কাঠপুতুল পর্ব ৭

#কাঠপুতুল
#লেখনীতে-তানভীন শিলা
#পর্ব-৭
.
“মৃদুলা কে পরশ?”
“আমার বউ”
পরশের সোজাসাপ্টা জবাবে অবাক হয় আন্বিষ।
“তাহলে আশনি? গার্লফেন্ড নিয়ে এসে তাকে বউ দেখাচ্ছিস?”
“আশনি সব জানে আন্বিষ। ও সব জানার পরেই নিজে থেকে এসেছে আমার সাথে।”
.
.
“মিফতি বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে।”
পরীর কথা শুনে বিষম খায় মৃদু। গলায় পানি আটকে গেছে যেটা গিলতে পাচ্ছেনা। পরী চটজলদি পিঠে চাপড় মেরে ঠিক করে মৃদুকে।
“কেন রে? আর বড়দের বুঝি এভাবে নাম ধরে বলে?”
“ইশ্ বড় মারাইতে আসছে হাহ্।”
“ছিঃ পরী জবানে লাগাম লাগা। কিসব বাজে কথা বলছিস? ভার্সিটিতে বুঝি এসব শিখায়?
“ধুর বাদ দে তো। ভাইয়া মিফতিকে বিয়ে করবেনা তাই মিফতি চলে যাবে।”
পরশ মিফতিকে বিয়ে করতে নাকচ করেছে শুনেই মৃদু খুশি হয়ে যায়। পরীকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রুম থেকে বের করে দেয়।
“তাহলে পরশ নিশ্চই আমাকে ভালোবাসে তাই মিফতি জঙ্গলি বিল্লিকে বিয়ে করবেনা। পরশ তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তোমাকে তুমি করে বলতে ইচ্ছে করছে, নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে করছে। ঘন্টার পর ঘন্টা সামনে দাড় করে রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার প্রবল ইচ্ছে জাগছে।”
.
.
“মা মৃদুলা কোথায়? আমাদের সাথে কেন খেতে বসেনি?”
“মৃদু পরে খাবেনি বাবা তোরা খেয়ে নে।”
“না মা মৃদুলাকে ডেকে আনো। আমাদের সাথেই খাবে।”
রুশানা বেগম জানেন পরশ মানবেনা তাই বাধ্য হয়েই পরীকে বলল ডেকে আনতে। পরী মৃদুলাকে নিয়ে আসে। পরশের মৃদুলাকে দেখেই রাগে চেহারা মুহুর্তেই পাল্টে যায়। মৃদুলার ফুল স্লিভ ব্লাউজ তো আছেই সাথে ইয়া লম্বা ঘোমটা। যাকে দেখার জন্য এতো বছর থেকে একটা রাত শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি সে তার চেহারা পর্যন্ত দেখতে দিবেনা? দিনের বেলায় কাজের চাপে নিজেকে ব্যস্ত রাখলেও দিনশেষে একটি চেহেরার অধিকারীনি খুব কষ্ট দিতো। এটা তো কিছুতেই মানা যায়না, পরশ তো এমন না-ইন্সাফি কিছুতেই সহ্য করবেনা। পরশের চেহারা দেখে টেবিলের সবাই রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছে। মিফতি তো কাঁপতেছে বলা চলে, কিন্তু মৃদুলার কোন হেলদোল নেই, থাকবেই বা কি করে? ইয়া বড় ঘোমটা যে দিয়ে রাখছে। পরশ চোখ-মুখ শক্ত করে গম্ভীর গলায় মৃদুলার উদ্দেশ্যে ঠাটিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে মারে-
“মৃদুলা!!! তুই কি নতুন বউ যে ঘোমটা দিয়ে বের হতে হবে তাও আবার নিজের বাড়িতেই? আর ঘোমটাই বা দিবি কেন এটা কি তোর শশুড়বাড়ি যে লজ্জা পেতে হবে?”
পরশের কথা শুনে শুধু মৃদুই না বাকীরাও অবাক। মৃদুলা তো পরশের বউ-ই তো এভাবে বলার কি আছে?
“ভাইয়া ও তো এবাড়ির বউ-ই আর তাছাড়া……(পরীকে বলতে না দিয়ে)”
“খুব বড় হয়ে গেছিস না? আমার কথা বলার মধ্যে তোর সাহস কীভাবে হয় কথা বলার? হাউ ডেয়ার ইউ?”
