এবোরশন পর্ব শেষ

#এবরশন
পর্ব নয় / শেষ পর্ব
লিখা —মিনহাজ মাহমুদ
.
জানালার গ্ৰিল ধরে দাড়িয়ে আছে রিভা । বাইরের থেকে আসা হালকা বাতাসে রিভার চুল গুলো উড়ছে । সময়টা বিকেলের কাছাকাছি । রিভা অনুভব করলো কেউ তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে । রিভা মূহুর্তেই পিছু ফিরে অবাক হলো । অবাকের পরিমাণ অনেকখানি । একটু না ! খুব কান্না পাচ্ছে রিভার ! তবুও নিশ্চুপ ।
কান্না করলেই সব কিছুর সমাধান হয়না । রিভার এখন কান্না করার কারণ , রিভা অনুভব করলো কেউ তাকে জড়িয়ে ধরেছে কিন্তু পিছু ফিরে দেখলো কেউ নেই । পুরো রুমে রিভা শুধু একা । ছিমছাম পরিবেশ রুমের মধ্যে । রিভার প্রতিটি নিঃশ্বাসও যেন দূর থেকে শোনা যাচ্ছে ।
অপারেশনে বাঁচার সম্ভাবনা কম থাকলেও রিভার অপারেশন সাকসেস হয়েছে । কয়েক মাস বাদেই দেশে ফিরলো রিভা সহ ওর ভাই ও ভাবি ।
আয়ানের চোখ দিয়ে অনবরত জল বের হয়েই যাচ্ছে । কষ্টটাও ক্রমেই বাড়ছে । কোথা থেকে যেন একটা গান ভেসে আসছে, আয়ান না চাইতেও আওয়াজ টা আয়ানের কানের আশপাশে ঘুরাঘুরি করছে ।
ভালোই ছিলাম তোরে ভালো না বেসে
তোর সুখের বলি হলাম আমি অবশেষে,
ভালোবাসার বিনিময়ে কষ্ট পেলাম
মন পিঞ্জরের পোষা ময়না আমি হারালাম !
তুই ভালো না মেয়ে , তুই ভালো না
ভালোর মুখোশ পড়ে ছিলি
চেনা গেল না !
। কিছুক্ষণ পর আয়ান অনুভব করলো তার কাধে কেউ হাত রেখেছে । আয়ান তাহা ভেবে খুশিতে পিছু ফিরেই অবাক হয়ে গেল ! আয়ানের মনে হচ্ছে সব ঠিকঠাক থাকলেও কি যেন ঠিক নেই ।
আয়ানের সামনে তাহা দাঁড়িয়ে আছে । তাহার চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে । চোখে মুখে প্রচণ্ড আবেগ ভর করেছে । জীবনের কিছু সময় মানুষ বুঝতে পারে না তার তখন কি করা উচিত । ঠিক আয়ানের তাই হয়েছে ‌ । তবে আয়ান না চাইতেও তাহা আকস্মিক ভাবে আয়ান কে জড়িয়ে ধরলো ।
তাহার চোখের জলে আয়ানের টিশার্ট ভেজাচ্ছে । তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই কারো ।
আয়ান আর তাহার গল্প এখানেই শেষ করা হচ্ছে । যদিও তাদের জীবনের ভয়াবহতা এখনও সামনে আসেনি । তবুও আর এই এবরশন গল্পে তাহা আর আয়ান চরিত্র তুলে ধরা হবে না ।
মিনহাজের বাবাকে ডেকে ডাক্তার সাহেব বললেন
-দেখুন, আপনি যেটা করেছেন সেটা আসলেই একটা হাস‍্যকর ব‍্যাপার । কারণ একজন কোমা অধিভুক্ত পেশেন্ট কে আমরা সর্বোচ্চ দুইমাস কোমাতে রাখি । কিন্তু আপনি সেখানে জেদ করে দুইবছরের বেশি সময় রেখেছেন । এতে শুধু আপনার সম্পদ নষ্টই হবে তাছাড়া কোনো ফল পাবেন না । আমি বলিকি এবার জেদটা কোমান । মরা মানুষের জন্য অপেক্ষা করা শুধুই অনর্থক । আপনি কি হূমায়ন আহমেদ এর উক্তি জানেন না ! তিনি তার অপেক্ষা উপন্যাসে বলেছেন
-মানুষের শুধু অপেক্ষা সকল জীবীত মানুষের জন্য । মরা মানুষের জন্য কেউ অপেক্ষা করে না । আপনি কেন এমন করছেন এটাই আমার বোঝার বাইরে ।
মিনহাজের বাবা হু হু করে কেঁদে দিলেন । তার চোখের কোণা বেঁয়ে স্বচ্ছ পানি গড়িয়ে পড়ছে । তিনি একটু শান্ত হয়ে বললেন
