#কি-ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-৩২
“মৈত্রী, খাবারের ব্যাগ রেখেছো গাড়িতে?”
“না মামনি”
“কি যে করোনা! সেটাই তো আগে দিলাম। ময়ূখ ভেতরেই আছে এখনো তাই না ওকে কল দিয়ে বলো ব্যাগটা নিয়ে নামতে।”
কথা ছিল মৈত্রী আর ইরশাদ যাবে সিলেটে৷ কিন্তু যাওয়ার আগের রাতে কি করে যেন পরিস্থিতি বদলে গেল। ইরশাদকে যে বাড়িটি অফিস থেকে দেওয়া হয়েছে সেটা মোটামুটি বড় এক বাংলো বাড়ি৷ সেখানে নতুন অবস্থায় গিয়েই দুজনে মিলে কতটুকু গোছাবে, কি করবে কি ভাবে করবে ভেবে ভেবে কিছুটা চিন্তিত ছিল রোকসানা, মুজিব। সেই চিন্তা তারা যখন ইরিনের সামনেও প্রকাশ করলেন তখন ইরিন বলল, ” আপা আমিও তেমনই ভাবছিলাম।”
ইরিন যখন ফোনে রোকসানাকে এসব বলছিলেন পাশেই ছিলেন ফকরুল। সে হঠাৎ করে বলে ফেলল, “তুমি, ভাবী আর ময়ূখও না হয় সঙ্গে যাও। শুনেছি বাড়িটা বড় তোমরা সবাই মিলে গুছিয়ে সাজিয়ে দু দিন ঘুরে ফিরেও এলে।”
কথাটা মনে ধরলো ইরিনের তাই সাথে সাথেই রোকসানাকেও জানালেন। তারা এমনটাই চাইছিলো সকলে তাই রাতেই মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল সবাই যাবে একসাথে। ময়ূখ রাতেই বড় গাড়ি ভাড়া করলো। ময়ূখ তার আব্বুর গাড়ি নিয়ে ড্রাইভারকে রাতেই ফিরে যেতে বলল। নতুন সংসার ঘরদোরের অনেক জিনিস লাগবে তাই ইরিন তাদের ভাড়া বাড়ির আসবাব সব ইরশাদকে নিতে বলেছিলেন। বছর পাঁচেকের ফার্ণিচারগুলো এখনও চকচকে কিন্তু মুজিব সাহেব আবদার করলেন মেয়ের ঘর তিনি সাজিয়ে দেবেন। সত্যি বলতে এই দিকটা ইরশাদ কিংবা ফখরুল কারোই পছন্দ হয়নি। মৈত্রী যখন বুঝলো শ্বশুর আর স্বামী দুজনেই রাজী নয় তার বাবার বাড়ির জিনিসগুলো নিতে এদিকে বাবারও মন খারাপ হচ্ছে তখন সে সকলের সামনে মুখ খুলল, “ও বাড়ির ডাইনিং টেবিল আর কিচেন সামগ্রীগুলো আমার খুব ভালো লাগে। আন্টির রুমের আলমারিটাও খুব সুন্দর আর ফ্রিজটাও মিডিয়াম সাইজের সেগুলো নিয়ে যাই আমরা। আর বাবার পছন্দে না হয় কিছু কিনি?”
