এক শহর প্রেম পর্ব -৩৪+৩৫

#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৪
সন্ধ্যার পরপর রিন্তি ও সাবিহা চলে যায়। মাহি তার দাদীকে ফোন করে জানিয়ে দেয় আজ আহনাফদের বাড়িতে থাকবে আর তার মাকে মেসেজ করে দেয়। তারপর ফোনে এরোপ্লেন মুড করে রাখে। হোয়াটসএপেও নোটিফিকেশন অফ করে রাখে যাতে ফোনকল না আসে। মাহির মা কয়েকবার মাহিকে ফোনে ট্রাই করে একা একা চিল্লাচিল্লি করে হতাশ হয়ে থেমে যান। ঝ*গড়া করতেও তো অপরপক্ষের অংশীদারিত্ব লাগে!
এদিকে মাহিরা রাতের অর্ধেক সময় ব্যালকনিতে গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছে। আহনাফের ভাবি রাত বারোটা পর্যন্ত ছিল তারপর চলে গিয়েছে। অর্ণি কিছুক্ষণ পড়ে তারপর আড্ডায় যোগ দেয় আবার পড়তে চলে যায় অবস্থা।

পরেরদিন সকালে মারসাদ থানা থেকে আদিরার বাবা-মাকে নিয়ে দুই বেডরুমের ভাড়া বাসায় যায়। গতকাল রাতে টিউশন শেষে ওরা রাত বারোটা পর্যন্ত টুকটাক গোছগাছ করেছিল তারপর আহনাফদের বাড়িতে গিয়ে রাতের খাবারের পর ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আদিরার বাবা বাসা দেখে বলেন,

–তুমি বাবা এতো কষ্ট করলা কেন শুধু শুধু। কতোকিছু করছ তুমি আমাগো লাইগ্যা। আমার মাইয়াডারেও ওই দেলোয়ারের হাত থাইকা দুই দুইবার বাঁচাইছো। তোমার কাছে আমি ঋণি হইয়া গেলাম। আমার কর্য পরিশোধ করতেও সাহায্য করছ।

মারসাদ আদিরার বাবার দুইহাত চেপে ধরে বলে,
–না আঙ্কেল। এসব বলে আমায় ছোটো করবেন না। আমি এখন আপনার মেয়ের জামাই। আপনারা আমারও পরিবার।

আদিরার বাবা মারশাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
–আল্লাহ্ তোমার ভালা করুক বাজান। অনেক অনেক সুখী হও।

মারসাদ তৃপ্তিময় হেসে উনাদের থাকতে বলে চলে যায় আহনাফদের বাড়িতে আদিরাকে আনতে। আহনাফরা ক্লাসে চলে যায়। আদিরা আহনাফের মা, ভাবি সকলের থেকে বিদায় নিয়ে আগে মেস থেকে সবকিছু নিতে যায় সাথে টাকা পরিশোধ করে কিছু বাজার করে ভাড়া বাসায় যায়। অনেকদিন পর বাবা-মা, ভাইকে দেখে আদিরা তার কান্না আটকাতে পারেনা। মারসাদ ওদের নিজেদের মতো থাকতে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে আদিরাকে বলে যায়, যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে যেন ফোন করে। তাছাড়া সন্ধ্যার পর আসবে আদিরাকে নিতে।

__________

মারসাদ ও আদিরা রাস্তার কিনারায় হাঁটছে। শরৎকালের একেবারে শেষের দিকে আশ্বিনমাস। সন্ধ্যার পর মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। দুজন দুজনার মতো নিঃশব্দে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে মারসাদ আদিরার ডান হাতটা ধরে। আদিরা হালকা কেঁপে উঠে মারসাদের দিকে তাকায় কিন্তু মারসাদের দর্শনেন্দ্রিয় সম্মুখপানে স্থীর। আদিরা আলতো হেসে নিজেও সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। মারসাদ নিরবতা ছেড়ে সুধায়,

–গতকাল যখন তোমার চোখ ধরেছিলাম তখন তো তোমার মাঝে কম্পনের কোনো অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারিনি? তাহলে আজ পাশাপাশি হেঁটে হাত ধরাতে তুমি কেঁপে উঠলে কেনো?

