#কলঙ্ক
#২য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
বাবা-মা পাগলের মতো ছুটে এলেন হসপিটালে। আমার বাবা প্রাইমারি স্কুলের টিচার। এমনিতে সীমাহীন ধৈর্য্য বাবার। কিন্তু আজ বাবা কেমন জানি পাগলের মতো হয়ে গেলেন। হসপিটালে এসেই চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন,’কী হয়েছে আমার মার?কী হয়েছে?’
ডাক্তার সাহেব বললেন,’ভাই,অত উত্তেজিত হয়ে উঠছেন কেন?ভয়ের কিছু নাই। বরং
আপনার জন্য সুখবর আছে। আগে দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে আসুন গিয়ে। তারপর সুখবর শুনবেন।’
বাবা অবাক হয়ে বললেন,’মিষ্টি আনবো কেন?’
‘আগে নিয়ে আসুন না। তারপর বলছি। মেয়েকে নিয়ে টেনশন করবেন না।সে পুরোপুরি সুস্থ। মিষ্টি ছাড়া আপনাকে সুখবর দেয়া যাবে না!’
বাবা আলহামদুলিল্লাহ বলে মিষ্টি আনতে চলে গেলেন দোকানে।মা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তারের সামনে।
‘
বাবা মিষ্টি নিয়ে ফিরে আসার পর ডাক্তার বললেন,’আসুন। আমার সাথে আসুন আপনারা।’
বাবা-মাকে নিয়ে ডাক্তার আমার কাছে চলে এলেন। তারপর এসে বাবাকে বললেন,’আপনি নানা হতে যাচ্ছেন। এখন আলহামদুলিল্লাহ বলে মেয়েকে মিষ্টি খাইয়ে দিন!’
ডাক্তারের মুখ থেকে কথাটা শুনেই বাবার মুখটা কেমন মলিন হয়ে উঠলো। চোখ দুটো হয়ে উঠলো লাল,রাগী রাগী। সঙ্গে সঙ্গে বাবার হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট দুটো মাটিতে ঝপ করে পড়ে গেল।আর বাবা আমার কাছে এসে আমার দু গালে দুটো শক্ত চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,’ডাক্তার কী বলছে এসব?’
আমি চুপ করে রইলাম। শুধু চোখ থেকে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো ক’ফোটা গরম রংহীন জল।
বাবা আর কথা বললেন না।মিষ্টির প্যাকেটের মতো তিনিও ঝপ করে বসে পড়লেন ফ্লোরের উপর। এবার মা এলেন আমার কাছে। তারপর আমার চুল টেনে ধরে নাকে মুখে চড় বসিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন,’তুই আমার মেয়ে হয়ে এসব করেছিস আমি ভাবতেও পারছি না! ইচ্ছে করছে এক্ষুনি তোকে গলা টিপে মেরে ফেলি!’
ডাক্তার সাহেব এতোক্ষণ বিষয়টা বুঝতে পারছিলেন না। কিন্তু এখন ঠিকই বুঝতে পেরেছেন আসল ঘটনা।আসল বললেও ভুল হবে। তিনি হয়তো মনে মনে ধারণা করেছেন আমি বিবাহ বহির্ভূত কোন একটা ছেলের সাথে বেড শেয়ার করে কনসিভ করেছি।ডাক্তার সাহেবের মুখ কেমন লাল হয়ে যেতে দেখা গেল।
মা এবার আমার চুলে শক্ত করে টেনে ধরে বললেন,’কার সাথে এসব করেছিস বল?’
আমি কিছু বলতে পারছি না। ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে।মা আমার মাথার চুল আরো শক্ত করে টেনে ধরেছেন।যেন টেনে টেনে আজ ছিঁড়েই ফেলবেন আমার মাথার সবকটি চুল!
আমায় চুপ করে থাকতে দেখে মা আবার আমার গালে চড় বসিয়ে দিতে শুরু করলেন।
আমি এবার কেঁদে উঠলাম।
মা আমার মুখে তখন থুথু ছিটিয়ে দিয়ে বললেন,’হারামজাদি বেহায়া! লজ্জা শরম নাই তোর গলা ছাইড়া কান্নাকাটি শুরু করছস যে আবার!’
বাবা ফ্লোরের উপর বসা থেকেই মাথায় হাত দিয়ে টোকা দিতে দিতে বিলাপ করে বললেন,’এই কাজ করার আগে একটি বারও মনে পড়লো না তোর বাবার কথা?তোর বাবা যে এলাকার একজন আদর্শ শিক্ষক তা তো তুই ভালো করেই জানিস! মানুষ আমায় নিয়ে গর্ব করে বুক ফোলায়। চায়ের স্টলে আমায় ডেকে নিয়ে বসায়।চা বিস্কুট খেতে দিয়ে তারা বলে,স্যারের ছেলে মেয়ে দুইটা ফিরিশ্তার মতন।শহুরে থাইকা লেখাপড়া করে অথচ কী নম্র ভদ্র।দেখলেই মন গলে যায়।মন থাইকা আপনা আপনি দোয়া আসে!
এবার যখন ওরা শুনবে আমার মেয়ে বিয়ে শাদি ছাড়াই এই সর্বনাশ করেছে তখন এই প্রশংসা কোথায় যাবে?আমি মানুষের কাছে মুখ দেখাবো কী করে রে তূর্ণা? তূর্ণা কাজটা করার আগে তুই কী একটিবার ভেবেও দেখলি না তুই কার সন্তান!’
আমি কী করবো?কী বলবো? কাঁদছি।কান্নাছাড়া যে আমার কিছুই করার নাই এখন!
