এক সমুদ্র প্রেম পর্ব – ৬৪

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৬৪)

সিকদার বাড়ির খাবার টেবিলটা বেশ লম্বা আর বড়। পরিবারের এত এত লোক যাতে আরামসে, একসাথে বসে খেতে পারে, তাই ফ্যাক্টরি থেকে পছন্দ করে বানিয়ে আনা এটি। প্রথম প্রথম লোকসংখ্যা কম ছিল,আস্তে আস্তে বাড়ল। ভাইয়েদের সন্তান এলো। আর এখন মেহমানদের একসাথে বসানোরও জায়গা হচ্ছে না। তাই,ওই টেবিলের সঙ্গে আরো একটি টেবিল আলগা ভাবে বসানো হয়েছে।
সবার খাওয়ার মধ্যে,পিউকে দেখেই আফতাব হৃষ্ট কণ্ঠে আওড়ালেন,
‘ আরে,আমার বউমা আসছে যে!’

পিউ লজ্জা পেলো। সবার দৃষ্টি ওর দিক পড়তেই মাথার ঘোমটা টেনে নিলো আরেকটু। মুচকি হেসে কাছে এলে আফতাব চেয়ার টেনে বললেন,
‘ আজ আমার বউমা আমার পাশে বসবে। ‘
বসল পিউ। চাচার মুখে বউমা শব্দটায় ওর খুশিতে হুশ হারানোর জোগাড়। এত কিউট লাগছে কেন শুনতে? ভেতর-বাহির শীতল হয়ে যাচ্ছে একদম! ইশ,কত স্বপ্ন দেখেছিল এই দিনটার! এত দ্রুত সত্যি হবে কে জানত!

কিন্তু রুবায়দা চোখ পিটপিট করে বললেন,
‘ ও পিউ, তুই এত বড় ঘোমটা দিয়েছিস কেন মা?’

শোনা গেল পুষ্পর দীর্ঘশ্বাস। টেনে টেনে জানাল,
‘ কী আর বলি! এটা না কী তার শ্বশুর বাড়ি মেজ মা। সে নতুন বউ,তুমি শ্বাশুড়ি, তোমার সামনে একটা ভদ্রতা আছেনা? ঘোমটা দেবে যখন,নাক চোখ ঢেকেই দিয়েছে।

সবাই হা করে তাকাতেই, উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ না না, এগুলো আমার কথা নয়,ওনার কথা। ‘

পিউকে ইশারা করল ও। মেয়েটা ঠোঁট উলটে নিয়েছে। কী আজগুবি যুক্তি দেখাল তখন,এইভাবে সবার সামনে আপুর বলে দিতে হলো? পেট পাতলা কোথাকারে!
রুবায়দা আশ্চর্য হয়ে বললেন,
‘ এ আবার কী কথা? আমি কি ওমন শ্বাশুড়ি না কী, যে জামা-কাপড় নিয়ে বলব? আর তার থেকেও বড় কথা, আমি কি নিজেকে ওর শ্বাশুড়ি ভাবি? আল্লাহ! ও পিউ,তুই এই গরমে শাড়িই বা পরতে গেলি কেন? এখন পায়ে বেঁধে পরে-টরে গেলে কী হবে?’

পিউ চুপ করে থাকল। নখ দিয়ে প্লেটের পরোটা খুঁটল। কী বলবে এখন?
এই ঘোমটা যে, তোমার ছেলের দেওয়া চন্দ্রচিহ্নের ফল সেসব কী বলা যায়?
সে যতটা পারছে মাথা নুইয়ে রাখল। পারলে ঢুকে যাবে থালার ভেতর।

মিনা মেয়ের খাবার নড়তে না দেখেই চাটি মা*রলেন মাথায়,
‘ কী রে,খাবার নড়ছেনা কেন? খা।’
পিউ মাথা ডলতে ডলতে বলল,
‘ খাচ্ছি তো।’

সহসা আফতাব প্রতিবাদ করে উঠলেন,
‘ ভাবি আপনি আমার বউমা কে মা*রলেন কেন? ‘

ভ্যাবাচেকা খেয়ে চাইলেন মিনা।
রুবাও তাল মেলালেন,
‘ তাইতো! হিসেব মতো
পিউ এখন শ্বশুর বাড়ি আছে। ও আমার ছেলের বউ। তুমি ওকে মা*রলে কেন আপা?’

