ওই_আকাশটা_আমার_ছিল পর্ব ২২

#ওই আকাশটা আমার ছিল
#রোকসানা আক্তার
পর্ব-২২

৩০.
অয়ন দুপুর নাগাদ বাসায় ফেরে।আলতো দরজা ঠেলে রুমে ঢুকতে নিলেই পৃথীর ক্ষীণ
কন্ঠস্বর কানে আসে,

“এদিকে আর এক পাও এগোবেন না।যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানেই থাকুন!”

মুহূর্তে অয়নের পা চলার গতি থেমে যায়।আর ড্যাবড্যাব চোখে পৃথীর দিকে সামনে দিকে তাকায়।অয়ন ভ্রু যুগল কুঁচকে বলে,

“কেন?”

পৃথী হাতে থাকা ফোনটা এক সপাটে পাশে ফেলে রেখে সুড়সুড় করে বিছানা থেকে নেমে অয়নের দিকে এগিয়ে আসে।দুইহাত দুই পাশে ভাঁজ করে এবার অয়নের দিকে কড়া চোখে তাকায়।এভাবে অনেকক্ষণ। তা দেখে অয়ন বলে,

“এভাবে তাকিয়ে আছো যে?”
“আপনি একটা চোর!”
“চোর!? কেন?”
“আপনার ফ্যামিলি আছে।ফ্যামিলিতে আপনার মা আছে।বাবা আছে।ভাই আছে।এবং ভাবী আছে।এ’কথাগুলো এতটা মাস আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছেন!তাদের সবার কথা আমাকে বললে কি এমন ক্ষতি হত আপনার!কী এমন ক্ষতি হত!বলুন!”
“এসব কে বলেছে তোমাকে?”
“যেভাবেই শুনেছি তা শুনেছি ত!এসব ত আর মিথ্যে না।বলুন মিথ্যে?”

অয়ন পৃথীর এ’কথার কোনো প্রতিত্তর করলো না!সোঁজা পৃথীকে পাশ কেঁটে হাতে থাকা ফোনটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বাথরুমে ঢুকে যায়।ঢুকেই ঝর্ণার সুুইচ টিপে শাওয়ারের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়!কয়েক সেকেন্ড এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই হঠাৎ অয়নের বুকের মাঝখানটায় চিনচিন করে ব্যথা করে উঠে। ছুটে যায় এতদিনের চেপে রাখা অতীতের কষ্টের কুন্ডলীতে—-বয়স তখন তার তেরো।পরিবারে তার মা-বাবা, দাদা-দাদী,সে এবং তার ভাই !পরিবারটার মোটামুটি ভালোই বলা চলে। তার বাবা সেকেলের একজন খ্যাতিমান জার্নালিস্ট ছিলেন।তিনি সত্যকে সত্য বলতেন।মিথ্যেকে মিথ্যে বলতেন।মিথ্যে দিয়ে কখনো সত্যকে বিবেচনা করতেন না।তার এই সৎ গুণাবলীতে আশপাশের মানুষ খুব প্রসংশা করতো।একজন সৎ,ন্যায়বান এবং সত্যবাদী জার্নালিস্টের অবশ্যই শত্রুর অভাব হয় না তা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন!অয়নের বাবারও ঠিক তাই হয়েছিল।দিনেক দিন উনার আশপাশে শত্রুর উৎপাত বেড়ে যেতে থাকে।কেউ এসে উনাকে ধমকিধামকি দেয়। কেউ এসে মেরে ফেলার থ্রেট দেয়। তো কেউবা আবার এসে পরিবারের সুরক্ষার কথ তুলে ভয় দেখায়।কিন্তু অয়নের বাবা মোটেও নড়বড়ে টাইপের লোক ছিলেন না।তিনি সবার সব ভয়ডর উপেক্ষা করে আগের মতনই সদা সত্য সংবাদ লিখে যেতে থাকেন।এভাবে লিখতে লিখতে হঠাৎ বড় রকমের এক প্রতিপক্ষের উপর লিখে ফেলেন।প্রতিপক্ষ ছিল এক জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে।সে এলাকার একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করে গাছের সাথে ফাঁস দিয়ে দেয়।আর সেটাকে আত্মহত্যা বলে চাপিয়ে দিতে চায়।কিন্তু সেখানে বিপত্তি ঘটায় অয়নের বাবা।সে ম্যাজিস্ট্রেট ছেলেকে সন্দেহ করে ফেলে।আর সন্দেহটা কিছুদিনের রিসার্চেই সাকসেস হয়ে যায় । লিখে ফেলে ” প্রিয়াকে আত্মহত্যা নয়,করা হয় ধর্ষণ”নিচে বিস্তারিত!বিস্তারিত পড়েই পুরো দেশের মানুষ হতবাক হয়ে যায়!আর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলের ফাঁসি চাই,ফাঁসি চাই বলে তুখোড় মিছিলে নামে সবাই!জনগনের মুখের উপর আইন আর চুপ করে থাকতে পারে নি।বাধ্য হয় ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলেকে এরেস্ট করতে।আর আদালতে তার ফাঁসির শুনানিও হয়ে যায়!এ নিয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রচন্ড রেগে যায়!বাঘের মতন গর্জে উঠে অয়নের বাবার উপর।সেই রাতে অয়নের বাবার অফিস থেকে বাসায় ফিরতে খুব দেরী হয়ে যায়।তা দেখে বাসার সবাই চিন্তায় অস্থির হয়ে যায়।বিশেষ করে অয়নের মা।এই শাশুড়ী মার দিকে ছুটে যান তো এই শ্বশুরের দিকে “আসতেছে না কেনো, আসতেছে না কেনো” বলতে বলতে পুরো ঘরময় পায়চারী করেন।কিছু সময় এভাবেই চলে।ঘড়িতে আরো একটা কাঁটা পার করে যেতেই পরে আর নিজেকে ধীরস্থির রাখতে পারেননি।ছুটে যান শ্বশুরের রুমে।

