#কাছে_দূরে 💕
#moumita_meher
#পর্ব___৪৩
—-‘ ভাবি ভেতরে আয়াম?’
দরজায় রুবি দাঁড়িয়ে। মুখ শুঁখনো। গতকালকের ঘটনার পর থেকে সে ভীষণ দোটানায় পড়েছে। হীরকে সে কি বলে ডাকবে? ভাবি নাকি ছোটআপা। আগের মতো ছোট আপা ডাকলে যদি সাবাব বকাঝকা করে। সেই ভাবনায় বিভোর হয়ে হীরকে সে ভাবি বলে ডাকল। কিন্তু হীর হুট করে চটে গেলো। রুবি তাকে ভাবি কেন ডাকবে।
—-‘ কে তোর ভাবি?’
হীরের শক্ত প্রশ্নে রুবির গলা শুঁকিয়ে এলো। থতমত খেয়ে বলল,
—-‘ ভাইজানের বউরে তো ভাবিই ডাকাম। আর কি-‘
—-‘ আর একবার ভাবি ডাকলে তোর ভাইজানের আগে তোকে মার্ডার করবো। যা ভাগ এখান থেকে।’
রুবি ‘ও মাগো’ বলে চেঁচিয়ে উঠে নিজের মুখ ঢাকে। হীর রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে রুবির দিকে। রুবি ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
—-‘ খালাম্মায় ডাইকা পাঠায়ছে আফনেরে। সক্কাল থেইকা তো একটা দানাপানিও মুখে তোলেননাই। রাইতেও খাইলেননা।’
হীর ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মাথার মধ্যে দপদপ করছে তার। সকাল ১১টা বাজে। সাবাব বেরিয়ে পড়েছে ভোরের দিকে। সে দেখেনি। তার ঘুম ভেঙেছে ৯টায়। রাতে সাবাবের সাথে আর তর্কে যায়নি সে। সাবাবের কড়া হুকুমে তার সাথেই বেড শেয়ার করে শুইয়েছে। সাবাব অন্য দিক ফিরে শুইয়ে পড়েছে। তাকে আর জ্বালায়নি। হীর উঠে মাথার কাছে ড্রয়ারের উপর ছোট্ট একটা চিরকুট পেয়েছে। সাবাব রেখে গেছে। -‘জরুরী কাজে বের হতে হলো। উঠে খেয়ে নিবে। মা বলল, রাতে নাকি খাওনি।’ লেখাটায় চোখ বুলিয়ে চিরকুট টা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেছে। সেই থেকেই রুমে। একবারও বের হয়নি রুম থেকে। এশা,মিলি এবং আদ্র এসেছিলো তার সাথে দেখা করতে। কারোর সাথে কথা বলেনি। সবাই বাড়ি ফিরে গেছে। সানিয়ার রিসেপশনে আসবেনা বলেও জানিয়েছে। তবুও হীর কিছু বলেনি। তার কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না বলেই বলেনি। কিন্তু মনে মনে ঠিকই তাদের কথার উত্তর দিয়েছে সে।
—-‘ ও ছোটআপা? চলেন না?’