মিনা স্বামীর দিক চাইলেন। আমজাদ হাসছেন। তিনি পরাস্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ ঘাঁট হয়েছে ভাই! তোমাদের বউমাকে আর মা*রব না। ক্ষ্যমা দাও।’

শব্দ করে হেসে উঠল সকলে। ওপর থেকে ধূসর নেমে এলো তখন। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে এসে দাঁড়াল টেবিলের কাছে।
গিয়ে বসল একদম পিউয়ের মুখোমুখি,সম্মুখের চেয়ারটায়। খেতে খেতে আড়চোখে একবার ঘোমটা দেওয়া ওর দিক চাইল। সকাল সকাল,তার প্রিয়তমা স্ত্রীর স্নিগ্ধ মুখ আর ভেজা চুল দেখার অভিলাষে। কিন্তু দানবীয় ঘোমটার আড়ালে অত কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

মেয়েটা ঠিকঠাক খেতে পারছেনা। বাম হাতে ঘোমটা ধরে রাখা। সরে গেলেই তো সর্বনাশ! ঠোঁটের ফোলা অংশ ঢেকে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টাটুকু বুঝে ফেলল
ধূসর। প্লেটের দিক চেয়ে ,স্বল্প,একপেশে,মিটিমিটি হাসল।
ইকবাল ওর পাশেই বসে। সে সবাইকে একবার, একবার দেখে নেয়। আস্তে আস্তে ঠোঁট খানা এগিয়ে নেয় ধূসরের দিক। আঙুল দিয়ে মুখ ঢেকে বিড়বিড় করল,
‘ তোকে ভালো মনে করেছিলাম। কিন্তু তুই…’

ধূসর ভ্রু কুঁচকে চাইল।
‘ কী করেছি?’
ইকবাল সবার কান এড়িয়ে,
চাপা কণ্ঠে বলল,
‘ কী করেছিস আবার প্রশ্ন করছিস? ছিছি! শোন,বিয়ে-সাদিতে আমি তোর সিনিয়র। সব জানি। পিউয়ের ঘোমটার রহস্য বুঝিনা ভাবিস? নিশ্চয়ই মেয়েটাকে চেহারা দ্যাখানোরও অবস্থায় রাখিস নি। ইশ! কী স্বৈরাচারী দৈত্য তুই! ব্রিটিশ রাও তোর চাইতে ভালো ছিল।’

ধূসর হতভম্ব হয়। একেকজনকে দেখে দাঁত পেষে। টেবিলের ওপর বাম হাত রাখা ছিল ইকবালের। ডিম পোচ কা*টার চামচটা আস্তে এগিয়েই, সেখানে চে*পে ধরল ও। চমকে,ছিটকে হাত সরাল ইকবাল। ভরকে বলল,
‘ শালা ডাকাত!’
তার নড়ার তোপে টেবিল নড়ে উঠেছিল। সবাই চাইল ওমনি। পুষ্প শুধাল,
‘ কী হলো? এমন করলে কেন?’
ইকবাল জোর করে হেসে বলল, ‘ কিছুনা,কিছু না।’

চোখ-মুখ শান্ত করে, খাওয়ায় মনোযোগ দেয় সকলে। ইকবাল কটমট করে বলল,
‘ এইভাবে মানুষ মানুষকে মা*রে? যদি চামচটা ঢুকে যেত হাতে?’

ধূসর নিরুৎসাহিত,
‘ গেলে যেত। ব্রিটিশ বন্ধু বানাবি,আর অ*ত্যাচার সহ্য করবিনা?’
ইকবাল আহ*ত চোখে চাইল। সে ফের বলল,
‘ আর তাড়াহুড়োর কথা কে কাকে বলে? যে বিয়ের ছ মাসের মাথায় বাবা হচ্ছে,সে?’