আদিরার নির্ভীক জবাব,
–গতকাল আমি আপনার উপস্থিতি আরও আগে বুঝতে পেরেছিলাম। আপনার পারফিউম! আর যেহেতু নিঃশব্দে আসছিলেন তাই আচমকা কিছু করবেন বুঝেছিলাম। আমি গতকাল একটুও আনমনা ছিলাম না। করমচা খাচ্ছিলাম তো। আর আপনি এসে আমার পেছোনে কিছু সময় স্থির ছিলেন বলেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

মারসাদ ভাবুক স্বরে বলে,
–ওহ আচ্ছা! তুমি তবে সিচুয়েশনের জন্য তৈরি ছিলে। আর এখন তুমি আশা করোনি আমি হাত ধরব?

আদিরা নিঃশব্দে হাসে অতঃপর বলে,
–আমার মন বলছিল আপনি আমার হাত ধরবেন। কিন্তু কী কারণে গতকাল ও আজকের মধ্যে পার্থক্য হলো তা আমি নিজেও জানিনা। মানুষের মস্তিষ্ক কখন কিসে রিয়েক্ট করে তা আগে থেকে তো মানুষ জানেনা। প্রতিটা সংবেদী স্নায়ুতন্ত্র কখন উদ্দিপনা বেশি করে আর কখন কম তা নির্ভর করে তার চিন্তার উপর। তবে উদ্দিপনা অনেকসময় বোঝা যায় না।

মারসাদ হতাশ স্বরে বলে,
–তোমার প্রিয় সাবজেক্ট প্রাণীবিদ্যা আমি জানি। আমি আমার সাবজেক্টের প্যারা খেতে খেতে অতীষ্ঠ। কবে যে শেষ হবে!

আদিরা কিছুটা জোরে হেসে উঠে। তারপর বলে,
–আপনি তাহলে ঢাবি ছেড়ে আসলেন কেন? একই তো সাবজেক্ট ছিল।

মারসাদের স্পষ্ট জবাব,
–আহনাফের জন্য। তাছাড়া তোমাকেও এখানে পেলাম। সেসব বাদ দেও। কিছু লাগবে বাসার জন্য?

আদিরা বলে,
–না। আজকের গুলোই তো ধরা হয়নি। মা গ্রাম থেকে রান্না করে এনেছেন। আপনি তো চলে গেলেন। মা আমাকে বকেছে এজন্য। একটুক্ষণ থেকে গেলে কী হতো?

–আচ্ছা যাও শুক্রবার যাব সবাই মিলে। শাশুড়ির হাতে রান্না খেয়ে আসব।

আদিরা খুশি হয় শুনে। এরপর ওরা টিউশনে চলে যায়।

_____
কেটে গেছে ওদের বিবাহিত জীবনের এক মাসের বেশি সময়। আজকে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এতোদিন পর আজকে আদিরা সামিরাকে ক্যাম্পাসে দেখল। কেমন রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। এর আগে সামিরা ক্লাস করেছে কীনা তা আদিরা জানে না। আজ সামনে পরেছে তাও ধা*ক্কা লেগে। সামিরা রেগে রূঢ় শব্দে বলল,

–চোখে দেখো না? কোথা থেকে আসে অসহ্য! তোমাকে দেখলেই আমার খু*ন করতে ইচ্ছে করে।

আদিরা কিছু বলল না। সামিরার সাথে লাগা মানে সা*পের লেজে পা দেওয়া। আদিরা পরীক্ষা দিতে চলে গেল। কাউকেই সামিরার বিষয়ে বলল না।
পরীক্ষার দিনগুলো নিজের মতো পর্যায়ক্রমে এসে চলেও গেল এখন শুরু ছুটি। পরীক্ষা সবার মোটামোটি ভালোই হয়েছে। আদিরা ওর ভাইকে সামনের বছর এখানকার স্কুলে ভর্তি করাবে বলে টুকটাক বাসায় পড়াচ্ছে। ক্লাস ফোরে ভর্তি করাবে।