“বাবা,আমার খুব ভয় করতেছে….উনি তো কখনো এমন দেরী করেন না!প্লিজ বাবা আপনি একটু যান।গিয়ে দেখেন।কেন এতটা দেরী হচ্ছে। নিজেকে আর আশ্বস্ত রাখতে পারতেছি না।”

“বউমা তুমি চিন্তা করো না!আমি এখনই যাচ্ছি।আর টর্চ লাইটটা আমাকে দাও!”

বলেই অয়নের দাদা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ান।তরহর গাঁয়ে পান্জাবী এঁটে বউমার থেকে লাইটটা নিয়ে মেইন ডোরে পা রাখতেই তখনই কোথা থেকে ছুটে আসে অয়ন।
“দাদা আমি যাবো।দাদা আমি যাবো।”
এভাবে বলতে বলতে চিল্লাতে থাকে অয়ন।অয়নের দাদা প্রথমে দ্বিরুক্তি করেও পরে বউমা,

“বাবা অয়ন যেহেতু যেতে চায় নিয়ে যান।আর আপনি ত একা যাচ্ছেন সাথে একজন সঙ্গীও পেয়ে গেলেন।”

অয়নের দাদা হো হো হো করে হেসে উঠে নাতিকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বাসা থেকে বের হোন।দুজনে মেইন রোডে এসে দাঁড়ায়।আর চারপাশে তাকিয়ে রিক্সা খুঁজতে থাকে।এতরাতে বাস,সিএনজি পাবে না তারপরও যদি ভাগ্যের ফেরো যদি একটা রিক্সা পেয়ে যায়।কিন্তু দশমিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন কোনো রিক্সা চোখে পড়লো না তখন অয়নের দাদা একপ্রকারে আশা ছেড়ে দিয়ে অয়নকে বলেন,

“অয়ন,আমাদের হেঁটে যেতে হবে।দুই কিলোমিটার পত হাঁটতে পারবি?”
“সমস্যা নাই দাদু।পারবো।চলো।”
“আচ্ছা চল তাহলে।”

বলেই অয়নের দাদা অয়নকে নিয়ে তার বাবার অফিসের দিকে হাঁটা ধরলো। হাঁটতে হাঁটতে মাঝপথে হঠাৎ দমকা বাতাস শুরু হয়।সুনশান,মানবশূন্য এই পরিবেশে বাতাসের বেগের রেশ দেখে অয়ন অনেকটা ভয় পেয়ে যায়।সে তার দাদার পাঞ্জাবিটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“দাদা আমার খুব ভয় করতেছে।”
” কোনো ভয় নেই ভাই।আমি আছি….!”

