাই তোমার রোমান্স করার ইচ্ছে হলে বলতে। আমি নিজে তোমাদের একটা রুম খালি করে দিতাম। তাও ছাদে তো যেকেউ চলে আসতে পারে।

আদিরা এমন লজ্জাজনক অবস্থায় পরবে আশা করেনি। চোখ মুখ খিঁচে মাথা নিচু করে রেখেছে। আদিরাকে এমনভাবে থাকতে দেখে মাহি ওর হাত ধরে বলে,

–ভাবিবান্ধুবী! তোকে আমি এখন কোনটা বলব বুঝতেছি না। নাম ধরে বললে যদি তোর বর রাগ করে!

মারসাদ মাহিকে বলে উঠে,
–তোকে এতো ফর্মালিটি করতে হবে না। ওকে আগে যেভাবে ডাকতি তেমন করেই ডাকিস।

মাহি মুখ বাঁকা করে বলে,
–ইশ! তোর কাছ থেকে ট্রিট নেওয়ার এখন আদিরারাই উৎস। তাই আমি ওকে ভাবি বলেও ডাকব যখন তোর থেকে কিছু নেওয়ার হবে।

মারসাদ মাহিকে দৌঁড়ানি দিলে মাহিও ছুটতে থাকে। ওদিকে একজন মলিন দৃষ্টিতে মারসাদ ও মাহির খুঁনশুটি দেখছে। সেই একজনটা আহনাফ। মাহি এখনও তার সাথে কথা বলেনি বলে সে মলিন দৃষ্টিতে তার প্রেয়সীকে দেখছে। মাহি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আহনাফের ভাবির পেছনে এসে থামে আর ভাবিকে বাঁচাতে বলে। মাহি পেছোন দিকে ব্যালেন্স হারাতে নিলে আহনাফ ধরে ফেলে। দুজন দুজনকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পরে। মারসাদ আহনাফ ও মাহিকে একত্রে দেখে থেমে যায়। ওদের দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হোক মারসাদ চায়।

অপ্রস্তুত হয়ে মাহি সরে আসে তারপর বলে,
–আদু চল। আমরা আড্ডা দিব। ভাবি ও আন্টিও আমাদের জয়েন করবে। চল চল।

এটা বলে সে খুব ব্যাস্ততার সাথে আদিরাকে টেনে নিচে নিয়ে যায়।
#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৩ (বোনাস)
চায়ের সাথে আড্ডা জমজমাট হয়ে উঠেছে। আহনাফের মা কিছুক্ষণ থেকে উঠে চলে যান। বিকেলের শেষ সময়টা একটু পার্কে হাঁটাহাঁটি করবেন তার স্বামীকে নিয়ে। শাশুড়ির উঠে যাওয়া দেখে আহনাফের ভাবি বলেন,

–মায়ের সামনে বলতে পারছিলাম না। তা তোমাদের কার কার বয়ফ্রেন্ড আছে? আদিরার তো বিয়েই হয়ে গেল। তো বলো মেয়েরা।

মাহি ইনোসেন্ট ফেস করে বলে,
–আমাদের মতো কিউট বাচ্চাদের তোমার এই মনে হয় ভাবি? এটা ভাবতে পারলে তুমি! আমরা ওসবে জড়াই না। আমরা ভালো মেয়ে বুঝলে। এতো ভালো মেয়ে তুমি হারিকেন দিয়ে খুঁজলেও পাবে না এমনকি অণুবীক্ষণযন্ত্রের পাওয়ারফুল লেন্স দিয়েও না।

আহনাফের ভাবি সেন্টিমার্কা হাসি দিয়ে বলে,
–ঠিকই বলেছ। তাইতো আমার দেবর সাহেব এখনও সিঙ্গেল! বেচারা ভাইটার জন্য দুঃখে আমার এখন পিপাসা লেগে গেলো গো! এ কেমন মেয়েরে সে মন দিয়েছে যে ব্যাকটেরিয়ার থেকেও পবিত্র! ব্যাকটেরিয়াকে তো অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু তোমার তাও যাবে না।

মাহি মুখ ফুলিয়ে বাঁকা চাহনি নিক্ষেপ করল অতঃপর বলল,
–তোমার দেবর আমাকে থ্রেড কেনো দিয়েছে বলো? সুন্দর করে বলতেছিল তারপর নরম স্বর রুক্ষ স্বরে পরিবর্তন কেনো হলো বলো? আমি একটু ভাব দেখাব তাও পারব না! তাই তাকে আমি ঝুলায় রাখব। হুহ্! ঝুলে ঝুলে যদি আমার সাথে লাগতে আসার স্বভাবটা কমে!