পরীক্ষা শেষে মারসাদরা সবাই মিলে প্ল্যান করল ওরা সাজেক যাবে। মেঘের রাজ্য সাজেকে বর্ষাকালে ও শীতকালে গেলে সুন্দর। কখনও তীব্র শীত সাথে কুয়াশা ও মেঘের বিচরণ আবার কখনও হুটহাট বৃষ্টি। শীতকালে গেলে কলাংক পাহাড়ে উঠা কিছুটা সহজ বর্ষাকালের তুলনায়।
মারসাদরা পাঁচজন, মাহি, আদিরা, সাবিহা, রিন্তি, সুমি, মৌমি, আশিক এরা সবাই যাবে। তবে মৌমি ও আশিক একদিন পর যাবে। মৌমির পরিবারে বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছিল বলে মৌমি আশিকের কথা বলে দিয়েছিল। মৌমির পরিবার প্রথমে রাজি হচ্ছিল না পরে মৌমির বুঝানো ও আশিকের খোঁজখবর নিয়ে রাজি হয়। ঘরোয়াভাবে ওদের আকদ হবে এরপর মৌমির অনার্স শেষ হলে অনুষ্ঠান। মারসাদরা যেদিন রওনা হবে সেদিনই মৌমি ও আশিকের আকদ হবে।

আদিরার বাবা-মাকে আদিরা বলেছে। তারা আপত্তি করেনি। মেয়ে তার স্বামীর সাথে যাবে তাই ভয়ের কিছু নেই। মারসাদ তার জুনিয়র কয়েকজনকে বলে গিয়েছে যাতে আদিরার বাবা-মায়ের কিছু লাগলে এনে দেয়। সাজেকের রিসোর্টে দুইটা ডাবল বেডের রুম ও একটা সিঙ্গেল বেডের রুম বুকড করে রেখেছে ওরা। ওদিকে মৌমি ও আশিকও একটা রুম বুকড করে রেখেছে। গাবতলী থেকে বাসে উঠেছে রাত ১০টায় বাসে ছাড়বে। আদিরা জানালার পাশে বসে। ওর এসি বাসে বেশি বমি হয় বলে মারসাদরা ননএসি বাস নিয়েছে। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি। প্রকৃতিতে শীতকাল এসেছে দিন দুয়েক হলো। তবে শীত অতোটা অনুভূত হচ্ছে না। শাল বা সোয়েটার পড়ার মতো শীত পরেনি। তবে সাজেকে এসময়ও শীত লাগবে বলে ওরা আজ সকালে হালকা কিছু কেনাকাটা করেছিল তাছাড়া রাতের বেলায় বাস জার্নিতে জানালা একটু খোলা থাকলে হুরহুর করে শীতল বায়ু ঢোকে শীত অনুভব করাবে। মারসাদ জানে আদিরার জন্য জানালা একটু হলেএ খুলে রাখতে হবে নয়তো ওর বমি হবে। বাসে উঠার আগে বমির ঔষধ খাওয়ানোর পরেও যার বমির সমস্যা আছে তার একটু বেতাল হলে হবেই। মারসাদ আদিরার দিকে তাকিয়ে দেখল আদিরা বাসের জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। এটা ওর স্বভাব যে বাসে উঠলে জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে রাখবে। মারসাদ ব্যাগ থেকে একটা শাল বের করে আদিরার মাথা জানালার কাছ থেকে উঠিয়ে মাথা ও কানসহ শরীরে শালটা পেঁচিয়ে দিয়ে বলল,

