#এবরশন
পর্ব সাত
লিখা –মিনহাজ মাহমুদ
.
রিভা সহ ওর ভাই ভাবি সকালের খাবার খাচ্ছে টেবিলে । কারো মুখে কোনো কথা নেই । হঠাৎই কলিংবেলের আওয়াজ । রিভার ভাবি উঠে গিয়ে দরজা খুললেন । দরজা খুলে রিভার ভাবি বড় ধরণের শক খেলেন । তিনি কিছুতেই এটা আশা করেননি । সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে তিনি এখনে কখনোই আশা করেননি । রিভার ভাবি একটু ঘোরের মধ্যেই চলে গেলেন ।
লোকটা রিভার ভাবিকে ক্রস করে ভেতরে ঢুকলো । লোকটা মিনহাজের বাবা । মিনহাজের বাবাকে দেখে রিভা ও তার ভাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো । তারাও বড় একটা অবাকের মধ্যে পড়লো । উনি এখানে কেন ?
মিনহাজের বাবা ,রিভা ও রিভার ভাই ভাবি ড্রয়িং রুমে বসে আছে । মিনহাজের বাবা অস্বস্তি ছেড়ে বললেন
-যত টাকা লাগে আমি দিব । আপনারা প্লিজ না করবেন না ।
রিভারা আবার অবাক হলো । কারণ রিভার এই ঘটনা তো মিনহাজের বাবা জানার কথা না !
মিনহাজের বাবা আবার বললেন
-অবাক হবেন না । আরিফ আমাকে সব বলেছে । আর আমি চাই মিনহাজের শেষ ইচ্ছা রাখতে ।
রিভারা আবারও অবাক হলো! মিনহাজের শেষ ইচ্ছা কি ?
রিভার ভাই বলল
-আপনার কথা কিছুই বুঝলাম না ।
মিনহাজের বাবা দুঃখ ভরাক্রান্ত মনে বললেন
-মিনহাজের চিঠিতে রিভার সম্পর্কে কিছু বলেছিল । আমি তা আর বলতে চাচ্ছি না ।
মিনহাজের বাবা রিভার ভাইয়ের হাত ধরে বললেন
-প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না । এমনিতেই ছেলের এই অবস্থায় আমি খুব ! মিনহাজের বাবা আর কথা বলতে পারলেন না । হু হু করে কেঁদে উঠলেন ।
রিভা উঠে দাঁড়ালো । বলল
-বেঁচে থেকে কি হবে আর ? তার চেয়ে মরে যাওয়ায় ভালো । আর যার সাথে বাঁচতে চেয়েছিলাম সেই তো নেই । কি দরকার এই জীবনের ! জীবনের শেষ মূহুর্ত আমার জন্য অপেক্ষা করছে । আমি চাই না তাকে ফিরিয়ে দিতে । রিভা মিনহাজের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি দয়া করে এই সম্পর্কে আর কিছু বলবেন না ।
রিভার কণ্ঠ স্বর খুব কঠিন । চোয়াল জোরা শক্ত!
মিনহাজের বাবা রিভার হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল
-মা আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না । মিনহাজের সাথে তোমার যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে । মিনহাজ তোমার সাথে চরম অন্যায় করেছে । যার ফল হয়তো আল্লাহ তাকে দিয়েছে । মিনহাজের ব্যাপারটা তুমি আমাকে একবার জানাতে পারতে , আমি তোমাকে পুরো মর্যাদা দিয়ে আমার পুত্র বধূ হিসেবে মেনে নিতাম । তুমি আমার কথা মেনে নাও মা । আমি তোমার হাত ধরে অনুরোধ করছি ।
-অনুরোধ !
রিভা তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিল । যে হাসির পিছনে লুকিয়ে আছে হাজারো বুক ভরা বেদনা ।
-অনুরোধ করেই কি সব কিছু হয় আংকেল ? আপনার অনুরোধ কি পারবে আমার সন্তানকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে ? আপনার অনুরোধ কি পারবে মিনহাজকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে ?যেখানে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ নেই , সেখানে থেকে কি হবে ।
রিভার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে । চোখের জল মুছতে ইচ্ছা হচ্ছে না রিভার । একটু থাকুক না !
মিনহাজের বাবা তবুও আবার বললেন
-তুমি দয়াকরে আমার কথা মেনে নাও মা !
রিভা উচ্চস্বরে বলতে লাগলো
– এটা অসম্ভব । আপনি চলে যান । এই বিষয়ে !
রিভা আর কিছু বলতে পারলো না । মাথা ঘুরিয়ে আকস্মিকভাবে পড়ে গেল । মেঝেতে পড়ে যাওয়ার কারণে মাথার এক কোণে একটু কেটে রক্তের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে । কেউ কোন কথা বলতে পারছে না । নিশ্চুপ হয়ে সবাই তাকিয়ে আছে । রিভার ভাই তটস্থ হয়ে রিভাকে কোলে তুলে নিল । মিনহাজের বাবার গাড়িতে করে হসপিটালে নেওয়া হলো ।
আয়ান আর তাহা ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলো । ডাক্তার জানালেন
-তাহা প্রেগনেন্ট !
