#ওই আকাশটা আমার ছিল
#রোকসানা আক্তার
পর্ব-১২
১৯.
অয়ন হাসপাতালে এসে পৌঁছায় সন্ধে সাতটার দিকে।ফাহাদ পৃথীর জ্ঞান ফেরার কথা সেই তিনটে জানায় কিন্তু অফিসের নানান ঝামেলায় আঁটকা পড়ে আর টাইম বের করতে পারে নি অয়ন।তাই দেরী হয়ে যায়।পৃথীর কেবিন রুমের সামনে আসতেই চোখ পড়ে স্বচ্ছ কাঁচের ওপাশ টায় ।পৃথী কেবিনের উপর দুই পা তুলে বাচ্চাদের মতো দুলে দুলে পিয়ারা বেগমের সাথে কথা বলছে আর খানিকক্ষণ পরপর মুখে মিষ্টি করে হাসি টানছে।পৃথীকে এখন পুরোপুরি সুস্থ্য দেখে অয়ন এবার চিন্তামুক্ত হয় আর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে।তারপর ফস করে একটা শ্বাস ছেড়ে ঘুরে রওনা দেয় ফাহাদের চেম্বারে দিকে।ভেতরে ঢুকেই,
“থ্যাংকস দোস্ত।রোগীকে এত তাড়াতাড়ি সুস্থ্য করে দেওয়ার জন্যে।খুব টেনশনে ছিলাম।”
ফাহাদ তখন ল্যাপটপে রোগীদের ফাইলগুলো ঘাটতেছিল।সে ল্যাপটপের দিকে চোখ স্থির রেখেই জবাব দেয়,
“আমিতো উছিলা মাত্র!সবটাই উপরওয়ালার কৃপায়।যাইহোক এবার বস।”
শেষ বাক্যটা বলেই ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকায়।অয়ন চেয়ার টেনে বসে শার্টের উপরের দুটা বোতাম খুলে হাওয়া খাওয়ার চেষ্টা করে।
“খুব ক্লান্ত,তাই না?”
“অনেক!অফিসে আজ যা চাপ ছিল না বলার বাহিরে।সারাক্ষণ মানুষের এই অভিযোগ আবার ওই অভিযোগ,কেউ এর মাথা ফাঁটিয়ে দিছে ,কেউ আবার ওরে হুমকি দিছে হ্যানত্যান মানুষের।মাথায় আর নিতে পারতেছি না রে ভাই!”
“তুই ত গ্যাংস্টার।বেচারা বিপদে পড়লে তোর কাছে না এসে আর কার কাছে যাবে,বল?কারণ তুই ই একমাত্র ব্যক্তি যাকে সবাই ভয় করে!আর তোর ভয়ের চোটে কিছু অসহায় মানুষও কারো অত্যাচার থেকে রেহাই পায়।”
“তুই ভয় করিস আমাকে ?”
“নাহ।আমি তোকে কেনো ভয় করবো তুই ত আমার বন্ধু!বন্ধু যদি বন্ধুকে ভয় পায় তাহলে সেটা বন্ধু না শত্রু। ”
অয়ন এ’কথার পিঠে একটা মৃদু হেসে দেয়।অত্যন্ত নরম সেই হাসি।হাসি থামিয়ে তারপর অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলে,
“তা রোগীর ওষুধগুলো লিখেছিস?”
” অনেক আগেই লিখা শেষ।এতক্ষণে হয়তো ওষুধগুলো কিনেও নিয়েছে।আচ্ছা একটা কথা এ ওই মেয়েটি না প্রায় দেড় মাস আগে যার র মাকে তুই একবার ব্লাড ডোনেট করেছিলি?”
“হুম।”
“আজ আবার মেয়েটিকে করলি।চিনিস নাকি মেয়েটিকে?”
অয়ন এবার মনে মনে বানিয়ে কথা বলার প্রস্তুতি নেয়।কারণ সব ত আর সবাইকে বলা যায় না, সে যতই ঘনিষ্ঠ হোক না কেন!
“হালকা পাতলা চিনি বৈকি!আমার এলাকার পাশেই বাসা।”
“ওহ আচ্ছা।তা মেয়েটির এ অবস্থা হলো কিভাবে?”
