#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৫
চোখের পাতায় নেমে এসেছে একরাশ প্রশ্নেভরা তীর্যক চাহনী।হাতে থাকা ওড়নাটায় চোখ বুলিয়ে এক কদম এগিয়ে যায় তোহা।
গলার স্বর নামিয়ে প্রশ্ন করে,
—“আপনি কি করে জানলেন আমি বারান্দায় ছিলাম?”
—“আমার প্রশ্নের উওর না দিয়ে তুই পাল্টা প্রশ্ন করছিস তিহু?ভেরি ব্রেভ!”ব্যঙ্গাত্তক কন্ঠে কথাটা বলে রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বারাতেই অগোছালো হাতে তিহানের বাহু আঁকড়ে ধরে তোহা।বলে,
—“আমাকে আপনি রুমে এনেছিলেন?”
তিহান ঘাড় ঘুরিয়ে তার হাতের দিকে তাকায়।।তোহা হাত নামায়না,একইভাবে ধরে রাখে।বরং আরেকটু শক্ত হয় তার বাঁধন।
তিহান ফুঁস করে শ্বাস ছাড়ে।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে অনেকটা কাছে আসে।তোহার চোখের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ সুঁচালো কন্ঠে বলে,
—“এখনো সন্দেহ আছে তোমার?”
মাথাটা ঘুরে উঠে তোহার।কন্ঠনালি শুকিয়ে কাঠ!গোলমেলে দৃষ্টি,অস্থিরময় মুখশ্রী।তিহানের এই “তুমি” সম্মোধনটা খুব বেশি মারাত্মক একটা বস্তু তার কাছে।কেমন সম্মোহনী একটা ডাক।মূহুর্তেই যেন তাকে এলোমেলো অনুভূতির অসীম সাগর স্রোতে ডুবিয়ে দিতে সর্বদা সক্ষম।তাকে এভাবে হাবুডুবু খাওয়ানোটা কি খুব বেশি প্রয়োজন?
দৃষ্টি নামিয়ে ধীরগতিতে নিচের ঠোঁটটা কাঁমড়ে ধরলো তোহা।হাতের দৃঢ় শক্তপোক্ত বাঁধনটা আপনাআপনিই ছুটে গেলো।নিশ্চুপ নির্বিকার ভাবে মাথা নুইয়ে এক পা পেছাতেই গটগট শব্দ তুলে বাইরের দিকে হাঁটা ধরলো তিহান।তার চোখমুখ স্বাভাবিকের চেয়েও অতিস্বাভাবিক।তবে শুধুমাত্র গভীরতম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলেই তার ঠোঁটের কোঁণের সুক্ষ্ণ হাসির রেখাটা চোখে পরবে কারো।
_____________
ভারি ভারি কানের দুলগুলো কানে ঝুলতেই “উহ্” বলে আর্তনাদ করে উঠলো তোহা।পার্লারের মহিলাটা দাঁত বের করে হাসলো।বললো,
—“আপনার মনে হয় অভ্যাস নেই।সুন্দর দেখানোর জন্য একটু কষ্টতো করতেই হবে”
তোহা প্রচন্ড বিরক্তবোধ করলো।কালের দুলগুলো হাত দিয়ে ধরে নিশার উদ্দেশ্য বললো,
—“আমি এটা পরতে পারবোনা আপু।ট্রাস্ট মি,কান ছিঁড়ে যাবে আমার।”
নিশা তখন চোখ বন্ধ করে বসে আছে।তার চোখে আঠা দিয়ে নকল ভারি ঘন পাপড়ি লাগানো হয়েছে।না শুকানো পর্যন্ত চোখ খোলা মানা।তোহার উদ্দেশ্যে বিরবির করে সে বলে,
—“ক্যাঁচাল করিসনা তোহা।এখান থেকে সোজা সেন্টারে যাবো আমরা। তোর জন্য নতুন দুল কই পাবো?একটা দিনই তো।কষ্ট করে পরে নে।”
তপ্ত নি:শ্বাস ফেলে তোহা।এমনেই গায়ে এতো ভারি একটা লেহেঙ্গা পরিয়ে দিয়েছে তার উপর এই দুল।যদিও জামাটা খুব সুন্দর তবুও গরমে যাচ্ছেতাই অবস্থা তোহার।
সবার প্রায় সাজগোজ শেষ।
পার্লারের মহিলাটা একটা পাপড়িতে আঠা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতেই সে আৎকে উঠে বলল,”এটা লাগবেনা।আমার সাজা শেষ।দয়া করে আর কিচ্ছু লাগাবেন না।”
মহিলা থেমে গেলো।বিরক্তিকর দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করে পাপড়িটা রেখে দিলো।হাঁফ ছাড়লো তোহা।
পার্লারে তারা পাঁচজন মেয়ে এসেছে।সে,নিশা,স্বর্ণালি,আর বাকি দুইজন নিশার খুব কাছের বান্ধবী।
সারাক্ষণ তাদের মুখে তিহানের এট্রাকটিভনেসের ব্যাপারে কথা শুনতে শুনতে কান পঁচে যাচ্ছে তোহার।
মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে অকারণেই।
॥
এবড়োথেবড়ো ভাঙা রাস্তা।দুহাতে লেহেঙ্গা উঠিয়ে কোনরকমে পার্লারের সামনে দু তিনটে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলো তোহা।বাইরে অপেক্ষা করছে পাশাপাশি দুইটা গাড়ি।একটার বাইরে দাড়িয়ে আছে সাইফ।আর আরেকটায় পাশে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে তিহান।অন্যদিকে তাকিয়ে ফোনে কথা বলছে সে।পরণে কালো রংয়ের ইন করা শার্ট আর কালো প্যান্ট।ব্লেজারটা হাতে ঝোলানো।কালো জুতোজোড়া চকচক করছে।হাতে সেই সিলভার স্টীলের ঘড়িটা।চুলগুলো আঁচরানো সুন্দরকরে।
তারা কাছে যেয়ে দাড়াতেই তিহান গাড়ি থেকে সরে দাড়ায়।ফোনটা কেটে দিয়ে তোহার দিকে না তাকিয়েই সামনের সিটের গেট খুলে দিয়ে বলে,
—“তিহু,আমার সাথে যাবে।বাকিরা সবাই সাইফের গাড়িতে যা।”
অন্যকেউ কিছু না বললেও নিশার বান্ধবীগুলো একসঙ্গে বললো,”কেন?”