–প্রচণ্ড ঠান্ডা পরবে বাস ছাড়লে। একে তো শীত ঋতু তারউপর জানালা খোলা। গরমের সময়ই খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসে।

আদিরা আর দ্বিরুক্তি করল না। মুচকি হেসে আবারও জানালার সাথে মাথা ঠেকাল। এদিকে আহনাফ মাহির সাথে নিজের সিট রেখেছে কিন্তু মাহি বলছে মাহি রিন্তির সাথেই বসবে। রিন্তির সিট পরেছে রাহিনের সাথে। রাহিন তো সেই খুশি। সে বারবার দাঁত কে*লিয়ে রিন্তির দিকে তাকাচ্ছে। আর রিন্তি মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছে। রিন্তির ভাবনা,

“এই মুটোই তো দুই সিট নিতে যথেষ্ঠ! তাহলে সে কই বসবে?”
(রাহিন অতোটাও মোটা না)

মাহি ও আহনাফের এই দুইমাসে যে কতো ঠোকাঠুকি লেগেছে যার দরুন মারসাদ এই দুটোকে দেখলেই টম এন্ড জেরি বলে। মাহি বলছে,

–আমি রিন্তির সাথেই বসব। আপনি আপনার বন্ধুর সাথে বসেন না।

আহনাফের ভাবলেশহীন জবাব,
–আমি তোমার সাথে বসব। দেখো জার্নিতে তোমার ঘুমোতে সুবিধা হবে।

মাহি নাছোড়বান্দা। সে তো নিজের কথায় অটল। সে বারবার একই কথা বলছে। বাসের অনেকেই চোখ-মুখ কুঁচকাচ্ছে আবার অল্প বয়সি কিছু ছেলে-মেয়ে আছে যারা মুখ টিপে হাসছে। মারসাদ আদিরার গায়ে শাল পেঁচিয়ে দিয়ে মাহি ও আহনাফের ঝ*গড়া শুনে বিরক্ত হয়ে বলে,

–প্লিজ অফ যা তোরা। এতো ঝ*গড়া কিভাবে করিস?

মাঝখান থেকে মৃদুল বলে উঠে,
–এরা যে একে অপরকে ভালোবাসে আমার মনেই হয়না। মাঝেমাঝে মনে হয় এরা চিরশ*ত্রু একে অপরের!

মারসাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–টস হবে। টসে যে জিতবে সেটাই হবে।

আহনাফ টসের কথা শুনে মারসাদের দিকে করুণ নজরে ইশারা করছে। মারসাদ বিরক্ত হয়ে টস করল।
#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৫
টসে আহনাফের নাম আসলে আহনাফ তো মহা খুশি। সে ভ্রুঁ নাচাচ্ছে মাহির দিকে তাকিয়ে। মাহি রাগে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে।

–দাভাই তুই চিটিং করেছিস। তুই ইচ্ছে করে আহনাফের সাইড নিয়েছিস। তুই তোর বোনের সাথে এটা করতে পারলি? কেমন ভাই তুই?

মারসাদ প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে মাহিকে একটা ধ*মক দিয়ে বলে,
–কয়েন টসের সময় কী আমি কোনো পৃষ্ঠ উপরের দিকে রেখেছিলাম? তাহলে চিটিং কিভাবে করলাম? এখন চুপচাপ আহনাফের সাথে বস। আমি যেন সামনে থেকে কোনো টুঁশব্দ না পাই। শব্দ পেলে দুইটাকে বাসের ছাদে বসিয়ে দিবো। বাসের উপরে কোনো র‍্যাক নেই যে বসবি তাছাড়া এই রাতের বেলাতে নিশ্চয়ই বাস সুস্থভাবে চলবে না!

