#এক_সমুদ্র_প্রেম!
#লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
#পর্ব_৩৪ (বর্ধিতাংশ)
বসার ঘরে হল্লাহল্লি চলছে। বড়দের প্রফুল্ল আওয়াজ বাড়ির প্রতিটি কোনায় ভেসে বেড়ায়। এখনই বসেছেন বিয়ের আলাপে। সামনে কী করবেন, কীভাবে সবটা গোছাবেন,এই আলোচনায় পরিবেশ মুখরিত।
পুষ্প বহু ক*ষ্টে ঘর অবধি এলো। তার পা চলছে না। এতটা ভারি হয়ত পাথরখন্ড ও হয়না। গলবিলে দলা পাঁকানো কা*ন্নার পরিমান হুহু করে বাড়ছে। কত ক*ষ্টে এতটা সময় চে*পে রেখেছে কেউ জানেনা।
চৌকাঠ পেরিয়ে কক্ষে ঢুকতেই চোখ ছাপিয়ে বেরিয়ে এলো তা। বর্ষার ন্যায় মুষলধারে ঝরে পরলো গালে। ঝরঝর করে, গা ভে*ঙে কেঁ*দে ফেলল সে।
ইকবাল ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে? এ দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায়না। একজন কে ভালোবেসে,তার প্রতি হৃদয় সপে, আরেকজন কে জীবনে বরন করা যায়? এতটা দুর্বোধ্য অনলে পু*ড়ে নিজের অন্ত ডাকার সাহস তার নেই।
ইকবালের চিত্তচাঞ্চল্যকর মুখমণ্ডল মানস্পটে হানা দেয় তখন। তার ওষ্ঠে বুলির মত আওড়ানো ‘ মাই লাভ ‘ শব্দটা উর্মির মত কানে বাজে। পুষ্পর কা*ন্না বাড়ে। শব্দ বের হয় মুখ দিয়ে। হাত দিয়ে চে*পে রাখার প্রয়াস চালায় কিছুক্ষণ। ব্যর্থ সে,অপারগ। এত কা*ন্না কেন পাচ্ছে? কেন ঝরছে এত অশ্রু? মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মত দিয়েছে বলে? ইকবাল টাকে ঠকালো বলে?
পুষ্পর বুক ধ্বক করে ওঠে , আজ দুপুরের কথাগুলো মনে করতেই।
ইকবালের হাতে হাত রেখে সে যে কথা দিয়েছিল,কোনও দিন ছেড়ে যাবেনা? তাহলে কী করে রাজী হয়ে গেল তখন? কেন প্রতিবাদ করল না? পুষ্প নিজেকেই ধিক্কার জানায়। সাহস নিয়ে তাচ্ছ্যিল্য করে। ইকবাল তো যেচে ভালোবাসেনি। সে বেসেছে,অনুরক্তির ধুমজাল বিছিয়ে ওকেও বাধ্য করেছে প্রেমে পরতে। ইশ! সে মানুষটা যখন জানবে এসব,কীভাবে সহ্য করবে? কীভাবে?
পুষ্প বালিশের ওপর আছড়ে পরে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উগলে দেয় অশ্রু। সাদা কভারটা ভিজে যায়,হয় চুপচুপে।
পিউয়ের ছোট্ট মুখটা আরো কয়েকধাপ সংকুচিত এখন। কোটর চিকচিক করছে জলে। দরজার এপাশে সে স্তম্ভের মতন দাঁড়িয়ে। নিরব চাউনীতে দেখে যায় বোনের হুতাশন ভরা কা*ন্না৷ খুব ইচ্ছে হয় একবার কাছে যেতে। যাবে কী? পিউ এক পা বাড়াল,পরমুহূর্তে কী ভেবে ফিরিয়ে আনল কদম। তার মস্তিষ্ক চিন্তায় ফাঁটছে। মাথাব্য*থা উঠেছে অনুচিন্তনের দাপা-দাপিতে। কপালের শিরা দপদপ করছে।
আজ যদি ওর অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক হতো? ধূসর ভাইকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করার কথা ভেবেই তার ক্ষুদ্র চিত্ত আঁ*তকে ওঠে। দম আটকে যায়। সেখানে আপুর অবস্থা না জানি কী!