পরশের রাগ সম্পর্কে সবাই কম-বেশি অবগত তাই রুশানা বেগম মৃদুকে বলে ঘোমটা সড়াতে। মৃদু ঘোমটা তুলে মাথায় রাখে।
“পরশ তো মৃদুকে দেখে প্রচন্ড রকমের অবাক। এটা কাকে দেখতেছে সে? ‍এটা মৃদু? আমার মৃদু? মনে হচ্ছে পরশের কলিজায় কেউ হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিষে দিচ্ছে। রক্ত চলাচলে বাঁধা পরলে যেমন হয় ঠিক তেমন মৃদুর অবস্থা। জীবন্ত মরা মানুষ। তাজা গোলাপ রেখে গিয়েছিলাম আর আসার পর শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ পেলাম? এজন্যই কি পরী বলেছিলো আমি তোর জীবনটা কয়লা বানিয়ে ময়লা করে দিয়েছি?? না মৃদু তোকে সুস্থ হতে হবে তবে নিজের জন্য না আমার জন্য।”
.
পরশের এভাবে তাকিয়ে থাকায় বেশ অস্বস্তিতে পরে মৃদুলা। একবার চোখা-চোখি হতেই চোখ নামিয়ে নেয় মৃদু। একনজরে পরশকে খুব ভালোভাবে দেখেছে মৃদু। চুলগুলো আগের মতোই আছে তবে খুবই সিল্কি আর কার্ল নেই ষ্ট্রেইট, কপালে পরে থাকা চুলগুলোয় দারুণ মানিয়েছে পরশকে, ঠোঁটদুটো এতোটাই লাল যেনো টোকা দিলেই রক্‌ত ঝড়বে, ব্ল্যাক গেট আপে ফর্সা বলিষ্ঠ দেহ অনেক বেশি আকর্ষনীয় করে তুলেছে, আর ধূসর চোখের মনি দুটো বড্ড চঞ্চলতা জাহির করতে ব্যস্ত। প্লেটে একফোঁটা পানি পরতেই মৃদু গালে হাত দিয়ে দেখে ওর চোখ দিয়ে পানি বেরোচ্ছে!! এতো কষ্ট পেয়েও যেখানে চোখে পানি আনতে পারেনি, সেখানে পরশকে একনজর দেখেই পানিরা নিঃস্বার্থহীনভাবে নিজেদের ঝড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরলো? চোখের পানিগুলো হয়তো পরশের জন্যই নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিলো। পরশ আসলেই পরশকে আলিঙ্গনে মত্ত্ব হবে তারা।
পরী পরিস্থিতি সামলাতে বলে-
“ভাইয়া সব ভাবি রান্না করেছে খেয়ে দেখতো কেমন হয়েছে। আজ তো তুই প্রথম ভাবির হাতের তৈরীকৃত খাবার খাবি।”
পরীর ভাবি বলটা না রুশানা বেগমের না সুমেনের বাবা-মায়ের আর না আন্বিষ এর পছন্দ হলো।
“মৃদুলার রান্না করা? তাহলে নির্ঘাত কিছুই খেতে পারবোনা। ওর নরম হাতের আধা সিদ্ধ খাবার কেমনে ভালো হতে পারে।?”
“কি যা তা বলছিস? ৩বছর থেকে ভাবি সব একাই রান্না করতেছে। আর ওর হাত অনেক বেশিই শক্ত বলা চলে। ভাবির রান্না করা খাবার আমি আমার হোস্টেলে নিয়ে যাই, আমার রুমমেটদের জন্য। না নিয়ে গেলে আমাকে পানিশ করে ওরা।”
“৩বছর থেকে আমার মৃদু রান্না করতেছে? ও তো কিছুই করতে পারতো না। খুব কষ্ট হয়েছে নিশ্চই? আগে খেয়ে দেখি।”(মনে মনে বলে পরশ)”
পরশ খাবার মুখে দিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে থাকে। এটা ওর বিশ্বাসের বাহিরে যে মৃদুর রান্না করা খাবার এতো ভালো হতে পারে। মৃদুকে পাওয়ার জন্যই তো স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে দিয়েছিল ‍ওর খালামনি। এতো আদরের মেয়ে তাদের আজ এতো কষ্ট করতেছে? কিছুই তো করতে দিতোনা মৃদুলাকে ওর মা-বাবা।
“সরি রে ‍মৃদু তোর লাইফটা সত্যিই হেল করে দিয়েছি আমি। ”(মনে মনে বলে পরশ)”
.
সবাই খাবার পরে যে যার রুমে চলে যায়। পরশ, আন্বিষ আর আশনিকে সারাদিন বিশ্রামের উপরে থাকার কড়া আদেশ জানিয়েছেন কাকু। সন্ধ্যায় আন্বিষ পরশের রুমে যায় কথা বলতে, যেটা বলার জন্য সে খাওয়ার পর থেকে আকুপাকু করতেছে।
“পরশ ভাই আমার, তোকে কিছু বলতে চাই। মানে কিছু জানতে চাই।”
“আমি জানতাম তুই আসবি। বল কি চাই তোর??”