“একটা গুন্ডা তুলে নিয়ে যায়।তারপর এ অবস্থা হয়!”
“সো সেড!তুই ওই গুন্ডার খোঁজ পেয়েছিস?”
“পাই নি।তবে পেতে কতক্ষণ! ”
“তাড়াতাড়ি গুন্ডাটাকে খুঁজে বের করে যমের বাড়ি পাঠানোর চেষ্টা কর যাতে ব্যাটা জীবনে তার বাপের নাম ভু্লে যায়!মেয়েটিকে কেউ এভাবে মারতে পারে?মেয়েটার মুখটা দেখেছিস কেমন নিষ্পাপ নিষ্পাপ। দেখলেই মায়া লেগে যায়!ছাড়িস না ব্যাটাকে।আর সালাকে খুঁজে পেলে আমাকেও জানাইস।আমিও ব্যাটাকে মারবো!”
“দেখা যাক।”
ফাহাদ এবার চুপ হয়।এ’কথার পিঠে আর জবাব দেয় নি।সে অন্যকিছু বলতে উসখুস করে উঠে। কিন্তু কীভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।তবে খুব বেশি দেরী হলো না।অয়নের তীক্ষ্ণ চোখ তা ওমনি ধরে ফেলে। টপ করে বলে,
“কিছু বলবি ফাহাদ?”
ফাহাদ এবার ছলছল চোখে অয়নের দিকে তাকায়।
“হু, বল?দ্বিধান্তিত হোস না।বন্ধুর কাছে দ্বিধান্বিত হতে নেই।যাকে মন খুলে সব বলা যায় সে হলো বন্ধু।সো বলে ফেল!”
“পৃথীকে দেখতে তোর কেমন লাগে?”
সাডেন ফাহাদের এ কথায় অয়ন কিছুটা নড়ে ওঠে।অপ্রস্তুত গলায় বলে,
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন? ”
ফাহাদ কিছুটা ঝুঁকে এসে,
“দোস,পৃথীকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।আমি বললাম না আমি যতদিন আমার নিজের মনের মতন কাউকে না পাবো ততদিন আমি বিয়ের কথা মুখেই আনবো না!পৃথী হলো আমার সেই মনের মতন মেয়ে যাকে এতদিন আমি খুঁজেছি।ওর চোখ,মুখ,ঠোঁট,কথাবার্তা, চালচলন সব সবই আমার স্বপ্নে আঁকা!বিশ্বাস কর আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি।চরমভাবে প্রেমে পড়েছি।প্রথম যেদিন ওর মাকে হাসপাতালে এনে ভর্তি করায় সেদিনই ওকে আমার মোটামুটি ভালো লেগে যায়।হঠাৎ চোখের দেখা কাউকে ভালো লাগা এটা যেকোনো মানুষের সাথেই ঘটে ভেবেই পরক্ষণে তা থেকে ঝেঁড়ে দিই।কিন্তু আজ তা শুধু আমার মাথায় না,আমার সারা দেহে,অস্থিমজ্জায় গেঁথে গেছে।ওকে ছাড়া আমার চলবে না।ওকে আমার চাই ই চাই।প্লিজ তুই ওর মার সাথে আমার ব্যাপারটা বল।আমি যে ওকে পছন্দ করেছি এবং বিয়েও করতে চাই!প্লিজ!”
ফাহাদের মুখে এসব কথা শুনে মুহূর্তে অয়ন বিস্মিত হয়ে যায়।ফাহাদ শেষ পর্যন্ত এসে পৃথীকেই পছন্দ করে বসবে এটা অয়ন কেনজানি মানতেই পারছে না।কিছুতেই মানতে পারছে না। মুহূর্তে অয়নের বুকটা ভার হয়ে আসে।সে হায় তায় করে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে।ফাহাদকে কি উত্তর করবে সে জানে না!জানতেও ইচ্ছে হচ্ছে না।
“কিরে কিছুতো বলবি?”
অয়ন চোখবুঁজে এবার বড় করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে।নিজেকে কোনোমতো আগলে বলে,
“আচ্ছা আমি দেখি!এখন উঠলাম!”
