#কিছু_কথা_প্রজাপতি।
#পর্ব:- দুই-(শেষ)
সাইফের নাম্বার বন্ধ পেয়ে আমার কান্না আসতে লাগলো। আমি আরো দুবার কল দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে সুপারভাইজারের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
বললাম,
“ ওনার নাম্বার তো বন্ধ পাচ্ছি ভাইয়া। এখন কি করবো? ”
“ আমাদের তো কিছু করার নেই। ঘটনাস্থল থেকে আহতদের সবাই উদ্ধার করতেছে। যদি সুস্থ থাকে বা আহত হয়ে থাকে তাহলে তো খবর পাবেন। ”
“ সেখানে আপনাদের কেউ নাই? ওনার বিষয় কোনো সন্ধান দিতে পারবে না? ”
“ না আপু, যে গাড়িটা পিছনে ছিল সেটা কিছুক্ষণ সেখানে থেকে আবার চলে গেছে। যেই ফিলিং স্টেশনে আমরা যাত্রা বিরতি করেছিলাম সেখান থেকে আমাদের লোক যাবে। তারা গেলে তারপর বলতে পারবো। ”
“ কি করি এখন? ”
“ ওনার নাম কি আপু? আর ওনার ফোন নাম্বারটা আমার কাছে দিন। আমি আমাদের বাগেরহাট কাউন্টারে কল দিয়ে সিট নাম্বারটা জিজ্ঞেস করি। যদি পিছনের দিকে সিট হয় তাহলে চিন্তা নেই, কারণ পিছনে যারা ছিল তারা ঠিক আছে। ”
নাম্বার নিয়ে সুপারভাইজার সামনে চলে গেল। আমি মোবাইলে ভাইয়ার নাম্বার বের করে তাকে কল দিলাম। ভাইয়ার কাছে সবকিছু বললাম, ভাইয়া বললো,
“ এতে কান্নার কি আছে, তুই সাবধানে আয়। বাগেরহাট আসার পর দেখি কি করা যায়। একটা না একটা খবর পাবি। ”
বাগেরহাট বাসস্ট্যান্ডে ভাইয়া আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বাস থেকে নেমে ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হলো। আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে ভাইয়া বললো,
“ এ কি অবস্থা হয়েছে তোর? এতক্ষণ ধরে কি কান্না করছিলি নাকি? ”
আমি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললাম,
“ ভাইয়া উনি বেঁচে আছে কিনা সেটাই তো জানি না। খুব খারাপ লাগছে আমার। ”
রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। হঠাৎ দেখি সেই সুপারভাইজার আমার কাছে আসলেন। বললেন,
“ আপু খবর পাওয়া গেছে, ওই ভাইয়া বেঁচে আছে। তবে হাতে আর মাথায় আঘাত লেগেছে। ”
আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে বললাম, “ আপনি কি নিশ্চিত যে তিনি বেঁচে আছেন? আপনি তো তাকে চেনেন না তাহলে কীভাবে বুঝলেন? ”
“ আমাদের যে-সব লোক সেখানে আছে তাদের কাছে বলেছিলাম যে সাইফ হাসান নামের একজন যাত্রী আছে। কালো টিশার্ট পরা লোকটার কি অবস্থা সেটা যেন জানায়। এইমাত্র ওরা জানালো যে ওই ভাইয়া বেঁচে আছে। ”
“ তাহলে ওনার নাম্বার বন্ধ কেন? ”
“ তা তো জানি না। ”
“ আমি কি একটু তার সঙ্গে কথা বলতে পারি? মানে আপনাদের সেই লোকদের মাধ্যমে একটু ব্যবস্থা করা যাবে? ”
“ আচ্ছা দেখি চেষ্টা করে। ”