“তুই কি সত্যিই মৃদুলাকে ডিভোর্স দিবি? মানে সিরিয়াস তুই?”
“না হওয়ার কি আছে? ওকে ডিভোর্স না দিলে তোর বোনের কি হবে??”
“না ওটা জানতে চাইনি আসলে…. মমম আই লাইক হার ম্যান।”
“হুম?(জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় পরশ)”
“আমার মৃদুলাকে চাই পরশ। একটু দুর্বল তাতে কি? আমি ওকে ঠিক করে দিবো। তুই তো ওকে ছেড়ে দিবিই তো আমাকে দেনা প্লিজ।”
“পি্‌লজ? তোর কি ওকে কোনো ফ্যালনা মনে হয় যে আমি ওকে ছেড়ে দিলাম আর ও তোর কাছে চলে গেলো? মৃদু এইবাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেনা তাই ওকে পাওয়ার চিন্তা ভুলে যা।”
“চেতিস কেন বলতো? আচ্ছা প্রবলেম নাই আশনিকে বিয়ে করে তো এখানেই থাকবি আমিও নাহয় মৃদুলাকে বিয়ে করে এখানেই থাকলাম। মৃদুলার জন্য আমি কিছু ফিল করেছি পরশ, যেটা আমাকে জানান দিচ্ছে আমার ওকে চাই-ই-চাই।”
পরশ আন্বিষকে কিছু না বলে বের হয়ে যায়।
.
রাত ১১টা
.
মৃদুলার রুমের দড়জায় কেউ নক করতেছে এতে মৃদুলা চরম বিরক্ত। কয়েকদিন থেকে বেশ আছে সে। কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই। হঠাৎ কে এলো? নিশ্চই পরী? এক বস্তা বিরক্তি নিয়ে গেট খুলে অবাকের চরম পর্যায়ে মৃদু।
“আপনি এতো রাতে আমার রুমে? পরশ কোন উত্তর না দিয়েই মৃদুকে ধাক্কা দিয়ে রুমের ভিতর ঢুকিয়ে নিজেও ঢুকে দড়জা বন্ধ করে দেয়। পরশের হাতে একটা ব্যাগ। ব্যাগ মৃদুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে-
“মৃদু ব্যাগে যা আছে এখনি পরবি যা চেঞ্জ করে আয়।”
“এখন?? না এখন চেঞ্জ করতে পারবোনা।(ঘুমু ঘুমু কন্ঠে)”
“আমি হেল্প করবো?”
“এ্যা?(পরশের কথা না বুঝে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় মৃদু)”
পরশ কিছু না বলে মৃদুর আঁচলে হাত দিতেই মৃদু পরশের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে দৌড় লাগায় ওয়াশরুমে।
পরশ যা বলে তা সে করেই করে। এতো রাতে চেঞ্জ কেন করবে আর এমন কি আছে ব্যাগে ভাবতে ভাবতেই ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে খুব জোড়ে একটা ধাক্কা খায়। থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর স্লিভলেস টপ!! এগুলো পরে কিভাবে বের হবো? হায় আল্লাহ্ কি করবো আমি এখন?
“মৃদু তুই কি বের হবে নাকি আমি ভিতরে আসবো?”
“উফ্ কি করি এখন?-ভাইয়া আর ২মিনিট।”
“জলদি বের হ।(কিছুটা রেগে বলে)”
.
ওয়াশরুমে মৃদুর একটা প্লাজো থাকায় সে প্লাজো আর টপের উপরে ওরনা না থাকায় খুব সুন্দর করে তোয়ালা পেঁচিয়ে বের হয়। পরশ মৃদুকে দেখে কিছুক্ষণ কপালের ফুলে ওঠা রগটাকে দাবিয়ে ঘষে। যে কারণে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর টপ দিয়েছিল সেটাই তো দৃশ্যমান নয়। পরশ নিজের রাগটাকে কিছুটা দমিয়ে মৃদুকে খাটের উপর ছুড়ে মারে। মৃদু বেশ ভয় পেয়ে যায়। পরশ একটানে তোয়ালা টেনে খুলে স্তব্ধ হয়ে যায়। পরশ অনুভব করে ওর গাল বেয়ে নিঃশব্দে পানি পরছে। কিছু না বলে মৃদুকে ওভাবেই ফেলে বের হয়ে যায় পরশ।
.
.
চলবে-
.
*

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here