কলঙ্ক পর্ব ১২

#কলঙ্ক
#১২তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক


সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার আগেই দরজায় টোকা পড়লো। এলিজা গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
পিয়ার রুমমেইড ইলা এসেছে।ইলা আমার মোটামুটি কাছের বন্ধু।ওর সাথে এডমিশন টেস্টের কোচিং করেছিলাম একসাথে। সেই থেকে আমাদের পরিচয়। এরপর এক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া। যদিও ওর সাবজেক্ট ভিন্ন।
ইলা এসে আমায় ডেকে ঘুম থেকে তুললো।
ঘুম থেকে উঠে চোখ কঁচলাতে কঁচলাতে বিছানার উপর বসে বললাম,’ইলা কিসের জন্য এসেছিস?’
ইলা বললো,’দোস্ত, পিয়া যা বললো তা কী সত্যি?’
ইলার মুখ থেকে কথাটা শুনে মাথাটা আমার চক্কর দিয়ে উঠলো! তবে কী পিয়া তার কথামতোই কাজ করেছে?জনে জনে সবকিছু বলে দিয়েছে!
আমি কী আর উত্তর করবো এখন? কিছুই বলার নাই।চুপ করে নীচ দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম।
ইলা বললো,’কিরে বল? এতো কিছু হয়ে গেলো আর তুই কিছুই জানাসনি আমায়!আমারচে কী পিয়া তোর আপন বেশি?’
এলিজা এবার কথা বললো।বললো,’ইলা আপু,তূর্ণা আপুর এমনিতেই মন খারাপ। আপনি এখন যান প্লিজ!’
ইলা ধমক দিলো এলিজাকে।বললো,’বড়দের কথায় তুই সুর মিলাচ্ছিস কেন?যা এখন তুই বাইরে যা।’
এলিজা চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে গেল।
এবার ইলা আমার মুখোমুখি হলো। তারপর বললো,’জানিস পিয়া জনে জনে তোর বিষয়টা বলে দিয়েছে। এমনকি ইউনিভার্সিটিতেও অনেকেই জেনে গেছে। আমাকে তো একটু আগে মেসেঞ্জারে দুজন জিজ্ঞেস করলো ঘটনা সত্যি কি না!আমি বলেছি, কিছু জানি না।’
ইলার কাছে বসে থাকতে আমার খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে মরে টরে যেতে।সারা শরীর কেমন কাঁপছে আমার। আবার ঘামও হচ্ছে।মাথা বনবন করে ঘুরছে।চোখ জ্বলছে।কী করবো আমি কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
ইলা বসে থাকতে থাকতেই রুমে এলো আমার দু’ব্যাচমেট। পিংকি আর ইন্দ্রা।ওরা এসে ইলার মতো করেই কথা বললো। জিজ্ঞেস করলো ঘটনা সত্যি কি না?
আমি আগের মতই চুপ করে রইলাম।কারণ চুপ করে না থেকে তো কোন উপায় নাই।কী উত্তর করবো এদের কাছে!
ওরা আমায় নানা ভাবে জেরা করতে লাগলো।
ইন্দ্রা বললো,’তূর্ণা,ছেলেটার সাথে কী এখন তোর একদম যোগাযোগ নাই?’
ইলা উত্তর দিলো তার কথার।সে বললো,’ছেলে নাকি আমেরিকা চলে গেছে।শালা হারামী একটা। উড়াল দিছে মধু খেয়ে!’
পিংকি এমনিতে কথা কম বলে। কিন্তু আজ সেও মুখ খুললো।কথা বললো।সে বললো,’শালা সব ছেলেদের এই এক বদ অভ্যেস। মেয়েদের সাথে রিলেশন করে কোনমতে কনভিন্স করে ফেলতে পারলেই হলো।ছোঁয়াছোঁয়ি হয়ে গেলেই কেল্লাফতে!’
ইলা বললো,’ঠিক তাই।এদের বিলিভ করার চেয়ে একটা কাল সাপকে বিলিভ করা বেটার।’
তারপর ওরা তিনজন হেসে উঠলো।
ইন্দ্রা বললো,’এই আমাদের হাসা উচিৎ না। তূর্ণা ডিপ্রেশনে আছে।ওর মন ভালো না।চল আজ বিকেলে ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাই!’
ইলা বললো,’ঠিক আছে।চল যাই।’
আমি এবার কাঁদো কাঁদো গলায় ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম,’আল্লার দোহাই লাগে বোন,তোরা এখন একটু এখান থেকে যা। আমার একটুও ভালো লাগছে না!’
ইলা বললো,’একা একা থাকলে তো আরও মন খারাপ থাকবে!’
আমি বললাম,’না।একা একাই বরং আমি ভালো থাকবো।যা প্লিজ তোরা এখান থেকে যা।’
ওরা তিনজন বিরক্ত মুখে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আরো দুজন এলো।এই দুজনের মুখেও একই প্রশ্ন।সেই একই ধাঁচের কথা।
আমি এবারও চুপ। কিন্তু চুপ করে আর কতক্ষন থাকা যায়!
আস্তে আস্তে আমার রুমটা আর আমি যেন ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে গেলাম। এবার অন্য হোস্টেলে আমার যে বন্ধুরা ছিল তারাও খবর পেয়ে আসতে লাগলো। দুপুর বেলা ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস রেখে বন্ধুরা আমায় দেখতে এলো। এদের মুখেও সেই একই ধরনের প্রশ্ন।কী সর্বনাশ!অতসব মানুষের সামনে নিজেকে অপয়া মনে হচ্ছে আমার! ইচ্ছে করছে এক্ষুনি নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেলতে!কী হবে এই অপমান নিয়ে বেঁচে থেকে?আজ থেকে তো আর রাস্তায়ও বের হতে পারবো না!স্যার ম্যামরাও জেনে যাবে। হয়তোবা জেনেও গিয়েছে এতোক্ষণে।আমি কী করে ওদের মুখ দেখাবো?