ইকবাল বিস্মিত কণ্ঠে, তেঁতে বলে,
‘ নিজের সিনিয়র কে খোঁচা দিলি? শালা সমন্ধি! অভিশাপ দিলাম তোকে,জীবনে ডিভোর্স পাবিনা।’

ধূসর আড়চোখে চেয়ে,হেসে ফেলল।
আমজাদ শুধালেন,
‘ বের হবে?’
‘ জি।’
‘ এখনই? ‘
‘ না। পরে।’
রুবায়দা বললেন,
‘ কাল বিয়ে করলি,আজকেও বের হবি? আজ অন্তত বাড়িতে থাক।’
‘ দুপুরে চলে আসব।’

আমজাদ ইকবালকে শুধালেন, ‘ তুমিও যাবে না কি?’
ইকবাল অবাক হলো। হিটলার শ্বশুর আবার ওর খোঁজ খবর রাখছে কবে থেকে?
নম্র কণ্ঠে বলল,
‘ জি। পার্লামেন্টে কাজ ছিল।’
‘ ওহ। যেখানেই যাও,দুজনেই দুপুরে ফিরো। পরিবারের সবাই একসাথে খেতে না বসলে মন ভরেনা।’

ইকবালের চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। সে হা করে চাইল পুষ্পর দিক। পুষ্প মুচকি হাসে। হাসল ইকবালও। যাক! একটু একটু করে যে শ্বশুর ওকে মেনে নিচ্ছে এটাই অনেক!

আস্তে আস্তে একেকজনের খাওয়া ফুরায়। টেবিল রেখে রুমে যায় তারা। অন্যদের কথাবার্তা চলে। আনিস বের হলেন অফিসের উদ্দেশ্যে। সৈকত আর বর্ষা বিদেয় নিলো।
ধূসর উঠে দাঁড়াল। সবার মধ্যেই, পিউকে বলল,

‘ তোর…
পুরো কথা সম্পূর্ন হলো না। এইটুকু শুনেই, গতিতে জ্ব*লে উঠলেন আফতাব।
‘ আশ্চর্য! তুই -তোকারি করছো কেন? ও এখন তোমার স্ত্রী না? সম্মান দিয়ে কথা বলবে।’

ধূসর পিউয়ের দিক চাইল। ভ্রু তুলে,অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল,
‘ তোকে এখন তুমি করে বলতে হবে?’

পিউ অসহায় হয়ে পড়ল। স্বামী আর শ্বশুড়ের তর্কের মাঝে কী বলবে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল। স্যান্ডউইচ হওয়ার থেকে বাঁচতে মিনমিন করে বলল,
‘ আপনার যা ভালো লাগে, তাই বোলবেন ধূসর ভাই।’

সুমনা তাজ্জব কণ্ঠে বললেন,
‘ ভাই? এখনও ভাই? ওরে তোদের না বিয়ে হয়েছে? এমন করলে বাইরের মানুষ তো সব গুলিয়ে ফেলবে।’
পিউ ফোস করে শ্বাস ফেলল। বাইরের মানুষ কী গোলাবে? ওর নিজেরই সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ধূসর ভাইকে ভাই ডাকবেনা বলে একটা সময় কত কী করত! ভাইয়া থেকে কে*টে*ছেটে ভাইয়ে নামল। হাজারখানেক ধমক শুনেও অনড় সে কিছুতেই পিছপা হয়নি। আর এখন মোক্ষম সুযোগ হাতে পেয়েও কিছু হচ্ছেনা? ওনাকে নাম ধরে ডাকার মত কলিজা,সাহস,ইচ্ছে, এখন যেন কোনওটাই নেই। তিন বছরের অভ্যেস কি আর রাতারাতি বদলাবে?
আবার, স্বামীকে যে ভাই ডাকলেও বিপদ! তাহলে কী ডাকবে? সিনেমার মত, ‘ওগো? হ্যাঁ গো,কী গো.. এভাবে?
না না। দেখা গেল অতি আহ্লাদে এসব বললে, ধূসর ভাইও অতি রেগে একখানা চ*ড় বসিয়ে দিলেন। কিংবা রুষ্ট হয়ে ধমকে বললেন,
‘ দূর হ আমার সামনে থেকে!’
তার চেয়ে থাক।