পিউয়ের সবটুকু রা*গ ওই মানুষটার ওপর বর্তাল। যে সব জেনেও চুপচাপ মেনে নিলেন। কেন? এমনি সময় তো মুরুব্বিদের মধ্যেও বুক ফুলিয়ে কথা বলে। সেবার গ্রামে? মা*রপিট করেও গর্ব করে বলে বসল ‘ দরকার পরলে আবার মা*রব।’
আজও কি ওরকম একটু সাহসিকতা দেখানো যেত না? তার আপু যে কোনঠাসা হয়ে সবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে সে ছোট মানুষ হয়েও বুঝতে পারছে। তাহলে ধূসর ভাইয়ের মত একটা দা*মড়া ছেলে, সে কী বোঝেনা এসব?
পিউয়ের বড় বড় চোখ দুটো ভীষণ ক্ষো*ভে জ্ব*লে ওঠে। দুঃসাহসের তোপে শুকনো শরীর ওঠানামা করে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করবে সে। ভ*য় পেলে হবেনা, জানতেই হবে ধূসর ভাই এমন কেন করলেন? ইকবাল ভাইয়ের ভালোবাসা পাইয়ে দেয়া কি ওনার দায়িত্ব নয় না কী? ওনার না বেস্টফ্রেন্ড? এই তার নমুনা?
পিউ দোতলার করিডোর থেকে একবার বসার ঘরে উঁকি দিলো। ধূসরের বসা, একেকবার একেক জনের দিক বিক্ষি*প্ত চাউনী,মাঝেমধ্যে পাতলা অধর নড়ে নিঃসৃত হওয়া বাক্যবাণ, পাকোড়া চিবানোর ধরন হারিয়ে দিলো খেই। ক্ষো*ভ যেন তুষারের ন্যায় গলে গেল। রা*গঢাক বদলে গেল মুগ্ধতায়। এই মানুষটাকে এত অসাধারণ হতে কে বলেছে? এমন প্রলুব্ধ মানবের ওপর রা*গ করার সাধ্যি তার নেই।
পিউ ঠান্ডা হলো খানিক। তবে সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত। ঘটনা সে জেনেই ছাড়বে। হয়ত রা*গের বদলে, শান্ত মাথায়। এখন তো ধূসর ভাই সবার মাঝে বসে, তাকে অপেক্ষা করতে হবে। পিউ আরেকবার বোনের ঘরের দিকে চায়। পুষ্প এখনও কাঁ*দছে, সে জানে। তবে শব্দশূন্য, আওয়াজহীন।
সে নিঃসহায় শ্বাস ফ্যালে। বাড়ি জুড়ে এত কাহিনী ঘটছে, আর এই সময়েই পরীক্ষা! কোনটা রেখে কোনটায় মনোযোগ দেবে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। মাঝেমধ্যে নিজের জন্যেই মায়া হয়, একটা বাচ্চা মানুষের পক্ষে মাথায় এত প্রেশার নেয়া সম্ভব?
