কাছে দূরে পর্ব ৭০+অন্তিম

#কাছে_দূরে 🌸🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৭০(অন্তিম পর্ব)🌺

পাঁচ বছর পর___🌺

ছোট্ট সুহানি বাবার পিঠ ঘেঁষে গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। সাবাবও মেয়ের মতো পাশ ফিরে গুটিশুটি হয়ে ঘুমচ্ছে। হীর ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে বাবা-মেয়েকে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শাড়ির আঁচলটা কাঁধে তুলতে তুলতে এগিয়ে গেলো আলমারির দিকে। কোমরে গোঁজা চাবির গোছাগুলো বের করে আলামরির লক খুলে ভালো ভালো দেখে তিনসেট গয়না বের করল। একহাতে গয়নার বক্স গুলো সাবধানে নিয়ে অন্যহাতে আলমারি লক করলো। পেছন মুড়ে মেয়ে-বাবাকে আরেক পলক দেখে গয়নার বক্স গুলো নিয়ে গিয়ে ছোট্ট ড্রয়ারটার উপর রাখল। অতঃপর সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ওয়াল ঘড়িতে সময়ের হদিশ চালালো। ঘড়ির ঘন্টার কাটা’টা ঠিক _৭টার উপর স্থির হয়ে আছে। হীর সময়ে চোখ বুলিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মেয়ের পাশে বসল। বাবার পিঠের নীচ থেকে মেয়েকে টেনে এনে বালিশে উঠালো। সুহানি মায়ের হাতের ছোঁয়া পেয়ে নড়েচড়ে আবারও ঘুম। হীর তার ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। দেখতে ঠিক বাবার মতো হয়েছে মেয়ে। তবে গায়ের রং পেয়েছে বাবা-মার দু’জনেরই। নাজমা বেগম বলেন, এক বালতি ঘোলা দুধের ভেতর চুবিয়ে উঠিয়েছে তার ছোট্ট পরীকে। সুহানির মুখের গড়ন ঠিক সাবাবের মতো। তার গভীর দৃষ্টি, টকটকে লাল ঠোঁট। জোড়া ভ্রু মেয়ের। নাজমা বেগম মনে করে বলেছিলেন রিয়াদের নাকি খুব ছোট বেলায় জোড়া ভ্রুর মতো ছিলো। বড় হতে হতে তা মিলিয়ে গিয়েছে। সুহানিরও হয়তো বয়স বাড়ার সাথে সাথে মিলিয়ে যাবে। হীর মেয়ের চুলগুলোয় বিলি কাটতে কাটতে কোমল স্বরে ডাকল,

—-‘ সুহামনি। আমার পরীটা?এবার উঠো মা। আরেকটু পরে আন্টিমনির বর চলে আসবে তো? সুহামনি যে আম্মুকে বলেছিলো সে আন্টিমনির বর দেখবে? সুহামনি? মা, আমার মা-টা। উঠো উঠো-

মায়ের কোমল স্বরে সুহা নড়েচড়ে উঠে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো মায়ের মুখে। মাকে সামনে বসে থাকতে দেখেই হাস্যজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার ঘুমন্ত মুখ। লাফ দিয়ে উঠে মায়ের গলা জড়িয়ে ঘুমঘুম কন্ঠে আধোস্বরে বলল,

—-‘ আন্তিমনি-র বর এস-ছে মা?’

হীর মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,

—-‘ না মা আসেনি। তবে সুহামনি আর বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলেই আন্টিমনির বর চলে আসবে। তাহলে সুহামনির এখন জলদি জলদি কি করতে হবে?’