ভাবলাম সুইসাইড করবো। কিন্তু সুইসাইডও এখানে করা যাবে না।একের পর এক ট্যুরিস্টরা আসছেই।ট্যুরিস্ট স্পট দেখছে।দেখে আবার যেতে চায় না। এখানে বসে বসে কত কী যে তারা শুনতে চায়।আমান এমন করলো কেন হঠাৎ!বেবিটাকে নষ্ট না করলেই ভালো ছিল।বেবিটাকে নষ্ট করে অনেক বড় পাপ হয়েছে।এই পাপের কোন ক্ষমা নাই। আবার কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে, এইসব ছেলেদের বিশ্বাস করতে নাই।প্রমাণ রাখতে হয়।পিক টিক তুলে রাখতে পারলি না!
আরেকজন বললো,’রেপড কেস করে দে।এটাই ভালো!’
এবার ওদের সামনেই উদ্ভট একটা কাজ করে বসলাম আমি। গতকালের মতো কালো বোরখা,মুজো , হিজাব আর নেকাবে নিজেকে আবৃত করলাম। তারপর ব্যাগটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে সোজা বেরিয়ে এলাম।
হোস্টেলের বারান্দায় অনেকেই আমায় ঘিরে ধরলো।ওরা আমায় ছাড়তে চায় না।যেন আমি চলে গেলে ওদের বিনোদনের ঘাটতি পড়ে যাবে!
আমি যখন বেরিয়ে যাবো তখন পিয়া আমার সামনে এলো। তারপর একবার চোখ মেরে আবার চলে গেল ওর ঘরের দিকে।
ওর চোখ মারাটা আমায় আর অতো কষ্ট দেয়নি।কারণ অমানুষের কোন কিছুতেই কিছু মনে করার নাই।যেমন মানুষ বলে না যে, কুকুর কাউকে কামড় দিলে তো আর তাকে কামড় দেয়া যায় না। সহ্য করতে হয়। আমিও সহ্য করলাম। সহ্য করে হোস্টেলের বারান্দা ফেরিয়ে একটা রিক্সা করে স্টেশনের পথ ধরলাম। রিক্সায় বসে থেকে অনেকবার মনে হয়েছে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি রাস্তায়। তারপর আমার উপর দিয়ে একটা বড় সড়ো মাল বোঝাই দেয়া ট্রাক কিংবা যাত্রী বোঝাই বাস চলে যাক।আমি ওই ট্রাক কিংবা বাসটার নীচে পড়ে চাপা পড়ে মরে যাই!
কিন্তু লাফাতে পারিনি! কেন জানি তখন কান্না পেতে লাগলো। বারবার মনে হতে লাগলো,মরতে আমি পারবো না।মৃত্যুকে আমি ভীষণ ভয় পাই! তখন নানান যুক্তি আসতে লাগলো আমার মাথায়।মনে হতে লাগলো,সোইসাইড করা তো মহাপাপ।সোইসাইড করলে তো চিরকাল জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে।আমি তো এই সামান্য কজনের অপমানে বুকে জ্বলতে থাকা আগুনটাই সহ্য করতে পারছি না। তবে কীভাবে পরকালের অত আগুন, সেই ভয়ংকর এবং কালো রংয়ের আগুন আমি সহ্য করবো!
পারবো না।আমি কিছুতেই এভাবে মরতে পারবো না!

