কল্পকুঞ্জে কঙ্কাবতী পর্ব -৩৬

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৩৬|

সুখ সাময়িক। প্রেমে সফল ব্যক্তিই যে সর্বোচ্চ সুখী, ব্যাপারটা এমন নয়। প্রেমের চেয়েও আগে কিছু আছে। সেটা হলো বন্ধুত্ব। আমাদের চারজনের বন্ধুত্ব বড্ড প্রগাঢ় ছিল। পড়াশোনায় যে আমরা চারজনই খুব ভালো ছিলাম, তা না। রাহী টপার ছিল, আর চিত্রা-নৌশি-আমি মোটামুটি পর্যায়ের স্টুডেন্ট ছিলাম। তবুও পড়ালেখার পেছনে শ্রম দিয়েছি অফুরন্ত। রিজন একটাই। চারজনকেই একই সাথে থাকতে হবে। যেহেতু চারজনেরই স্বপ্ন মেডিকেল ছিল, তাই টার্গেটে রেখেছিলাম ডিএমসি। এজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু হলো না। পাবলিকে চান্স পাওয়াটা আমাদের চারজনের কাছেই বড্ড আনন্দের বিষয় ছিল, কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে শোকে পরিণত হতে লাগল তখন, যখন জানতে পারলাম– চারজন চার জায়গায়।
আমার ডিএমসিতে হয়েছে। রাহীর মেডিকেলে একটুর জন্য আসেনি, তবে ইঞ্জিয়ারিংয়ে হয়েছে; চুয়েটে। নৌশির সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল আর চিত্রার জাবিতে। এভাবে আলাদা হয়ে যাওয়াটা আমরা কল্পনাতেও আনিনি।
প্রথম প্রথম মন খারাপ হলেও, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কেটে গেল দুটো বছর। তবে ভুলতে পারিনি সেই দিনগুলো। রাহীর অভিমান, চিত্রার অবুঝ স্বভাব, নৌশির গুন্ডামী! কিচ্ছুটি ভুলিনি। মাঝে মাঝে সেসব মনে হতেই, বুকের ভেতরটায় চিড়িক দিয়ে ওঠে। বড্ড অস্থির লাগে।

সেদিন আমার বিশতম জন্মদিনে, আমি মামার কাছে এক অদ্ভুত আবদার করে বসি। মামা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “যা লাগবে, আমাকে বলবি, আমি এনে দেব।”

আমি হেসে শুধাই, “সত্যিই তো?”

মামা কথা দেন, “আমার মা যা বলবে, তাই তাকে দেব।”

আমি তখন সোজাসুজি চেয়ে বসি তারই ছেলেকে, “তবে সামাজিকভাবেও আপনার মেয়ে হতে চাই।”

মামা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন, “তা কীভাবে?”

লাজ-লজ্জা খেয়ে বলি, “আপনার ছেলের বউ হয়ে।”

মামার হাসি মিইয়ে যায়। পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ– কোনো টাইপেরই অ্যান্সার পাই না। আমার মন বিষিয়ে যায়। তবুও আশা ছাড়ি না। এতে অবশ্য লাভ বৈ ক্ষতি হলো না। একদিন এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন মামা, “ভেবে চাইছ তো?”

এই এক প্রশ্নে অনেক কিছু বুঝে যাই। খুশির আর সীমা থাকে না। কোনোমতে উত্তরে বলি, “জি, মামা।”