—-‘ ফ্লেসস হতে হ-বে।’

সুহা আনন্দিত স্বরে ফট করে জবাব দিলো। হীর মেয়ে কোলে বসিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,

—-‘ এই-তো আমার সোনা মেয়ে। কত বুদ্ধি আমার পরীটার।’

সুহা মায়ের আদর পেয়ে চোখ পিটপিট করে বাবার দিকে তাকালো। মাকে দেখিয়ে বলল,

—-‘ আম্মু, বাবা গুমো-য়।’

মেয়ের কথায় হীর পাশ ফিরে একবার সাবাবকে দেখল। মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে বলল,

—-‘ কুম্ভকর্ণ মশাই যে আর কত ঘুমোবে জানা নেই। মা,যাও ওশারুমে গিয়ে ব্রাশ নাও। আম্মু আসছি-

মায়ের আদেশে সুহামনি মাথা নেড়ে গুটিগুটি পায়ে দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমে। হীর উঠে সাবাবের ঐপাশে চলে গেলো। বাবা-মেয়ে হয়েছে একদম এক ধাঁচের। বাবাও যা করবে মেয়েও তা করবে। ঠিক তেমনই মেয়েও যা করবে বাবাও তা করবে। এই যেমন এখন। সাবাবের ঘুমের স্টাইল দেখে মনেই হচ্ছে না সে এক মেয়ের বাবা। মনে হচ্ছে সুহামনিই শুয়ে আছে। হীর ঝুঁকল খানিকটা। সাবাবের গায়ের উপর হাত রেখে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগলো। কিন্তু তার কোনো হুঁশ নেই। হীর গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতে লাগল।

—-‘ এই যে শুনছো? সাতটা কিন্তু বেজে গিয়েছে। এখনও ঘুমোলে কি করে চলবে? ওদিকে বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গিয়েছে তোমার নাম করে। নেহাল ভাইয়া,আদ্র,মীর ভাইয়া সবাই তোমায় খুঁজছে। কি গো-

—-‘ উমম-

—-‘ আরে! আবারও ঘুমিয়ে পড়লে। এই উঠো তো। অনেক হয়েছে। এবার কিন্তু ওরা তোমায় খুঁজে না পেয়ে রুমে এসে হানা দিবে।’

সাবাব নড়েচড়ে বারবার ঘুমিয়ে পড়ছে। যা দেখে হীর অতিষ্ঠ হয়ে ডাকা বন্ধ করে দিয়ে উঠে চলে গেলো। না জানি মেয়েটা ওয়াসরুমে ঢুকে কি করছে। সেই চিন্তা নিয়ে হীর ওয়াসরুমে ঢুকে দেখল মেয়ে তার ব্রাশ নাগাল পাচ্ছে না দেখে একা একা টুলের উপর উঠছে। হীর চোখ জোড়া ডিম্বাকৃতির ন্যায় করে ছুটে গিয়ে ধরলো মেয়েকে। বকার সুরে বলল,

—-‘ তোমাকে আম্মু বারন করেছি না একা একা এভাবে টুলের উপর উঠবে না। এবার বকবে আম্মু?’

সুহা ঠোঁট উল্টে মায়ের মুখের দিকে তাকালো। ব্রাশ নাগাল না পেয়ে টুল টেনে তার উপর চড়ে ব্রাশ নামানো তার কাছে নতুন কিছু না। তবে তার মায়ের কাছে নতুন। সে মেয়েকে বারন করেছে একা একা এসব পাকামো না করতে। পরে গিয়ে একটা যাচ্ছে তাই কান্ড হবে। কিন্তু সাবাব তার বিপরীত। এখন থেকেই মেয়েকে টুলে ওঠা থেকে শুরু করে গাছে ওঠাও শেখাচ্ছে সে। কারন সে চায়না তার মেয়ে কোনো কাজে অনভিজ্ঞ থাকুক। ছোট থেকেই সব কাজে তার একমাত্র মেয়ে পারদর্শী হোক।

—-‘ আম্মু-

—-‘ এখন আম্মু কি হু? আম্মু বারন করেছি না একা একা এসব করবে না? তাও কেন শুনোনা আম্মুর কথা?’

—-‘ বাবা বলে-ছে তো!’

মেয়ের কথায় হীর কপাল কুঁচকে তাকালো। একহাতে ব্রাশ আর টুথপেষ্ট নামিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল,

—-‘ বাবা বলেছে? কি বলেছে বাবা?’