মৈত্রী কথাটা খুব ভয়ে ভয়েই বলেছিল৷ কিন্তু তার বলার উদ্দেশ্য বোধগম্য হতেই সকলে রাজী হয়ে গেল। ইরশাদ চুপচাপ শুনেছিলো তার কথা এখানে তার আর বলার কিছু নেই। যাওয়ার সময় বেছে বেছে মৈত্রীর বলা জিনিসগুলোই নেওয়া হলো। ইরশাদ তার গাছগুলো কিছু সঙ্গে নিলো আর পাখির খাঁচায় আনা নতুন এক জোড়া পাখি নিয়ে বাকি এক জোড়া আর বেছে বেছে গোলাপ আর চন্দ্রমল্লিকার দুটো টব বাড়ি রেখে গেল। ময়ূখকে বলে গেল পরের বার ঢাকা যাওয়ার সময় যেন এগুলো মেহেরের জন্য নেয়।
রাতে রওনা দিলে কারো খুব একটা ক-ষ্ট হবে না ভেবে রাত করেই বেরিয়েছে তারা। ময়ূখ ড্রাইভার এর পাশে বসেছে। পরের সিটগুলোতে বড়রা আর শেলি বসেছে। একদম পেছনের সিটে ইরশাদ আর মৈত্রীকে বসতে বলা হয়েছে। ইরশাদ চাইছিল মৈত্রী প্রথমে বসুক তারপর সে পাশে বসবে কারণ মিশুও বসবে তাদের সাথে। গত দু রাত ধরে দুজনের মধ্যকার যে দূরত্ব তার কারণ ইরশাদ এখনো জানতে পারেনি। সুযোগও হয়ে উঠেনি এ নিয়ে মৈত্রীকে আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করার। একই ঘরের দুজন হয়েও কেমন হঠাৎ এক অদৃশ্য দেয়ালের দু প্রান্তের হয়ে আছে তারা। মৈত্রী নিজেও বুঝতে পারছে তার করা আচরণটা ভু-ল। ইরশাদের সাথে কথা না বলে আগেই এমন বৈরী আচরণ সম্পর্কের ওপর কতোটা ক্ষ-তি-কা-র-ক। কিন্তু মন অবুঝ তা এখনই মানতে চাইছে না কিছু। নিজের মত নিজেকে শান্ত করে তবেই যেন ইরশাদের মুখোমুখি হবে প্রশ্ন নিয়ে। অথচ সে বুঝতেই পারছে না তার মন আসলে আগে প্রশ্নের উত্তর না জেনে শান্ত হবে না। ইরশাদের পাশে বসেনি মৈত্রী। মিশুকে বসিয়ে দিয়েছে ইরশাদের পাশে তারপর সে বসেছে। সামনের কেউ খেয়াল না করেনি জিনিসটা কিন্তু ইরশাদ কোন রিয়াক্ট না করে সেভাবেই বসে রইলো। গাড়ি চলছে গন্তব্যে ইরশাদ শ-ক্ত মুখে বসে ছিল অনেকটা সময়। হঠাৎই খেয়াল হলো মিশু ঘুমিয়ে পড়েছে মৈত্রীর কাঁধে মাথা রেখে৷ গাড়ির বাতি নেভানো সবাই চুপচাপ চোখ বুঁজে আছে। ইরশাদ কয়েক মিনিট বোধহয় লক্ষ্য রাখলো সবার অবস্থান তারপরই এক আজব কান্ড করে বসলো। দু হাতে মিশুকে কোলে তুলে ধীরে ধীরে নিজের বা’পাশে বসিয়ে দিয়ে নিজেই মধ্যখানে এসে বসলো। মৈত্রী আঁধারে ডোবা গাড়ির ভেতরই বোঝার চেষ্টা করছিল ইরশাদ আসলে করছেটা কি। কিন্তু সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে মৈত্রীকে টেনে নিজের সাথে চেপে বসে রইলো৷ ডানে বায়ে স্ত্রী আর শ্যালককে জড়িয়ে পথ শেষ হলো তার। ভোরের আলো উঁকি দিচ্ছে চা বাগান আর পাহাড়ি পথে। গাড়ির গায়ে কুয়াশার আড় মাখানো সকালে বেশিরভাগেরই ঘুম ভা-ঙ-লো। রাতটা জেগে কা-ট-লো শুধুই গাড়ির ড্রাইভার আর ইরশাদ-ময়ূখের। নোরার মেসেজ ছিল সে যে কোন সময় ফ্রী হয়েই কল করবে ময়ূখকে। সে আশায় অপেক্ষায় প্রহর কেটেছে তার। এদিকে মৈত্রীও কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ইরশাদের কাঁধে। দু