বসার ঘরের রমরমে আড্ডার শেষ নেই। একেকজনের মুখে হাসি যেন ধরছে না। অন্যদিনে এই হাসিখুশি, উৎফুল্ল পরিবার পিউয়ের মন প্রশান্ত করে। অথচ আজ কেমন অস*হ্য লাগছে। দুটো মানুষকে কাঁ*দিয়ে খুশি থাকার মানে হয়না। এসব আনন্দ নিরর্থক।
পিউ প্রতীক্ষা করছে এই সভা ভঙ্গের। ধূসর কখন ওপরে আসবে, কখন জিজ্ঞেস করবে, উতলা সে।
সাদিফ পুরো কাপের চা খালি করেছে। পরপর মাকে বলেছে আরো এক কাপ রং চা আনতে। একেবারে গাঢ় লিকারের। কোনও রকম চিনি দেয়ার নিষেধাজ্ঞা সেখানে। জবা একটু অবাক হলেন। সাদিফ তুলনামূলক মিষ্টিপ্রিয় ছেলে। তার হঠাৎ এমন আবদার বিভ্রান্ত করল ওনাকে। কিন্তু কথা বাড়ালেন না।
চা বানিয়ে এনে হাতে দিলেন। সাদিফ নিষ্পৃহ ভঙিতে চুমুক দিলো। তিঁতকুটে চা শেষ করল চোখের পলকে। বিস্বাদে একটুও নাকমুখ কোঁচকাতে দেখা গেল না।
সমস্তটা খেয়ে,তবেই উঠে দাঁড়াল। ‘ঘরে যাচ্ছি’ বলে সিড়িতে পা রাখল। কেউ কিছু বলে না। সে আলগোছে এগিয়ে যায়।
রুমের কাছাকাছি এসে পিউকে দেখে দাঁড়াল সাদিফ। পিউ ও তাকিয়েছে তখন। সাদিফ কিছু একটা ভাবল। চোখের চশমাটা খুলে এগিয়ে দিল হঠাৎ। খুব ধীর-স্থির কণ্ঠে বলল
‘ একটু মুছে দে তো। ঝাপ্সা হয়ে গিয়েছে।’
পিউ দ্বিরুক্তি করে না। বাধ্যমেয়ের মত চশমা এনে ওড়না দিয়ে মুছতে থাকে। তার গভীর মনোনিবেশ যখন সেখানে ব্যস্ত,সাদিফের বরফ দৃষ্টি লুটোপুটি খায় ওর মুখেতে। নিখাঁদ, পূর্ন চোখদুটো এক ধ্যানে দেখে যায় তাকে। পিউয়ের নাক,ঠোঁট, ভ্রুঁ, গাল, সব কিছু এঁকে নেয়,মুখস্থ করে। বক্ষ অশান্ত,দুরন্ত। মন্তঃস্তাপ প্রতিটি পলকে। পিউ তাকানো মাত্র হিঁচ*ড়ে সরায় নেত্র। চেহারা ঘোরায় অন্য কোথাও। মুখমণ্ডলে ফুটিয়ে তোলে বিরসতা।
পিউ অতশত খেয়াল করেনি। সে চশমা এগিয়ে বলল,
‘ নিন।’
সাদিফ না তাকিয়েই ধরল। আর একটি কথাও বলল না। নিঝুম প্রস্থান নিলো। তবে যেতে যেতে মনে মনে আওড়াল,
‘ এই চশমা মোছার দায়িত্বটা আজীবনের জন্যে তোকে দিতে চেয়েছিলাম পিউ। হলোনা বোধ হয়! ‘
***
অপেক্ষার অবসান হচ্ছেনা। উলটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ঝিম ধরে যাচ্ছে। মেরুদন্ডের হাড়ে অনুভব হচ্ছে চিনচিনে ব্য*থা। পিউ বির*ক্ত হলো। অধৈর্য সে। যদি পারতো, ধূসরকে ডেকে ওপরে আনতে? ওখান থেকে টেনে তুলতে? ইশ!
সেই ক্ষনেই চট করে মাথায় উদয় ঘটল নতুন বুদ্ধির। পিউ তৎক্ষনাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল। ছুটে গেল নিজের ঘরে। ফোন এনে ফিরে এলো আগের জায়গায়। ধূসরের নম্বরে কল দিলো ঝটপট ।
ফোন বেজে উঠল তার কামড়ায়। পিউ হতাশ হয়। নিরাশায় কান থেকে নামিয়ে ঠোঁট ওল্টায়। পরপর আবার এক বুদ্ধি পেতেই মুখবিবর চকচকে হলো। তক্ষুনি গলা উঁচিয়ে ডাক ছুড়ল,
‘ ধূসর ভাই!’
সে তাকানোর সাথে সাথে বাকীদের দৃষ্টিও ক্ষেপণ হলো। এত জোরা চাউনী ক্ষানিক গুঁটিয়ে দেয় তাকে। তবুও সে দমে না। ধূসরকে উদ্দেশ্য করেই বলল,
‘ আপনার ফোন বাজছে। ‘
ধূসরের চোখেমুখে আগ্রহ দেখা গেল না। নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল
‘ বাজুক।’
পিউ ভ্রু কোঁচকায়। বাজুক মানে? এটা কোনও কথা হলো?