মাহির কথা শুনে সকলে হা করে তাকিয়ে আছে। মাহি এজন্য আহনাফের সাথে কথা বলছে না শুনে সবার আকাশ থেকে পরার মতো অবস্থা। রিন্তি অবাক স্বরে বলে উঠে,

–তার মানে তুই আহনাফ ভাইয়াকে ভালোবাসিস? এই একটু কারণে তুই তার সাথে কথা বলিস না?

মাহি ঠোঁট উল্টে চাইল সকলের দিকে। তারপর বলল,
–সে আমার সাথে শুধু লাগতেই আসে। আমার সব কথায় প্যাঁচ ধরে সে। এমনে চললে তো মা*রা*মা*রি করেই আমরা শেষ!

উপস্থিত সকলে কপালে হাত দিয়ে সমস্বরে বলে উঠে,
–হায়রে কপাল!

সাবিহা এবার শক্ত কন্ঠে বলে,
–আমি এবার ছাদে আহনাফ ভাইয়াকে ডাক দিয়ে যেতে বলব। তারপর তুই যাবি। আজকে তোকে কনফেস করতেই হবে। নাহলে তোর একদিন কী আমার যতদিন লাগে।

মাহি আমতা আমতা করে বলে,
–পরে বলবনে। একটু প্রিপারেশন লাগবে তো। আই এম নট প্রিপেয়ারড এট অল।

কথাটা বলা মাত্রই সবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিবাণ নিজের উপর দেখে থতমত খেয়ে যায় মাহি। এরপর আর কী! অগ্যতা তাকে রাজি হতে হলো।

__________

আহনাফ ছাদে গিয়ে পশ্চিমদিকে হেলে পরা লালাভ দিবাকরের পানে চেয়ে আছে। তাকে ছাদে কেনো আসতে বলেছে জানানো হয়নি। পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম সূর্যরশ্মি তার সামনের কপালে পরে থাকা চুলগুলোতে ঝিলিক করছে। মুক্ত সমীরণ বড্ড মনকারা। দূরে একটা শঙ্খচিল উড়ে গেল। সন্ধ্যার বাতাসে শঙ্খচিল তার স্বীয় নীড়ে ফেরে। বাড়ির পাশে আশ্বিনী আম গাছে কাঁচা-পাকা আম ঝুলে আছে। অবস্থা এমন যে আমগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই পারতে হবে। আহনাফের পড়নে সাদা শার্ট ও খাঁকি রঙের জিন্স। একটু পর বাহিরে বেরোবে বলে তৈরি হয়ে নিয়েছিল। মাহি ছাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পেছোন থেকে সুদর্শন যুবকটির রূপ পড়ন্ত সূর্যরশ্মিতে অবলোকন করছে। পকেটে দুহাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। মাহির ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে গিয়ে পেছোন থেকে জড়িয়ে ধরতে। নিজের অযাচিত ইচ্ছে সংযত করে নিজের মধ্যে একটু গম্ভীর ভাবমূর্তি ধারণ করে এগিয়ে যায়। তারপর ঠিক আহনাফের পেছোনে দাঁড়িয়ে মাহি শব্দ করে,

–উহুম উহুম।

আহনাফ এতক্ষণ অন্যমনস্ক ছিল। এখন সে মাহির করা শব্দে মাহির দিকে তাকায়। তারপর অপ্রস্তুত কন্ঠে বলে,

–তুমি? কখন এলে?

মাহি মনে মনে কুটিল হাসল। তারপর বলল,
–এইতো অনেকক্ষণ। তুমি নাজানি তোমার কোন গফের কথা চিন্তা করছিলে যে আমাকে লক্ষ্যই করোনি।

আহনাফ ঘার হালকা ঘুরিয়ে বাহিরের দিকে নজর দিয়ে মলিন হাসল। মাহি ইতিউতি করে দেখতে চাইল আহনাফের রিয়াকশন। আহনাফ এরপর মাহির আঁখিজোড়াতে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে হেসে বলে,

–ভালোবাসা এতো সস্তা না যে আজ এর প্রতি মন আসল কাল ওর প্রতি। যদি এমনই হতো তাহলে শত শত হৃদয় ভাঙার চাপা কষ্টে রাতগুলো ভারী হতো না। যারা আজ একে ভালোবাসে তো কাল ওকে তারা আসলে ভালোইবাসে না। তোমার যদি আমাকে ওরকম মনে হয় তাহলে তুমি ভাবতে পারো। তোমার ভাবনাতে আমার কন্ট্রোল নেই। তুমি নিজ ভাবনায় স্বতন্ত্র।

মাহি থমকে গেল। সে তো মজা করে বলেছিল। কিন্তু তার কথায় যে কারও হৃদয়ে আ*ঘাত হানবে তা তার চিন্তার সীমায় ছিল না। মাহি অপরাধী সুরে বলে,

–আই এম সরি। আই ডিডেন্ট মিন টু। কেমন আছো?