বাড়ি ফিরতে রাত হলো। আমাকে এই রাত করে ফিরতে দেখে মা ভয় পেয়ে গেলেন।মা ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,’কিরে?কী হয়েছে মা? এভাবে হুট করে চলে এলি যে?’
মার পেছন পেছন বাবাও এসে দাঁড়িয়েছেন।
আমি মার বুকের উপর এলিয়ে পড়ে কেঁদে উঠলাম হাউমাউ করে।
মা আতংকগ্রস্ত গলায় বললেন,’কিরে?তূর্ণা কী হয়ছে তোর বল!বল মা!’
আমি কান্নাভেজা গলায় বললাম,’মা,আমি আর ঢাকায় যাবো না! ওইখানে কোন ভালো মানুষ নাই! ওখানকার সব মানুষ নিষ্ঠুর!’
‘কী হয়েছে বল তো খুলে!’
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,’মা,ওরা সবাই জেনে গেছে। উঠতে বসতে ওরা আমায় অপমান করে।আমি আর পারছিলাম না।মনে হচ্ছিল সোইসাইড করে মরে যাবো। কিন্তু আমি মরতে পারিনি মা। আমার ভয় করে মা!মরতে আমার ভয় করে!’
মা আমার মুখে আলতো করে চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,’কতো বড় সাহস তোর! মৃত্যুর কথা বলিস! তোকে কী বড় করেছি মরে যাওয়ার জন্য!আমি আগেই জানতাম এমন কিছু হবে। তোকে ঢাকায় যেতে এই জন্যই বারবার নিষেধ করেছিলাম।তোর ভাই শুনেনি। তুইও শুনিসনি। এখন কেমন হলো! আমার কপাল ভালো! আল্লাহ যে তোকে সহিহ সালামতে বাড়ি পর্যন্ত পৌছাইছে! আমার প্রাণ আমার বুকে ফিরাইয়া দিছে!’
তারপর মা আমায় ঘরে নিয়ে গেলেন।সে রাতেই বাবা মা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন এই কয়েকদিনের ভেতর তারা আমার বিয়ে দিবেন। এবং আমি যে এখন বাড়িতে কিংবা আমার যে বিয়ে হবে এই খবর কিছুতেই ভাইয়াকে শুনতে দিবে না তারা!