বিয়ের পরের দিন বউয়ের প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা সহজে মেনে নেওয়া কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব না। তেমনি আয়ানের ক্ষেত্রেও অসম্ভব ! তবে একটা বিষয় ভালো হয়েছে , ডাক্তার জানেনা যে এদের গতকাল বিয়ে হয়েছে । তাহলে হয়তো দুজনেই প্রচণ্ড লজ্জা পেত ।
তাহা মুখ নিচু করে হাঁটছে । আয়ান বোকা বনে চলে গেছে । এখন ওর কি বলা উচিত ওর জানা নেই । আর আয়ানের কাছে সবচেয়ে অবাক ব্যাপার লাগছে যে ডাক্তার তাহাকে প্রেগনেন্ট বলায় তাহা কোনো রিয়েক্ট করলো না কেন ? তাহলে কি তাহা সত্যিই ! আয়ান আর ভাবতে পারছে না । মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে । একটা ডিপ্রেশন ভর করেছে মাথার মধ্যে । আয়ান তাহার দিকে তাকালো , তাহা মাথা নিচু করে হাঁটছে । চোখের কোনা বেয়েঁ লোনা পানি গুলো সাড়ি বেধে নামছে । তাহা আসলেই একটা মায়াবতী । কিন্তু এমন ঘটনা কোনো মেয়ের সাথেই শোভা পায় না ।
বাড়ি ফিরতেই আয়ানের বোন জিজ্ঞাসা করলো
-কিরে কি হয়েছে ? কোনো সমস্যা ?
তাহা রুমে চলে গেল । আয়ান ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে রইলো । আয়ানের হাত থেকে রিপোর্ট টা নিয়ে আয়ানের বোন পড়তে শুরু করলো । একটা রিপোর্ট দেখে তো আয়ানের বোনের চোখ কপালে উঠার উপক্রম !
রিপোর্টটা দেখার পর তিনি চিল্লাচিল্লি করে বাড়িটা মাথায় তুললেন ।
বাসার সবাই এখন একত্রিত হয়ে বসে আছেন । সবার একমত ,
-এই মেয়েকে কিছুতেই এই বাড়িতে রাখা যাবে না । যত টাকা লাগে লাগুক ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে হবে । তাহা দরজায় দাড়িয়ে সব শুনছিল । তাহার লাগেজ গোছানোই আছে । গতকাল মাত্র এসেছে । তেমন কাপড় বের করতে হয়নি । তাহা লাগেজটা হাতে নিয়ে বের হলো । চোখের কোণে জল । সবার সামনে দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেল । শুধু একবার তাকলো আয়ানের দিকে । মেয়েদের শ্বশুর বাড়িতে একটাই সম্বল থাকে । স্বামী ! প্রত্যেক মেয়েই শুধু স্বামীর দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকে শত কষ্ট সহ্য করেও । স্বামীকে আকড়ে ধরেই তাদের পৃথিবী । এক জোড়া গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড সঙ্গমে লিপ্ত হলে যতটুকু আপন হয় , তারচেয়ে বেশি আপন হয় দুটি অচেনা মানুষ তিনবার কবুল বলায় । হয়তো তেমনি তাহারও একটা মায়া ছিল আয়ানের প্রতি । আয়ান উঠে রূমে চলে গেল । এসব আলোচনা একদম অসহ্য লাগছে । তাহা আয়ানের বাড়ি ত্যাগ করেছে এতক্ষণে । বাসার সবাই খুশি । হয়তো আয়ানও ! খুশি হবেই বা না কেন ? আপদ নিজের ইচ্ছায় বিদায় হয়েছে এর থেকে বড় আর কি হতে পারে । তাহা স্টেশনে বসে আছে । একটু পরেই ট্রেন আসবে । হুইছেল দিতে দিতে একটা ট্রেন এসে স্টেশনে থামলো । এটাই তাহার গন্তব্যে যাওয়ার আগন্তুক । তাহা উঠে দাড়িয়ে লাগেজটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতেই একজন পরিচিত মানুষকে দেখে অবাক হলো । তাহা কোনোভাবেই এটা আশা করেনি । কয়েকবার চোখ ডলেও একই দৃশ্য পরিলক্ষিত হলো তাহার কাছে ।
ডাক্তার সাহেব রিভাকে অনেক সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করলেন । তাপর রিভার ভাইকে একপাশে আলাদা ডেকে নিয়ে বললেন
-আপনাকে তো সেদিনই গোপনে সব বললাম , আর নতুন করে কিছু বলার নেই । যত তাড়াতাড়ি পারেন ব্যবস্থা করেন । কন্ডিশন খারাপ ।
রিভার ভাই পাশের বেঞ্চে বসে পড়লো । তার হাঁটার শক্তি লোপ পেয়েছে । মিনহাজের বাবা রিভার ভাইয়ের পাশে বসে তটস্থ হয়ে বললেন
-কি বললো ডাক্তার ? বলেন দয়াকরে ।
-রিভার ব্রেইন টিউমার ! অনেক আগে থেকেই নাকি । সেদিনও ডাক্তার বলেছিল । কিন্তু সবার সামনে যা বলেছিল , ঠিক সবার অগচরেও তার বিপরীত বলেছিল ।
রিভার ভাই কেঁদে দিলেন । মিনহাজের বাবা বললেন
-আপনি শান্ত হন । আমি সব ব্যবস্থা করছি ।
রিভাকে অপারেশনের জন্য বাইরে নেওয়া হয়েছে । সেটা অবশ্য রিভার অগোচরেই । তবুও রিভার জানা ।
রিভা বেডে শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছে । বাইরের হসপিটাল গুলো বেশ উন্নত । পুরো রুমে এখন রিভা একা । কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে রিভা দরজার দিকে তাকালো । দরজার দিকে তাকিয়ে অবাকের উচ্চ ধাপে পদার্পণ করলো । মানুষটি তার খুব চেনা । রিভার জীবনে যেন খালি আকস্মিক কিছুই ঘটছে । এটাও যে ঘটবে তা সত্যিই আকস্মিক !
চলবে …
(বিতর্কিত মন্তব্য থেকে বিরত থাকুন । ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন । )
.
.
.