****
সোফায় তখন আন্ডা-বাচ্চাদের আসর। টেলিভিশন চলছে। সদ্য টেলিকাস্ট হয়েছে শাহরুখের নতুন সিনেমা। একেকজন তূখোড় মনোযোগী পর্দায়।
এর মধ্যে জবা বেগম ফালুদা নিয়ে এলেন। তার হাতের ফালুদা এ বাড়ির সবার পছন্দ। মেহমান মিলিয়ে বাড়িতে প্রায় পঁচিশ জন লোকের উপস্থিতি। সবার জন্য বানিয়েছেন।

প্রথমে এসে বাচ্চাদের হাতে হাতে দিলেন। পুষ্পর দিকে বাটি ধরতেই সে বিরস গলায় বলল,
‘ খাব না।’
‘ একটু খা।’
‘ উহু,বমি হবে।’
‘ হলে হবে। তাই বলে না খেয়ে থাকবি? তোর জন্য মিষ্টি কম দিয়েছি। নে…’
জোরাজোরিতে পুষ্প বাটি নিলো। ওপর থেকে সুপ্তি চঞ্চল পায়ে নামল তখন। স্লোগান দিলো,
‘ টাকা পেয়েছি,টাকা পেয়েছি।’
ছুটে সবার কাছে এলো সে। থামল,শ্বাস নিলো। পিউ শুধাল,
‘ কী পেয়েছিস?’
সুপ্তি সোজা ইকবালের হাতে একটা মোটা টাকার বান্ডিল দেয়। জানায়,
‘ ধূসর ভাইয়া দিয়েছেন। বলেছেন, আপনি মুরুব্বি, আপনার হাতে দিতে।’

পুষ্প উচ্ছ্বল কণ্ঠে বলল, ‘ আমাদের গেট ধরার টাকা?’
‘ হ্যাঁ। ‘

ইকবাল মাথা নাঁচিয়ে বলল,
‘ দেখলে,ধূসরটা কত সম্মান দেয় আমাকে? এই হলো আমার বন্ধু। যাই হয়ে যাক,কথার খেলাপ করেনা হু। একটা সন্টামন্টা আমার।’

তার গদগদ ভাব দেখে, পুষ্প বলল,
‘ তোমার বন্ধু পরে,আগে আমার ভাই।’
রাদিফ লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ আর আমাদের দুলাভাই।’
রিক্ত হাত তালি দিলো।
একদফা হাসির রোল পড়ল ওমনি।

ইকবাল কড়কড়ে টাকার নোট গোনায় ব্যস্ত হলো। গুনে দেখল ৩৪ হাজার। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ এক হাজার কম কেন?’

সুপ্তি দাঁত বের করে জানাল,
‘ বলেছে আপনি মিরজাফর! কাল ওনার সাপোর্ট করেননি। তাই আপনার ভাগ থেকে এক হাজার কাটা ।’
ইকবালের হাসি শেষ। একটু আগেই ধূসরের প্রসংশা করা মুখেই, কটমট করে বলল,
‘ শালা একটা ধাপ্পাবাজ! আমার মত ভালো মানুষের ভাগ থেকে এক হাজার কেটে নিলো? যোচ্চর একটা! ‘

হুহা করে হেসে উঠল ওরা। পুষ্প দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল,
‘ আহারে! একটু আগেই কে যেন বলল সন্টামন্টা? টাকা কম পেয়েই সব ভালোবাসা বেরিয়ে গেল?’

পিউ বলল,’ এখান থেকে আমি কিছু পাব না? আমাকে যে জিম্মি রাখা হয়েছিল,একটা ক্রেডিট তো আমারও তাইনা?’

‘ ইশ! নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলি তুই। কিছুতো টেরই পাসনি। আমরা বাকবিতন্ডা করে টাকা আদায় করে,তোকে কেন দেব?’

