১৭+১৮
ক্যাকটাস
পর্ব-১৭
Writer Taniya Sheikh-Tanishq
Tumhare Siva Kuch Na Chaahat Karenge
Ke Jab Tak Jiyenge Mohabbat Karenge,,,,,,,
আশেপাশের কারো বাড়ির সাউন্ড বক্স থেকে গানটি ভেসে আসে বিছানায় শায়িত রাফসানের কানে। এতোক্ষনের চাপা ব্যথা মুহূর্তে হু!হু! করে বেড়ে বিন্দুমোচন রুপান্তরিত হলো। চোখের সম্মুখে দিবালোকের আলোর ন্যায় উদ্ভাসিত নীরা। যে চাওয়া এতোদিন বুকের কোনে দাফন করতে ব্যতিব্যস্ত ছিল। আজ মনে হচ্ছে কেন এতো অসহায়ত্বের বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি? কেন এতো যন্ত্রণা! কেন তাকে চাওয়াতে এতো বাঁধা? রাফসান বালিশে মুখ গুঁজে প্রাণপণে চিৎকার করলো। তার চিৎকার একসময় কান্নার তোড়ে ক্ষীণ। একবার মনে হলো এই অসহায়ত্ব থেকে চিরতরে মুক্তি পাই। পরক্ষনেই মাতৃমূর্তি হয়ে চোখের তারায় উদিত হলো তার জন্মদাত্রী। মা! এই মা’কে ধোঁকা দিয়ে কী করে যাবে সে? কেউ তো নেই তার রাফসান ছাড়া। রাফসান নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। দরজা,জানালা বন্ধ করে গানের আগত শব্দ রুখে দেয়। বিছানার এককোনে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে বসে রাফসান৷ দু’হাতে সমস্ত জোর দিয়ে খাটের কোনার অংশ চেপে ধরে। গম্ভীরমুখে স্বগতোক্তি করে,
” এই প্রচন্ড গতির আবেগকে আমি রুখে দেব। কী হবে তাতে! হ্যাঁ পাথর হয়ে যাবে গতিহীন আবেগ হওয়ায় এ হৃদয়। হোক! হোক পাথর এই হৃদয়, এই দেহ। তবুও মা’কে কষ্ট দিতে পারব না। হলাহলের মতো নিজেই যন্ত্রণার বিষ ধারণ করব, তবুও নীরাকে এই বিষে বিষাক্ত হতে দিতে পারব না। আমার মন তাকে চেয়েছে। না করিনি পাপ তাকে ভালোবেসে। ভালোবাসায় পাপ হয় না,ভালোবাসা পবিত্র। সেই পবিত্রতাকে কলুষিত হতে দেব না। বিনিময়ে সমস্ত পৃথিবীর প্রেমিকের চোখে হলাম না হয় ভীরু,কাপুরুষ!”
ঢাকা থেকের আসার দু’দিন পরও রাহেলা রাফসান মুখোমুখি হয়নি। রাফসান অফিস শেষে সোজা রুমে চলে আসে। টুসি খাবার দিয়ে আসলেও তেমন খায় না। রাহেলাও ছেলের মতো চুপচাপ বসে থাকেন ঘরে। টুসি এ দু’দিন চুপ থাকলেও আজ থাকল না। মায়ের ঘরে গিয়ে জিনিসপত্রের উপর রাগ ঝাড়ছে। শব্দ করে খুলছে আর প্রচন্ড বারি দিয়ে আটকাচ্ছে আলমারির দরজা। রাহেলা একপাশ হয়ে শুয়ে শুয়ে তসবিহ গুনছিল। টুসির শব্দের উৎপাতে বিরক্ত হলেন তিনি। মন মেজাজ এমনিতেও তার বেশ একটা ভালো না। ঘার ঘুরিয়ে ধমকের সুরেই টুসিকে বললেন,
” এমন করে কাজ করছিস কেন? নিঃশব্দে কাজ করলে কর নয়তো দূর হ চোখের সামনে থেকে।”
টুসি যেন এতোক্ষণ এ কথার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। রাহেলার কথা শেষ না হতেই চেঁচিয়ে উঠল সে। বললো,
” হ সব দূর হয়ে যাই। আপনে একা থাকেন আপনার মতো। করেন যা মন চায় আপনার।”
টুসির গলার ঝাঁঝে বিব্রত রাহেলা বিছানার উপর উঠে বসে। রাগী গলায় বলেন,
” ঐ তুই চোপা নারাস কেন? সকাল সকাল এসব কী শুরু করছোস? তোর ভাই আমাকে শান্তি দিল না। তুই ও কী তাই করবি নাকি?” ছেলের কথা বলতেই বুকটা হু হু করে উঠল রাহেলার। এতোবড় ছেলের গায়ে তিনি হাত তুলেছেন।ছিঃ কতো খারাপ কাজই না করেছেন তিনি। কতো কষ্টই না পেয়েছে তার রাফসান। রাহেলার চোখ ভিজে আসে। টুসি মায়ের সিক্ত গলার স্বরে দমে যায়। চুপচাপ এসে বসে মায়ের সামনে। মায়ের হাতটা দু’হাতে নিয়ে বলে,
” আমি জানি তুমি ভাইয়ার জন্যে কতো কষ্ট পাচ্ছ? এমন কেন করলে তুমি আম্মা!”