বাকি কথায় দাদা আর মুখ মেলাতে পারলো না।তাকিয়ে দেখলো সামনে একজন লোক দাঁড়িয়।লোকটা কে জানে না।জানার উপায়ও নেই।কারণ এই গাঢ় অন্ধকারে লোকটাকে দেখা যায় স্পষ্ট। যা দেখা যায় কালো মূর্তি!অয়নের দাদা আবার মুখ খুলে “কে” বলতে যাবে কিন্তু তার আর সুযোগ হলো না।লোকটি পৃথিবী কাঁপানো একটা মারাত্মক পৈশাচিক হাসি দিয়ে দাদার ঠিক পেটের মাঝখানটায় একটা ধারালো ছুরি বসিয়ে দেয়।ওমনি দাদা কাঁত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।ছোট্ট অয়ন চিৎকার করে কেঁদে উঠে।তার এই চিৎকারে রাতের অন্ধকার,গাছের তুখোড় বাতাসও যেন কেঁদে উঠে।পরদিন সকালে অয়ন এবং দাদাকে পুলিশ বাসায় পৌঁছে দেয়।তবে অয়নের পরিবার অয়নকে পায় জীবিত, আর দাদাকে পায় মৃত!দাদার বিভৎস মুখের মৃত দেহটা দেখে দাদী আর ঠিক থাকতে পারে নি। সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোক করেন।হাসপাতালে নেওয়ার পথে দাদীও মৃত ঘোষিত হয়!সেদিন অয়নের বাবা দুই দুইটা তরতাজা প্রাণকে নিজ হাতে কবরে পাশাপাশি শায়িত করেন।দুইজনকে মাটি চাপা দেওয়া শেষে অয়নের বাবার সে কি কান্না!সেই কান্না কিন্তু পরে আর সেখানেই থেমে থাকে নি।তা আরো অন্যরূপে অস্বাভাবিকভাবে রূপ নেয়। তাও অয়নের উপর।হ্যাঁ অয়নের উপর!সেদিন তিনি বাসায় ফিরেই,

“আমার বাবাকে কে খুন করেছে?কে?তুই না লোকটাকে দেখেছিস?? ”

ছোট্ট অয়ন কোনো উত্তর করতে পারে নি।শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে কান্না করা ছাড়া!
“বল? কে?”

অয়ন তাও কিছু বলতে পারি নি।
“এই টুকু মনে করতে পারছিস না কে আমার বাবাকে খুন করেছ!?ওরে ছন্নছাড়া, ওরে কুক্ষাল তোকে আমি এভাবে নি বড় করতেছি?কতটা বলদ তুই!এ ত আমার জীবনে অনেক বড় সর্বনাশ ডেকে আনবে!এখনো সময় আছে খেয়াল করে বল কে আমার বাবাকে হত্যা করেছে!”

নাহ!এবারও অয়ন কিছু বলতে পারে নি।তা দেখে অয়নের বাবার খুব রাগ উঠে যায়।উনি দুই কদম এগিয়ে এসে ঠাস ঠাস করে এবার তার গালে চারটা চড় বসিয়ে দেন।উনার ওমন উগ্র আচরণে সেদিন অয়নের মা চরম অতিমাত্রায় অবাক হয়ে যান।আর অয়নের বড় ভাই ও!অবাক হবারই কথা!এত ঠান্ডা -শীতল-শুষ্ক মস্তিষ্কের একজন মানুষ এতটা উগ্র হওয়া যে কারো মনেই প্রশ্ন থেকে যাবে!তবে অয়ন দুইটা চড় খেয়েই যে তার বাবার থেকে বেঁচে গেলো তা নয়।বরং তারপর থেকে শুরু হলো অয়নের আরো কঠিন থেকে কঠিনতম দিন!অয়নের বাবা অয়নকে আগের মতন সেই স্নেহটা করতেন না।!অফিস থেকে ফিরলেই আগে যেমন অয়ন,নয়ন বলে দুই ভাইকে ডাকতেন।ডেকে দুইজনকে ক্যান্ডি,আইসক্রিম আরো কত কি দিতেন কিন্তু শুধুই নয়ন কে ডাকতেন।নয়নকেই ক্যান্ডি,আইসক্রিম যত যা আছে সব দিতেন!অয়নকে না।তা দেখে অয়নের মনটা একটু হলেও ভার হত।এমনকি একা একা রুমে বসে বসে খুব কাঁদতো।তার সব অয়নের মা দেখতেন!তিনি ছেলের পাশে এসে বসতেন।কাঁধে হাত রাখতেন।অয়ন সেই হাত সরিয়ে দিত আর বলতো,