তিহান নিখুঁতভাবে হেসে বললো,
—“ওর আসলে বমি টমির অভ্যাস আছে খুব।এত গাদাগাদি করে বসলে তোমাদের গা ভরিয়ে বমি করতে দুইমিনিটও লাগবেনা ওর।আশা করি বুঝতে পারছো?”
নাক সিঁটকালো ওরা দুজনই।তোহা আপত্তি করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই তিহান তাকে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—“চুপচাপ ভেতরে গিয়ে বস।”
॥
তুলনামূলক ধীরগতিতে ড্রাইভ করছে তিহান।সাইফদের গাড়িটা আগে চলে যেতেই আরো একটু কমে এলো স্পিড।তোহা থম ধরে বসে আছে।তার কোলের উপর রাখা তিহানের ব্লেজারটা।
গাড়িতে এসি ছাড়া বিধায় তেমন গরম লাগছেনা।তবে কানের ব্যাথাটা বেড়ে চলেছে।দাঁতে দাঁত চেপে সেটা সহ্য করছে তোহা।দুহাতে কানের দুল দুটো ধরে রেখেছে সে।যেন বেশি চাপ না পরে।
সাইফদের গাড়ি যেইনা মোড় ঘুরে চোখের আড়াল হয়ে যায় তখনই তাদের গাড়ি থেমে যায় ।
—“কি হয়েছে?”জিজ্ঞাসু কন্ঠ তোহার।
নিজের সিটবেল্টটা খুলে ফেলে তিহান।একটু উঠে তোহার উপর ঝুঁকে যেতেই মাথা পিছিয়ে ফেলে তোহা।তিহান তার চুলগুলো আঙ্গুলের স্পর্শে ঘাড়ের পিছে দিয়ে দেয়।ঠান্ডা হাত কাঁধ ছুঁয়ে যায় কয়েকবার।তোহা শুকনো কন্ঠে বলে,
—“তিহান ভাই কি..করছেন?”
তিহান রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায়।মুখে কাঠিন্য ভাব।জ্বালাময়ী গাঢ় ধূসর চোখ।সে কানের দুলদুটো খুলে নিতে নিতে উচ্চস্বরে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
—“ব্যাথা পাচ্ছিস তাও পড়ে আছিস কেনো?ইডিয়ট!”
বলে কানের দুলের হুক খুলে তা খোলার জন্য আস্তে করে টান দিতেই “আহ্” বলে চেঁচিয়ে উঠে তোহা।চোখমুখ কুঁচকে যায় তীক্ষ্ণ ধাঁরালো ব্যাথায়।তিহান লক্ষ্য করে হাল্কা রক্ত বেরিয়ে আসছে তার কান থেকে।
দুআঙ্গুলের ডগা দিয়ে জায়গাটা চেপে ধরে সে।রক্তটুকু মুছে দিয়ে হাতের মুঠোয় থাকা কানেরদুল জোড়া সজোরে গাড়ির সামনের জায়গাটায় রাখে।তোহার চোখ বন্ধ।তিহানের রাগের মাত্রাটা আন্দাজ করতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছেনা তার।
খানিকবাদে পিটপিট করে তাকায় সে।
—“ব্যাথা কমেছে?”নরম কোমল শোনায় তিহানের কন্ঠ।
তোহা আড়চোখে একবার তাকিয়ে ছোট্ট করে উওর দেয়,
—“কমেছে।”
গাড়ি স্টার্ট দেয় তিহান।হঠাৎই বলে,
—“নিজেকে আঘাত করে,কষ্ট দিয়ে অন্যের জন্য নিজেকে আকর্ষনীয় করবিনা আর কখনো।ভারি ভারি দুল পরে কান থেকে রক্ত বের করে সুন্দর সাঁজতে হবেনা তোর।তারপর একটু থেমে ধীর কন্ঠে বলে,
“তুমি যা আছো,যেমন আছো তাই আমার জন্য যথেষ্ট।”
শেষের কথাটা শুনতেই একমূহুর্তের জন্য কেঁপে উঠে তোহার হৃদস্পন্দন।স্হির দৃষ্টিতে জানালার বাইরে চেয়ে রয় সে।
॥
কিছুক্ষণ পর অসচেতনতায় আলতো করে তিহানের বাহুতে মাথা রাখে তোহা।অবচেতন,আচ্ছন্ন মনে ভাবে,
“তিহান ভাই”…মানুষটা যেন আগাগোড়াই আস্ত এক প্রহেলিকা!
~চলবে~