#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১২
তপ্ত দুপুরের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। দুপুরের ভাতঘুম শেষে বাচ্চারা খেলতে বেড়িয়ে পড়েছে । তাদের কলকল হাসির ধ্বনি, ছোটাছুটি সবই উপভোগ্য। নাবিলা বাড়ি ফেরার পথে রাস্তাঘাটের নানান খুটিনাটি বিষয় দেখতে লাগলো। রিক্সায় বসে সাদা মেঘের ভেলা যুক্ত আকাশটা দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে নাবিলার। তানজিলার বাড়ি থেকে ফিরতে বিকেল গড়ালো।
রিক্সা দিয়ে আসতে আজ কেমন যেনো একটা অস্বস্তি অনুভব করছে নাবিলা। হঠাৎ হঠাৎই মনে হচ্ছে কেউ ওকে দেখছে, ফলো করছে। কিন্তু আশে পাশে সন্দেহভাজন কোনো ব্যাক্তি অথবা গাড়ি নজরে পড়ছে না। এই অস্বস্তিটা কি শুধুই ভ্রম? অথবা এতোগুলো গাড়ির মাঝে কেউ ফলো করলে নাবিলার বোঝার কথাও নয়। মনের ভেতর দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়েই বাড়ি পৌছালো নাবিলা।
রুমে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিতেই জেসি এসে হাজির। নাবিলার কাছে জেসি শাড়ি পড়িয়ে দেওয়ার আবদার করলো। আজ প্রয়াস ও জেসি শপিং করেছে। প্রয়াস দুইটা শাড়ি এনেছে। একটা লাল পাড়ের সাদা কাতান শাড়ি এবং অন্যটা হালকা ল্যাভেন্ডার রঙের। নাবিলার মনের ক্ষতটাকে আবার পুনরুজ্জীবিত করার জন্য জেসির এইসময় আগমনই যথেষ্ট ছিলো। তার ওপর হাতে শাড়ি।
জেসির অনেকদিনের ইচ্ছে শাড়ি পড়বে। অগত্যা নাবিলা পড়াতে রাজি হলো। নাবিলাকে জোর করে নিয়ে প্রয়াসের বাড়িতে গেলো জেসি। প্রয়াস ওদের অপেক্ষাতেই ছিলো। থমথমে মুখে নাবিলাকে দেখে বললো,
‘সকাল থেকে কোথায় ছিলি?’
‘তানজিলার বাড়ি।’ নাবিলার নির্বিকার জবাব।
‘তা ফোন কেনো ধরলি না? এই পর্যন্ত কতবার ফোন করেছি দেখেছিস? জানিস না বিপদ ওত পেতে আছে চারিদিকে?’
নাবিলা শ্লেষাত্মক কন্ঠে বললো,
‘আমার দিকে খেয়াল আছে তোমার? তোমরা ঘুরতে গেলে, সেখানে ইনজয় না করে আমাকে কল দেওয়ার কি দরকার?’
প্রয়াস কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে ঠোট টিপে হাসলো। জেসি বললো,
‘আমরা তো এক ঘন্টার মধ্যেই ব্যাক করেছি। ভেবেছিলাম তোমায় নিয়ে আবার বের হবো। কিন্তু ততক্ষণে তুমি চলে গেছিলে। তাই আমাদের আর যাওয়া হলো না।’
‘আমার জন্য তোমরা গেলে না কেনো?’
‘এতকিছু তোর জানতে হবে না। এটা ধর।’
ল্যাভেন্ডার রঙের শাড়িটা জেসির হাতে দিয়ে লাল-সাদা রঙের শাড়িটা নাবিলার হাতে দিলো প্রয়াস। নাবিলা প্রশ্নসূচক চোখে তাকাতেই প্রয়াস বললো,
‘জেসি একা শাড়ি পড়বে কেনো তুইও সাথে পড়। এমিলি তোদের দুজনের একটা সুন্দর ছবি চেয়েছে। দুজনের শাড়ি পড়া ছবি তুলে নাহয় পাঠাবো।’
নাবিলা মুখ গোমড়া করলো শাড়ির রঙ দেখে।
‘লাল-সাদা শাড়ি পড়বো না আমি। সাদা পড়লে আমাকে নাকি বুড়ি বুড়ি লাগে কেউ বলেছে।’
নাবিলার কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। প্রয়াস মৃদু হাসলো। বললো,
‘সেই ‘কেউ’টাই যখন দিচ্ছে তারমানে নিশ্চয়ই তাকে আরেকবার বুড়ি দেখতে চাইছে সে। তাছাড়া বুড়িতো শুধু ‘কেউ’ এর চোখেই লাগে অন্যরা নাকি পছন্দ করে শুনেছি। তাহলে একজনের জন্য আটকে থাকবে কেনো?’