“এই বাসার কেউ এখন আর আমাকে ভালোবাসে না।আচ্চা মা বলো ত?সত্যিই কি দাদা-দাদীর মৃত্যুর জন্যে একমাত্র আমিই দায়ী?”

অয়নের মা শুধু জবাব দিতেন,
“তোর দাদা-দাদী মারা যাওয়াতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে!তাই এরকম করতেছে।যখন তোর দাদা-দাদীর মৃত্যুর কথা আস্তে আস্তে ভুলে যাবে তখন ঠিকই তোকে আগের মতন কোলে টেনে নিবে!”

অয়নের আঠারো বছর কেঁটে গেলেও অয়নের বাবার অয়নকে আর আগের মতন কোলে টেনে নিল না।বিহেভিয়ার সেই আগের মতনই থেকে গেলো। কোনো পরিবর্তন হলো না ।অয়ন বারো বছর কালে ছোট্ট ছিল।কষ্ট পেলেও তা মায়ের ভালোবাসায় ভুলে যেত।কিন্তু আঠারে তে সে একজন কিশোর!আঠারো ত এদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না।হালকা আঘাতেও প্রতিঘাত করে!জেদটা একটু বেশি থাকে। শেষবার যখন তার বাবা আবার তার দাদা-দাদীকে টেনে তাকে কথা শুনাতে গেলো তখনই প্রথম সে তার বাবার মুখের উপর কথা ছুঁড়ে দিল,

“হ্যাঁ আমি বলদ,হ্যাঁ আমি কুক্ষাল,হ্যাঁ আমি বেয়াদব!দোহাই আল্লাহর এসব আমাকে আর বলো না।আমি আর নিতে পারছি না!আমি প্রায় বিরক্ত! চলে যাবো এই বাসা থেকে!”

“চলে যাবো এই বাসা থেকে” সেই কথাটা অয়নের জীবনে আজ অনেক বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে ।সে সেদিন সবার অগোচরে রাত বারোটায় বাসা থেকে পালিয়ে এসে আজ সাত সাতটা বছরের ব্যবধানে শহরের মস্ত বড় একজন গ্যাংস্টার হয়েছে।অথচ সেই যে চিরচেনা পরিবার তাদের কারো সাথই এখন আর কথা নেই।যোগাযোগ নেই!একসময় তার একটা পরিবার ছিল এটা যেন অয়ন এখন ভুলেই গেল বা ছিল এটাও মনে হয় না!চাপা একটা কষ্টে অয়ন শাওয়ারের মাঝে ফুঁপিয়ে একটা অস্ফুট কান্না করে উঠে!কান্নায় গড়িয়ে পড়তে থাকে পানি তা ঝর্ণার ধারার সাথে তৈরী হয় সহস্র ধারা!কত কষ্ট তার মনে!কত কষ্ট তার হৃদয়ে!কত কষ্ট তার এই বুকে!এই সবটাই কি তার পৃথী জানে?কষ্টের ভাবনাগুলো আবার বুকের বামপাশে চেপে রেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যে শাওয়ার শেষ করে বাথরুম থেকে বের হয়!বের হয়ে দরজার সামনের দিকটা দাড়াতেই পৃথী দমকা হাওয়ার মতন অয়নের বুকের উপর হঠাৎ ঝেঁকে যায়।

“কি ব্যাপার পৃথী?এরকম করতেছো কেন?”
“কিছু না!আপনার কষ্টগুলো শুনবো।বুকটা কি আরেকটা আমার কানের কাছে আনবেন?”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here