মিনিট পাঁচেক পরে সাইফের সঙ্গে কথা বলতে পারলাম। ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে ততক্ষণে আমি বেশ স্বাভাবিক হয়েছি।
“ হ্যালো বৃষ্টি। ”
“ আপনি কেমন আছেন? ”
“ আমি ঠিক আছি, শুধু মাথা আর হাত কেটে গেছে। তবে সামনের দিকে যারা ছিল তাদের মধ্যে অনেকেই মা’রা গেছে। টিকিট পেয়েছিলাম সবার পিছনে তাই হয়তো রক্ষা পেলাম। ”
“ আপনার মোবাইল কোই? আমি কল দিয়ে নাম্বার বন্ধ পেলাম বারবার। অনেক চিন্তা হচ্ছিল। ”
“ আসলে আমি জানালা খুলে মোবাইল দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের ভিডিও করতেছিলাম। হঠাৎ বাস ধাক্কা লেগে নিয়ন্ত্রণ হারানোর সময় মোবাইল হাত দিয়ে ছিটকে পড়ে গেছে বাহিরে। ”
“ আমি এখন আসতেছি ওখানে, আপনি থাকবেন নাকি চলে যাবেন? ”
“ আপনি যদি আসেন তাহলে থাকবো। মাথায় তো ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। সমস্যা নেই আর। ”
“ ঠিক আছে আমি আর ভাইয়া আসছি। আপনি সাবধানে থাকবেন। ”
“ বৃষ্টি শুনুন! ”
“ হ্যাঁ বলেন শুনছি। ”
“ নাহ কিছু না, কথা জমুক সব একদিনে বলবো। ”
কল কেটে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়া বললো,
“ কোথায় যাবি তুই? ”
“ ভাইয়া চলো না আমরা যাই। ”
“ যাবার কি দরকার বৃষ্টি? বাবা বারবার কল দিচ্ছে আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তাছাড়া সে তো বেঁচে আছে, সুস্থ হয়ে ঠিকই নিজের বাসায় ফিরে যাবে। আমাদের গিয়ে কাজ কি? ”
“ কিন্তু আমার তো পাশে থাকা দরকার। এতবড় একটা এক্সিডেন্ট থেকে রক্ষা পেল তাই না। ”
“ বৃষ্টি , তুই কি ভুলে গেছিস বাবা অন্য যায়গায় তোর বিয়ের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। যার সঙ্গে তোর বিয়ে হবার কথা ছিল কিন্তু হয়নি, এখন যদি সেই ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাস তাহলে বাবা কি পরিমাণে রাগ করবে ভেবে দেখেছিস? ”
নীরব দৃষ্টিতে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা আঙ্গুলে আমার দ্বিতীয়বার আংটি প্রবেশ করেছে পনের দিন আগেই। সাইফকে দেখে হয়তো কয়েক মুহূর্তের জন্য সবকিছু ভুলেছিলাম। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ফুফুর বাসা থেকে গ্রামে যাবার প্রধান উদ্দেশ্য আমার বিয়ে।
কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাইয়া বাইক নিয়ে এসেছে, একটু পরে বাইকে উঠে গ্রামের দিকে রওনা দিলাম। চোখ দিয়ে খানিকটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মনে মনে ভাবলাম, মানুষটা হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। আসার সময় সুপারভাইজারকে খুঁজেছিলাম যেন তিনি তার সেই লোকটার কাছে বলে সাইফকে অপেক্ষা না করতে। কিন্তু সুপারভাইজারকে কোথাও খুঁজে পেলাম না।
..
..
..