হাতে দুজনকে ধরে রেখে ঘুম এলো না তার চোখেও। গন্তব্যে যখন সবাই গাড়ি থেকে নামলো তখন প্রত্যেকেই কেমন বিষ্ময়ে তাকালো দু ভাইয়ের দিকে। ইরশাদের শার্ট বুকের দিকটা একদমই থু-ব-ড়ে আছে, বিড়াল দুটি চোখ কেমন ফ্যাকাশে আর ফোলা ফোলা৷ ময়ূখের ঝাঁকড়া এলোমেলো চুল গুলো আরও বেশি অগোছালো যেন একটু আগেই পক্ষীকূলের মেলা বসেছিল ওখানটায় আর চোখ দুটোতে রক্তাভা। কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে চা বাগান থেকে একটু বিপরীতে পাকা এক তলা বাড়ি৷ বাড়ির চারপাশ বাঁশের তৈরি বেড়া দিয়ে ঘেরা যা ঢেকে আছে বিভিন্ন গুল্মলতা আর রঞ্জনরশ্মি গাছের সারি। বাড়ির গেইটও সেই বাঁশের তৈরি। গেইট জুড়ে জড়িয়ে আছে অপরাজিতার লতা সবুজের ফাঁকফোকরে উঁকি দিচ্ছে নীলরঙা ফুল৷ একদিকে আছে গোলাপি বাগান বিলাস গেইটের ভেতর বাহির দু দিকেই ছড়িয়ে আছে গোলাপি সেই পাপড়ি৷ ময়ূখ গাড়ির ভাড়া, বখশিশ দিয়ে ড্রাইভারকে পাশেই কোন রেস্ট হাউজে থাকতে বলে বিদায় দিলো ততক্ষণে প্রত্যেকেই বাড়ির ভেতর ঢুকেছে। মৈত্রীর তখনো গুম কা-টে-নি ঠিকঠাক সে ভেতরে গাড়ি বারান্দার মত অংশে বেতের তৈরি ফোমবিহীন সোফা দেখে তাতেই বসে পড়লো। বড়রা চারপাশে নজর বুলাচ্ছে লন সাইড, ঘরের আশপাশ সবটা জুড়ে বিভিন্নরকম গাছগাছালি। শেলি আর মিশু বাড়ির একদিকে বড় এক জামগাছ তারই পাশে লোহার শিকলে বাঁধা দোলনা দেখে বসে পড়েছে৷ ইরশাদ ফোন বের করে অফিস থেকে বাড়ির কেয়ারটেকারের যে নম্বর দিয়েছিল তাতে ডায়াল করলো৷ মাত্র মিনিট দশের মাঝেই এসে পৌঁছুলো একজন বয়স্কলোক। দাঁড়ি নেই গোঁফের জঙ্গল মুখে সাদা চুলের একজন বৃদ্ধা। লোকটা এসেই কেমন সবাইকে সালাম দিতে লাগল। বড় ছোট প্রত্যেকেই একটু অস্বস্তিবোধ করলো এমন আচরণে। বৃদ্ধা পকেট থেকে একগোছা চাবি বের করলে জানতে চাইলো ইরশাদ শাহরিয়ার কে? ইরশাদ ‘আমি’ বলতেই লোকটা চাবি দিয়ে জানালো সে নয় তার ছেলে এ বাড়ি এবং পেছনের মালিকের বাড়ির কেয়ারটেকার। এ বাড়িটাও মালিকের থাকার ছিল তবে এটা বহু পুরাতন আর এতে আধুনিক অনেক ব্যবস্থাই নেই। এ বাড়ির পেছন দিকে মানে মূল সড়কের সামনের দিকে যে নতুন দোতলা বাড়িটি সেটা নতুন মালিকের পরিবার এলে সেখানেই থাকে। আর এ কারণেই কোম্পানির নতুন একাউন্ট্যান্টকে এত বড় বাড়িটও দেওয়া হয়েছে। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে তো বাড়ি, কোয়ার্টার কিছুই দেওয়া হয় না। ইরশাদ চাবি নিয়ে ঘর খুলে দেখলো সবটাই ঝকঝকে-তকতকে রাখা। বুঝতে পারলো অফিস থেকেই সব করিয়েছে। ভেতরে ঢুকে গেল সকলেই ব্যাগপত্র নিয়ে। মৈত্রী তখনো ঘুমে ঢুলছিল তা দেখে ইরশাদ এগিয়ে এসে একবার বড়দের খুঁজলো৷ নাহ, বাইরে কেউ নেই আর তাই ঝট করে মৈত্রীকে পাজাকোলে তুলে নিলো। আকষ্মিক এমন শূন্যে চড়তেই আঁতকে উঠে চোখ মেলতেই সে চমকালো। ইরশাদ তাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে!
