#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১৬
সকাল সকাল প্রয়াসের মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। শাহেদ সাহেব ওর জন্য মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছেন। সেই মেয়ে আর কেউ না জেসি। তিনি জেসি এবং প্রয়াসের ভালো বন্ধুত্ব দেখে ভেবে নিয়েছেন দু’জনের মধ্যে প্রনয়ের সম্পর্ক আছে। সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে শাহেদ সাহেব প্রয়াসকে ডাকলেন।
শাহেদ সাহেব কিছুটা শক্ত ও গম্ভীর মেজাজের মানুষ। প্রয়াস কিংবা পরিবারের প্রতি তেমন একটা যত্নবান তিনি নন। সায়মা বেগমের কাছে ছেলের দায়িত্ব দিয়ে তিনি নিশ্চিন্তে অফিস সামলে যাচ্ছে। প্রয়াসের মা মারা যাবার পরই মূলত সাংসারিক ঘোর প্যাঁচ থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছেন। দ্বিতীয় বিয়ে কিংবা সংসার সবই ওনাকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
হয়তো মানুষটা মারা যাওয়ার সাথে সাথে নিয়ে গেছেন শাহেদ সাহেবের সকল সাংসারিক অনুভূতি। কিন্তু নিজের জীবনের মতো প্রয়াসের জীবনকে হেলায় ভাসালে চলবে না। এইবার সময় এসেছে বাড়িটাকে সংসারে রুপ দেওয়ার। প্রয়াস খাবার টেবিলে বসে বাবাকে সকালের অভিবাদন জানালো। শাহেদ সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,
‘আমাদের এই ছন্নছাড়া জীবনকে এবার শক্ত গাথুনিতে বাধতে চাই আমি। পাত্রী যেহেতু পছন্দ করেই ফেলেছো তাহলে শুভ কাজে আর দেরি করার দরকার নেই। সংসারটা এবার একটু সুন্দর হোক।’
প্রয়াস বুঝতে পারলোনা বাবা কিভাবে জানলো পাত্রী পছন্দের ব্যাপারটা। তবে মনে মনে খুব খুশি হলো এই ভেবে যে বাবা তার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে প্রয়াস বাবাকে যেইনা নাবিলার কথা বলতে যাবে অমনি শাহেদ সাহেব বলে উঠলেন,
‘জেসিকে বলো ওর মাকে যেন আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাকিটা আমি সামলে নেব।’
প্রয়াস ভ্রু বিলাস করে জানতে চায়,
‘সামলে নেবে মানে?’
‘মানে তোমাদের বিয়ে নিয়ে কথা বলতেই তিনি বাংলাদেশে আসছেন নিশ্চয়ই!’
‘আমাদের বিয়ে নিয়ে কথা বলতে জেসির মা কেনো আসবেন। তিনি আসছেন নিজের বাবার বাড়িতে বেড়াতে। তাছাড়া আমাদের বিয়ের সাথে ওনার কি সম্পর্ক?’
‘তুমি তার মেয়েকে বিয়ে করবে অথচ তার কোনো সম্পর্ক নেই? বিদেশি ছেলে-মেয়েরা কি বাবা মাকে ছাড়াই বিয়ে করে?’
প্রয়াসের মাথায় বজ্রপাত ঘটলো ক্ষনেই। টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো সাথে সাথে।
‘তুমি কি বলছো বাবা। ওনার মেয়ে মানে জেসিকে আমি কেনো বিয়ে করতে যাবো?’ কিছুটা থেমে প্রয়াস আবার বললো,
‘সামহাউ তুমি কি এটা ভাবছো যে আমার এবং জেসির মধ্যে সম্পর্ক আছে?’
শাহেদ সাহেব কিছুটা থমকালেন। ভ্রু কুচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘সেটাইতো হওয়ার কথা। তোমরা সেভাবেই মেলামেশা করছো এবং সবাই তাই ভাবছে।’
প্রয়াস আবার ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। মাথার চুল টেনে ধরে নিজেকে ধাতস্থ করে শান্ত গলায় বললো,
‘আমি এবং জেসি শুধুই ভালো বন্ধু বাবা। আমাদের মধ্যে তেমন কিছুই নেই। তাছাড়া জেসি বিদেশি। সে ছেলে-মেয়েতে তফাৎ দেখে না বলেই ওভাবে মেলামেশা করে। তাই বলে বেশি কিছু ভাবার মতো কিছুই নেই আমাদের মধ্যে। ওর মা বিয়ের কথা বলতে আসছেন না। আর না আমরা একে অপরকে ভালোবাসি, আর না বিয়ে করবো।’
‘বন্ধু থেকেই ভালোবাসা হয় প্রয়াস। তাছাড়া তোমরা একে অপরকে জানো, বোঝো। তারপরও কেনো আপত্তি? নাকি অন্য কাউকে পছন্দ করো?’