সুহা যেন না চাইতেই কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলেছে! এবার যে মায়ের বকা থেকে তাকে তার বাবাও উদ্ধার করতে পারবে না। সুহা মুখে হাত চেপে চুপটি করে রইলো। হীর ব্রাশ তার মুখের কাছে এনে বলল,

—-‘ কি হলো? চুপ হয়ে গেলে কেন? আম্মু জিজ্ঞেস করছি না কি বলেছে বাবা?’

—-‘ আম্মু-(ঠোঁট উল্টে)

—-‘ আম্মু কি?’

—-‘ আম্মু-

পূনরায় ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো স্বরে ডাকলো সুহা। হীর ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—-‘ আম্মু শুনছি তো।’

—-‘ আম্মু ক্ষুদা পাই-সে!’

সুহা মুখে আঙ্গুল দিয়ে করুন চেহারা করে কথাটা বলল। হীর মেয়ের কথা শুনে বিদিব্যস্ত হয়ে পড়ল। দুই সেকেন্ডে জেরা বাদ দিয়ে মেয়েকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কোমল স্বরে বলল,

—-‘ এই তো মা, আমরা ব্রাশ করেই নাশতা করব।’

সুহা আর কিছু বলল না। হীর তার হাতে ব্রাশ দিতে সে অভিজ্ঞর মতো আয়নার দিকে ফিরে একা একাই ব্রাশ করতে লাগল। হীর মেয়ের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রুমের দিকে দেখল একবার। সাবাব এখনও যে উঠছে না। এবার আর তাকে ভালো ভাবে ডাকা যাবেনা। তার মতো করেই তাকে উঠাতে হবে।

সুহার ব্রাশ করা শেষ হতেই মা-মেয়ে দু’জনে পরিকল্পনা করে সাবাবের ঘুম ভাঙাতে গেলো। হীর হাতে করে এক গ্লাস জল নিলো আর সুহা বিছানায় উঠে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হীর আচমকা গ্লাস ভর্তি জল সাবাবের মুখে ঢেলে দিতেই সাবাব ঘুমের ঘোরে চেঁচিয়ে উঠে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে হাত তালি দিতে লাগল সুহা। সাবাব বোবা চোখে মা-মেয়েকে দেখে চলেছে। একবার হীরকে দেখছে তো একবার সুহাকে দেখছে। কাকে কি বলবে সে যেন কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। হা করে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগল সে। এরই মাঝে চোখে সানগ্লাস এঁটে একদম পরিপাটি হয়ে ঘরে ঢুকল ছোট্ট অভি। অভি সানিয়া আর নেহালের একমাত্র ছেলে। ঠিক পাঁচ বছর তার। এখনই তার ভেতরে নায়ক নায়ক ভাব। সব কিছুতে পরিপাটি থাকা চাই তার। কোনো উচ্ছৃঙ্খলা যেন তার চোখের বিষ। সে এসেছে মুলত সুহাকে নিতে। এবাড়িতে এলে সে তার বোনকে ছাড়া এক মুহুর্তও থাকেনা। সুহা তার একমাত্র কলিজার বোন। সুহার জন্য অভিবাবু যেন সব করতে পারে।

অভিকে আসতে দেখে সুহা নেমে পড়লো বিছানা ছেড়ে। অভির হাত টেনে বিছানার পাশে এনে তার বাবাকে দেখিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

—-‘ ভাইয়া দেকো বাবা,বাবা।’

অভি সাবাবকে এমন দশায় দেখে একটানে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেললো। সাবাবকে সাতসকালে কাকভেজা অবস্থায় দেখে তার হাসির ফোয়ারা উঠলো। হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরে বলল,

—-‘ মামা! মামা তুমি বিছানায় গোসল করেছো?’