সে দ্বিগুন ছট*ফট করে ওঠে। ফটাফট মিথ্যে বলে,
‘ ইকবাল ভাই ফোন করেছেন। অনেকক্ষণ ধরে করছেন দেখছি।’
এই বুদ্ধিটা কাজে লাগে। ধূসর শোনামাত্র উঠে এলো সেখান থেকে। পিউয়ের অধর ভরল জয়ের হাসিতে। আমজাদ সিকদার নাকচোখ গুঁটিয়ে বসে রইলেন। এই ইকবাল হতচ্ছাড়াটাই সব ন*ষ্টের মূল। একটা পারিবারিক আলোচনার মধ্যেও এর ফোন করতে হবে?
ধূসর সোজা নিজের ঘরে যায়। পিউ ত্রস্ত এগোলো তার পেছনে। ধূসর টেবিলের ওপর থেকে ফোন তুলে হাতে নেয়। ভাবল,কল কে*টে গিয়েছে,ব্যাক করবে। স্ক্রিন জ্ব*লতেই ‘মিসডকল ফ্রম পিউ ‘লেখা ভেসে উঠল। ধূসরের ভ্রুতে ভাঁজ পরল। কললিস্ট চেক করে ইকবালের সম্প্রতি কোন কল পেলোনা। এর মানে পিউ মিথ্যে বলেছে? তার মেজাজ খারা*প হলো ওমনি। চিবুক শ*ক্ত করল। পুঁচকিটাকে কয়েকটা কড়া কথা শোনাতে ঘুরতে গেল, তখনি ওপাশ থেকে চঞ্চল পায়ে এসে দাঁড়াল পিউ। নাকটা মুহুর্তে ঠু*কে গেল তার বুকের সাথে। পিউ পিছিয়ে এলো খানিক। চোখ ঝাপ্টে ধাতস্থ হলো। ধূসরের শৈলপ্রান্ত বেঁকে আছে। ভ্রুঁ একসাথে গোছানো।
‘ কী মানে এসবের?’
তার নিম্নভার,রুদ্রপ্রতাপ কণ্ঠে পিউ জড়োসড়ো হল। সদাজাগ্রত নজরে তাকাল।
‘ মিথ্যে বলেছিস কেন?’
পিউয়ের নিষ্পাপ জবাব,
‘ কী করব? অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি,আপনার কথাই শেষ হয়না। উঠছিলেনই না ওখান থেকে। তাই জন্যেইত…..’
ধূসরের কপালের ভাঁজ শিথিল হলো। বিদ্বিষ্ট চাউনী গভীরতা পেল। কয়েক সেকেন্ডে যা ছুটে গেল পিউয়ের স্নিগ্ধ,ললিত চেহারা জুড়ে।
পিউ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘ আপু খুব কাঁ*দছে ধূসর ভাই। ‘
সে ছোট করে বলল ‘ ও।’
নিরুৎসাহিত উত্তরে, পিউ আশ্চর্য হয়ে বলল ‘ ও মানে? আপনি কিছু বলবেন না?’
‘ কী বলব? ও কাঁ*দছে,এখানে বলার কী আছে?’
পিউ হা করে বলল,
‘ কিছু নেই?’
‘ না।’
পিউ রুক্ষ ধাতে বলল,
‘ এটা কোনও কথা হলো ধূসর ভাই?’
ধূসর চোখ ছোট করতেই তার চিবুক গিয়ে গলদেশে ঠেকল। ভদ্র,মৃদূ কণ্ঠে বলল,
‘ না মানে,আপনি আমি দুজনেই জানি,আপু আর ইকবাল ভাইয়া একে অন্যকে পছন্দ করেন। বিয়েতে আপু রাজী না। তাও…. ‘
ধূসর পথিমধ্যেই কথা কে*ড়ে নিয়ে বলল,
‘ কীভাবে জানলি? পুষ্প তোকে বলেছে?’
পিউ তাকায়।
উত্তর দেয়,
‘ বলেনি। আমিত জানি। আপনিও তো জানেন।’
‘ ওরা জানিয়েছে আমাদের?’