‘সেটা সময় হলেই তোমায় জানাবো বাবা। কিন্তু প্লিজ! জেসি এবং আমাকে নিয়ে আর কিছু ভেবো না। সময়মতো আমিই সব জানাবো।’
শাহেদ সাহেব কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিলেন। ক্ষণকাল চুপ থেকে বললেন,
‘তুমি যা ভালো বুঝো। তবে বেশি দেরি যেন না হয়।’
____________
সকাল সাড়ে আটটা বেজে গেছে। নাবিলার ঘুম থেকে ওঠার নামই নেই। নয়নতারা বেগম আটটার দিকে একবার ডেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ফিরে গিয়েছেন। ভেবেছেন ঘুম ভাঙেনি। কিন্তু সাড়ে আটটায় সায়মা বেগম ডাকতে এসে কিছুটা ভয় পেলেন। নাবিলার ঘুম এতোটাও গাঢ় নয় যে একজন মানুষ এতোবার দরজা ধাক্কালেও খুলবে না বা জবাব দেবে না। ওয়াশরুমে থাকলেও এতোক্ষনে বেরিয়ে পড়তো। তাছাড়া ভেতর থেকে হু হা কোনো জবাবই আসছে না।
সায়মা বেগম এবার আরো জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। তারেক হোসেন একটু আগেই অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেছেন। সায়মা বেগমের ডাকাডাকিতে নয়নতারা বেগমও ভয় পেলেন। তিনি ছেলের নাম্বারে কল করলেন এবং সায়মা বেগম ছুটলেন প্রয়াসের বাড়ি।
প্রয়াস সবে রেডি হয়েছে অফিসের জন্য। জেসিকে মামা বাড়ি নামিয়ে দিয়েই সে অফিস যাবে। এমন সময় সায়মা বেগম উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসলেন প্রয়াসের সামনে। দ্রুতগামী নিশ্বাসের ওঠানামায় সায়মা বেগমের কথা গলায় আটকে আটকে বেরোলো। প্রয়াস বা জেসি কেউ বুঝলো না সায়মা বেগম আসলে কি বললেন। তবে বিপদের কিছু তা ওনার চেহারাই বলে দিচ্ছে।
প্রয়াস তাকে শান্ত হতে জোর করে টেনে সোফায় বসাতে চাইলে সায়মা বেগম প্রয়াসকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেললো।
প্রয়াসের এবার সত্যি ভয়ের মাত্রা বেড়ে গেলো।
‘কি হয়েছে মনি? তুমি শান্ত হয়ে আমাকে বলো।’
সায়মা বেগম কষ্ট করে উত্তর দিলো,
‘নাবিলা…’
বাকিটুকু বলা হলো না। প্রয়াস ছুটে গেলো নাবিলার নাবিলার বাড়ি। পেছনে ছূটলো সায়মা বেগম এবং জেসি। নাবিলার রুমের সামনে নয়নতারা বেগম কান্না করে একবার ছেলেকে জলদি ফিরতে বলছেন তো আরেকবার নাবিলাকে ডেকে যাচ্ছেন। প্রয়াসের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। প্রয়াস নিজে কয়েকবার জোরে জোরে ডেকে দরজা ধাক্কালো। দাদির উদ্দেশ্যে জানতে চাইলো,
‘কখন খেয়াল করেছো নাবিলা দরজা খুলছে না?’
নয়নতারা বেগম বললেন,
‘আটটার দিকে একবার ডেকে গিয়েছি খোলেনি। ভেবেছি ঘুমাচ্ছে। কিন্তু এখন বউমা ডাকতে এসে…’
নয়নতারা বেগম ঢুকরে কেদে উঠলেন। প্রয়াস চুল খামচে ধরে কিছুক্ষন ভাবলো। কাঠের মজবুত একটা দরজা সিনেমার মতো আর যাই হোক প্রয়াসের পক্ষে ভাঙা সম্ভব হবে না। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই হবে। হতে পারে রাতে জ্বর এসে নাবিলা জ্ঞান হারিয়েছে। খারাপ ভাবনা ভুলে ভালো ভাবনাকে মনের মাঝে ঠাই দিলো প্রয়াস।
কিছু একটা মনে পড়তেই প্রয়াস সিড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে গেলো। প্রয়াস নিজের রুমের বারান্দায় এসে দেখলো নাবিলার বারান্দার দরজাটা খোলা। ভোরেও একবার দেখেছিলো। কিন্তু তখন ভেবেছিলো নাবিলা হয়তো জেগে গেছে তাই খোলা।
প্রয়াস বারান্দা টপকে নাবিলার বারান্দায় আসলো। পায়ের মাংসপেশিতে টান অনুভূত হলো খুব জোরে। দু’টো বারান্দার দূরত্বটা নেহাৎ নগন্য নয়। রুমে ঢুকে দেখলো বিছানা ফাকা সাথে ওয়াশরুমের দরজাও খোলা। প্রয়াসের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেলো। অবিন্যস্ত বিছানায় তাকিয়ে ফাকা ঢোক গিলল কয়েকবার। নাবিলা ঠিক আছেতো?