সাবাব আঁড়চোখে হীরের দিকে তাকালো। হীর হাসতে হাসতে পেট চেপে বসে পড়ল সাবাবের পাশে। মেয়ের সামনে সাবাব না পারছে রাগতে আর না পারছে হাসতে। অবশেষে হীর কোনো মতে হাসির বেগ চাপিয়ে সুহা আর অভির উদ্দেশ্যে বলল,

—-‘ সুহামনি,অভি বাবু দু’জনে এবার নীচে যাও। আমি আসছি। সোজা গিয়ে ডাইনীংএ বসবে। এদিক ওদিক কোথাও ছুটবে না। আমি আসছি যাও তোমরা।’

অভি মাথা কাত করে হীরের আজ্ঞা পালন করে সুহাকে নিয়ে নীচে চলে গেলো। তারা যেতেই হীর উঠে দাঁড়ালো। সাবাবের উদ্দেশ্যে বলল,

—-‘ এতক্ষণ ভালো করে ডেকেছি শুনোনি। তাই এটা হলো তার শাস্তি। এবার জলদি উঠে ফ্রেশ হয়ে নীচে এসো। নীচে অনেক কাজ আছে। তোমাকে গত এক ঘন্টা যাবত খুঁজছে সবাই।’

হীর কথা গুলো বলতে বলতে গয়নার বক্স গুলো হাতে তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোতেই হাওয়ার বেগে ছুটে এসে তার পথ আটকালো সাবাব। পেছন মুড়ে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,

—-‘ আমার শাস্তি তো আমায় দিয়ে দিলে। এবার নিজের শাস্তিটার জন্য প্রস্তুত হও হীরপাখি।’

সাবাবের কথায় হীর চোখ দুটো বড়বড় করে আমতাআমতা করে বলল,

—-‘ ন-নিজের শাস্তি মানে? আ-আমি আবার কি করলাম শুনি?’

সাবাব আচমকা হীরের কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,

—-‘ কি করলে? জানোনা কি করলে?’

হীর চমকে উঠে নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বলল,

—-‘ এ-এ-কি! কি করছো? কেউ এসে পড়বে?’

—-‘ আসলে আসুক? ভয় পাই নাকি আমি? নিজের বউকেই তো ধরেছি!’

—-‘ ছাড়ো তো! একে তো বিয়ে বাড়ি ভরা মানুষজন আর তারউপর তুমি দরজা চাপিয়ে-

—-‘ শশশ একদম চুপ। এখন কোনো কথা হবেনা। শুধু রোমাঞ্চ হবে।’

হীরের বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। মুখ হা করে বলল,

—-‘ নির্ঘাত মাথাটা পুরোপুরি গেছে তোমার। ছাড়ো বলছি। সুহামনি এসে পড়বে কিন্তু?’

—-‘ সুহামনি এখন ভুলেও এ-ঘরে আসবেনা! আমার মেয়েকে আমি ভালো করে চি-নি-

—-‘ বাবা-

আচমকা দরজার খোলার শব্দ ভেসে আসার সাথে সাথে সুহার গলাও ভেসে এলো। সুহার গলা পেয়ে সাবাব হীরকে মুহুর্তেই ছেড়ে দিয়ে ছিটকে পড়লো দশহাত দূরে। হীর চোখ বড় বড় করে মেয়ের পানে তাকালো। মনেমনে সাবাবকে দু-চারটে বকা দিয়ে দ্রুত গিয়ে মেয়ের পাশে দাঁড়াল।

বাবা-মায়ের এমন মুহুর্তের মানে কি সুহার বোধগম্য না হলেও সে ফট করে এক অদ্ভুত কথা বলে বসলো,

—-‘ বাবা তোম-রা রোমানস কর-সিলে?’

মেয়ের এমন কথায় সাবাব-হীর দু’জনেরই চোখ জোড়া তার কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। সাবাব হীরের দিকে অসহায় মুখ করে তাকাতেই হীর চোখ পাকিয়ে তাকালো। সাবাব মাথা চুকলে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। হীর মেয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বকার সুরে বলল,

—-‘ বলেছি না সোজা ডাইনীং এ গিয়ে বসবে? আবার চলে এলে কেন?’

সুহা মায়ের বড়বড় পায়ের সাথে পা মেলাতে মেলাতে বলল,

—-‘ তুমি আস-সিলে না তাই-

—-‘ তাই আবার চলে এলে?’