জলদগম্ভীর স্বরে, পিউ দুদিকে মাথা নেড়ে বলল ‘না।’
‘ ওরা আমাদের জানায়নি,আমরা নিজেদের মত করে জেনেছি। জানি যে পুষ্প রাজী নয়। কিন্তু একে অন্যকে ভালোবেসেছে ওরা,তাই সবাইকে সত্যি জানানোর দায়বদ্ধতা ওদের পিউ। তোর বা আমার নয়।’
‘ কিন্তু…. ‘
ধূসর হাত উঁচু করল। পিউ থেমে যায় ওখানেই। সে বলল,
‘ পুষ্পকে আমি সময় দিয়েছি,সুযোগ দিয়েছি। সবার সামনে ওকে জিজ্ঞেস করেছি সে রাজী কীনা। ও যদি একবার না বলতো,বাকীটা আমি সামলাতাম। কিন্তু সে বাবার বাধ্য মেয়ে। বলে বসল ‘হ্যাঁ’। বোকা মেয়ে বুঝলোইনা,তোর বাবা ওসব কথা আমাকে শোনাতে বলেছেন।’
পিউ অবাক চোখে তাকাতেই বলল,
‘ কাকে কী বলছি, তুইত আরেক নির্বোধ।”
পিউ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল ‘ আমি কী করলাম?’
ধূসর সে কথার জবাব দিলোনা। সুদৃঢ় গলায় বলল,
‘ পুষ্প,ইকবাল কেউই আমাকে বলেনি তাদের সম্পর্কের কথা। তাদের মতে আমি কিছুই জানিনা। তাই যতক্ষণ না ওরা নিজেরা এসে আমাকে জানাবে,আমি এরকমই থাকব। নির্লিপ্ত, চুপচাপ। ওরা যদি আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ না করে,তাহলে যা ভালো বোঝে করুক। আমি এসবে নেই,আর তুইও থাকবি না। ‘
পিউ আগ্রহভরে শুধাল,
‘ আর যদি জানায়, তখন?’
ধূসর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
‘ আমাকে ভরসা করিস?’
পিউ বিলম্বহীন মাথা দোলাল।
করে না মানে? বাবা মায়ের পর এই মানুষটাকে সবথেকে বেশি ভরসা আর বিশ্বাস তার। অন্ধ যেমন একজন অচেনা মানুষের হাত ধরে রাস্তা পার হতে শেখে? একটা তুলতুলে শিশু যেমন মায়ের মুখ থেকে শুনে দুনিয়া চিনতে শেখে? এই ভরসা হয়ত তারও উর্ধ্বে।
ধূসর বলল,
‘ তাহলে নিশ্চিন্ত থাক। যা হবে,খা*রাপ হবে না৷ ‘
এই এক বাক্য অচিরেই দূর করল পিউয়ের সকল অস্থিরতা,উদ্বীগ্নতা।
তার ওষ্ঠপুটের মৃদূমন্দ হাসি,আর মুখস্রীতে অকংপিত চিহ্নটা ধূসর সূচালো,একাগ্র চিত্তে দেখল। পরোখ করল এক কথায়। ততোধিক শান্ত গলায় বলল,
‘ কাল পরীক্ষা রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? পড়াশুনা নেই তোর? দিনে একবারও বইয়ের আশেপাশে দেখিনা তোকে। ফেল করার ইচ্ছে আছে?”
অলঘু কণ্ঠ পিউয়ের ধ্যান ভা*ঙায়। হাসি মিলিয়ে তটস্থ হয়। জবাব দেয়,
‘যাচ্ছি।’
সে মোটামুটি নিরুপদ্রব এখন। ধূসর ভাই যখন বলেছেন,তিনি নিশ্চয়ই কিছু করবেন। শান্তিপূর্ণ মন নিয়ে উল্টোপথে হাঁটা ধরল পিউ। দরজা অবধি গিয়ে আবার ফিরে তাকাল।
ডাকল ‘ ধূসর ভাই?’
‘হু।’
‘ একটা কথা বলতাম।’
‘ কী?’
‘ ইয়ে,ইকবাল ভাইকে জানাব,আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে যে?’
