কাঠপুতুল পর্ব ১৬

#কাঠপুতুল
#লেখনীতে-তানভীন শিলা
#পর্ব-১৬
.
“ঘুমন্ত পাখিটাকে কতই না বাচ্চা বাচ্চা লাগতেছে। ইশ্ এই বাচ্চাটার জীবনে যদি আমি অভিশাপ হয়ে না আসতাম, তাহলে হয়তো বাচ্চাটা অনেক ভালো থাকতো। খুব কি ক্ষতি হতো আমার, মৃদপাখির জীবনটা এতোটা কষ্টকর না বানালে? উফ্ আমি এইসব কি ভাবছি, আমি তো আমার মৃদপাখিকে ভালোবাসি। না না মৃদপাখি শুধুই আমার, আমি ওর জীবনটা আবারো আগের মতো প্রাণবন্ত করে দিবো। এখন আমার উঠিৎ আন্বিষের সাথে কথা বলা।”
ঘুমন্ত মৃদুর মুখ দেখে ভাবছিলো পরশ।
.
“চুপ করে না থেকে টুপ করে বলে ফেলা। যদি কল করে সব না বলতি আই সয়ের তোকে খুন করার সব প্ল্যান আমার করা হয়েগিয়েছিল।”
“তুই খুব ডেঞ্জারাস মাল সেটা জানার পরেও আমি মৃদুলাকে নিজের করে নিতে চেয়েছিলাম এতে তোরও বুঝা উচিৎ ছিলো আন্বিষ ঠিক কি কি করতে পারে।”
“তা তো বুঝেই গেছি। সানজুকে পেয়ে আমার পাখিটার কথা মনে ছিল তোর? সানজু যদি সময়মতো উদয় না হতো আমি সত্যিই তোকে খুন করে ফেলতাম।”
.
ফ্ল্যাশব্যাক-
আন্বিষ মৃদুলাকে নিয়ে সোজা কাছের একটা হসপিটালে আসে। মৃদুলার ট্রিটমেন্ট চলাকালীন নার্স আন্বিষকে কিছু মেডিসিন নিয়ে আসতে বলে। তাড়াহুরা করে মেডিসিন নিয়ে ছুটে আসার সময় কারো সাথে ধাক্কা লেগে হাতে থাকা প্যাকেট পরে যেয়ে বিকট শব্দ করে উঠে। আন্বিষ ক্রুদ্ধ নয়নে সামনের মানুষটা দেখতেই স্তব্ধ হয়ে যায়, সাথে সামনের মানুষটাও। আন্বিষ মৃদু স্বরে বলে উঠে-
“সানজু? ‍তুই এখানে? আমি কি সত্যি দেখছি? তোকে আমি ফিরে পেয়েছি?”
সানজু আন্বিষকে দেখে তো অবাক হয়েইছিল সাথে আন্বিষের বলা কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারেনা।
“তুই এখানে কি করতেছিস আন্বিষ? কাছের কেউ বুঝি হসপিটালাইজড্? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি এখন আসি বাই।”
সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হয় যে, আন্বিষ বুঝে উঠতে পারেনা। সানজু চোখের আড়াল হতেই আন্বিষ হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে শুরু করে। ৩-৪মিনিট খুঁজে পেয়েও যায়। তারপর আন্বিষ সানজুকে জোড় করে মৃদুলার কেবিনের সামনে নিয়ে আসে। সানজু বেশ বিরক্ত হয় কারণ সে তার পরিচিত একজনকে হেল্প করতে এসেছিল আর এখন বেশ দেরি হয়ে যাচ্ছে।
“আন্বিষ প্লিজ আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই এখন নাটক করবিনা প্লিজ।”
“নিজের প্রতিচ্ছবিকে দেখবি সানজু?”