—-‘ হ্যাঁ। আম্মু বাবা খাবে-না?’

—-‘ হ্যাঁ খাবে তো। বাবা ফ্রেশ হয়ে আসছে।’

মা-মেয়ের কথা কিছুদূর যেতেই মিলিয়ে গেলো। সাবাব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। বুকে হাত চেপে বিরবির করে বলল,

—-‘ মেয়ে তো আমার থেকেও এক ধাপ এগিয়ে!’

_______________🌺

আজ রোজ আর আদ্রিকের বিয়ে। সেই আমেজেই পুরো বাড়ি হয়ে উঠেছে রাজপ্রাসাদ। রোজের বিয়েতে হীর কোনো কমতি রাখবেনা বলেই সব কিছুই সাজিয়েছে নিজের মনের মতো। হীর ভুলে গিয়েছে রোজ তার মনির মেয়ে। সে রোজকে নিজের ছোট বোনের চেয়েও বেশি ভালোবেসে আগলে রেখেছে। এই পাঁচ বছরে হীর একজন পরিপূর্ণ মা এবং দায়িত্বশীল এক নারীতে পরিনত হয়েছে। এই গোটা সংসারটা সে গত পাঁচ বছর যাবত নিজে একা হাতে সামলাচ্ছে। নাজমা বেগমকে এখন সে ভুল করেও রান্নাঘরে পা রাখতে দেয়না। সবটা সে নিজের হাতে করে। নাজমা বেগমও যেন সব ভার হীরকে দিয়ে সন্তুষ্ট। হীর যে সবকিছুতে তার চেয়েও বেশি অভিজ্ঞ আর পারদর্শী। একা হাতে দশদিক সামলানোই এখন তার কর্তব্য।

বর এসেছে, বর এসেছে হুল্লোড় করে ছেলে-মেয়েরা সব ছুটে গেলো গেটের কাছে। বাবার বিশাল হাতের মুঠোয় সুহার ছোট্ট হাতখানা শক্ত হয়ে আঁটকে আছে। সেও বাবার সাথে বড়বড় ধাপ ফেলে বর দেখতে যাচ্ছে। পেছন পেছন অভিও আসছে তার বাবার সাথে। বরকে ভেতরে প্রবেশ করানো হলে সুহা আর অভি ছুটে গিয়ে বরের হাত ধরে দাঁড়ায়। আকস্মিক কোথা থেকে কারা এসে আদ্রিকের হাত ধরে প্রথমে বুঝতে পারেনা আদ্রিক। পরক্ষনেই নতমুখে দু’জনকে দেখে মুচকি হাসে। সুহা ও অভিও তার ন্যায় হাসে। বরকে তার আসনে এনে বসালো সবাই। এতো মানুষের ভীড়ে সুহা আর অভিকে নিয়ে আসে সাবাব। বাসার ভেতরে এসে ড্রয়িং রুমে কয়েকজন পরিচিত মেহমানদের মাঝে দু’জনকে বসিয়ে দিয়ে যায়। সেখানে অভির দাদীর সাথে বসে ছিলেন আদ্রিকের মা। ভদ্রমহিলাকে মাস খানিকের মাঝে বেশ কয়েকবার দেখেছে সুহা। তাই চোখ পিটপিট করে তাকে দেখতে দেখতে তার কাছে এগিয়ে গেলো। তার পাশে বসতে বসতে বলল,

—-‘ তুমি নানু-মনি?’

সুহার প্রশ্নে ভদ্রমহিলা মুচকি হেসে তাকায়। সুহার গাল টেনে বলে,

—-‘ না সোনা। আমি তোমার দাদুমনি।’

সুহা কারো সাথে ভাব জমাচ্ছে দেখে বেশ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এলো অভি। সুহার পাশে বসতে বসতে ভদ্রমহিলার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সে। ভদ্রমহিলা চুপ থেকে কিছুক্ষন পর আবারও বললেন,

—-‘ না সোনা। আমি তোমার দাদুমনি।’

ভদ্রমহিলার ফের একই জবাবে অভি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সুহা তার রোগ বুঝতে না পেরে হেসে উঠলো। অভি ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার মাঝে ভদ্রমহিলা আবারও বলে উঠলেন,

—-‘ না সোনা। আমি তোমার দাদুমনি।’

সুহা এবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। কিন্তু অভির বিস্ময় কিছুতেই কাটছে না। অভি ভ্রু কুঁচকে তার দিকেই চেয়েই রইলো। ভদ্রমহিলা অভিকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে ভাবুক কন্ঠে বললেন,

—-‘ তোমার নাম টা যেন কি?’