-ডাক্তার সাহেব , আমি টাকা দিয়ে কি করবো ! আমার সকল টাকার বিনিময়ে আপনি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন । আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে মিনহাজ । আর আজ আমার চলে যাওয়ার কথা ছিল । কিন্তু ও কিভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে আর আমি বাবা হয়ে এটা কি করে মেনে নিব বলেন । মিনহাজের বাবার কান্নার শব্দটা বেড়েছে । অনেকটা ।
ডাক্তার সাহেব চশমা টা খুলে চোখ মুছলেন । তিনি বললেন
-আমি জানি , আপনার কষ্টটা আমি বুঝি ।হয়তো আপনার জায়গা আমি থাকলে আমিও আপনার মতোই অস্বাভাবিক আচরণ করতাম । কিন্তু কি করার আছে বলেন । নিয়তি তো আর কেউ বদলাতে পারে না । নিয়তির জালে আমরা সবাই আটক ।
ডাক্তার সাহেব আবার বললেন
-মিনহাজের ফিরে আসার সম্ভাবনা 1% ছিল । তাও এখন আর আমরা দেখতে পাচ্ছি না । তাই আজই মিনহাজকে কোমা থেকে বের করতে চাচ্ছি ।
ডাক্তার সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না । চোখ মুছতে মুছতে রুম ত‍্যাগ করলেন । মিনহাজের বাবার কান্নার বেগ বেড়েই চলেছে ।
সন্ধ্যায় সবাই হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে । মিনহাজের মা কিছুটা সুস্থ হলেও মিনহাজকে দেখে আজ আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন । ওনাকে স‍্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে । মিনহাজের মা বাদে সবাই মিনহাজের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে । ডাক্তার সাহেব আর সময় নষ্ট করলেন না । অক্সিজেনের নলটা খুলে দিলেন ।
কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দে সবাই সেদিকে তাকলো । ঘটনার আকস্মিকে সবাই অবাক । রিভা মেঝেতে পড়ে গেছে । মনে হচ্ছে সেন্সলেস হয়েছে । রিভার মাথার পিছন সাইডে রক্তের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে । রিভাকে দ্রুতই চিকিৎসার অধীনে নেওয়া হলো । তেমন কোনো সমস্যা হয়নি । মাথায় হালকা চোট পেয়েছে ‌ । রিভার জ্ঞান ফিরলো পরের দিন দুপুরে । ততক্ষণে মিনহাজের জানাযা কার্যক্রম শেষ হয়ে গেছে ।
রিভা জ্ঞান ফিরেই পাশে ওর ভাবিকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বলল
-মিনহাজ কোথায় ? আমি ওর কাছে যাবো ! আমাকে নিয়ে চলো প্লিজ ।
ভাবি কোনো কথা বলছে না । রিভা আবার বলল
-ভাবি কথা বলছো না কেন ? আমাকে নিয়ে চলো মিনহাজের কাছে । ওর সাথে আমার অনেক জরুরী কথা আছে । আমি ওর কাছে যাবো । ওই ভাবি ।
রিভার ভাবির চোখে পানি । তিনি কোনো কথা বলার ভাষা পাচ্ছেন না । এখন কি বলা উচিত । রিভা ওর ভাবির হাত ধরছে , মুখে হাত দিচ্ছে , রাগ দেখাচ্ছে , একদম পাগলের ন‍্যায় আচরণ করছে । আর মুখে বলেই চলেছে ,মিনহাজের কাছে যাবো । রিভা এবার কেঁদে দিয়ে বলল
-ভাবি , আমাকে মিনহাজের কাছে নিয়ে চলো প্লিজ । আমি ওকে শেষ বারের মতো একবার দেখতে চাই । ওকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে চাই । ও ভাবি , নিয়ে চলো না !