সবকিছু শুনে বাবাও অনেক রাগ করলো। যারা এমনভাবে সেদিন বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে তাদের সঙ্গে কেন কথা বলতে গেলাম। তাছাড়া যেহেতু আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে আবারও তাই এরূপ অবুঝের মতো কাজ কেন করলাম। বারবার শুধু এইসব অভিযোগ করতে লাগলো বাবা।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পিছন থেকে ভাবি এসে আমার কাঁধে হাত রাখলো। বললেন,
“ এভাবে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ”
“ ভাবি আমি না একটা ভুল করেছি! ”
“ কি ভুল? ”
“ সাইফ আমার হাতটা ধরেছিল। আমার হাত ধরে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করেছিল আমি তাকে বিয়ে করবো কিনা। ”
“ তুমি তাকে বলো নাই তোমার বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক হয়ে গেছে। ”
“ না ভাবি বলিনি। আমি আসলে তখন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভাবি তুমি একটা অনুরোধ রাখবা? বাবা আর ভাইয়াকে একটু বুঝিয়ে বলো না ওরা যেন এই বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়। আমি ওই সাইফকে বিয়ে করতে চাই ভাবি। তুমি তো জানো আমি আজও তাকে ভুলতে পারিনি। ”
“ সেটা হয়না বৃষ্টি, তাছাড়া সাইফ তোমাকে বিয়ে করবে তার কি গ্যারান্টি আছে? যে একবার সব নষ্ট করেছে তাকে আবার পুনরায় তোমার বাবা ভাই কেউ বিশ্বাস করবে না। ”
“ ভাবি ওনার তো দোষ নেই। ওনার মামা সবকিছু করেছে, তিনি আমাদের বিয়ে ভেঙ্গেছে। সাইফ এসব কিছুই জানে না ভাবি। ”
“ বৃষ্টি শোনো, তোমার এবারের বিয়ের ব্যবস্থা কিন্তু আগের চেয়ে বেশি ধুমধামে হবে। তাই চাইলেই আমরা বিয়ে ভাঙ্গতে পারবো না। আর তাছাড়া তুমি একা এক জীবনে কেন বারবার এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। ”
..
..
..
তিনদিন পার হয়ে গেল।
নিজের রুমেই ঘুমিয়ে ছিলাম, ভাবির ডাকে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসলাম। জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের সূর্যের আলো রুমে প্রবেশ করছে।
ভাবি বললেন,
“ সাইফ এসেছে? ”
চমকে উঠে ভাবির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম।
“ হ্যাঁ সত্যি বলছি, সামনের রুমে তোর ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলছে। তোর সঙ্গে দেখা করতে চায়। তোর ভাইয়া সাইফকে সবকিছু বলেছে। ”
“ কি বলেছে? ”
“ তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আগামী সোমবার তোমার বিয়ে এইসব। সাইফ বললো যে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলে তারপর নাকি চলে যাবে। ”
মাথায় ব্যান্ডেজ সাইফ বসে আছে। আমি ভাবির সঙ্গে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সাইফ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। বললো,
“ আপনার ভাইয়া বললেন আপনার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি তো জানতাম না এটা। জানলে সেদিন বাসে ওঠার সময় আপনাকে দেখে ওভাবে ছুটে যেতাম। আমার জন্য আপনাকে বিভ্রান্ত হতে হতো না। আমাকে ক্ষমা করবেন। ”
আমি কিছু বললাম না। সাইফ বললো,
“ বাড়িতে ফিরে মামার কাছে জিজ্ঞেস করেছি। গ্রামের মেম্বর হিসেবে নিজের একটু সম্মান আছে তার। তাই তো একমাত্র ভাগ্নের জন্য এইচএসসি ফেল করা মেয়ে বিয়ে করাতে চান নাই। তবে মামা বুঝতে পেরেছিলেন আমি আপনাকে অনেক পছন্দ করেছিলাম। তাই আমাকে না জানিয়ে তিনি একা একাই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছেন। এমনভাবে কাজটা করেছেন যে আমি আপনাদের ভুল বুঝি আবার আপনারা আমাকে ভুল বোঝেন। ”
ভাইয়া বললো,