“এ একি করছেন, নামান আমাকে আব্বা আম্মা সবাই…. ”
মৈত্রী কথা শেষ করতে পারেনি। খুব সুন্দর আদুরে আদুরে চোখদুটো ভীষণ, ভীষণরকমের ক্রো-ধ দেখাতেই সে থেমে গেছে। ভয়-ভীতি আর লজ্জা ভুলতেই চোখ নামিয়ে নিয়েছে। শার্টের বুক বরাবর বোতামটিতে যেন মহামূল্যবান কিছু লু-কিয়ে আছে ঠিক এমন ভঙ্গিতেই মৈত্রী তাকিয়ে আছে সেদিকে৷ এরই মাঝে ইরশাদ তাকে একটা ঘরে এনে বসিয়ে দিলো কাঠের একটি নড়বড়ে অতি পুরাতন চেয়ারে। মুহূর্তগুলো ঠিক কতখানি সুন্দর তা যেন বুঝতে পারছে মৈত্রী আর তাইতো শত রা-গ, অপ্রকাশিত ঘৃণার দলকে ছুটি দিয়ে চোখ বুঁজে উপভোগ করতে চাইছে। হায়! মানুষটার দেহের কেমন মাতাল মাতাল এক খুশবু সম্মোহিত করে দিচ্ছে মৈত্রী। চা- বাগানে লুকিয়ে পড়া ভোরের কুয়াশা আপনা থেকেই এসে জড়ো হচ্ছে তার চোখের সামনে। সব ধোঁয়াশা শুধুই তার মনপুরুষটি উজ্জ্বল। ইরশাদও যেন টের পেল তার সহধর্মিণীর বর্তমান অনুভূতি আর তাইতো কুঁজো হয়ে ঝুঁকে এলো মেয়েটির মুখের কাছে। বিগত দু দিনের জমে থাকা সকল তৃষ্ণা ওষ্ঠপুটে নিমেষেই মিটিয়ে নিলো। ঝ-ড়ে-র গতিতে ছুঁয়ে গেছে একে অপরের ঠোঁট দুটি। ইরশাদ আর দাঁড়ায়নি সেখানে যেন তৃষ্ণা মেটানোর পর তার দাঁড়িয়ে থাকা শা-স্তিযোগ্য অপরাধ।
ইরশাদদের ফার্নিচার যে পিক-আপ ভ্যানে ছিল সেটি এসে পৌছেঁছে এখানে কিন্তু সমস্যায় পড়লো ড্রাইভারটি ঠিকঠাক এলাকা চিনতে না পারায়। ময়ূখ ফখরুল সাহেবকে ফোন করে জানালো সে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। কিছু সময়ের মধ্যে সে এসে পৌছুলো পিকআপে করেই। লোক নিয়ে একে একে ফার্ণিচারগুলো নামাতেই ইরশাদও এগিয়ে এলো৷ মহিলারা সকলেই তখন রান্নাঘরে চা আর বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খাবার গরম করায় ব্যস্ত। ইরশাদ-ময়ূখ নিজেও লোকেদের সাথে হাত মিলিয়ে সকল আসবাব গুছিয়ে নিয়েছে। লোকগুলো আর পিকআপের ভাড়া মিটিয়ে সবাই মিলে চা-নাশতা পর্ব সারতেই মুজিব সাহেব বললেন, এবার আমাদের এদিকে হাট- বাজারের খোঁজ নেওয়া দরকার।
ইরশাদও ভাবছিল, তারা সঙ্গে এনেছে একটি মাত্র খাট আর আম্মুর জোরাজোরিতে তিনটা তোশক আর একটা ম্যাট্রেস। কাঁথা কম্বলও আম্মু জ-ব-র-দস্তি তিন চারটে বেঁধে দিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে এতগুলো মানুষ এসেছে তারা অথচ এখন শীতের মধ্যে ঘুমাতে গেলে এসবে হবে না। তারওপর এই পাহাড়ি এলাকায় দিন যত উষ্ণ রাত ঠিক ততোটাই হিম শীতল হবে। আর যাইহোক, এক খাটে চলবে না অন্তত আব্বু আম্মু, শ্বশুর শ্বাশুড়ি মেঝের বিছানায় ঘুমাতে পারবে না। তাই সে ঠিক করলো, সস্তার মধ্যেই আরেকটি খাট এবং আরও কিছু কম্বল, লেপ যা হয় কিনে আনতে হবে। নাশতার পর্ব শেষ হতেই ফখরুল, মুজিব, ইরশাদ, ময়ূখ চারজনে বেরিয়ে পড়লো বাজারের উদ্দেশ্যে। তাদের সহকারী হয়ে সঙ্গে গেল কেয়ারটেকার হামিদুর। জানা গেল লোকটা সিলেটের স্থায়ী বাসিন্দা কিন্তু নিজের ভিটেমাটি কিছুই নেই এখানে। খাওয়া পাগল পরিবার তার খাওয়ার পিছেই সব উজার করেছে। এখানে সপরিবারে থাকতে পারছে মালিকের বিশ্বস্ত হওয়ায় একটুখানি জমি আর কাঁচাঘর পেয়ে৷ পুরুষেরা সকলে যখন বাজারের দিকে গেল তখন মহিলাদের সুযোগ হলো একটু গুমিয়ে নেওয়ার। ময়ূখ নিজেই এক ঘরের মেঝেতে দুটো তোশক বিছিয়ে দিয়ে গেছে আর সেখানেই সকলে একটু গড়িয়ে নিচ্ছে৷ প্রথমেই শুয়েছে শেলি তার পাশে ইরিন৷ ইরিনের পাশে মৈত্রী, তারপর রোকসানা বেগম এবং তারও পরে মিশু। সবারই কমবেশি শরীরে হালকা ব্যথাবোধ একাটানা গাড়িতে বসে ঘুমানোর ফলে৷ তাই সমতল নরম বিছানা পেতে সকলেরই চোখ লেগে এসেছে৷ মৈত্রীও আবার ঘুম ঘুম অবস্থায় ছিল কিন্তু হুট করে রোকাসানা যখন কম্বলখানা তাকে আরেকটু জড়িয়ে ঢেকে দিল তখনই তার চোখ আলগা হলো। সেইসাথে বুঝি আলগা হলো মনের শক্ত দ্বার। মা হীন জীবনে এই আদরখানি সে পেয়েছিল তার এগারো কি বার বছর বয়স পর্যন্ত। বাবা রোজ রাতে এসে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে যেতেন৷ কাঁথা লাগলে সেটা ঠিক করে দিতেন, গরমকালে লোতশেডিং হলে উঠে এসে তাকে হাত পাখায় বাতাস করতেন রাত জেগে৷ তারপর হুট করেই সে কেমন বড় হয়ে গেল। ঘুমাতে গেলে দরজা লাগিয়ে দিতো আর রাত জেগে বাবা তাকে বাতাস করতে পারতেন না, যখন তখন কোলে তুলে নিজের সাথে শুইয়ে দিতেন না। ঘুমের মাঝে পাওয়া সকল যত্ন শেষ হয়ে গিয়েছিল আবার শুরু হলো ইরশাদকে পেয়ে। কিন্তু মা কিংবা কোন নারীর মমতা আর পাওয়া হয়নি তার৷ চোখ ছাপিয়ে উঠলো আনমনেই। পাশ ফিরে সে চোখ বুজেই ফিরলো ইরিনের দিকে। কি আশ্চর্য! ইরিনও তাকে ঘুমন্ত ভেবে হাত বুলিয়ে দেখলো কম্বল ঠিকঠাক আছে কিনা। হুট করেই আবার বুকের কাছে জড়িয়ে রাখলেন যেন ছোট্ট একটি বাচ্চাকে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন৷ ভারী জ্বালা তো! এরা দুজন এমন করে আদরে, স্নেহে চেপে ধরলে মৈত্রী তো আনন্দেই দম ব-ন্ধ হয়ে মারা যাবে৷ এদের এই মা মা আদর যে তার খোলসে ঢাকা মনটা সইতে পারবে না এত সহজে৷ কা-ন্না পাচ্ছে তার একটু যদি চিৎকার করে চোখের জল ফেলে কাঁ-দা যেত তবে বড্ড শান্তি লাগতো অন্তরটাতে। মৈত্রী একটুও থাকতে পারলো না এখানে৷ সে শোয়া থেকে উঠে পড়লো। ঘর ছেড়ে বের হচ্ছিলই কি তখন রেকসানা, ইরিন প্রায় একসাথেই বলে উঠলো, “কোথায় যাচ্ছো মৈত্রী? ঘুমিয়ে নাও একটু নইলে শরীর খারাপ করবে৷”