নাবিলা জেসির শাড়ির দিকে তাকালো। প্রয়াস বলেছে ল্যাভেন্ডার রঙে নাকি জেসিকে অসাধারণ লাগে। তাই তার জন্য ল্যাভেন্ডার রঙের শাড়ি। অন্যদিকে কয়েক বছর আগে প্রয়াসই ওকে বলেছিলো লাল-সাদা পড়লে নাবিলাকে বুড়ি লাগে তবুও ওর জন্য সেই রঙের শাড়িই এনেছে সে। নাবিলার মাঝে মাঝে প্রয়াসকে চিনতে খুবই কষ্ট হয়। তার হেয়ালি কথার দ্বারা অনেক কিছু প্রকাশ পেলেও পরমুহূর্তেই তা ভুল প্রমান করে দিয়ে আরো দ্বিধা দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। যেমনটা এখন দিয়েছে।
জেসিকে তৈরি করে দিয়ে নাবিলা নিজেও শাড়িটা পড়ে নিলো। শাড়ির সাথে লাল রঙের কাচের চুড়ি এবং ঝুমকো কানের দুলও এনেছে প্রয়াস।
খোলা চুলে, চশমা চোখে, ঠোঁটে একটু লাল লিপস্টিক ছোয়ালো হালকা করে। এই সাধারন সাজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মন্দ লাগলো না নিজেকে দেখতে। জেসি শুধু একজোড়া স্টোনের দুল পড়লো সাথে নুড শেইডের লিপস্টিক।
শাড়ির আচল সামলাতে সামলাতে বসার ঘরে আসতেই জেসি বললো প্রয়াস ক্যামেরা নিয়ে ছাদে গিয়েছে। অগত্যা নাবিলাকেও যেতে হলো। জেসির শাড়ি পড়ে হাটতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। সিড়ি দিয়ে উঠয়ে বারকয়েক হোচটও খেলো।
ছাদে উঠতেই কারো নিষ্পলক দৃষ্টির সামনে পড়লো নাবিলা। শেষ বিকেলের ম্লান হওয়া কমলা আলো তখন প্রকৃতিতে বিরাজমান। সেই কমলা আলোয় এক লাল-সাদা শাড়ি পরিহিতা, কোকড়ানো চুলের শ্যামারঙা নারীর উজ্জ্বলতা যেন হাজারগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ফুরফুরে হাওয়া বইছে মৃদুমন্দ। সেই সাথে ফুরফুরে হয়ে উঠেছে কারো মন। সেই একই রুপ, একই সৌন্দর্য।প্রয়াস নিষ্কম্প নয়নে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বললো,
‘অপূর্ব।’
জেসি ওর কনুইয়ে হালকা ধাক্কা দিতেই নিজেকে সামলে দৃষ্টি সংযত করলো প্রয়াস। তারপর স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
‘অসাধারণ লাগছে তোমায় জেসি। আর তোকে!উমম…খারাপ লাগছে না। তবে একটা জিনিস মিসিং।’
‘কি?’ নাবিলা জানতে চাইলো।
‘না কিছুনা। সেটা পড়ে কখনো হবে। চল এবার জলদি কয়েকটা ছবি তুলি। পশ্চিম দিকে ফিরে দাড়া দুজনে।’
ছবি তোলা শেষে জেসি, প্রয়াসকে রেখেই নেমে গেছে নাবিলা। বাড়ি ফিরেও কিছু ভালো লাগছিলো না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার প্রয়াসের বলা মিসিং ভাবটা খুজলো। কিছু গয়না জড়ালো, কিছু বদলালো কিন্তু কোথাও খালি খালি মনে হলো না। একবার ভাবলো টিপের কথা বলছিলো প্রয়াস ভাইয়া, আবার পরক্ষণেই মনে পড়লো প্রয়াস কপালে টিপ দেওয়া পছন্দ করে না। তাহলে মিসিং কোথায়?