রুবি করুন কন্ঠে ডাকলো। মনেমনে প্রস্তুত হয়ে নিলো হীরের আরেকটা ধমকের। কিন্তু হীর তা করলো না। দু’বেলা পেটে কিছু না পড়ায় শরীর বারবার নেতিয়ে পড়তে চাচ্ছে। খুব দুর্বল লাগছে। এখন খাওয়া উচিত। তাই সে রুবিকে জবাব না দিয়ে চলে গেলো নীচে। অল্প কয়েকজন মেহমান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন চারপাশে। হীরকে নামতে দেখে সবাই কুটিল দৃষ্টিতে দেখলেন। তাদের মতে হীর সুন্দরী নয়। সাবাবের সাথে তার মিল হয়না। তবুও কেন সাবাব এই মেয়েটার জন্য এত পাগল ভেবে পায়না কেউ! তাদের মেয়েরা বিশ্ব সুন্দরী। মেয়ে পক্ষ হয়েও তারা বারবার নির্লজ্জের মতো প্রস্তাব রেখেছেন আজিম সাহেব এবং নাজমা বেগমের কাছে। কিন্তু দু’জনের কেউই কিচ্ছুটি বলেননি। না অপেক্ষা করতে বলেছেন আর না ফিরিয়ে দিয়েছেন। কেবল এইটুকু জানিয়েছেন, ছেলের পছন্দই আমাদের পছন্দ। নাজমা বেগমকেও অনেকে সহ্য করতে পারেন না। মনে হয় যেন বড় অদ্ভুত নারী তিনি। আসলে যা দেখান তেমনটা তিনি নন।
—-‘ হীরপরী?’
খাবারের টেবিলে দাঁড়িয়ে ডাকলেন নাজমা বেগম। হীর একবার তাকিয়ে বসলো চেয়ারে। নাজমা বেগম দ্রুত খাবার বাড়লেন। হীরকে অপেক্ষা না করিয়ে নিজ হাতে খাবার মেখে হীরের মুখের সামনে ধরলেন। হীরের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো হঠাৎ। বুক ফেটে কান্না আসছে। কান্নাগুলো ঢোকের ন্যায় গিলে খেতে চাচ্ছে। কিন্তু তবুও ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। নাজমা বেগম হাতে ভাত নিয়েই অসহায় মুখ করে তাকিয়ে রইলেন হীরের দিকে। মেয়েটার পরিস্থিতি তাকে ভেঙে দিচ্ছে। মেয়েটা যে কোনো দিকে এগোতে পারছে না। সবচেয়ে প্রিয় দুটি মানুষই বেঁকে আছে তার বিরুদ্ধে। নাজমা বেগম বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। কন্ঠ স্বাভাবিক করে বললেন,
—-‘ হা করো।’
হীর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
—-‘ হীর। বড় মা ডাকছে না? হা করো?’
হীর জবাব দেয়না। ফোপাঁতে ফোপাঁতে হা করে। নাজমা বেগম মলিন হেসে হীরের মুখে খাবার দেয়। হীর হেঁচকি তুলতে তুলতে খাবার গিলে। নাজমা বেগম স্নেহের হাত বাড়ালেন হীরের দিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—-‘ খাবার শেষ করে নিজের রুমে গিয়ে যত খুশি কাঁদবে। এখন আর কোনো কান্না নয়।’
হীর কান্না থামায়। জলের গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে জল খায়। এবার আর কান্না আসবেনা। নাজমা বেগম গোপনে নিঃশ্বাস ছাড়েন। তার মনে মনে একটা কথা ঘোরে। তিনি দ্বিধা নিয়ে ভাবে হীরকে কি করে বলবে এই কথা।
খাবার শেষ করে হীর আবার চলে যায় সাবাবের রুমে। নিজের রুমে একবার যেতে নিয়েও যায়না। মনে পড়ে যায় সাবাবের উদ্ভট আচরণ। তাই আর যায়না। চলে যায় সাবাবের রুমে। মা-বাবার ছবিটা হাতে নিয়ে বসে। আনমনে কথা বলে। কাঁদে,হাসে। আর থেমে যায়। আবার কথা বলে।