” আমার ভুল হয়ে গেছে রে টুসি। মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। আমার বাবুরে কেন যে মারতে গেলাম?” রাহেলা মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদে। টুসি পাশে সরে এসে মাকে এক হাতে কাছে টেনে বলে,
” তুমি চলো আমার সাথে ভাইয়ার রুমে। ভাইয়ার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ঠিকমতো খাচ্ছেও না ভাইয়া। চলো আম্মা!”
” না! ও আমারে রাগাইলো কেন? ওরে আসতে ক। আমি যাব না।”
” আবার জেদ করছ তুমি? এই না কাঁদছ?”
” কাঁদব না তো কী করব? কপাল করছি কাঁদার। আমি বেশি কিছু কী চাইছিলাম ওর কাছে? শুধু পুত্রবধূ হিসেবে মেহেরকে চেয়েছিলাম। দিল মূল্য আমার চাওয়ার। ও নিশ্চয়ই এমন কিছু বলেছিল যার জন্য মেহের ঐ ছেলেরে বিয়ে করলো হুট করে। সব দোষ ওর।” রাহেলা তেজে ওঠে
” তাইলে তুমি যাবা না উপরে?” টুসি কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের মুখে।
” না!” গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় রাহেলা।
” তুমি আসলেই একটা ত্যাঁড়া বুঝলা আম্মা। খালি আছ পোলার বিয়া নিয়া। তোমার পোলা বিয়ে কেন করতে চায় না জিগাইছ একবারও?” টুসি দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছে
” জিজ্ঞেস করলে কী বলবে আমাকে ও? আমারে ত্যাঁড়া বলছ? তোরা দুইটা কী? কোনো কথা শুনোস আমার? যা আমার চোখের সামনে থেকে। ভাই বোন মিলে ভালো থাক যা। আমি মরি বাঁচি তোদের কী? যা!” হাত নাড়িয়ে দরজা দেখায় রাহেলা। টুসি দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
” তোমার সাথে কথা বলায় বৃথা। ছেলের মুখ চোখের দিকে একটু তাকাইয়ো আম্মা। তাইলে বুঝবা ছেলে বিয়া কেন করতে চায় না। আমার তো মনে হয় তোমার জন্যেই করতে চায় না।”
” ঐ টুসি! এসব কী বলোস তুই আমারে? আমার জন্যে করতে চায় না মানে কী?” মেয়ের উপর চিৎকার করে ওঠে রাহেলা
” আমি বলতে যামু কেন? তোমার পোলা তুমি আবিষ্কার করো গিয়া মানে কী? বউ! বউ! না করে পোলার মন বোঝো আগে আম্মা। সংসার তুমি করবা না বুঝছ? যার জীবন তার পছন্দ- অপছন্দ,মতামতের গুরুত্ব দেওয়া শেখো। আদ্দিকালের মানুষের মতো যারে তারে ধইরা আইন্যা বিয়া কর! বিয়া কর! বইলা চিল্লানো বন্ধ করো এবার।”
টুসি সশব্দে দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে যায়। রাহেলা ভ্রুকুটি করে বন্ধ দরজায় তাকিয়ে ভাবনায় ডোবে। টুসির কথার সাথে নিজের মন মানসিকতা মেলানোর চেষ্টা চালায়। তার কী ভুল হয়েছে কোথাও? কী ভুল হয়েছে? সমর্থ ছেলের বউ দেখতে চাওয়াতে ভুল কোথায়? নাকি অন্য কিছু লুকায়িত এর মধ্যে? রাফসানের কী হয়েছে? কেন এমন পরিবর্তন তার ছেলের? এতোটা গুমোট ভাব তো কোনোদিনই ছিল না। রাহেলা বেশকিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা শেষেও বুঝে উঠতে পারলো না কিছু। তার কষ্ট একজায়গায় টিকে রইল। মেহের কে পুত্রবধূ না করতে পারায়।