সেটা তো আয়নার সামনে দাড়ালেই দেখা যায়। এমন কাহিনী করার মানেই হয়না, আন্বিষের দ্বারা এমন বাচ্চামো মোটেই কাম্য নয়। ঠাস করে একটা জোড়েসোড়ে থাপ্পড় দিলে হয়তো আন্বিষের পাগলামো ছুঁটে যেতো। যত্তসব আউল বাউল ফাউল কান্ড করে এই ছেলেটা। সানজুর প্রচন্ড ইচ্ছে চেপেছে আন্বিষের ঠোট দুটো স্টিচ করে দিতে যাতে করে কোনো প্রকার ফালতু কথা না বলতে পারে। এমনিতেই ‍দেরি হচ্ছে তারমধ্যে মনের মানুষটার থেকে উল্টাপাল্টা আচরণ জাস্ট অসহ্যকর।
একপ্রকার জোড় করেই টেনে কেবিনে ঢুকে মৃদুর। সানজু মৃদুলাকে দেখেই থ মেরে যায়। একদম তার মতো মেয়েটা। শুধু দূর্বল হওয়ায় ফ্যাকাশে হয়ে আছে মুখটা, চেহেরারও অনেকটা মিল আছে তবে অনেক কম। নাক টা তো হুবহু মিলে সাথে অধরযুগলও।
“এটা পরশের মৃদুলা রে সানজু।”
পরশের মৃদুলা শুনতে অবাক হয় সানজু। কেননা পরশ মৃদুলার থেকে দূরে থেকেও কতটা পাগলামী করেছে তার স্বাক্ষী সে নিজেই একজন। মাঝে মাঝেই ডুকরে কেঁদে উঠতো, প্লেস দেখে কিছুই করতোনা। যেখানে সেখানে ‘আমি তোকে ভালোবাসি মৃদপাখি’ বলে অদ্ভুত আচরণ করতো। আর সানজু এখন খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে পরশ কেন তাকে ইগনোর করতো। ভালোবাসার মানুষটার মতো কেউকে দেখলে নিশ্চই ঠিক থাকা যায়না।
“মৃদুলা এখানে এই অবস্থায় কেন আন্বিষ?”
“পরশের মায়ের জন্য।”
“মানে?”
“আমি মৃদুলার মধ্যে অন্য কেউকে খুঁজে পেয়েছিলাম সানজু। তাই ওকে নিজের করে নিতে কিছু ভুল করে ফেলি আর সেজন্যই মৃদুলা এখানে।”
সানজুর বুঝতে বাকী রইলো না আন্বিষ কি বুঝাইতে চাইছে। সানজু আন্বিষকে আর মৃদুলাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। তারপর ৩দিন খুব সেবা করে মৃদুর। ৪র্থ দিন পরশকে কল করে ঠিকানা দিয়ে আসতে বলে সানজুর বাড়িতে।
“আচ্ছা বুঝলাম সব কিছুই। এখন বল তোর মাথার ভুত পালাইছে নাকি আমার কিছু করতে হবে?”
“নারে ভাই আমার সানজুই ইনাফ। মাফ চাই আর ভুল করবোনা প্রমিস। তুই ভাগ তোর মৃদপাখিকে নিয়ে।”
“সেটা তো যাবোই। অনেক কষ্ট পেয়েছে আমার মৃদপাখি এখন কষ্টদানকারীটাকে কষ্ট দেয়ার সময়।”
“তোর যা ইচ্ছা হয় কর।”
সানজু বলে-“পরশ সব ঠিক আছে তো? আমার সাথে তোর তেমন একটা কথা হয়নি কিন্তু তোর পাগলামীর অনেকটাই আমি দেখে এসেছিলাম।”
“হুম আন্বিষের সানজিদা আর আমার সানজিদা আপা সব ঠিক আছে।”
সানজিদা পরশ আর আন্বিষকে বসে কথা বলতে বলে নাস্তা তৈরী করতে চলে যায় কিচেনে। আর পরশ ভাবতে থাকে মাকে জেলে পাঠিয়ে কি ঠিক করেছে? আবার ভাবে অবশ্যই ঠিক করেছে। যদি আগে এই সত্যিটা জানতে পারতো তাহলে আরো আগেই তার মা জেলে ঘানি টানতো। মায়ের মতোই হয়েছে সে এটা ভেবেই আনমনে হেসে উঠে। পরশের হাসি দেখে কপালে ভাঁজ পরে আন্বিষের। এই হাসিটাও পরশের ঠোঁটে আসতো না যদি আন্বিষ সানজুকে না পেতো। আন্বিষ নিজের ভুলটা বুঝতে পারে। অযথাই মরিচিকার পিছনে ছুঁটে যাচ্ছিল সে, কেননা মৃদুলা আর সানজু দুজন সম্পূর্ণ আলাদা। মৃদুলার মোহ্ ইতিমধ্যেই কেঁটে গেছে দেখে আন্বিষ নিজেকে বকা দিচ্ছে, কেননা যদি সে ওমন একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েই এগিয়ে যেতো একসাথে সে সহ ৩টা জীবন নষ্ট হয়ে যেতো। সানজুর ফিলিংস তো পরে জানতে পারলো।
.