‘ এইভাবে বলতে পারলি আপু? বড় বোন হিসেবে দশ টাকা অন্তত দিতে পারতি। খুশি হোতাম।’
সুপ্তি বলল,
‘ তোমাকে খুশি করতে ডেঞ্জারাস ধূসর ভাইয়া আছেন। গরিবের হকে ভাগ বসিওনা। ‘

পুষ্প ভ্রু বাঁকায়,’ ডেঞ্জারাস?’
সুপ্তি মিনমিন করে বলল,
‘ ওনাকে দেখলেই আমার ভ*য় লাগে! কেমন যেন হিং*স্র মনে হয়। খালি পে*টাবে,মা*রবে… বাবাহ! পিউপু যে কীভাবে ওনার সাথে সংসার করার সাহস করল আল্লাহ জানে।’

পিউ ধমকে বলল,
‘ একদম বাজে কথা বলবি না।’
ইকবাল তাল মেলাল,
‘ হ্যাঁ, নো বাজে কথা ক্ষুদে শালিকা! ধূসরকে ওপর থেকে যেরকম দেখতে ভেতরর মানুষটা ততটাই ব্যতিক্রম! যদিও তুমি ছোট, অতশত বুঝবেনা। তাও বলি, ওর মত একটা লোকের সঙ্গ পাওয়া কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার। আর এইদিক থেকে আমি, পিউ দুজনেই লাকি! কী বলো পিউপিউ?’

পিউ হেসে বিলম্বহীন মাথা ঝাঁকাল। পুষ্প ভ্রু গুটিয়ে বলল,
‘ তুই এখনও এমন ঘোমটা দিয়ে আছিস কেন? তোর মুখটাও দেখতে পারছিনা ঠিকমতো। ঘোমটা খোল,তোকে দেখে আমার গরম লাগছে।’

পুষ্প টানতে যেতেই পিউ সরে বসল ওমনি। মাথা নেড়ে বলল,
‘ না, এখন খোলা যাবেনা, পরে।’

শান্তা চুপচাপ। তার এসবে মন নেই। টিভির দিক চেয়ে থাকলেও,চোখেমুখে বিরক্তি। ধূসর-পিউ এদের বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে এখনও কিশোরী হৃদয়ে মেঘের প্রভাব স্পষ্ট।
সে একবার সুপ্তির দিক চাইল। নিস্প্রভ কণ্ঠে শুধাল,
‘ আম্মুকে জিগেস করেছিস, কখন যাব আমরা?’
সুপ্তি মাথা নেড়ে না বোঝাল। কিন্তু পিউ বলল,
‘ আজ যাবি কেন? কাল -পরশু যাস,থাক দুটোদিন।’

শান্তা কিছু বলেনি। নিরুত্তর মাথা ঘুরিয়ে টেলিভিশনের দিক ফেলল।

ইকবাল যার যার ভাগের টাকা,তাকে কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দিলো। মারিয়া আর সাদিফেরটা গচ্ছিত রাখল নিজের নিকট। এলে দিয়ে দেবে।

পুষ্প সিনেমা দেখার তালে তালে বেশ কয়েক চামচ মুখে দিলো খাবার। ক্ষণ বাদেই, পাঁক খেল নাড়িভুঁড়ি। তৎপর বাটি রেখেই,মুখ চেপে দৌড়ে গেল বেসিনে।
ইকবালের নিজের খাওয়া ওখানেই স্থগিত। ফালুদা রেখে, চপল পায়ে, স্ত্রীর পেছনে ছুটল সেও।

আমজাদরা বসেছিলেন একটু দূরে। দৃশ্যটা চোখে পড়ল ওনার। মেয়ের প্রতি ইকবালের প্রতিনিয়ত এই যত্নে, বিমুগ্ধ হলেন এবারেও। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ভাবলেন,
‘ সেদিন ইকবাল -পুষ্পর বিয়ে দেওয়া, আরেকটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল আমার। ছেলেটার মত আমার মেয়েকে এতটা ভালো কেউ বাসত কী না, সন্দেহ!’

***
পিউ টিভির দিক হা করে চেয়েছিল। পলক ও পড়ছেনা। যেন একটুখানি পাতা ফেললেই অনেক কিছু মিস হবে।
বিষয়টা, মিনা দেখেই, খ্যাক করে বললেন,
‘ এখনও বসে আছিস কেন? ধূসর ডেকে গেল না? যা ওর ফালুদা ঘরে দিয়ে আয়।’

মনোযোগে ব্যঘাত পেয়ে একটুও খুশি হয়নি সে। মায়ের প্রতি, টলমলে অভিমান নিয়ে বলল,
‘ আপুর বিয়ের পরতো ওর সাথে কী সুন্দর করে কথা বলো! তাহলে আমার সাথে এমন কোরছো কেন আম্মু?’