পরদিন সকাল বেলা বাবা ঘটককে খবর দিয়ে আনালেন। তারপর ঘটককে জিজ্ঞেস করলেন,’হরমুজ,ওই যে বারহাট্টার আলাপটা আনছিলে,যে ছেলেটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ওই ছেলে কী বিয়ে শাদি করে ফেলছে?’
হরমুজ ঘটক বললো,’জানতে হইবো ভাইজান।’
বাবা বললেন,’জেনে দেখো। বিয়ে করে ফেললে তো করেই ফেললো।আর যদি বিয়ে না করে তবে আবার আমার মেয়ের বিষয়ে আলাপটা করতে পারো।আমি নিজে গিয়ে ছেলেকে দেখে আসবো। ছেলের বাড়ি দেখে আসবো!’
হরমুজ ঘটক বললো,’আইচ্ছা ভাইজান।’
বাবা হরমুজ ঘটককে পাঁচশো টাকার একটা নোট অগ্রীম বকসিস দিলেন। হরমুজ ঘটক কড়কড়ে টাকার নোট পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে বললো,’ভাইজান,বিয়া ছেলে করে নাই এখনও।’
বাবা অবাক হয়ে বললেন,’তাহলে আগে যে বললা কিছু জানো না তুমি?’
হরমুজ ঘটক পান চুন সুপুরিতে ক্ষয়ে যাওয়া লাল দাঁত বের করে হেসে বললো,’ইয়াদ ছিলো না ভাইজান।আইজকা আসি। ছেলের মার সাথে কথা বলে দেখি কী কই!রাজি হইলে আফনে যাইবেন তারার বাড়িতে।বিয়া হইবো এনশাল্লা মনে খাচ আশা রাখেন।’
বাবা হেসে বললেন,’আচ্ছা আশা রাখলাম।’
হরমুজ ঘটক লাজুক ভঙ্গি করে বললো,’ভাইজান এমনে না, কন এনশাল্লা আশা রাখলাম।’
বাবা হেসে উঠে বললেন,’ইনশাআল্লাহ,আশা রাখলাম।’
হরমুজ ঘটক চলে যাওয়ার পর বাবা মাকে বললেন,’আমেনা, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই বিয়েটা হবে!’
মা খুশিতে হেসে উঠে বললেন,’হয়ে গেলেই বাঁচি। আমার যে মেয়েটাকে নিয়ে কত টেনশন! রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারি না! ওইসব কথা লোকে জেনে গেলে কী যে হবে!ভাবতেই বুক কাঁপে!’
বাবা বললেন,’ঘটক খবর জানালেই আমি যাবো।দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করবো ইনশাআল্লাহ!’
মা বললেন,’তাই হোক তবে।’

ঘটক আমাদের বাড়িতে এলো দু’দিন পর রাতের বেলায়। ঘটকের মুখ মলিন।বাবা মনে হয় আশাহত হয়েছেন মনে মনে। তবুও হাসিমাখা মুখে বললেন,’খবর কী হরমুজ?’
হরমুজ ঘটক মুখ মলিন রেখেই বললো,’খবর ভালা আলহামদুলিল্লাহ।মেয়ের মা বলছে আফনি গিয়ে ছেলে দেইখা আসতেন।আফনের ইচ্ছা।যেকুনো দিন যাইতে পারইন।আফনে শিক্ষক মানুষ।শিক্ষক মানুষের মাইয়া তাদের ঘরের বউ হইবো এইটা শুইনা তারার বেকেই খুব আনন্দিত!’
বাবা বললেন,’তাই নাকি!’
বলেই পকেট থেকে আরেকটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে হরমুজ ঘটকের হাতে দিলেন। হরমুজ ঘটক লজ্জা মাখা ভাব করে টাকাটা হাতে নিলো। তবে এবার আর তার মুখ মলিন না।টাকা পেয়ে মুখে হাসি ফুটেছে।

বাবা গিয়ে দেখে এসেছেন ছেলেকে। ছেলের নাম আগেও বলা হয়েছিল। মেহরাব। যতোটুকু শোনা হয়েছিল তারচেয়েও নাকি বেশি সুন্দর দেখতে। বাড়ির লোক সকলও ভালো। বাবার খুব পছন্দ হয়েছে।বাবা বলেছেন, তাদের লোক সকল এসে দেখে যেতে। কিন্তু মেহরাবের মা বলেছেন,আমরা মেয়েকে দেখবো না। আপনার ঘর দোরও দেখবো না। ফরহাদ মাস্টারের মেয়ে আমার ঘরের বউ হবে এটাই আমার বিরাট পাওয়া!’
বাবা বললেন,’বিয়ের ব্যপারে আন্দাজে কাজ না করা ভালো!ছেলের উচিৎ মেয়েকে দেখা। আমার মেয়েরও তো পছন্দ আছে। দুজন দুজনকে দেখুক।কথা বলুক। পছন্দ হলে আলহামদুলিল্লাহ!’
বাবা কথা বলে চলে এলেন। বাড়িতে এসে বললেন, যেকোনো দিন ছেলে আসবে আমাদের বাড়িতে। আমাকে দেখবে। আমার সাথে কথা বলবে।
শুনে আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম।ভয়ও হচ্ছিল খুব।ভয় হচ্ছে এই জন্য যে আমি একটা ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।জানি না এমন সিদ্ধান্তের ফলাফল কতটা মন্দ হয়!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here