________________
মির জানায় তাদের ফ্লাইট ছেড়েছে। সাবাবের ধারনাকে সত্যি করে দিয়ে মনিকা সত্যি চলে যায় মালয়েশিয়া। সবার মাঝে ধারনা দিয়ে যায় হীর আর সাবাবের হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়াতে তিনি অস্বস্তিতে পড়েছেন। তাই আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। যখন এই ব্যাপার তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারবেন তখন আবার ফিরে আসবেন। মনিকার চলে যাওয়াতে সাবাব যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলো। এবার মনিকার রহস্য সামনে আসার পালা।
সাবাব বাহিরের সব কাজ শেষ করে বাসায় ফিরল। রুমে আসতে আসতে অনেকের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সেই সাথে কিছু কানাঘুঁষাও ভেসে এলো কানে। সাবাব তোয়াক্কা না করে রুমে এলো। রুমে ঢুকতেই দেখলো হীর রুমে নেই। সাবাব চারপাশে চোখ বুলালো। হীর নেই কোথাও। সাবাব জামাকাপড় চেঞ্জ করে বিছানায় বসলো। হীরকে তখনও নজরে এলো না। সাবাব বসে না থেকে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। হীর অদৃশ্যে দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে আনমনে। মাপছে জীবনের গতিবিধি। সাবাব নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ালো গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনেমনে বলল,
—-‘ হীরকে স্বাভাবিক করা প্রয়োজন। হীর পুরনায় আগে মতো হয়ে গেছে, যেমনটা দেশে ফিরে দেখেছিলাম। একদম চুপচাপ আনমনা। মাঝে অনেকটাই বদলো গিয়েছিলো। কিন্তু বাবার কথা গুলো ওকে আবারও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। না সাবাব, হীরকে আবারও ঘোরে হারাতে দিলে চলবে না। ওকে স্বাভাবিক থাকতেই হবে। সামনে অনেক বড় বড় ঝড় ওর জন্য অপেক্ষা করছে। এটুকুতেই এভাবে ভেঙে পড়লে চলবেনা।’
সাবাব গলা খাঁকারি দিলো। হীরের ভাবনার সুতো ছিঁড়তেই চমকে উঠলো। সাবাবের দিকে চকিত তাকালো। সাবাব হীরের চাহনীকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে বলল,
—-‘ সানির সাথে কথা হয়েছে?’
—-‘ না।’
—-‘ কল দেয়নি?’
—-‘ হুম।’
—-‘ এখন বলবে?’
হীর জবাব দিলো না। মানে সে কথা বলতে চায়না। সাবাব প্রসঙ্গ পাল্টালো। বলল,
—-‘ বাবার কথা গুলোয় খুব কষ্ট পেয়েছো?’
—-‘ না।’
—-‘ কাঁদছো কেন তাহলে?’
হীর চমকে উঠলো। গালে হাত রাখতেই তার হাত ভিজে উঠলো। সাবাব যেন না দেখে তেমন করেই তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছলো। সাবাব হাত বাড়িয়ে হীরের গাল স্পর্শ করলো। হীর ছিটকে দূরে সরে পড়লো। সাবাব অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
—-‘ ফড়িংয়ের মতো লাফ মারছো কেন?’
—-‘ জ্বালাচ্ছো কেন?’
—-‘ জ্বালাচ্ছি কোথায়?’
—-‘ তাহলে কি করছো? দেখছো না একা আছি। তার মানে কি?’
—-‘ কি?’
—-‘ মানে আমি একা থাকতে চাই।’
—-‘ যাব্বাবা! তাহলে বিয়ে করলাম কেন?’
—-‘ জোর করে করেছো!’
—-‘ আমার হক ছিলো।’
—-‘ জোর করে বিয়ে করা কেমন হক?’
সাবাব থামলো। হীর দম নিয়ে কথা বলছে। মানে সে স্বাভাবিক হতে বেশি সময় লাগবেনা। সাবাব মনে মনে হাসলো। হীরের দিকে ঘুরে পেছনে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। বেশ জব্বর একটা উত্তর রেডি করছে মনেমনে। যাতে হীর তার উপর চেতে যায়। পকেট থেকে ফোন বের করে কিছু একটা বের করে মৃদু হাসলো। হীরের মুখের সামনে ফোনটা তুলে বলল,
—-‘ এটা আদ্রের বোন ইলিনা তাই না?’
হীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সাবাবের ফোনে।
—-‘ আমরা যখন বিয়ের কার্ড নিয়ে ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখনই তো দেখেছিলাম মেয়েটাকে।’
সাবাব আবারও বলে উঠলো। হীর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
—-‘ ইলিনা আপুর ছবি তুমি কোথায় পেলে?’
—-‘ ইলিনা দিয়েছে।’
হীরের ভেতরটা জ্বলে উঠলো। তবে প্রকাশ করল না। পুনরায় গম্ভীর মুখে বলল,
—-‘ ইলিনা আপু কেন তোমাকে ছবি দিবে। আর কি করেই বা দিলো?’
সাবাব ভাবলেশহীন ভাবে ছবিটার দিকে তাকালো। চোখে মোহ। হীর খেয়াল করছে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে। সাবাবের উত্তরের অপেক্ষা না করে ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,
—-‘ কি হলো জবাব দিচ্ছো না কেন?’
সাবাব যেন চমকে উঠলো। তেমন ভাব নিয়েই বলল,
—-‘ আরে বাবা রাগছিস কেন? এখানে রাগার কি হলো?’
হীর চেতে বলল,
—-‘ এতক্ষণ তো বেশ তুমি তুমি বলছিলে! হঠাৎ এই শাঁকচুন্নির মুখ দেখে তুই বলছো কেন?’
সাবাব গোলগোল চোখে তাকালো। বলল,
—-‘ যে বিয়েই মানে তার কাছে তুই তুমি এতো প্রভাব ফেলছে কেন?’
—-‘ প্রভাব ফেলছে কারন তুমি তোমার বউয়ের সামনে একজন তৃতীয় ব্যক্তির ছবি বের করে তাকে মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে দেখে ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’-তে চলে যাচ্ছো। মেয়েবাজ লোক।’
—-‘ আরে তুই তো মানিস না এই বিয়ে। তাহলে এতো লাগছে কেন তোর?’
হীর ফুঁসে উঠে বলল,
—-‘ তুমি তো মানো নাকি?’
—-‘ আমি মানলেই কি আর না মানলেই বা কি?’
—-‘ অনেক কিছু।’
—-‘ অনেক কিছু কি?’
হীর রাগে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। ফোঁস করে উঠে বলল,
—-‘ তুমি মানলেই আমি ভালো থাকব। আমি সুরক্ষিত থাকবো, সুখে থাকবো।’
কথাগুলো বলে থমকে গেলো হীর। মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে এসব কথা। সে বলতে চায়নি। সাবাব ঠোঁট কামড়ে হাসলো। ইলিনার ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল,
—-‘ তুই সুখে থাকলে আমার কি লাভ? আমার সুখ খুঁজে বের করতে তো এমন একজন দরকার তাই না?’
হীর ক্ষেপা দৃষ্টিতে তাকালো। সাবাবের হাত থেকে ফোনটা ছো মেরে কেঁড়ে নিয়ে ছুড়ে মারলো দূরে। ফেনটা ছিটকে পড়তে সাবাব আর্তনাদ করে উঠলো। বুকে হাত চেপে বলল,
—-‘ এটা কি করলে?’
হীর বাঁকা হাসি টানলো ঠোঁটে।
—-‘ ঐ মেয়ে আসলেই শাঁকচুন্নি। ওর ছবি যতক্ষণ তোমার হাতে ছিলো ততক্ষণ তুমি ‘তুই’ করে ডেকেছো আমাকে। আর যেই মাত্র ফেলে দিলাম তুমি আমাকে ‘তুমি’ বলে ডাকলে।’
কথাটা বলে হনহন করে চলে গেলো হীর। সাবাব তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে হেসে উঠলো। প্ল্যান কাজ করেছে।
#চলবে_
[ বিঃদ্রঃ এতদূর কষ্ট করে পড়ে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেননা। যদি ছোট্ট একটা মন্তব্যে আপনার মতামত জানাতে কষ্ট হয়। ধন্যবাদ। ]