‘ তোকে বাড়ি থেকে বিদেয় করতে না পারার দুঃখে পাগল হয়ে গেছি। এখন যা,তোরটাও নিয়ে যা।’

পিউ কিছু বলল না। শুধু নীচের ঠোঁট ফুলে উঠল। ট্রেতে কাচের বাটিদুটো তুলে হাঁটা ধরল ঘরের দিক।

******

ধূসর বিছানায় আধশোয়া। ফোনে কিছু একটা দেখছে। তার বেশভূষা পরিপাটি। একটু পরেই বের হবে।
পিউ নরম পায়ে কক্ষে ঢুকল তখন। নূপুরের শব্দে চোখ তুলে চাইল ও । নীল-সাদা মিশেলের তাঁতের শাড়ি পিউয়ের পড়নে। মাথায় ঘোমটা। তা ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে ছোট্টখাট্টো মুখ।

ধূসর ফোন পকেটে ভরল। পিউ চোরা দৃষ্টিতে ওকে একবার দেখে ট্রে রাখল টেবিলে। সোজা হয়ে ফিরতেই ধূসর সামনে এসে দাঁড়ায়। স্তম্ভের মতো হঠাৎ ওকে দেখে কিছু চমকাল পিউ। ধাতস্থ হয়ে,
চোখে চোখ রাখতেই মনে পড়ল রাতের কথা,সকালের কথা। স্বীয় বেহায়া চিন্তাভাবনায় নিজেই মিশে গেল মাটিতে।

উশখুশে ভঙিতে মাথা নোয়াল। ওমনি টের পেলো গতরে একটি ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। শাড়ির পার ভেদ করে কোমড় আকড়ে ধরেছে।
ধূসর সেখানটা টেনে পিউকে নিজের কাছে আনল। ডান হাত উঠে এলো ওর মুখমন্ডলে। ঠোঁট আর গালের লাল দাগে আঙুল বুলিয়ে, হেসে ফেলল নিঃশব্দে।

পিউ গাল ফুলিয়ে বলল,
‘ খুব মজা না? আমি এই গরমে একটা ঘোমটা দিয়ে ঘুরছি আর আপনি হাসছেন? ‘
ধূসরের চেহারায় পরিবর্তন দেখা গেল না। না কমলো তার হাসি। কোমল হাত ধরে বিছানায় এনে, বসাল ওকে।
ড্রয়ার খুলে মলম বের করল। এসে বসল মুখোমুখি। মলম দেখেই পিউ মাথাটা পিছনে নিয়ে বলল,
‘ না না, জ্ব*লবে!’
‘ কিছু হবেনা, আমি আছি।’

এই এক কথা পিউয়ের সব ভয়-ভীতি উড়িয়ে দিতে সক্ষম। ধূসর যখন ঠোঁট নেড়ে আওড়ায়,’ আমি আছি।’ দু বাক্যের এই লাইনে ভেতর জুড়িয়ে যায় ওর। বক্ষে ভর করে দূর্দমনীয় সাহস।
পিউ পিছিয়ে নেওয়া মস্তক ফের আগের জায়গায় আনল। ধূসর খসখসে তর্জনীতে মলম নিয়ে, ঠোঁটে ছোঁয়াতেই কেঁ*পে উঠল ঈষৎ।
কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল ,
‘জ্ব*লছে…’

ধূসর ঝুঁকে এলো। আস্তে আস্তে ফুঁ দিলো সেখানে। চোখে-মুখে যত্নশীলতার স্পষ্ট প্রলেপ! পিউয়ের জ্বা*লাপো*ড়া উবে যায়। চাউনী হয় নিশ্চল। ধূসরের দিক চেয়ে থাকে এক ভাবে। আবিষ্টের মতোন।

ধূসর একে একে গলায়,ঘাড়ে ঠোঁটের আশেপাশে মলম লাগিয়ে শুধাল,
‘ আর কোথাও আছে?’