ঘুমের রেশ কাঁটতেই পানির তৃষ্ণায় হাত বারিয়ে পানির গ্ল্যাস নিতে যেতেই সেটা ঠাস করে নিচে পরে যায়। হাত তুলতেই প্রচন্ড ব্যথায় কাতরাতে থাকে মৃদু। ব্যথার কারণেই গ্লাসটা ধরতে পারেনি। এই শব্দটাই যথেষ্ট ছিল পরশের কলিজার পানি শুকিয়ে দিতে। রুমে ঢুকতেই দেখে মৃদু আধো শোয়া হয়েই বেডসাইড টেবিলে হাত দিয়ে আছে।
“মৃদপাখি তুমি ঠিক আছো তো? কিছু লাগবে তোমার? গ্লাসটা পরে গেল কেন? পানি পান করতে চেয়েছিলে? আমাকে ডাকলেই তো হতো। আচ্ছা সরি আমারই ভুল হয়েছে তোমাকে একা ছেড়ে যাওয়া।”
পরশের অস্থিরতায় বিরক্ত মৃদুলা। একটা গ্লাস পড়েছে বলে এভাবে রিয়েক্ট করতে হবে?
“একটু পানি দেবে প্লিজ?”
“হ্যাঁ ১টা মিনিট ওয়েট করো প্লিজ আমি এখনি গ্লাস নিয়ে আসছি ওকে?”
পরশ রুম থেকে বেড়িয়ে যেতেই আন্বিষ গেট থেকে এগিয়ে মৃদুলার কাছে আসে। মেয়েটাকে নিয়ে বাজে কিছু পরিকল্পনা করেছে, মনে পরলেই নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মাচ্ছে তার। কিভাবে ক্ষমা চাইবে এখন? ক্ষমা চাইলেই কি ক্ষমা করবে মৃদুলা? মৃদুলা তো এসব কিছুই জানেনা, জানানো কি ঠিক হবে? আন্বিষের ভাবনার মধ্যেই তড়িঘড়ি করে রুমে আসে পরশ। মৃদুকে পানি পান করিয়েই, ‍মৃদুর হাত নিজের হাতে নিয়ে ছোট ছোট চুমুতে ভরে দিতে থাকে। আন্বিষকে উদ্দেশ্য করে বলে-
“বের হওয়ার জন্য কি নিবি? দেখতে পাচ্ছিস না আমি আমার মৃদপাখিকে আদর করতেছি? বের হ।”
আন্বিষের খেয়ালই ছিলনা, পরশের থেকে এসব শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই আবারো ধমক দেয় পরশ। এবার আর দেরি করেনা আন্বিষ, বের হয়ে যায় রুম থেকে।
“মৃদপাখি আর কোন প্রকার কষ্ট পেতে দিবোনা তোমাকে। এখন থেকে শুধু আদর দিবো আর আদর দিয়ে দিয়ে পুরোই বাদর বানিয়ে দিবো।”
“বাদর! সেটা কিভাবে?”
“উপমার মানেটা হচ্ছে এতোটাই আদর দিবো যে তুমি পাগল হয়ে যাবে আর..”
“আর?”
“নিজে থেকে আসবে আদর নিতে।”
পরশের কথায় লজ্জায় লাল হয়ে যায় মৃদু। এই প্রথম পরশ এভাবে লজ্জা দিয়েছে। মৃদুকে লজ্জা পেতে দেখে পরশ বলে-
“মৃদপাখি এখনি লজ্জা পেতে হবেনা গো। এই একটু অল্প অল্প করে লজ্জা পাওতো, আমি অল্প অল্প করে ভাঙ্গাবো। তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাও তো আমি প্রেম প্রেম খেলবো।”
.
.
চলবে-
*

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here