ওই_আকাশটা_আমার_ছিল পর্ব ২১

#ওই আকাশটা আমার ছিল
#রোকসানা আক্তার
পর্ব-২১

পরদিন সকালে অয়ন অফিসে চলে যায়।অবশ্যি অফিসে যাওয়ার কথা ছিল না কিন্তু অফিস থেকে দশটা রিফাতের কল আসে।সে জানায় অফিসে কয়েকজন অপরিচিত লোক এসে খুব ঝামেলা করতেছে।উল্টাপাল্টা কথা বলতেছে।এবং নানান রকমের হুমকিহামকি দিচ্চে।কিন্তু রিফাত লোকগুলোকে চেনে না বা লোকগুলোকে কখনো দেখেছে বলেও মনে হয়না।অপরিচিত লোক তার অফিসে এসে কেন ঝামেলা করবে এবং কী কারণে?এই প্রশ্নগুলোকে মাথায় ভনভন করতেই অয়ন আর এক মিনিটও দেরী করলো না।ছুটে গেলো অফিসের দিকে।তবে খালি পেঁটে বেরিয়ে পড়তে ধরেছিল কিন্তু পৃথী পথ আগলে দাঁড়ায়।সকালে খালি পেটে একদমই বের হতে না।প্রয়োজনে এক গ্লাস পানি খেয়ে হলেও বের হতে।আর কি বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলো না।কোনোমতে একটা স্যান্ডউইচ আর এক গ্লাস জোস খেয়েই বাসা থেকে বের হয়।

———————————-—
অয়ন চলে যাবার পর পৃথী রুমে আসে।এসে ফোন হাতে নেয়।ফোন নিয়ে বেলকনিতে এসে বসে।কিছুক্ষণ ফোনটা টিপে।টিপাটিপি শেষ করে ফোনটা আবার নিচে নামিয়ে রাখে।মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে।সকাল থেকেই খুব ধরা ধরা।ঘুম ঠিকমতোই গিয়েছে কিন্তু মাথাটা কেন ধরেছে তা জানে না পৃথী।তবে একটা কড়া চা খেলে মাথা ধরাটা সেরে যেত।ভেবেই পৃথী ফুলমতিকে ডাকলো।ফুলমতি ভেতরে এলো,

“জ্বী,আপা?কন? কী লাগবো?”
“এক কাপ আদা দিয়ে রং চা করে দিতে পারবে? ”
“জ্বী আপা পারমু। আপনি বহেন। এক মিনিটের মধ্যেই কইরা।নিয়া আসতেছি।”
“আচ্ছা। ”

ফুলমতি চা বানাতে তাড়াতাড়ি কিচেনে যায়।তার সাত মিনিটের মাথায় চায়ের কাপ হাতে আবার রুমে আসে।পৃথীকে কাপটা দেয়।

“আপা খান।কড়া কইরা চা টা বানাইছি।মাথাটা খুব ধরেছে না আপা? ”
“হু।”
“একটু টিপে দিব?”
“তার প্রয়োজন নেই।”
“জ্বী,আচ্ছা আপা।আর কিছু লাগলে ডাইকেন।আমি বাইরেই আছি।”
“আচ্ছা। ”

ফুলমতি বেরিয়ে যায়।পৃথী এবার মনোযোগ দিয়ে চা খায়।চা খাওয়া শেষ করে তা নিচে এসট্রে তে রাখে।তারপর চেয়ারের হাতলে ভর রেখে উঠার চেষ্টা করে।উঠে ভেতরে আসে।তারপর কাবার্ডের দরজা খুলে অয়নের জামা কাপড় গুলোতে চোখ বুলায়।ভেতরের জামাকাপড়গুলো কেমন অগোছালো ভাবে পড়ে আছে।ইদানীং তার শরীরটা ভালো না। তাই সবকিছু ঠিকমতো দেখারও সুযোগ হয়নি।আর এই গুরুচন্ডা ছেলেটা পড়েই কীভাবে জামাকাপড় গুলোকে রেখেছে একেবারে বস্তি বানিয়ে ফেলছে।ভেবেই পৃথী মনে মনে অয়নকে ছোট্ট একটা অভিমানী বকা দেয়!বকাটকা শেষ করে ড্রেসগুলো কাবার্ড থেকে বের করে।তারপর ড্রেসগুলো আস্তে আস্তে একটা একটা করে গুছিয়ে আবার কাবার্ডের ভেতর রাখতে থাকে।গোছগাছের মাঝেই ফুলমতি আবার রুমে আসে।

“আপা?”
“হু?”
“কোন এক মহিলা আইছে আপনার লগে দেহা করতে।”
“কে ?”
“চিনি না আপা।”
“ওহ।আচ্ছা আসছি।”

পৃথী সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে গেলে টুপ করে নজর পড়ে সোফার দিকে।গুটিসুটি মেরে সোফার উপর এক ভদ্র মহিলা বসে আছেন।ভদ্র মহিলার বয়স পাঁচ চল্লিশের এপারওপার।পড়নে উনার সাদা রঙ্গের শাড়ি।চুলগুলো খোপা করা।খোপা করা চুলগুলোর ফাঁকফোকর থেকে ফ্যানের বাতাসে কিছু ছোট্ট ছোট্ট সাদা চুল বেরিয়ে গেছে।ভদ্র মহিলার গায়ের রং সাদা উজ্জ্বল। তবে বয়সের পরিপক্কতায় তা ঢাকা পড়েছে।পৃথী নিচে নেমে সোফার দিকে এগিয়ে যায়। ভদ্র মহিলাকে সালাম করে।ভদ্র মহিলা সালামের জবাব নিয়ে ফের সামনে তাকায়।তাকাতেই চোখজোড়া উনার ছলছল করে উঠে।সাথে সাথে চোখের কিনারকানারে পানি এসে যায়।অত্যন্ত গভীর মনোযোগে পৃথীর দিকে তিনি কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে।