ডাক্তার সাহেব এবার বাবার একটা হাত ধরলেন। তারপর বললেন,’ভাই,মেয়েটা না হয় একটা ভুল করেই ফেলছে!এই যুগের মেয়েরা অত কিছু বুঝে না। তাছাড়া ওর বয়সটাই বা তেমন কী হয়েছে!বোঝ কম। এখন বিলাপ না করে,চিল্লাপাল্লা বন্ধ রেখে সমাধান খুঁজুন।এই দেশের মানুষ ভয়ংকর রকমের খারাপ।এরা যখন এরকম একটা ঘটনার আঁচ পাবে তখন দেখবেন সারা দেশে ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়াবে।জনে জনে বলবে অমুক মাস্টরের মেয়ে এই কুকাম করছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ!’
ডাক্তার সাহেব ভুল বলেননি। কিন্তু তার কথাগুলো শুনেও আমার খারাপ লাগছে।আমি তো আর অবৈধভাবে সম্পর্ক স্থাপন করে কিছু করিনি। বিয়ে করেছি। কিন্তু লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়েটা যে আমাদের সমাজের কাছে এখনও ভালো কিছু নয়।আর ভালো কিছু হবেই বা কী করে? এইসব লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়ের ভবিষ্যতটাই বা কী?এই যে আমি লুকিয়ে বিয়ে করলাম। এখন আমার বর উধাও। বিসিএস দেয়ার নাম করে যোগাযোগ বন্ধ রেখে বর চলে গেছে আমেরিকা। পেটে দিয়ে গিয়েছে এক সন্তান। এখন এই সন্তানের ভবিষ্যতই বা কী?
‘
ডাক্তার কেবিন থেকে চলে গিয়েছেন। আমার শরীর এখন সুস্থ। মায়ের কাছে আমি সব বলেছি।বাবাও শুনেছেন সবকিছু।শুনে মা বলেছেন,’অত বড় সাহস করলি কীভাবে?কেন বিয়ে করেছিলে গোপনে? আমাদের জানাসনি কেন?’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’ছেলে বেকার ছিল। তাছাড়া আমি মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। পড়াশোনার অনেক বাকি! আমায় নিয়ে তোমাদের কত স্বপ্ন—‘
আমার মুখ থেকে বাবা কথাটা কেড়ে নিলেন।বাবা বললেন,’স্বপ্ন।তোকে নিয়ে আমাদের স্বপ্ন।গোপনে বিয়ে করে আর অতবড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের স্বপ্ন তুই একেবারে পূরণ করে দিয়েছিস! বাহ্ মা বাহ্! তোকে নিয়ে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠছে!’
বাবা কথাগুলো বলে কেঁদে উঠলেন। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদার সময় বাবাকে কেমন বোকাসোকা দেখাচ্ছে।মনে হচ্ছে আল্লার দুনিয়ায় এমন ব্যথিত, অসহায় মানুষ আর দ্বিতীয়টি নাই!
মাও কাঁদছেন। কেঁদে কেঁদে বলছেন,’তোর ভাই নেহালকে এখনও কিছু শুনাইনি!ও যা রাগী শুনলে কী হবে ভাবতে পারছিস? তোকে গলা টিপে মেরে ফেলবে একেবারে! তারপর নিজেও মরবে!’
আমিও কাঁদছি। নাকেমুখে কাপড় চেপে ধরে কাঁদছি।
মা এবার বললেন,’ওই নম্বরটা দে।ফোন ধরিয়ে দে আমায়।ওই শুয়োরটার মার সাথে আমি কথা বলবো।দেখি কেমন সন্তান জন্ম দিয়েছে সে!’
আমি ভয়ে ভয়ে ওই নম্বরে ফোন দিলাম। ফোনের সুইচ অফ।
মা রেগেমেগে আগুন হয়ে বললেন,’ওদের বাড়ির ঠিকানা বল। কোথায় ওদের বাড়ি?’
আমি খানিক সময় চুপ থেকে বললাম,’ময়মনসিংহের ফুলপুরে। কিন্তু ওরা ঢাকায়ই থাকে। মিরপুর একে ওদের বাসা।’
মা বাবাকে বললেন,’তুমি তূর্ণার কাছে থাকো।আমি মিরপুর থেকে আসছি। দেখে আসি ওই বেজন্মাটার মাকে!আর ওই কমজাত মেয়েটাকেও! নাগালে পেলে কান ধরে হারামজাদিকে এখানে নিয়ে আসবো!’
‘
মা সন্ধ্যা বেলায় গেলেন মিরপুর। ফিরে এলেন রাত বারোটার সময়।তার মুখ বিরস। শরীর জুড়ে ক্লান্তির ছাপ।মা এসে বেডের উপর ধপ করে বসে পড়ে বিলাপের করুন স্বরে বললেন,’নাই। মিরপুরে এদের কেউ নাই!’
বাবা বললেন,’কোথায় আছে কোন তথ্য বের করতে পারছো?’
‘না। বাসার মালিকও কিছু জানে না। শুধু জানে ওরা বাসা ছেড়ে দিয়েছে!’
বাবা আবার মাথায় হাত দিয়ে বিলাপ করতে করতে ধপ করে বসে পড়লেন।
মা বললেন,’অতকিছু ভাবলে আর হবে না। এলাকার মানুষ এখনও কিছু জানে না।সময় থাকতে একটা কিছু করতে হবে। তুমি বাড়ি থেকে আরো টাকা পয়সা আনাও।আজ রাতের ভেতর এবরশন করাতে হবে। তারপর হসপিটালে দু চারদিন থেকে ওকে সুস্থ করে ওকে নিয়ে গ্রামে চলে যাবো একেবারে।গ্রামে গিয়ে ওর বিয়ে দিয়ে দিবো!’
বাবা—
‘
#চলবে