তার ক্ষুদ্র জবাব ‘ ইচ্ছে।’
পিউ মাথা দোলাল। হাঁটতে গিয়ে কী একটা ভেবে আবার থামল। ঘুরে চেয়ে দেখল ধূসর সেখানেই দাঁড়িয়ে, এদিকেই তাকিয়ে।
সে মনঃদ্বিধা নিয়ে বলল,
‘ না থাক। আপনিই জানিয়ে দিন। আমার দ্বারা হবে না।’
ধূসরের হাসি পেলো পিউয়ের মুখ দেখে। অথচ ভারী গলায় বলল ‘ ঠিক আছে, যা।’
পিউ আবার মাথা দুলিয়ে চলে গেল। বরাবরের মত ওই পথে গেঁথে রইল ধূসরের অবিচল,অনিমেষ, তৃষ্ণাতুরা চক্ষুদ্বয়।
***
পিউ পড়ার টেবিলে বসলেও তার মনোযোগ নেই। ইংলিশ ফার্স্ট পেপার বলে আগ্রহ ও কম। সে ইংরেজিতে ভালো,বলা বাহুল্য যথেষ্ট ভালো। আগে যা পড়েছে ওতেই হবে।
পিউ কলমের গোড়া দিয়ে মাথা চুল্কাল কিছুক্ষন। উশখুশ লাগছে। খচখচ করছে মনের মধ্যে। ইকবাল কে ফোন করবে ভেবেও করেনি। এরকম দুঃসংবাদ কী করে দেবে সে? ভাইয়া কতটা ক*ষ্ট পাবে তার কী জানা নেই ? এতটা নি*ষ্ঠুর সে নয়। ওসব ধূসর ভাই করুক গে। তার বন্ধুকে তিনিই সামলাক।
পুষ্প-সাদিফের ব্যাপারটা যতবার ভাবছে ততবার মন খারা*প হচ্ছে তার। বইয়ের পৃষ্ঠায় জাগছে বিতৃ*ষ্ণা। একবার চাইছে,সাদিফকে গিয়ে জানাবে সব। পরক্ষনেই ধূসরের কথা মনে করে থেমে যাচ্ছে।
নিজের প্রতি অস*ন্তোষ ভঙিতে মাথা নাড়ছে। বিমুখ হয়ে খাতায় আঁকিবুঁকি করছে। তবুও লাভের লাভ হচ্ছেনা। ঘুরেফিরে প্রশ্ন করছে মনটা ‘ কীভাবে কী হবে?’
শেষে শ্রান্ত ভঙিতে মাথাটাকে টেবিলের ওপর এলিয়ে দিলো পিউ। যা হওয়ার হোক। পৃথিবী উলটে যাক,ভঃ*স্ব হোক। যতক্ষণ না ধূসর ভাই কিছু করবেন,সে নিজেও থাকবে নীরব দর্শক।
**
ইকবাল ফোন করে করে ক্লান্ত,অবিশ্রান্ত। বিপ*ন্ন হস্তে শেষ বার চেষ্টা করল,রিসিভ হলো না। তার অস্থিরতা বাড়ল ক্রমশ। পুষ্প ফোন ধরতে দেরি করলেও একদম ধরেনা এরকম ঘটেনি আগে। তাদের তো ঝগ*ড়াও হয়নি। তবে রিসিভ হচ্ছেনা কেন? ঠিক আছে তো মেয়েটা?
ইকবাল দ্রুত হাতে আবার চেষ্টা করল। এবারেও একই ফল। শেষে রে*গেমেগে ফোনটাকে বিছানায় ছু*ড়ে ফেলল সে। সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে চলল বারান্দায়।
পুষ্প সাদিফের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে। তার মুখটা এইটুকুন। বুকটা জড়োসড়ো ভ*য়ে। তবুও চমৎকার এক আশা পুষে এখানে হাজির হয়েছে। ভাইদের মধ্যে সাদিফের সঙ্গে তার নৈকট্য বেশি। বয়সের গ্যাপ কম হওয়ায় একে অন্যকে বোঝেও ভালো। সাদিফ ভাইয়াকে সব জানালে তিনি নিশ্চয়ই একটা কিছু করবেন। সেজো মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজী করাবেন বিয়ে আটকাতে। এটুকু ভরসা ওর আছে।
এই আশ্বাসেই পুষ্প কা*ন্নাকা*টি থামিয়ে এখানে উপস্থিত হলো। ভেতরটা তবুও কাঁ*পছে অজানা আশ*ঙ্কায়। বুক ধড়ফড় করছে খুব। সবটা ভালোয় ভালোয় হবে তো?