মাহি ঠোঁট উল্টে কিউট ফেস করে চুপ করে জানালার পাশে বসে পরল। আহনাফ একটু পরে বসবে। বাস ছাড়তে আরও পনেরো মিনিটের মতো বাকি ছেলেরা একটু বাহিরে গেছে সিগরেট টানতে। যথাসময়ের পাঁচ মিনিট পরে বাস ছেড়ে দেয়। মারসাদ ও আহনাফ সেন্টার ফ্রেশ দিয়ে মুখ ফ্রেশ করে আসলেও বাকিরাতো করেনি। বেচারা রাহিন রিন্তির পাশে বসার সাথে সাথে রিন্তি মুখ কুঁচকে বলে উঠে,

–ছিহঃ আপনি আমার পাশ থেকে সরেন। সিগরেটের বিশ্রি গন্ধ আসছে।

রাহিন থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
–না মানে আসলে আমি বুঝতে পারিনি।

রিন্তি নাক চেপে ধরেই বলে,
–আপনি আহনাফ ভাইয়ের সাথে সামনের সিটে বসেন যান। মাহিকে এখানে দেন।

সামনে থেকে আহনাফ রাহিনের কোলের উপর একটা সেন্টার ফ্রেশ ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
–এটা মুখে দে। তাহলে আর সমস্যা হবেনা। যত যাই হোক তুই তোর জায়গা থেকে সরবি না।

রিন্তি মুখ ফুলিয়ে জানালার দিকে তাকায়। মাহিও মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। আহনাফ নিজের পকেট থেকে একটা মাঝারি সাইজের ডেইরিমিল্ক সিল্ক চকলেট বের করে মাহির ডান হাতটা ধরে তাতে দেয়। মাহি চকলেট দেখে নিজের ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে হেসে উঠে। বাসে এখনও আলো নেভানো হয়নি বলে আহনাফ মাহির হাসিটা দেখল। আহনাফ এই হাসির বিনিময়ে মুচকি হাসল। মাহি প্যাকেটটা খুলে প্রথম বা*ইট আহনাফকেই দেয়।

এদিকে মারসাদ পকেট থেকে কয়েক পদের চাটনি আদিরার হাতে দেয় আর বাস বারবার ঝাঁকি খাবে বলে আদিরার মাথা নিজের কাঁধে এনে রাখে। আদিরা নিঃশব্দে মুচকি হাসে। মারসাদ তার মনোহরিণীকে তার বাম হাত দ্বার আগলে নেয়।

________
সুন্দর শুভ্র সকাল। রোদের আনাগোনায় প্রাণোচ্ছল প্রকৃতি। সাজেক যাবার জন্য খাগড়াছড়ি থেকে চান্দের গাড়িতে উঠেছে ওরা ১০জন সাথে আরও দুইজন নিয়ে সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা করেছে। খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্প হয়ে সাজেক ভ্যালি যেতে হয়। গাড়ি চলছে আর মেয়েরা উঠে দাঁড়িয়েছে। আদিরা বসেই আছে। বসে বসে সে প্রকৃতি উপভোগ করছে। রাস্তার ধারের দৃশ্যগুলোও চলন্ত গাড়ি থেকে দেখতে অসাধারণ দেখায়। মনে হচ্ছে, কোনো সবুজের বিস্তৃত চাদর দৌঁড়ে চলেছে অবিরত। দীঘিনালা নেমে আধা ঘণ্টার জন্য হাজাছড়া ঝরনা ঘুরে আসল। সেখানে ছেলেরা ইচ্ছামতো ভিজে গোসলও সেরে নিয়েছে। সাজেকে এমনিতে পানির অভাব। হাজাছড়া ঝরনা রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাট এলাকায় অবস্থিত। সেখানে হীমশিতল জলপ্রবাহ পর্যটকদের হৃদয় কেড়ে নেয়। সবুজ ঘেরা ঝিরিপথ আরও আকর্ষণীয়। দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করিয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি উঁচুতে উঠতে থাকে।

ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ওরা সাজেক পৌঁছে যায়। রিসোর্টে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো।
আশিক ও মৌমি ফোন করে জানিয়েছে ওরা আজ সকালেই চট্টগ্রাম এসেছে বিমানে তারপর বিআরটিসি বাসে করে খাগড়াছড়ি এরপর একটা সিএনজি নিয়েছে।
মারসাদরা ভাবে ভালোই হয়েছে সাজেকে আজ, কাল ঘুরে পরশু সকালে চট্টগ্রাম যাবে সেখান থেকে কক্সবাজার। আজকে ওদের ঘোরাফেরা হলো না অতোটা। আজ ওরা রিসোর্টের আশেপাশে একটু ঘোরাঘুরি ও ছবি তুলে নিল সাথে সাজেক ০ পয়েন্টের কাছে একটু ঘোরাঘুরি করল বিকেলে। মৌমিরা বিকেলে এসে পৌঁছেছে। ওরা রিসোর্টে ব্যাগ রেখেই ঘুরতে চলে এসেছে। রাতে পাশের রেস্তোরায় ডিনারে সবাই বেম্বো চিকেন অর্ডার করে। কাল সকালে ভোরে ওরা সাজেক হ্যালিপেডের উদ্দেশ্যে যাবে সূর্যোদয় দেখতে।

সারাদিন জার্নিতে টায়ার্ড সাথে আগামীকাল জলদি উঠে তৈরি হতে হবে বলে ঘুমোতে যাবে। মাহি রিসোর্টের বাগানে যেখানে বনফা*য়ার জ্বালানো সেখানে বসে আছে সবার চলে যাবার পরেও। আহনাফ সেটা দেখে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে। মাহি কোনো বাক্যব্যয় না করে আহনাফের কাঁধে মাথা রাখল। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আহনাফ বলে,

–ঘুমাবে না? জার্নি করে এসেছ এখন না ঘুমালে সকাল ভোরে কিভাবে উঠবে?

মাহি তারপর চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো উঠে চলে গেল। আহনাফ মাহির যাওয়ার পানে চেয়ে রইল। মাহির মাঝে মাঝে কী হয় তা সে নিজেও বুঝে না তো আহনাফ কিভাবে বুঝবে! আহনাফও উঠে চলে গেল।

এদিকে মৌমির ঘুম ও শরীর দুর্বল লাগাতে সে ঘুমিয়ে পরেছে। আশিক তার ঘুমন্ত স্ত্রীকে দেখে আলতো হেসে বুকে জড়িয়ে সেও ঘুমিয়ে পরে।

মারসাদ যখন রুমে আসে তখন আদিরা ব্যালকনিতো দাঁড়িয়ে। গায়ে জড়ানো পাতলা শাল। হীমশিতল সমীরণে শিহরিত মন ও প্রাণ। মেঘেরা গা ছুঁয়ে যাচ্ছে হালকা করে। আদিরা সাজেকের রাতের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অন্য ঘোরে ডুবে গেছে। মারসাদের উপস্থিতি সে অনুভব করতে পারল না। মারসাদ এসে আদিরাকে পেছোন থেকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করল। যার দরুন আদিরার ঘোর ভঙ্গ হওয়ায় সে হকচকিয়ে উঠে কেঁপে উঠল। মারসাদ এর আগে এমনটা করেনি। এই দুই মাসে মারসাদ আদিরার সাথে ভাড়া বাসায় থাকতেও আসেনি। মারসাদ আদিরা কেঁপে উঠা উপভোগ করল।

–তোমাকে একটা নতুন নাম দেয়া যায় বলো? তরঙ্গকন্যা? বারবার তোমার কম্পন আমার ফিজিক্সের তরঙ্গ বিদ্যার কথা স্মরণ করায়।

আদিরা আমতা আমতা করে বলে,
–আপনি হুট করে এভাবে ধরাতে একটু…

আদিরাকে থামিয়ে মারসাদ রম্যস্বরে বলে,
–ভয়? ভয় তো তুমি পাওনি। নাকি অন্যকিছু? হ্যাঁ? প্রকৃতিতেও আজ প্রেমের রঙ লেগে আছে সাথে আমার মনে। ভেজা মেঘ তোমায় বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে যা আমায় বড্ড আকর্ষণ করছে।