নীরা আগামীকাল কক্সবাজারের হিমছড়ি যাবে। সেখানেই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মনটা অস্থির ওর। এতোদূর একা যাবে ভাবতেই কেমন ভয়, সঙ্কোচে অসাড় অসাড় লাগছে। শারমিন নীরার কক্সবাজার যাওয়ার কথা শুনে বেজায় আনন্দিত। মেহেরকেও মোবাইল করে জানানো হয়েছে। মেহের খুশি হয়েছে সাথে সতর্ক করে দিয়েছে আশেপাশের বিপদ থেকে। এতোদূরে যাবে নীরা যেন নিজের খেয়াল রাখে। শ্বশুরবাড়ির ব্যস্ততায় সে আসতে পারছে না, কিন্তু ম্যানেজারকে যা বলার বলে দেবে। নীরার সাথেও কথা হয়েছে মেহেরের। নীরার মনোবল বাড়াতে যা যা বলার প্রয়োজন মেহের বলেছে। নীরার ভেতর আগের চেয়ে ভয় একটু কম কাজ করছে, তথাপি মনটা তার অশান্ত।
অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলে মন অন্য ভাবনা ভাবার অবকাশ পায় না। আজ সে ব্যস্ততাও নেই। যারা আগামীকাল কক্সবাজার যাবে। অফিস কতৃপক্ষ তাদের আজ জলদি ছেড়েছে। নীরা বাসায় এসে প্যাকিং সেরে নেয়। শারমিন রাতে বসে বসে কীভাবে পার্সোনালি নীরা চলবে, ফিরবে তার একটা মোটামুটি ধারণা দিয়ে দিল। বলে দিল কোনো সমস্যা হলে তাকে কল করতে। নীরা ঘার নাড়িয়ে সম্মতি জানায় বোনের সকল কথায়। রাতে দু’ বোন বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে। জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছে মুখে। শীতের কাঁপুনি দেওয়া বাতাস গায়ে লাগতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে নীরার। নীরা অপলক চেয়ে আছে চাঁদের দিকে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে বড্ড ভালো লাগে নীরার। পাশে ঘুমন্ত শারমিনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে বাইরের শীত পবনের অযাচিত ছোঁয়ায়। কম্বল গলা অব্দি টেনে ঘুম জড়ানো কন্ঠে সে বলে,
” নীরা জানালা লাগা! সাথে পর্দাও টেনে দে।”
নীরা মুখটা বেজার করে শারমিনের কথা রাখল। চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে রইল সে। আগামীকালের লং জার্নির চিন্তায় সারারাত ঘুম এলো না। যদিওবা ভোরের দিকে দু’চোখ একটু লেগে এসেছিল সেটা ভাঙল দুঃস্বপ্নের কারনে। যেদিন থেকে কক্সবাজার যাবে বলে ঠিক হয়েছে। সেদিন থেকেই উদ্ভট দুঃস্বপ্ন সে দেখছে। দুঃশ্চিতার ফল ভেবে নীরা দুঃস্বপ্নটা বার বার এড়িয়ে যায়। আজও তাই করল। তবুও বুকটা অনেকক্ষণ যাবত ধুকপুক করে কিছুসময় থেমে, আবার আগের মতো হলো অস্থির, অশান্ত।
সকালের গাড়িতেই রওনা হলো নীরা সহ আরও দশজন। ছয়জন সাধারণ কর্মচারী তার মতো, বাকি চারজন উর্ধ্বতন অফিস কর্মচারী। এসি বাসের জানালা সংলগ্ন সিটটাতে বসেছে নীরা,পাশে বসবে বলে এগিয়ে এলো তার সিনিয়র আমরিন আফরোজ৷ নীরার বেশ পছন্দ আমরিন। সে কিন্তু নীরার অফিসের নয়, হেড অফিসের। তবে প্রায়শ অফিসিয়াল কাজে এখানে আসা যাওয়া করে। অনেকেই বলে ম্যানেজারের সাথে তার সম্পর্ক আছে। নীরা অতোসব কথায় যায় না। তার আমরিনকে ভালো লাগে ব্যস এতোটুকুই। আমরিন নীরাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসিমুখে বললো,
” নীরা রাইট?”