দাদির কান্নার আওয়াজ কানে যেতেই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। সবাই হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে গেলো। যখন বুঝলো নাবিলা রুমে নেই সবার কান্নার আওয়াজ বেড়ে গেলো। জেসি এসে চুপচাপ প্রয়াসের মুখের দিকে তাকালো। প্রয়াস চোখ বন্ধ করে ভাবছে। যে মেয়ে গাছে উঠতে পারে না সে আর যাইহোক বারান্দা বেয়ে নিচে নামা অসম্ভব।
প্রয়াস আরেকবার চোখ বুলালো ঘরটায়। অগোছালো বিছানা, বেডসাইড টেবিলে আধখাওয়া একটা পানির গ্লাস। গ্লাসের ওপরের ঢাকনাটা নিচে পড়ে আছে আছে এবং গ্লাসটাও একদম শেষ সীমানায়। আরেকটু হলে পড়ে যাবে। অন্ধকারে হাতরালে হুট করে হাত লেগে এমন হয়ে যেতে পারে। এখন একটাই উত্তর নাবিলার উধাও হয়ে যাওয়ার। কেউ ওকে তুলে নিয়ে গেছে। সেই কেউটা যে অয়ন ছাড়া কেউ নয় সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই প্রয়াসের। তবে গ্লাসটা পড়ে গেলে হয়তো শব্দ শুনে সাথে সাথেই নাবিলার মা ছুটে আসতে পারতো। আর নাবিলাকে নিয়েও বেশি দূর যেতে পারতো না অয়ন।
প্রয়াসের রাগ হলো। প্রচুর রাগ হলো। পুরো এক সপ্তাহ নাবিলার বারান্দার দরজা বন্ধ দেখে প্রয়াস ভেবেছিলো কালও বন্ধই থাকবে৷ কেননা রাত সাড়ে দশটায় প্রয়াস একবার দেখে গেছিলো নাবিলার বারান্দার দরজা বন্ধ। তাই আশা ছেড়ে ঘুমাতে চলে যায়। তারপর কখনই বা নাবিলা দরজা খুললো আর কখনইবা কেউ ঢুকলো প্রয়াসের অজানা। তাছাড়া মেইন গেইট পেরিয়ে কেউ ঢুকবে কি করে। প্রয়াস সবাইকে রুমে রেখে ছুটে চলে গেলো দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করতে।
দুইবাড়ির একটাই প্রবেশ পথ করেছে শাহেদ এবং তারেক হোসেন। সেই গেইটে দুইজন দারোয়ান কাজ করে। একজন শামীম, প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি বয়স তার। অন্যজন হাবিবুল মিয়া। প্রায় বৃদ্ধ বলা যায়। শামীম দিনের বেলা এবং হাবিবুল মিয়া রাতের ডিউটি করে সবসময়। তাদের থাকার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থাও আছে। প্রয়াস গেইটে গিয়ে যথারীতি শামীমকে পেলো। শামীম প্রয়াসকে সালাম প্রদান করতেই প্রয়াস উত্তর দিয়ে বললো,
‘রাতের ডিউটি কে করেছে?’
‘ হাবিবুল ভাই করছে ছার। ক্যান কোনো ঝামেলা হইছেনি?’
প্রয়াস তার প্রশ্ন এড়িয়ে বললো,
‘হাবিবুল চাচা কি রুমেই আছে?’
‘হ ঘুমাইতাছে। আজকে সকালে আমার ডিউটি শুরু হওনের আগেই দেহি ঘুম দিছে গিয়া।’
প্রয়াস আর দেরি না করে হাবিবুল চাচার রুমের দিকে ছুটলো। পেছনে পেছনে জেসিও এসে পড়েছে। শামীম কিছুই বুঝলোনা এমন করার। তবে কিছু একটা হয়েছে এবং সেটা গুরুতর তা বেশ বুঝতে পারলো।
হাবিবুল এবং শামীম একটাই রুমে ভাগাভাগি করে থাকে। তাদের খাবার সায়মা বেগম পাঠায় নিয়ম করে। বর্তমানে খালি গায়ে বিছানায় উপুর হয়ে ঘুমাচ্ছে হাবিবুল মিয়া। দরজা হালকা ভেজানো। প্রয়াস ধরাম করে দরজা খুললে হাবিবুল ঘুম চোখে তাকালো। প্রয়াসকে দেখে হুড়মুড় করে উঠে বসে গায়ে শার্ট চাপাতে লাগলো। লোকটার চুল, দাড়ি সব পাকা এবং তাতে মেহেদি দেওয়া। প্রয়াস ক্রোধিত কন্ঠে বললো,
‘রাতের ডিউটিতে তো আপনিই ছিলেন চাচা।’
হাবিবুল মিয়া হকচকিয়ে গেলো। তার ঘুম প্রয়াসের কথায় পুরোপুরি ছুটে গেছে। তুতলিয়ে উত্তর দিলো,
‘হ..হ বাজান। আ..আমিই আছিলাম রাইতের ড..ডিউটিতে।’
‘বাড়ির দিকে কি আপনি সত্যিই খেয়াল রেখেছিলেন?’
হাবিবুল মিয়ার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো কথাটা শুনে। তার অন্তরাত্মা পানি শূন্য হয়ে গেলো। মুখের রঙও ফেকাসে হয়ে গেছে কথাটা শুনে।
চলবে…