মারসাদের এহেনো উক্তিভাবে আদিরার মাঝে লজ্জারা ঝেঁকে বসেছে। মারসাদ আদিরার গুটিয়ে যাওয়া দেখে হালকা হাসল অতঃপর আদিরার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

–বিয়ের দুই মাস পর আমার তোমার প্রথম একসাথে রাত্রীযাপন। লেটস মেক সাম লাভ ডিয়ার!

আদিরার হৃৎপিন্ড তার সাথেই ধোঁকা করে বারংবার দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। মারসাদ পেছোন থেকেই আদিরার গালের নিম্নাংশে নিজের ওষ্ঠ স্পর্শ করালে আদিরা জমে যায়। এই সুযোগে আদিরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় মারসাদ। তারপর রেলিংয়ের সাথে ঠেকিয়ে নিজের দুইহাত দিয়ে আদিরার উড়ন্ত কেশাগ্র কানের পিঠে গুঁজে আরেকপাশের গালের নিম্নাংশে নিজের অধর স্পর্শ করায়। তারপর আদিরার আঁখিপানে নজর সরালে দৃষ্টিগোচর হয় রমণীর বদ্ধ লোচন ও কাঁপতে থাকা আঁখিপল্লভ। মারসাদ আদিরাকে কোলে তুলে নিলে আদিরা নিজের মুখ লুকাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে।

______________
দীর্ঘ রজনীর সমাপ্তিতে নতুন ভোরের সূচনা। আবছা আলোয় ওরা রওনা করেছে সাজেক হ্যালিপেডের উদ্দেশ্যে। সেখানে সূর্যোদয় দেখবে বলে। সেখান থেকেই তারপর কলাংক পাহাড়ে যাবে ট্র্যাকিং করে। হ্যালিপেড থেকে যেনো মনে হচ্ছে সুবিশাল এক মেঘের সমুদ্র। সমুদ্রের বিস্তর জলরাশির মতো মেঘেরা ভেসে আছে। সূর্য উদিত হলো মেঘের বুক চিড়ে। সোনালি আভায় মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সাথে মেঘদের বিচরণ। যে কেউ এসে মুগ্ধ হবেই। পুরো সাজেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। সময় বাড়তে বাড়তে মেঘগুলো আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠবে। হ্যালিপেড থেকে পুরো সাজেককে এক সবুজের সমারোহে মেঘেদের বিচরণ পরিলক্ষিত। উঁচু নিচু টিলা ও পাহাড়ের সমন্বয়ে হৃদয়স্পর্শী দর্শণ। এই সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্ধী করে ওরা নিজেদের নয়নেও বন্ধী করে নিল।

কালরাতের পর আদিরা লজ্জার কারণে সুমি, মাহিদের সাথেই থাকছে বেশি বেশি। মারসাদ বারকয়েক ভ্রুঁ কুঁচকে লক্ষ্য করে আবার প্রকৃতি দেখে। শেষমেশ আদিরার আসার কোনো লক্ষণ না দেখে সে আদিরাকে ডাক দেয়। আদিরা মারসাদের ডাকে কেঁপে উঠে। দ্বিতীয়বার আবার ডাক দিলে আদিরা আস্তে ধীরে নিচের দিকে তাকিয়ে মারসাদের কাছে যায়। মারসাদ আহনাফের হাতে ক্যামেরা দিয়ে বলে ছবি তুলে দিতে। মেঘমল্লারের রাজ্যে যুগল ছবি ফ্রেম বন্ধী করার মতো।