” জি আপু!” আমরিন বসতেই শারমিন উঠে এলো হন্তদন্ত হয়ে। নীরা বেশ অবাক বোনকে আবার বাসে দেখে। শারমিন মোবাইলটা আমরিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
” মেহের কথা বলবে আপনার সাথে।”
” মেহের!” আমরিন উচ্ছ্বাসিত হলো। নীরা বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে আমরিনকে দেখে যাচ্ছে। হোয়াইট আবায়ার উপর হোয়াইট, ব্লু কম্বিনেশনের হিজাব পরিপাটি করে বাঁধা। মুখটা উন্মুক্ত রেখেছে। নীরার চোখে আরমিন সুন্দরের চেয়েও বেশি কিছু। মেহেরের সাথে কী কথা হলো স্পষ্ট শুনতে না পেলেও বুঝতে পারল তাদের কথার কেন্দ্র বিন্দু সে। আমরিন হেঁসে হেঁসে কথা শেষ করে শারমিনকে বললো,
” তুমি চিন্তা করো না। তোমার বোন মনে করো এখন থেকে আমারও বোন। সো ডোন্ট ওয়ারি।”
” থ্যাংকস!” আমরিনের দিকে চেয়ে সৌজন্যের হাসি দিল শারমিন। নীরার দিকে তাকিয়ে বললো,
” এই নীরা! আপু যা বলে শুনবি। তাকে না বলে কোথাও যাবি না ঠিক আছে?”
নীরা ঘাড় নাড়াল। শারমিন আরও দু’তিন কথা বলে নেমে গেল বাস থেকে । যথাসময়ে বাস ছাড়ল। বাস ছাড়তেই শেষবারের মতো শারমিনকে দেখলো নীরা। কান্না পেল খুব ওর শারমিনকে ছেড়ে এতোদূর যাচ্ছে ভেবে। ইচ্ছা হচ্ছিল এখনই নেমে যেতে। সবসময়ই কী আর ইচ্ছা পূরন হয়? হয় না! নীরা মনমরা হয়ে বসেছিল জানালার বাহিরে দৃষ্টি রেখে। তার দৃষ্টি ছলছল।
বেশখানিকটা পথ অতিক্রম করার পর আমরিন কথা বললো ওর সাথে। বললো,
” ভয় হচ্ছে? ”
নীরা নত মুখে ঘাড় নাড়াল। আমরিন মৃদু হেঁসে বললো,
” আল্লাহ ভরসা! ভয় করবে না একদম। ভয় মানুষকে মরার আগেই মেরে ফেলে। ভাবনায় শুধু একটা কথায় রাখবে আমিই আমার সব। যা হবে দেখা যাবে। মনোবল হারাবে তো সব হারাবে। মানুষের জীবনের পথ কঠিন, মেয়ে মানুষের জীবনের পথ তারচেয়েও বেশি কঠিন৷ কঠিন পথে চলতে গেলে এতো দূর্বল চিত্ত থাকা চলে না নীরা। বি স্ট্রং!”