সে দোরের পৃষ্ঠে টোকা দিতে গেল,ওপাশ থেকে আগেই খুলে যায় সেটা। সাদিফও তখন বের হচ্ছিল। দুজন আকষ্মিক দুজনের সামনে পরায় মৃদূ চমকাল,হতভম্ব হলো।
একে অপরের মুখ দেখেই যত্র গাঢ় অস্বস্তিতে ডুবে গেল। নিজেদের বিয়ের আলাপ,নিজেদেরই সামনে হওয়ায় এই স্বস্তিহীনতার সীমা নেই। ছোট বেলা থেকে যারা নিজেদের ভাই-বোন জেনে এসেছে তাদেরই বিয়ে?
পুষ্প চোখ নামিয়ে নিলো। সাদিফ সামলালো তার অপ্রতিভ অভিব্যক্তি। স্বাভাবিক হয়ে শুধাল,
‘ তুই হঠাৎ? ‘
পুষ্প ওমন নীচে চেয়েই বলল ‘ একটু কথা ছিল।’
‘ ভেতরে আয়।’
সাদিফের পিছু নিয়ে সে ঘরে ঢুকল। খোলা দরজাটা হাত দিয়ে আস্তে করে চাপিয়ে দিল।
‘ বোস।’
‘ না,ঠিক আছি।’
‘ কী বলবি?’
পুষ্প ঘামছে। কপাল গড়িয়ে দু এক ফোটা পরছেও গলায়। ঢোক গি*লছে বারবার। কোত্থেকে শুরু করবে বুঝে উঠছেনা। সাদিফ তা*ড়া দিল,
‘ কী? বল!’
পুষ্প শ*ক্ত হলো খানিক। মস্তিকে সাজিয়ে,গুছিয়ে আনা বাক্যসংলাপ আরেকবার আওড়াল।
প্রচন্ড মিহি কণ্ঠে বলল,
‘ আমি বিয়েটা করতে চাইনা ভাইয়া।’
সাদিফের কর্নকুহর হলোনা। বলল,
‘ আরেকটু জোরে বল।’
পুষ্প তাকাল। জ্বিভে ঠোঁট চেটে বলল,
‘ এই বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব।’
‘ কেন?’
সাদিফের উদ্বেগশূন্যতা, পুষ্পর সব গুলিয়ে দেয়। ভী*ত হয় সে।
সাদিফ নিজে থেকেই জানতে চাইল,
‘ কাউকে পছন্দ করিস?’
পুষ্প মাথা নামিয়ে নেয়,তবে ওপর নীচে দুলিয়ে বোঝায় ‘ হ্যাঁ। ‘
সাদিফের শান্ত স্বর ‘ কাকে?’
পুষ্পর গলা কাঁ*পছে খুব। ইকবালের নাম নিতে আতঙ্কে থরথর করছে ভেতরটা। এরপর কী হবে ভেবে শ*ঙ্কিত সে।
কিন্তু না জানিয়ে উপায়ও যে নেই। এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়ার এটাই পথ।
প্রগাঢ় ভ*য়ডর বুকে চে*পে,
রুদ্ধশ্বা*সে সে জানাল ‘ ইকবাল কে।’
সাদিফ অবাক হলো। চেহারায় পরিষ্কার ফুটে উঠল চিহ্নটা। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল ‘ ধূসর ভাইয়ার বন্ধু ইকবাল?’
পুষ্পর গ্রাস তরতরিয়ে বাড়ে। বক্ষস্পন্দন জোড়াল। তার মৌণতা সাদিফকে উত্তর বুঝিয়ে দেয়। সে রাশভা*রি গলায় প্রশ্ন করে,
‘ কবে থেকে? ‘
‘ দু… দু বছর।’
সাদিফ একটু ভেবে শুধাল ‘ ভাইয়া জানেন?’
তার ত্রাসিত জবাব,
‘ না।’
‘ এখন আমাকে কী করতে বলছিস?’