পিউ মিহি কণ্ঠে জানাল,
‘ বাকীটা আমি লাগিয়ে নেব। ‘
ফোন বাজল তখন। খলিলের নাম ভাসছে স্ক্রিনে। ধূসর দেখল না,বরং না চেয়েই, সাইড বাটন চেপে সাইলেন্ট করল। যেন জানে কার ফোন!

মলমের ঢাকনা লাগিয়ে পিউয়ের হাতে ধরিয়ে দিলো। উঠে দাঁড়াল, দাঁড়াল সেও। ধূসর বাইকের চাবি তোলে। ছোট করে জানায়,
‘ বের হচ্ছি।’

পিউ উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ ফালুদা এনেছিলাম,খাবেন না?’
‘ তুই খেয়ে ফ্যাল!’
‘ এতগুলো!’
জবাব না পেয়ে বুঝল,আর লাভ নেই বলে । নিজেই জানাল,
‘ দুপুরে কিন্তু একসাথে খাব, মনে আছে তো?’
‘ আছে।’
‘ তাড়াতাড়ি আসবেন।’

ধূসর ফিরে তাকায়। কাছে আসে। কপালে প্রগাঢ় চুমু বসায়। জিজ্ঞেস করে,
‘ আর কোনও সমস্যা হচ্ছে?’
পিউ দুদিকে মাথা নাড়ল। সে বলল,
‘ মনে করে মলমটা লাগিয়ে নিস। এরকম একটু-আধটু দাগ কিন্তু এখন রোজ হবে।’

পিউ লজ্জায় নড়েচড়ে উঠল। এলোমেলো পল্লব ফেলল ডানে -বামে। কুণ্ঠায় রাঙা হলো তার গাল দুটো। যেন হাওয়ায় দোল খাওয়া ডালের রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার ঝাঁক। মাথা নুইয়ে নীচু কণ্ঠে বলল,
‘ আপনিতো আগে এমন ছিলেন না ধূসর ভাই! এখন এত নির্লজ্জ হচ্ছেন কী করে?’

ধূসরের বিলম্বহীন,অবিচল জবাব,
‘ আগে কী তুই বউ ছিলি?’
পিউ নিম্নাষ্ঠ চেপে চুপটি করে রইল। লাজুক ভঙি।
ধূসর ‘ আসছি’ বলে বেরিয়ে যায়।

পিউ চেয়ে থাকল যতক্ষন দেখা যায় তাকে। মুচকি হেসে মন্ত্রের ন্যায় আওড়াল,
‘ ধূসর ভাই! আপনার নির্লজ্জতা আকাশ ছুঁয়ে দিক। মেঘ হয়ে ডাকুক। তারপর বৃষ্টি হয়ে গড়িয়ে পরুক আমার সারা শরীরে। ‘

পরপর, হুটোপুটি কদমে ছুটে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। ঝুলে পড়ল রেলিং এ। কিছুক্ষণের মাথায় ইকবাল আর ধূসরকে বের হতে দেখা যায়।
বাইক চেপে বসেছে দুজন। ইকবালের ঠোঁট নড়ছে। বিশ্রামহীন বকবক করছে। মুখভঙ্গি সিরিয়াস। হয়ত, এক হাজার টাকা কম পাবার হা-হুতাশ।
ধূসর বাইক স্টার্ট দিতে দিতে কী মনে করে থামল। ঘুরে চাইল এদিকে।
আন্দাজ সঠিক হওয়ার ফলস্বরূপ, পিউকে দাঁড়ানো দেখেই, ঠোঁট দুটো উঠে গেল একপাশে।
পিউ স্ফূর্ত চিত্তে, হাত নেড়ে বিদায় জানায়। ধূসর দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে,বাইক ছুটিয়ে গেট পার হয়।
প্রস্থান দেখে পিউ প্রশান্ত শ্বাস টানল। বাতাসে ওঠানামা করল বক্ষপট।
চলে যাওয়া মানুষটা ওর নিজের। নিজের এই ঘর বারান্দা,এই সংসার।
যা আজ থেকে স্বযত্নে বুকের মাঝে আগলে রাখবে পিউ। ধূসর ভাইকে বিছিয়ে দেবে,এই শীর্ণ হৃদয়ে জমে থাকা এক_সমুদ্র_প্রেমের সবটুকু!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here