কিছুক্ষণ ঘরে হাসফাস করে ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো নাবিলা। দিনের আলো তখন ম্লান হয়ে আবছা হয়ে উঠছে পরিবেশ। আকাশের নীল বর্ণ ধুসর রঙ ধারন করছে। পাখিরা যার যার নীড়ে ফিরছে। নাবিলা প্রেমহীন বিষন্ন মন নিয়ে শেষ সিড়ি টপকে ছাদের দরজায় পা দিতেই পাশের ছাদে প্রয়াস এবং জেসিকে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। ভেবেছিলো এতোক্ষণে নেমে গেছে ওরা।
দুজনের ঠোঁটেই অল্পবিস্তর হাসি। প্রয়াসের দৃষ্টি অসীম শূন্যে। সেই দৃষ্টি আজ উৎফুল্ল, প্রানবন্ত, সজীব। ঠোঁটের কোনে আত্মতৃপ্তির মৃদু হাসি। আর জেসির দৃষ্টি আকাশ পানে মুখ করে থাকা লোকটার দিকে। নাবিলা আর এক পা ও সামনে এগোতে পারলো না। থমকে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত ওদের দেখলো।
ইশ… খুব কি ক্ষতি হতো জেসির যায়গায় নাবিলা দাঁড়িয়ে থাকলে! মুগ্ধ নয়নে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষিত পুরুষকে দেখে প্রেমানুভূতি পেতে! এসব ভাবলে ঘুরেফিরে প্রয়াসের ওপর রাগ হয় নাবিলার। একটু কি আশেপাশে মন দেওয়া যেত না? যাকে এতো শাসনে রেখেছে তার চোখে কি একটু ভালো করে তাকানো যেত না? নাকি নাবিলা নিজের চোখের দ্বারা মনের কথা প্রকাশে ব্যর্থ? প্রেমে পড়ে মনের কথা অপ্রকাশিত থাকতেই ছ্যাকা খাওয়ার অনুভূতি বুঝি একেই বলে!
নাবিলার চোখ ছাপিয়ে জলধারা নেমে এলো। বয়ে গেলো কপোল বেয়ে চিবুকে, চিবুক বেয়ে গলায়। আধার আরো একটু ঘন হলো। জেসি এবং প্রয়াস আরো একটু আবছা হয়ে এলো নাবিলার কাছে। তবে প্রয়াসের নয়ন জোড়া এখনো অন্তরীক্ষ থেকে ফেরেনি। জেসি মাঝের দূরত্ব আরেকটু কমালো। দুজনের মাঝে এখন এক হাত দূরত্ব। জেসি ডান হাতটা বাড়িয়ে প্রয়াসের কাধে রাখলো। প্রয়াস তখনো একইভাবে দাঁড়িয়ে।
‘আজকে তুমি খুব খুশি তাইনা প্রয়াস?’ জেসি জিজ্ঞেস করলো।
‘ খুব। প্রিয়তমাকে নিজের মনের মতো আকাঙ্খিত রুপে দেখতে পেয়ে আমার তৃষিত নয়ন, হৃদয়, অনুভূতিরা, সব আজ তৃপ্ত। ‘
নাবিলা আর সহ্য করতে পারলো না। ওর উপস্থিতি কেউ টের পাওয়ার আগেই নেমে যেতে চাইলো। কিন্তু সিড়িতে একধাপ এগোতেই থমকে গেলো নাবিলা। আটকে গেলো ওর পা। কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো জেসির কন্ঠে উচ্চারিত অনাকাঙ্খিত শব্দ।
‘ওকে মনের কথা এখনো জানাচ্ছো না কেনো? মেয়েটাতো কষ্ট পাচ্ছে।’
নিস্তব্ধ হয়ে আশা পরিবেশে জেসির এমন কথার মানে বুঝলো না নাবিলা। কিন্তু বুঝতে চাইলো। কাকে মনের কথা জানাবে প্রয়াস ভাইয়া? আর কে কষ্ট পাচ্ছে?