পুষ্প চট করে তাকায়। চেহারায় উঁকি দেয় অল্পস্বল্প আশার আলো। সাদিফের প্রতি তার অমায়িক আস্থা,বিফলে যাবেনা নিশ্চয়ই?
সে আকুল স্বরে অনুরোধ করল,
‘ সেজো মাকে একটু বুঝিয়ে বলোনা ভাইয়া। তুমি বললে আব্বুও শুনবেন। আমি ইকবালকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব না। ‘
সাদিফের চেহারায় পরিবর্তন হলো না। সে চুপ করে তাকিয়ে আছে। বাইরে থেকে ভেতরটা বুঝে ওঠা মুশকিল।
পুষ্পর ব্যগ্র চাউনী। বক্ষঃপিঞ্জর আন্দোলিত। সাদিফের অভিপ্রায় বুঝতে অক্ষম মস্তক।
সেই মুহুর্তে শোনা গেল তার তপ্ত শ্বাস আ*ছড়ে আসার শব্দ। সাদিফ দীর্ঘকায় নিঃশ্বাস নিলো।
পরপর বলল,
‘ সমস্যাটা তোর পুষ্প,আমার নয়। তাই যা করার,যা বলার তুই বল। আমার থেকে কিছু আশা করিস না।’
পুষ্প মাথায় বাঁ*জ পরল। বিস্ময়াকুল সে। হৃদয় ভে*ঙে খান*খান হয়। আলোকশ্যূন্যতায় ছেঁয়ে যায় অন্তঃস্থল। লোঁচন থেকে ঠিকড়ে গড়ায় দুফোঁটা জল। নৈরাশ্যে পিছিয়ে গেল এক পা। মর্মাহ*ত কণ্ঠে বলল,
‘ এর মানে তুমি কিছু করবে না?’
সাদিফ অকপটে বলল,
‘ না। বড়দের ওপর কথা বলা, আমার ধাঁচে নেই। তুই বিয়েটা ভা*ঙতে পারলে আমার আপত্তি নেই,তবে নিজে কিছু করতে পারব না। সরি!
পুষ্পর চোখেমুখে অবিশ্বাস। ছোট বেলা থেকে চিরপরিচিত সাদিফ ভাইকে আজ অজ্ঞাত,অচেনা মনে হচ্ছে। এ কেমন মানুষ তার সম্মুখে? পুষ্পর ঝাপ্সা নেত্র অচিরাৎ ক্রো*ধিত হলো। অক্ষিপট দপ করে জ্ব*লে উঠল রু*ষ্টতায়। শান্ত,সংযত মুখমণ্ডল শ*ক্ত হলো ভীষণ।
একেবারে মুখের ওপর,সরাসরি বলে বসল,
‘ তুমি খুব স্বার্থ*পর সাদিফ ভাই। তোমার মত স্বার্থ*পর মানুষ, আমাদের এই সুন্দর পরিবারের জন্যে বিষা*ক্ত। আমারই ভুল,মিথ্যে আশা নিয়ে তোমার কাছে আসা। নিজের সময় ন*ষ্ট করে আমি অনুতপ্ত। ‘
সাদিফ নিরুত্তর। টু শব্দ করল না। তর্কে গেল না। পুষ্প ক্রো*ধে গজগজ করে বেরিয়ে গেল। দেয়ালে দরজা ফেলার শব্দটা বিক*ট হলেও পা থামেনি তার। সাদিফ পুনরায় দম ফেলল। ভ্রুঁ কুঁচকে এগিয়ে গেল বিছানায়। তার নির্জীব ভাবভঙ্গি, যেন পুষ্পর কথায় যায় এলোনা। চশমা খুলে,আলো নিভিয়ে,গায়ে কম্বল পেঁচিয়ে চুপচাপ শুয়ে পরল সে। প্রস্তুতি নিলো একটি চমৎকার নিদ্রার।
#চলবে,
(আড়াই হাজার শব্দ। আজ একটানা বসে লিখেছি। আপনাদের কথানুযায়ী এত ছোট পর্বটা লিখতে পুরো পাঁচ ঘন্টা আমার এখানেই শেষ। 🙂)