অভি ভ্রু কুঁচকেই জবাব দিলো,

—-” আমার নাম অভি।’

ভদ্রমহিলা দাঁত কেলিয়ে হাসলেন। অভির গাল টেনে বললেন,

—-‘ বেশ সুন্দর নাম।’

ভদ্র মহিলা অভির গাল থেকে হাত সরাতেই অভি নিজের গালে হাত বুলালো। এর অর্থ সে গাল টানা একদম পছন্দ করেনা। ভদ্রমহিলা হেসে আবার চুপ হয়ে গেলেন। ফের খানিক সময় পেরোতে পুনরায় অভিকে একই প্রশ্ন করলেন,

—-‘ তোমার নাম টা যেন কি?’

অভি এবার দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। সোফা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত চেপে বিরক্ত কন্ঠে বলল,

—-‘ আমার নাম অভি।’

ভদ্রমহিলা দাঁত কেলিয়ে হেসে জবাব দিলো,

—-‘ বেশ সুন্দর নাম।’

অভি কপাল কুঁচকে ভদ্রমহিলাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। মহিলার সমস্যা কি? এক কথা বারবার কেন বলছে? ভদ্র মহিলা এবার অভিকে ছেড়ে সুহাকে নিয়ে পড়ল। সুহা সোফার উপর ভর দিয়ে দু-গালে হাত দিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। ভদ্র মহিলা এক এক করে মোট সাতবার সুহার নাম জিজ্ঞেস করেছে। আর সুহাও খিলখিল করে হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছে,

—-‘ আমা-র নাম সুহামনি।’

꧁_____________༆❦︎°সমাপ্ত°❦︎༆_____________꧂

[シ︎আলহামদুলিল্লাহ। টানা ৭০টা পর্ব সম্পন্ন করে ভালোবাসার লম্বা সফর শেষ করলাম। শেষ পর্ব টা যখন লিখছিলাম তখন ভীষণ দুঃখ হচ্ছিল এই ভেবে প্রিয় উপন্যাস টা এখানেই সমাপ্ত করতে হবে! প্রিয় চরিত্র গুলো নিয়ে আর লেখা হবেনা এই ভেবে। তবে দুঃখ হলেও কি করার? শুরু যখন করেছি শেষ তো করতেই হবে। আর প্রিয় পাঠকদের বিষয়ে নতুন করে কি বলবো? যত বলবো ততই কম। আমার প্রতিটা পাঠক আস্ত একটা ভালোবাসা। যাদের প্রত্যেককেই মন থেকে ভীষন ভালোবাসি আমি। আমার লেখার জীবনের প্রথম থেকে সবাই আমাকে খুব সাপোর্ট করেছেন। আর বিশেষ কয়েকজন অবশ্যই আছেন। তাদের প্রতি দুইগুন বেশি ভালোবাসা। পরিশেষে এটা বলবো,আমায় সবসময় এভাবেই ভালোবাসুন আর সাপোর্ট করুন। সবাইকে ভালোবাসা। ধন্যবাদ।㋛︎❦︎]

4 COMMENTS

  1. জীবনে অনেক গল্প পরেছি, কিন্তু এই গল্পটার মত ছিল না।
    বিশ্বাস করেন গল্পটা যখন পরছিলাম তখন মনে হচ্ছিল,সবকিছুই যেন আমার সামনে গঠছে,এতটা জীবন্ত ছিলো গল্পের শব্দগুলো 🥰🥰🥰🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here