‘জানাবো। কিন্তু অভিমানিনীর অভিমানে ডুবন্ত চোখদুটো দেখার লোভ যে সামলাতে পারছিনা।’
এর পর খানিক সময়ের নিরবতা। তারপর জেসি আবার বললো,
‘তোমাদের অনুভূতির শুরুটা কিন্তু আমাকে এখনো বলোনি। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি শোনার জন্য।’
প্রয়াস আকাশ থেকে চোখ সড়ালো। মৃদু হেসে দূরের নিকষ আধারে তাকালো। আধার সর্বদা দুঃখের সঙ্গী হয়না। কখনো সুখের সঙ্গীও হয়। যেখানে যেখানে মনের সব অনুভূতিগুলো ছড়িয়ে দিয়ে নিজেকে আরো স্পষ্টরুপে চেনা যায়। প্রয়াস বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করলো,
‘অনুভূতির শুরুটা মূলত নাবিলার দিক থেকে। ও তখন দশম শ্রেণিতে পড়ে। হাসি-খুশি, চঞ্চল, প্রানবন্ত একটা মেয়ে। আর পাঁচটা কিশোরীর মতোই ডানা মেলে উড়তে চাওয়া যার চেষ্টা। পৃথিবীকে জানতে চাওয়া, নতুন নতুন অনুভূতিকে বুঝতে চাওয়ার অদম্য উচ্ছাস যার চোখে মুখে উপচে পড়ে।
আমি তখন ভার্সিটিতে। বন্ধুবান্ধব, আড্ডা এবং ক্যারিয়ার নিয়েই ছিলো আমার সব ভাবনা। সেই ভাবনার মাঝে প্রশান্তি ছিলো এই পরিবারের প্রতিটা মানুষ। যাদের ছোট থেকেই আপন ভেবে এসেছি। বাবাতো সারাজীবন নিজের ব্যবসা নিয়েই ব্যাস্ত থাকতো এবং এখনো থাকে। সেসব কথা থাক।
দুই পরিবারের সবাই আমার বড়। আমায় উপদেশ আদেশ করে। কিন্তু আমার উপদেশ আদেশ দেওয়ার ওই একজনই ছিলো এবং আছে। নাবিলা। ছোটবেলা থেকে ওকে শাসন করতাম বড় ভাব দেখাতে। কেউ আমাকে মেনে চলুক সেই জন্য। নাবিলাকে শাসন করতে আমার ভালো লাগতো। ওর বোকা বোকা চোখে যখন আমার জন্য ভীতি কাজ করতো খুব মজা পেতাম।
আমাকে সবসময়ই এড়িয়ে চলতে চাইতো ও। আমিও তা কিছুতেই হতে দিতাম না। তবে শাসন ওর ভালোর জন্যই করতাম। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই পড়তে বসাতাম। নাবিলাও আমাকে তাড়াতে একদিন পেটে ব্যাথা তো অন্যদিন মাথা ব্যাথা বলে ঘাপটি মেরে থাকতো দাদির ঘরে। কিন্তু সত্যি যখন অসুস্থ হতো দাদির সাথে পারলে আমি নিজেও সেবা করতাম।
আমার কাছে এই যত্ন, দায়িত্ববোধ, শাসনের কোনো নাম ছিলো না। শুধু জানতাম ওকে আগলে রাখা, সঠিক পথে চালনা করা আমার কর্তব্য। দুই পরিবারের সবার আদরের ছিলো নাবিলা। আমার মায়ের একটা মেয়ের খুব শখ ছিলো। কিন্তু তা আর হয়নি। নাবিলাকে তিনি নিজের মেয়ে মনে করতেন। হয়তো মায়ের আদরের ও যত্নের ছিলো বলেই নাবিলা আমারো যত্নের ও আদরের হয়ে ওঠে। যদিও আদরের বহিঃপ্রকাশ করতে আমি নারাজ ছিলাম। বেশ কঠোরতা দেখাতাম।’
প্রয়াস থামলো। ওর ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসির রেখা। চোখদুটো যেন সেইসব দিনগুলি আবার দেখতে পাচ্ছে মনের আয়নায়। অনুভব করতে পারছে অতীতের স্মৃতি। সবই প্রানবন্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে আবার। ওর চোখের খুশিটা জেসি দেখতে পেলো। পেলোনা শুধু নাবিলা। ও নিজের চোখ বন্ধ করে শুধু প্রয়াসের বলা কথাগুলো অনুভব করতে লাগলো। ওর প্রয়াস ভাইয়া ওকে নিয়ে নিজের অনুভূতির কথা বলছে! এও কি সম্ভব!
চলবে…
(গল্পটা কেমন হচ্ছে তা নিয়ে একলাইন মন্তব্য করে যাবেন।)