বলেই অয়ন টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে হর্ণপায়ে বেরিয়ে আসে। বাইরে আসতেই রহিমার সামনে পড়ে।রহিমার হাতে ওষুধের স্লিপ।হয়তো কোনো ওষুধ বুঝতে সমস্যা হচ্ছে তাই তা ডাঃ ফাহাদকে দেখাতে এসেছেন। তিনি অয়নকে দেখেই উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে উঠেন,
“বাবা তুমি আজ সারাদিন কোথায় ছিলে?ডাক্তার ফাহাদকে দিয়ে তোমার নাম্বারে কতবার কল করিয়েছি।জানো?পৃথীর তিনটের দিকে জ্ঞান ফিরেছে?”
“হু,জানি আন্টি।”
“যাও পৃথীকে দেখে এসো।পৃথী আজ অনেকবার তোমার কথা বলেছে!”
“আচ্ছা,যাচ্ছি।”
“আচ্ছা!”
বলেই রহিমা ফাহাদের চেম্বারের ভেতর ঢুকে পড়ে।অয়ন পৃথীর কেবিনের কাছে আসে।পৃথীর সাথে কেনজানি তার দেখা করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।মনে হয় পৃথীর সাথে দেখা করলে খুব বেশি কষ্ট ফিল হবে।কিন্তু দেখা না করেও উপায় নেই।তাই আর অন্যকিছু ভাবলো না অয়ন।আলতো হাতে কাঁচ ঠেলে ভেতরে ঢুকে।পৃথী কেবিনে উপর বসে বসে পত্রিকা পড়ছে।অয়ন চারপাশে একবার চোখ বুলায়। পৃথী ছাড়া রুমে আর কেউ নেই। পিয়ারা বেগমও নেই।অয়ন এগিয়ে যেয়ে,
“হোয়াট’স আপ,পৃথী?”
পৃথী পত্রিকার দিকেই তাকিয়ে থাকে।অয়নের কথা তার কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে কিনা বুঝার জো নেই।
“এই যে হোয়াট’স আপ?”
তাও পৃথী তাকায় নি।অয়ন এবার বুঝতে পারে পৃথী যে ইচ্ছে করে এরকম করতেছে।কিন্তু কেন এরকম করতেছে?ভাবনার মাঝেই পৃথী কড়া চোখে অয়নের দিকে তাকায়।বলে,
“আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই!আপনি একটা পাষাণ!”
অয়ন এবার ভীষণ কষ্ট চাপা বুকে মনের অজান্তে হেঁসে দেয়।
“পাষাণ কেন?”
“এই যে সেই তিনটের দিকে জ্ঞান ফিরলো আর আপনি আসলেন মাত্র এখন!কত ঘন্টা পর আসলেন একটু টাইমটা দেখেন ত?”
“আসলে আমার অফিসে ঝামেলা ছিল।তাই দেরী হয়ে গেছে।”
“এত এক্সকিউজ আমি শুনবো না!”
“তাহলে কি শুনবে?”
বলেই অয়ন উত্তর জানার অধীর আগ্রহে দুইহাত ভাঁজ করে সরু হয়ে দাঁড়ায়।কিন্তু পৃথীর থেকে এ’কথার জবাব আসে নি।সে অন্য একটা কথা টানে,
“থ্যাংকস মিস্টার অয়ন!”
অয়ন ভ্যাবাচ্যাকা খায়।বলে,
“সাডেন থ্যাংকস কেন?”
“এই যে ওই গুন্ডাটার হাত থেকে আমাকে বাঁচালেন!”
“এটার জন্যে আবার ধন্যবাদ দিতে হয় নাকি?”
“হয় অবশ্যই হয়!”
“হয় না!”
“হয়!”
“হয় না!
“আপনি খুব ত্যাড়া!কথা প্যাঁচান খুব!”
অয়ন হেসে উঠে।অত্যন্ত বেদনা ভরা সেই হাসি!
চলবে…
(এই ফাহাদের আর দুনিয়ার কোনো মেয়ে পছন্দ হলে না পৃথীকেই পছন্দ হতে হলো?😐)