“কে আপনি?আপনাকে ত ঠিক চিনলাম না।”

ভদ্র মহিলার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার তেমন ভাবান্তর হলে না।তিনি পৃথীর দিকে আগের দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রইলেন।তা দেখে পৃথী কিছুটা উসখুস করে উঠে।ইনি তার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?আর এভাবে তাকানোর কারণ কি!কে ইনি?কী জন্যে এখানে এসেছ।পৃথীর হাজারো প্রশ্নর মাঝে ভদ্র মহিলা বলে উঠে,

“মা তুমিই কী অয়ন বাবার বউ?”

“অয়ন বাবা” শব্দ দুটি পৃথীর শুকনো কানে ঢুকতেই পৃথী এবার খানিকটা নড়েচড়ে উঠে।

“জ্বী।আপনি অয়নকে চেনেন?”

ভদ্র মহিলা এ’কথার পিঠে চুপ করে থাকে।প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
“তোমার শরীর কেমন আছে, মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তবে আপনি কে পরিচয়টা কি জানতে পারি দয়া করে?”
“জানবে পরিচয় অবশ্যই জানবে।আগে আমার পাশে এসে বসো।”

পৃথী ভদ্র মহিলার পাশে যেয়ে বসে।ভদ্র মহিলা পৃথীর ডান হাতটা উনার কোলের মধ্য নিয়ে অত্যন্ত নরম গলায় বলেন,

“আমি খুব স্বপ্ন দেখতাম আমার অয়নের একটা বউ হোক।একটা বাচ্চা হোক এবং সুন্দর একটা সংসার হোক।অয়ন ফিরে পাবে আগের মতন স্বাভাবিক জীবন।খুনখারাবি করবে না।লোকদের মারধর করবে না।কারো গলায় ছুড়ি ধরে টাকাপয়সা লুট করে নিবে না।একদম নিষ্পাপ শিশুদের মতন হয়ে যাবে।কেউ আর মুখ তুলে বলতে পারবে না অয়ন ছেলেটা খারাপ।জঘন্য খারাপ।মা আমার স্বপ্ন কি এখন সত্যি হয়েছে?তুমি পেরেছ আমার ছেলেকে ঠিক করতে?”

“আপনি অয়নের মা!!!?”

মহিলা এবারও চুপ হয়ে যায়।তবে চোখে ইতোমধ্যে পানির ঢেউ খেলা।যে কোনো মুহূর্তেই কেঁদে দিতে পারেন উনি।পৃথী ভদ্র মহিলার বামহাতটা খুব শক্ত করে ধরে মহিলাকে সামলানোর চেষ্টায় লেগে যায়।আরো কাছে এসে মৃদু কন্ঠে এবার বলে,

“আপনি আমার শাশুড়ী মা তাই না?এতদিন নিজেকে লুকিয়ে রেখে আমাকে কেন খুব কষ্ট দিয়েছেন, বলুনতো?আমার কি ইচ্ছে ছিল না আমার একজন শ্বশুর থাকুক।একজন শাশুড়ী মা থাকুক।ঝা থাকুক।ঝালাতি থাকুক।ননদ থাকুক।ননদাই থাকুক আরো কত কি!আপনার ছেলে নাহয় সব লুকালো আমার থেকে।কিন্তু আপনারা কেন দূরে থেকেছেন?”

ভদ্র মহিলা এবারও দমে যায়।
“বলবেন মা?”

এই “মা”ছোট্ট একটা শব্দেই ভদ্র মহিলার ভেতরের অন্ধ্রেরন্ধ্রে একটা অনুভূতি ছুয়ে যায় ।পৃথিবীর সব ভালোলাগা,ভালেবাসা আবেগ,মায়া -মমতায়ই যেন মেয়েটির এই ” মা”বলা শব্দটিতে একাকার করে দিচ্ছে ।খুব ইচ্ছে হয় মেয়েটিকে বুকের সাথে মেশাতে।প্রাণ খুলে তার মনের যত কালো রাগ,অভিমান,কষ্ট দুঃখ সব মেয়েটিকে বলতে! মা শুনতে পারছো?আমার ছেলেটা আজ সাত সাতটা বছর আমার বুক থেকে আলাদা হয়ে গেছে।আমি এক শূন্যতা ভরা কষ্টে আছি।একটিবারও আমার পরিবারের কেউ আমার ছেলেটাকে আমার বুকে এনে দিতে চায় নি!আমি কাঁদি।রোজ রাতই কাঁদি।কারো কানে আমার কান্না পৌঁছায় নি।তারা আমার বেহালিশ মনের অবস্থা তারা বুঝতে পারে নি!আমি আহত মা।চরমভাবে আহত।তুমি পারবে মা আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে? আমার খা খা শূন্য ভরা বুকটা পূর্ণ করে দিতে?পারবে মা পারবে?

চলবে….
(আজ আরেকটা পর্ব পেয়ে যাবেন।আর হ্যাঁ গল্পটা খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে আসছে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here