“ওয়াশরুমে যাব।”
দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হতে চলল। পাহাড়জুড়ে আজ রোদের দেখা মেলেনি আর এখন সন্ধ্যের আগেই যেন সন্ধ্যে নেমে এসেছে৷ মিশু আর শেলি ছাড়া কেউ দুপুরে কিছুই খায়নি ইরশাদরা ফেরেনি বলে৷ ফ্রীজে ইলেকট্রিক সংযোগ দেওয়া হলেও তাতে এখনও কোন কিছুই রাখা হয়নি৷ ইরিন বুদ্ধি করে অন্যান্য আসবাবের সাথে উনার ইলেকট্রিক প্রেশার কুকারটাও দিয়েছিলেন আর চাল-ডাল- আলুও এনেছিলেন সঙ্গে৷ ভাগ্যিস এনেছিলেন তাই পুরুষেরা না ফিরলেও তারা সহজ রান্না ভাত, ডাল আর আলুর ভর্তা করতে পেরেছেন৷ তবে পেঁয়াজের কথা কিছুতেই মনে ছিল না তাই আজকের আলুর ভর্তা তার শুধুই মরিচের৷ বিকেলের শেষ মুহূর্তে ফিরে এসেছে সকলে সাথে এসেছে আসবাবপত্রের মেলা। মুজিব সাহেব কারো কথাই শোনেননি। মেয়ের নতুন সংসারের জন্য বেছে বেছে খাট, সোফা, আলমারি, ড্রেসিংটেবিল, ডাইনিং টেবিল, লেপ-তোশক প্রায় প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটা জিনিসই তিনি কিনেছেন৷ ইরশাদ যখন রে-গে গেল শ্বশুরের এসব কেনা দেখে এমনকি সে তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে বেরিয়েও পড়েছিল৷ কিন্তু মুজিব যখন বললেন মৈত্রীর মায়ের বড় সাধ ছিল নিজে মেয়ের জন্য এই কিনবেন, সেই কিনবেন তার ভবিষ্যত নাতি নাতনীর জন্য এক কথায় আবে্গী কিছু বাক্য ব্যবহার করেই তাকে শান্ত করতে পেরেছিল৷ বাড়ি ফিরে আবার একদফা আসবাব সাজানোর পেছনেই কে-টে গেল তাদের অনেকটা সময়। রাতের খাবারের সময় আবারও হলো আলুর ভর্তা আর বেগুন ভাজা। তবে এবারে ভর্তায় পেঁয়াজ -মরিচ সবই ঠিকঠাক দেওয়া গেল। কেয়ারটেকার তাদের কাঁচা বাজার করে দিলো৷ রাতের খাওয়া শেষে ঘুমের ফিরিস্তি দিল ময়ূখ বাবা আর আঙ্কেলের সাথে ঘুমাবে সে আর মিশু৷ আম্মা, শেলি আর আন্টি মিলে শোবে এক ঘরে আর একটিতে থাকবে মৈত্রী ইরশাদ। তাই হলো ; রাত বাড়লো সবাই ঘুমানোর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
জীবন কখনো কখনো ঝ-ড়ে-র বেগে বদলে যায়। ময়ূখেরও বদলেছে তেমন করেই। হুট করেই নোরা জীবনের এমন এক অংশে জড়িয়ে গেছে যেখানে ভালোবাসা না থাকলেও দ্বায়িত্ব আছে শেষ নিঃশ্বাস অবধি৷ যাকে কাজিনের বাইরে অন্যকিছু স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না সে, আজ তার রাত কা-টছে সেই মেয়েটির ফোনকল আসবে বলে৷ সমঝোতা, দ্বায়িত্ব এই দুটি জিনিস গলায় ঠিক ফাঁ-সের মত লেগে থাকা জিনিস। আর ময়ূখের জীবনটাতে সময় এখন এই ফাঁ-সেই তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
চলবে
(তথ্য কিংবা অন্যান্য ভুল চোখে পড়লে জানানোর অনুরোধ রইলো)