ছবি তুলা শেষে মারসাদ আদিরাকে একটু একপাশে নিয়ে গিয়ে বলে,
–তুমি এতো লজ্জা পাচ্ছ কেনো? বি নরমাল প্লিজ। নাহলে এখানকার কিছুই উপভোগ করতে পারবে না। আমার সাথে সাথে থাকবে। ওই দেখো, মাহি একের পর এক ছবি তুলেই চলেছে। রঙ-তুলি আনলে হয়তো এখানেই আঁকতে বসে যেত।

আদিরা এবার সামনের দিকে তাকিয়ে অধর প্রসারিত করে হাসল। দূর থেকে আহনাফ মারসাদের কথামতো এই মোমেন্টের অপেক্ষা করে ছবিটা তুলে নিলো। সবাই সবার মনমতো উপভোগ করে নাস্তা করে কলাংক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যেতে থাকে। বর্ষা কাল হলে ট্র্যাকিংয়ে অনেক রিস্কি। পিচ্ছিল পথ থাকে বর্ষা কালে। শীতকাল হওয়াতে শুষ্ক। ১ঘণ্টা ট্রাকিং করে ওরা কারণ মাঝে মাঝে থেমে ছবি তুলেছে কিছু। কলাংক পাহাড়ের চূড়া থেকে পুরো সাজেককে দেখাটা অনেকটাই সুন্দর।

সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া কংলাক পাহাড়। চূড়ায় উঠতে উঠতে দেখতে পাবেন মিজোরাম সীমান্তের পাহাড় আর সবুজের মিতালি। কংলাকের চূড়ায় উঠে চারপাশে তাকালে সত্যি ভুলে যাবেন, যান্ত্রিক শহরের কোলাহল। বিশুদ্ধ বায়ুতে মন-প্রাণ পুলকিত হবে। কলাংক পাহাড়ের চূড়া থেকে ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়।

আদিরা একটা ছোটো গাছ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেটা মারসাদ ক্যামেরায় বন্ধী করে নিলো। তখন রোদের আলো ঠিকরে পরছিল আদিরার চোখে-মুখে। সুমি, সাবিহা, রিন্তি, রাহিন, রবিন, মৃদুল এরা সবাই নিজেদের মতো ছবি তুলছে সাথে একে অপরের সাথে কথা বলা, গ্রুপ ছবি তোলা। রাহিন অনেকক্ষণ ধরে চাইছে রিন্তির সাথে একটা ছবি তুলবে কিন্তু রিন্তি আছে কী সুযোগই দিচ্ছে না! আহনাফ ও মাহি কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছে। সাজেক আসার পর থেকে মাহি খুব খোশমেজাজে আছে। কোনো ঝগড়া করছে না আহনাফের সাথে। আহনাফেরও ইচ্ছে করছে না রাগিয়ে দিতে। মৌমি তো আশিকের হাত ধরে হাঁটছে আর সেলফি তুলে চলেছে। সুমিদের সাথেও কিছু ছবি তুলেছে। এবার মৃদুল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–আমাদের পাঁচ বন্ধুর একটা গ্রুপ ছবি তুলে দেও এরপর আশিক ভাইকে নিয়েও। তোমাদের মেয়েদেরও ছবি তুলে দিবো। তারপর একটা গ্রুপ সেলফি হবে।

সূর্যাস্ত ওরা কলাংক পাহাড়েই দেখবে বলে কলাংক পাড়ায় কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে ও দুপুরের খাবারও খেয়ে নিয়েছে। সূর্যাস্তের রক্তিম আভা বড্ড সুন্দর দেখায় কলাংকের চূড়া থেকে। সারাদিন ঘোরাফেরা করে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে রাতের বেলাতে আশেপাশে হাঁটাচলা করে রাতের খাবার খেয়ে যার যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরে। এতো ট্রাকিং ও পাহাড় চড়ার কারণে এখন সবারই পা ব্যাথা করছে তাছাড়া ক্লান্তও লাগছে। কাল সকালে হালকা ঘোরাঘুরি করে চট্টগ্রামের জন্য চলে যাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here