“ দেখো ভাই, এসব ইতিহাস আমাদের শুনিয়ে কোনো লাভ নেই। আমরা তোমাকে এবং তোমার মামাকে ভুলে গেছি। আমার বোনের আরো ভালো যায়গা বিয়ে দিচ্ছি। তুমি এখন যাও। ”
সাইফ আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দুপা সামনে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
“ যদি ভাগ্যে থাকে লেখা ,
হয়তো আবার হবে দেখা।
কিছু মুহূর্ত শুধু কল্পনায় সুন্দর। আপনার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল। ”
সাইফ বের হয়ে গেল। আমি তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুকের ভেতর থেকে কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হলো। জীবন তো এরকম না হলেও পারতো।
আমি দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।
রাত দশটার দিকে বেলকনিতে বসে বসে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকি। একহাতে মোবাইল আর অন্য হাতে সাইফের সেই ভিজিটিং কার্ড। বারবার নাম্বার উঠিয়ে কল দিতে ইচ্ছে করছে। কল দিলে হয়তো নাম্বার বন্ধ পাবো। আর যদি সে সিম নতুন করে রিপ্লেস করে তাহলে চালু থাকবে।
নাম্বারটা মোবাইলে তুললাম। কল দেবার ঠিক আগ মুহূর্তে বাবা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ বৃষ্টি আসবো? ”
আমি বেলকনি থেকে রুমে গিয়ে বাবাকে ভিতরে আসতে বললাম। বাবার মুখটা অন্ধকার।
বললাম,
“ কি হয়েছে বাবা? তোমার মন খারাপ কেন? ”
“ একটা সত্যি কথা বলবি? ”
“ আমি তো তোমাকে কখনো মিথ্যা বলি না বাবা। আজও যেটা বলবো সেটা সত্যিই বলবো। ”
“ তোর ভাবি বলছিল সাইফ ছেলেটার সঙ্গে আবারও দেখা হবার পর থেকে তুই অন্যরকম হয়ে আছিস। এখন যেখানে বিয়ে ঠিক হয়েছে সেখানে বিয়ে হলে তোর নাকি কষ্ট হবে। এটা কি সত্যি? ”
বাবার প্রশ্ন শুনে চুপ করে রইলাম। বাবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“ জীবন তো একটাই মা তাই না? সাইফের মা আমাকে কল দিয়েছিল। সন্ধ্যা বেলা ওর মামা এসেছিল আমাদের বাজারে। তাদের একটাই অনুরোধ যে তারা সাইফের সঙ্গে তোর বিয়ে দিতে চায়। এদিকে তুইও হয়তো সাইফের প্রতি দুর্বল। এখন আমি কি করি বল তো মা? আমি তো চাই না তোর কষ্ট হোক। ”
“ বাবা তোমার মতো আমিও তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমার জন্য তোমার কোনো সমস্যা হোক সম্মান নষ্ট হোক সেটাও চাই না। তুমি আমার জন্য যা সিদ্ধান্ত নেবে আমি সেটাই করবো। ”
“ আমি তো ভাবছি সাইফের সঙ্গেই তোর বিয়ে দিয়ে দেবো। একটু আগে মেহেদীর বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে, তাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে বললাম। একটু রাগারাগি করছে তবে আমার মনে বিয়েটা বন্ধ করা যাবে। ”
বাবার দিকে তাকালাম, বাবা খানিকটা খুশির হাসি দিয়ে বললো,
“ আমার তো পাঁচটা সাতটা মেয়ে নয় যে যেমন তেমন বিয়ে দেবো। বিয়ের পরে তুই যদি ভালো থাকতে না পারিস তাহলে আমি শান্তি পাবো কীভাবে বল তো? তুই চিন্তা করিস না মা, আমার যা করা লাগে আমি করবো। কিন্তু তোকে আমি ওই সাইফের হাতেই তুলে দেবো। ”
..
..
..
আমাদের বিয়েটা হলো সোমবারে।
যেহেতু এই তারিখেই আমার অন্য বিয়ের তারিখ ঠিক করা ছিল তাই সেই তারিখ আর পরিবর্তন হয়নি। বহু নাটকীয় ঘটনার সমাপ্তি শেষে আমার আর সাইফের বিয়েটা হয়ে গেল।
লাল শাড়ি পরে বাসর রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি যখন সাইফকে প্রথম জড়িয়ে ধরলাম। তখন সাইফ আমাকে তার বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“ কিছু কথা প্রজাপতি,
সারাজীবন সঙ্গের সাথী।
যদি ভাগ্যে থাকে লেখা ,
থাকবো কেন একা?
খুঁজে নেব পৃথিবী জুড়ে৷
মনের কোণে গহীন নীড়ে। ”
সমাপ্ত।