তারপর একদিন আশ্চর্যজনক এক ঘটনা ঘটল। আমি তখন মামার সাথে বসে গাল-গল্প করছিলাম। আজ-কাল আর বাসায় মন টেকে না। গত বছর আপিরও বিয়ে হয়ে গেছে আসিফ ভাইয়ের সাথে। সে-অনেক কাহিনি। সবটা লিখতে গেলে, বাকি কথা লিখতে ভুলে যাব। তাই ওই ঘটনা স্কিপ করলাম। তো, ও-বাসায় মন টেকেই না। আগে যেমন হুট-হাট মামার বাসায় চলে আসতাম, এখন আর তারও ইচ্ছে হয় না; রাহী নেই যে! মাঝে মাঝে অবশ্য ছুটিতে আসে, তবে তাতে কী আর সাধ মেটে? নৌশির সাথে মাঝে মাঝেই দেখা হয়, তবে চিত্রার সাথে আর এই দুই বছরে দেখা হয়নি। আঙ্কেল-আন্টি গ্রামে চলে গিয়েছেন যে।
ইদানিং কিছুটা মন খারাপ নিয়ে ঘুরছি। খানিকটা উদাস মনে আকাশ দেখছি। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে পড়াশোনায়। রাতটা আমি কুঞ্জ ভাইয়ের রুমেই কাটাই। এই নিয়ে কেউ কখনই কিছু বলেনি।
তখন, দুপুরে খাওয়া শেষে, মামার সাথে বিভিন্ন কথা বলছিলাম। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে।

মণি কিচেনে ছিল, তাই আমিই গিয়ে দরজা খুলি। খুলতেই, সামনে কুঞ্জ ভাইকে দেখে আমি বিস্ময়ে রা করতে পারি না। কথা বন্ধ হয়ে যায় আমার। নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হলেও, কখনও বাসায় আসেননি উনি। আজ এলেন! তাও আবার মামা থাকতেই! মস্তিষ্কে ঘুরতে লাগল সেই আবদারটি। বিগত দুই বছরে বোধহয় এত খুশি আমি হইনি।

আমাকে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি মুচকি হেসে বললেন, “প্ল্যানিং তো মাশাআল্লাহ।”

ভ্রু কুঁচকালাম। নিচু স্বরে শুধালাম, “কীসের প্ল্যানিং?”

“দুই কাপ চা নিয়ে রুমে আয়, বলছি।”

আমি চা বানাতে কিচেনে গেলাম। গিয়ে নিয়ে ফ্রিজ খুললাম। শব্দ হতেই, মণি আমার দিকে তাকাল। এরপর আবার রান্নায় মনোযোগ দিয়ে শুধাল, “কে আসছে?”

আমি ফ্রিজ থেকে আপেল বের করে ধুচ্ছিলাম। মণির কথা শুনে, ও-তে কামড় বসিয়ে বললাম, “তোমার আদরের ছানাটা এসছে, যাও যাও।”

“রাহী আসছে?”

“না না, বড়োটা।”

মণির হাত থেকে খুন্তিটি পড়ে গেল। বিকট একটা শব্দ হলো। সেদিকে মণি পাত্তা না দিয়ে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি এক দৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ইশ! এজন্যই বোধহয় মায়েরা মমতাময়ী।
এদিকে, তরকারি পুড়ছিল বলে। আমি খুন্তিটি ধুয়ে নিয়ে তরকারি নেড়ে দিলাম। অন্য চুলোতে চায়ের পানি বসালাম।

________
মিনিট বিশেক পর, চা নিয়ে কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের সামনে গেলাম। দরজায় নক করতে গিয়েই, একটা দুষ্টুমি খেলল মাথায়। তাই, দরজা নক না করেই ভেতরে ঢুকে পড়লাম। মণি কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছে। কুঞ্জ ভাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিলেন। আমি চায়ের ট্রে-টা বেড সাইড টেবিলে রেখে, ধীর পায়ে কুঞ্জ ভাইয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি হাত বাড়ালাম, শক্ত করে জড়িয়ে ধরার উদ্দেশ্যে। এগোতেই, কুঞ্জ ভাই সরে গেলেন।
গ্রিলের সাথে বাড়ি খেয়ে, অস্ফুট স্বরে ‘উফফ!’ বলে উঠলাম। বেদ্দপ্টার এখনই সরতে হলো? তাকিয়ে দেখলাম, উনি ফোন ছেড়ে এতক্ষণে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। খানিকটা আগ অবধিও যেই ভালো মুড নিয়ে আমি ছিলাম, তার সামান্যও অবশিষ্ট নেই।
আমাকে এভাবে থাকতে দেখে উনি বললেন, “কী? কী হয়েছে?”

আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, “আপনার ১২টা মেয়ে হয়েছে। কান্না করছে ননস্টপ। থামান গিয়ে।”

“নবু, একটু মেপে কথা বল! আমার ১২টা মেয়ে হলে কি তুই এখনও সারাদিন ল্যাদ খেতে পারতিস? তোর তো নাওয়া-খাওয়াই হারাম হয়ে যেত রে!”

“উফ! বাজে কথা! এখনই সরতে হলো আপনার? দু‘মিনিট পরে সরলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?”

“কেন? তুই কি দোয়া করছিলি নাকি? যে, আর দুই মিনিট পর আমার মাথার উপর সিলিং ভেঙে পড়বে!”

“ওটা সিলিং নয়, আকাশ হবে।”

“আপাতত মাথার উপর আকাশ দেখতে পারছি না। ওহহ! তোর চশমায় তো আবার বেশি দেখায়।”

“কুঞ্জ ভাই, আপনি আমার চশমার পেছনে কী পেয়েছেন? যবে থেকে চশমা নিয়েছি, তবে থেকেই এ-নিয়ে খোঁচাচ্ছেন!”

“যা-ই বলিস! তোকে চশমায় পার্ফেক্টলি ডাক্তারনি লাগে!”

“এতক্ষণে ভালো কথায় এলেন। সবসময় এরকম করে আমার প্রশংসা করবেন। বুঝেছেন? এবার ভালোয় ভালোয় বলে ফেলুন— মামা করেছেটা কী?”

“শুনবি?”

“অবশ্যই। আপনি তো সোজা কথার জাত না। মামা সব ভুলে আপনাকে আসতে বললেও, কুঞ্জ দ্যা ঘাড়ত্যাড়া জীব্বনেও আসবে না— এই গ্যারান্টি আমি নিজে দিতে পারি। তো এখন, লাইনে আসসো, মাম্মা!”

“তোর মুখের ভাষা অনেক খারাপ হয়ে গেছে, নবু। ফ্রেন্ড চেঞ্জ কর।”

নতমুখী হয়ে মিনমিনে স্বরে বলি, “এগুলো তো আপনার সাথে থাকার সাইডিফেক্ট।”

“কী বললি?”

ইশ! জোরে বলে ফেলেছি কি? উনি শুনে ফেলেছেন? শুনুক গিয়ে! আমার কী! মিথ্যে বলিনি তো। সাহস করে এবার ওঁর চোখে চোখ রেখে বললাম, “নিজের মুখের ভাষা আগে ঠিক করুন। ছোটোরা বড়োদের থেকেই শেখে।”

কুঞ্জ ভাই কিছু না বলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমার কপালে টোকা দিয়েই ভেতরে ঢুকে গেলেন। উফ! জঘন্য! আমিও পিছু পিছু গেলাম।

কুঞ্জ ভাই চায়ের কাপ নিজেরটা নিয়ে, আমারটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি কাপ হাতে নিয়ে শুধালাম, “এরপর?”

“তোর মামা আমাকে সেদিন কল দিয়েছিল। ভারি অবাক হই আমি। রিসিভ করলাম। অথচ, স্যার কোনো কথাই বললেন না! তারপর কল কেটে দিলেন।”

“এটুকুই?”

কুঞ্জ ভাই কিছু না বলে, চোখে হাসলেন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “এরপর বলুন।”

“এরপর, তোর মামা আমার ফ্ল্যাটে চলে আসে। হাজার হোক, জন্মদাতা পিতা তো! বের করে দিতে পারিনি। বাসায় এসেই আমার সামনে শর্ত রাখল, পলিটিক্স ছেড়ে দিতে।”

“আপনি মেনে নিলেন?”

“ ‘ন’-আকার না।”

“তো?”

“তো, আমিও তাকে এভাবেই রিফিউজ করলাম। উনি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বাসা থেকে চলে গেলেন।”

“এটা কবের ঘটনা?”

“উম.. মাস দুয়েক আগের।”

“আমাকে বলেননি কেন?”

“স্পেশ্যাল কিছু না তো!”

“আমি আপনার সবকিছুতে থাকতে চাই, কুঞ্জ ভাই। সবকিছুতেই…”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here