আহনাফ হালকা হাসল।
–এইতো আলহামদুলিল্লাহ্‌। জানো মনের বোজ একদিক দিয়ে একটু হালকা হয়েছে আবার আরেকদিক দিয়ে ভয়ানক মন খারাপেরা ভর করেছে। সব মিলিয়ে বেশ আছি। তা তুমি কেমন আছো?

মাহি আহনাফের অভিমান মিশ্রিত কথা বুঝতে পারল। মাহি বলল,
–এগেইন সরি। তোমাকে ইগনোর করা উচিত হয়নি। আমি খুব ভয়ে ছিলাম। কী হবে না হবে সেটার ভয়ে।

আহনাফের শান্ত জবাব,
–আমি তোমাকে জবাবদিহি করতে বলিনি। তুমি আমার সাথে কোনো কমিটমেন্টে নেই। তোমার মন তুমি যা খুশি করো।

আহনাফ মাহির সাথে আগে কখনও এমন করে কথা বলেনি। হঠাৎ আজ বলাতে তার খুব খারাপ লাগছে। মাহি ভাবল, আর কথার মারপ্যাঁচে ফেলে সময় নষ্ট করবে না। সরাসরি এবার চোখ মুখ খিঁচে বলে উঠে,

–আই লাভ ইউ ঠু। সরি এতোদিন অপেক্ষা করানোর জন্য। আমার ভয় হচ্ছিল কারণ তোমার সাথে আমার প্রচুর ঝ*গড়া হয় যার দরুন ভেবেছিলাম পরে যদি সম্পর্ক খারাপ হয়! সরি। আমার জন্য তোমার মন এতোদিন খারাপ ছিল।

মাহি নিজের মনের সব গোপন কথা বলে লম্বা একটা দম নিলো। আস্তে আস্তে পিটপিট করে চোখ খুলে আহনাফের রিয়াকশন দেখতে চাইল। কিন্তু কী আশ্চর্য! আহনাফ কেমন ভাবলেশহীন ভাবে চেয়ে আছে। আহনাফের চোখের ভাষা মাহির বোধগম্য হচ্ছে না। মাহি ভ্রুঁ কুঁচকে ঠোঁট উল্টে আহনাফকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাৎক্ষণিক আহনাফ হাই তুলতে তুলতে বলে উঠল,

–যা আমি জানি তা কেনো বলছ! নতুন কিছু বলো।

মাহি আহনাফের কথায় হা হয়ে তাকিয়ে আছে। এবার রেগে গিয়ে তৎক্ষণাৎ ধুপধাপ পা ফেলে ছাদ ত্যাগ করল। মাহি যেতেই আহনাফ নিজের কন্ট্রোল করে রাখা হাসি আর চেপে রাখতে পারল না। জোরালো শব্দে হেসে উঠল। আহনাফের বরাবার গাছের ও পানির টাংকির আড়াল থেকে মারসাদ, মৃদুল, রাহিন ও রবিন হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো। রাহিন ভিডিও অফ করে এসে বলে,

–তুই ভালো হবিনা তাই না? তোর এই উল্টো কথার জন্যই মেয়েটা রেগে যায়।

আহনাফ বাঁকা হেসে বলে,
–ওর রাগ শুরুও আমাতে আর তার সমাপ্তিও আমাতে।

মারসাদ তীক্ষ্ম নজরে চেয়ে বলে,
–আমার বোনকে বেশি রাগাবি না। তাহলে তোরে আমি…!

আহনাফ মারসাদের কথাকে পাত্তাই দিলো না।
–কিছুই করতে পারবি না। আফটারঅল আই এম ইউর বেষ্টফ্রেন্ড তাও লং টাইম!

পাঁচ বন্ধু একত্রে হেসে উঠে। সূর্য আজকের মতো শেষ হেসে আস্তে আস্তে অস্তমিত হলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here