রিভা চোখের পানি মুছে সিরিয়াস কণ্ঠে বলল
-ঠিক আছে তুমি যখন নিয়ে যাবে না । আমি একাই যাচ্ছি ।
রিভার ভাবি বলল
-দেখ পাগলামি করিস না । একটু শান্ত হও । আমার কথা বুঝতে চেষ্টা কর । সব ঠিক হয়ে যাবে বোন । একটু শান্ত হও ।
-আমাকে আগে মিনহাজের কাছে নিয়ে চলো । আমি ওকে দেখবো ভাবি ।
-ওর আর দেখার মতো অবস্থায় নেই । ওর জানাযা সকালেই শেষ হয়েছে । তুই একটু শান্ত হও । তোকে পরে নিয়ে যাবো ।
রিভা জোরে একটা চিৎকার দিল । কেঁদে কেঁদে বলল
-না ভাবি ,আমি ওকে দেখবোই । ও আমার সাথে কথা না বলে যেতে পারে না । আমি মানিনা । আমি এখনি যাবো ।
রিভা দৌড়ে যেতে নিলেই ততক্ষণে কয়েকজন নার্স এসে রিভাকে জোর করে একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে শুইয়ে দিল । একটু পরেই রিভা শক্তি হারিয়ে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেল ।
কয়েকদিন পরে রিভাকে রিলিজ করে দিল । রিভা এখন বাসায় মোটামুটি সুস্থ ।
রিভার ভাই অফিস থেকে ফিরে গেটের সামনে বড় ধরনের ভীড় লক্ষ্য করলেন। মানুষ কি যেন দেখছে । চারিদিকে ঘিরে মাঝখানে একটু ফাকা জায়গা রেখে মানুষ কি করছে ?হয়তো কোনো জাদু খেলা হবে । তিনি এসব পাত্তা না দিয়ে বাসার ভেতরে যেতে অগ্ৰসর হলেন । কিন্তু গেটের কাছে আসতেই একটা কান্নার আওয়াজ তিনি শুনতে পেলেন । ওই জড়ো মানুষের মাঝখান থেকেই কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে । কণ্ঠটা খুব পরিচিত ।
তিনি ভীড় ডেলে ভেতরে গেলেন। দেখার সাথে সাথে স্বজন বেদনায় তার মনটা কান্নায় ভেঙে পড়লো । রিভা রক্ত মাখা শরীরে শুয়ে আছে । পাশে রিভার ভাবি বসা । তিনি নিস্তেজ হয়ে কাঁদছেন। রিভার ভাই দৌড়ে রিভার লাশটা বুকে জড়িয়ে ধরলো । হাও মাও করে কাঁদতে শুরু করলেন ।
-ওরে বোন তুই আমাদের ছেড়ে কেন চলে গেলি । তোকে তো কখনও কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত করিনি । তুই আমার সাথে শেষ বারের মতোও কথা বললি না । আমি এখন বোন পাবো কোথায় রে । আমি প্রতিদিন বাসায় ফিরে কার সাথে গল্প করবো রে । তুই কেন এটা করলি ।
জড়ো হওয়া মানুষের চোখেও পানি ।
রিভা কেপে উঠলো । ভয়ে আতঙ্কে । এতক্ষণ ছাদে বসে ভাবছিল , সে যদি এখন ছাদ থেকে লাফ দেয় তাহলে একটু পরে কি ঘটতে পারে । ওর ভাই অফিস থেকে এসে নিশ্চয় কান্না কাটি ক‍রবে ! একটু না অনেকখানি । তারপরও রিভার আর এই পৃথিবীতে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে না । মরে যাওয়ায় শ্রেয় । কিভাবে বাচঁবে রিভা !
মিনহাজের কথা সারাক্ষণ মাথায় ভোঁ ভোঁ করে ঘোরে । মিনহাজের অস্তিত্ব বুঝতে পারে রিভা । অতীতটা ইদানিং বড্ড জ্বালাচ্ছে । নাহ এভাবে আর বেঁচে থাকা সম্ভব না । রিভা উঠে দাড়ালো ‌ । আস্তে আস্তে ঠিক ছাদের একদম কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো । নিচে পিচ ঢালা রাস্তা । রাস্তায় গাড়ি গুলো মূহুর্তে দৃষ্টি সীমিনা অতীক্রম করছে । রিভা দুই হাত মেলে ধরলো ‌ ‌ । চোগ বন্ধ করে দিল এক লাফ ।
মুহূর্তেই তিন তলার ছাদ থেকে নিচে আছড়ে পড়লো রিভা । মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে । একটু মাথাটা তুলতে চেষ্টা করলো । দূর থেকে একটা ট্রাক ছুটে আসছ । তার একটু পাশেই রিভা দেখলো মিনহাজ তার দিকে এগিয়ে আসছে । মুখে একটু হাসি ।মিনহাজ আসার আগেই মালবাহী ট্রাক এসে রিভাকে চাপা দিয়ে গেল ‌ । রিভা আর মাথা তুলে উঠতে সক্ষম হলো না ।
হয়তো এটাই রিভার জীবনের প্রাপ্তি । একটু পরে হয়তো রিভার ভাবনা গুলোই বাস্তবে পরিণত হবে । রিভার ভাই অফিস থেকে ফিরবে । ওকে জড়িয়ে ধরে বিনিয়ে বিনিয়ে কান্না করবে ইত্যাদি ‌ ‌। রিভার জীবনের পূর্ণতা অপূর্ণতা সবই হয়তো আকাঙ্ক্ষা । তাতে কি , যা চেয়েছে তাতো পেয়েছে !
হয়তো যায় তাকে ছাড়া বাঁচা
সেখানে থাকে না কোনো জীবনের আশা ,
ভেতরের যন্ত্রণা দেখে না কেউ
পাশে থাকা মানুষ টা , সেও।
এই ব‍্যাথা বোঝে না রক্ত
বোঝেনা অন‍্যকেউ কভু,
আশাহত কিছূ্ তরুণী বলবে
ভালোবাসি ভালোবাসি তবুও ।
(সমাপ্ত )
(বিতর্কিত মন্তব্য থেকে বিরত থাকুন )
.
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here