নীরার খারাপ লাগা কমে গেল। আমরিনের প্রতিটি কথাতে মনে সাহস পেল সে। কথায় কথায় আমরিন তার এবং মেহেরের পরিচয়ের সূত্রটা কবে থেকে সেটাও বললো।নীরার বিষয়েও খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করে আরমিন। আরমিনও নীরার মতোই মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। তবে এখন সে একাই থাকে। কাজের সূত্রধরেই মেহেরের সাথে তার পরিচয় হয়। নীরা আগ্রহ নিয়ে সব শুনছে। বেশ অমায়িক ব্যবহার আমরিনের। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সহজ সম্পর্ক হলো দুজনের। নীরা এখন বেশ সহজ এবং সাবলীল বোধ করছে বাসে। আরমান নীরার বিপরীত দিকের সিটে বসেছে। ইশারায় হাসি বিনিময় হলো নীরার সাথে ওর। বাসে সবাই যার যার মতো গল্প করে,ঘুমিয়ে সময় কাটাচ্ছে। বাসে উঠলে বমি ভাব হওয়ার প্রবল সম্ভবনা থাকে নীরার। তার জন্য প্রস্তুতি হিসেবে পলিথিন, কমলালেবু ব্যাগে রাখা। বমি নিরোধক ট্যাবলেটও খেয়েছে সে। আমরিন বুদ্ধি দিল ঘুমিয়ে পড়লে বেটার হবে তার ক্ষেত্রে। নীরা সেটাই চেষ্টা করল। চেষ্টা সফল হতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। গত কিছুদিনের চিন্তায় তার যে ঘুমের ঘাটতি হয়েছিল। সে ঘাটতি অনেকাংশে লাঘব হলো বাসে ঘুমিয়ে। দু’ধারের জনাকীর্ণ অংশ ছেড়ে নিরিবিলি ছায়াবিথী রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাস। সময়টা শীতের হলেও বাইরে ওঠা ঝলমলে রোদের তাপে বাসের ভেতরটায় গরম অনুভূত হলো। সবার কথায় লো ভলিউমে এসি ছাড়া হয়েছে। এখন বেশ লাগছে সবার। সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমন্ত কেউ কেউ। আমরিন সামনে বসা ম্যানেজার মিনহাজের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মিটমিটিয়ে হাসছে। ম্যানেজার সতর্কে ঘাড় বাঁকিয়ে বার বার আমরিনকে দেখছে আর হাসছে ঠোঁট টিপে। তাদের এই লুকোচুরি প্রেমবিনিময় চলতে থাকল গন্তব্য পর্যন্ত।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। যেদিকে চোখ যায় ছোট বড় গাছের সারি,ঝোপঝাড়। মাথার উপর প্রিয় চাঁদ। আজ আর প্রিয় নয় বড়ো অপ্রিয় ঠেকছে চাঁদটাকে। অন্ধকারে ভূতূড়ে লাগছে সবকিছু। এক পা এগোতেই সম্মুখ আঁধারে আড়াল সুউচ্চ নাম না জানা গাছের ধাক্কায় কপালে বারি খেল সে। তখনই রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে চারপাশে অজানা পাখির কূজনে মুখরিত। গা শিউরে উঠলো নীরার।এক পা এগোতেই চুলের মুঠি ধরে আছড়ে ফেললো কেউ তাকে। আতঙ্কিত নীরা দেখল অন্ধকার ফুঁড়ে এগিয়ে এসেছে ভয়ংকর এক মানবমূর্তি। নীরা চিৎকার করতে চেয়েও পারছে না। মনে হচ্ছে কন্ঠনালি চেপে ধরে আছে কেউ। দমবন্ধ হয়ে আসছে। ভয়ংকর মানবমূর্তিটি তাকে হাত ধরে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। শুকনো পাতার উপর পড়ে থাকা ছোট বড় ডাল,কাটার আঘাতে পিঠটা তার ছিঁড়ে গেল বোধহয়। না সে পারছে না শব্দ করতে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে বার বার। চোখের সম্মুখের অন্ধকার ক্রমশ আলো হতে লাগল। কই সেই আঁধারে আলোতে খেলা চাঁদ? কই সেই ভুতুড়ে গাছের সারি?
” নীরা! এই নীরা!” আমরিনের দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় নীরা। এই কনকনে শীতে ঘেমে নেয়ে একাকার সে। আমরিন নীরার রক্তলাল সিক্ত চোখে চেয়ে আতঙ্কিত গলায় বলে,
” কী হয়েছে তোমার? দুঃস্বপ্ন দেখেছ? নীরা! এই মেয়ে কথা বলো?”
আমরিনের হাতের হালকা ঝাকুনিতে নীরার হুশ ফেরে। ভীরু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
” হুমম!” অস্ফুট আওয়াজ হতেই গলার উপর হাত রাখে নীরা। এই তো কথা বলতে পারছে সে। তবে কী ঐসব দুঃস্বপ্ন ছিল? নীরা শরীরে বল পেল না। কাঁপা, দূর্বল হাতে মুখ চোখ মুছে নিল গায়ের ওড়না দ্বারা। আমরিন ওর গায়ের চাদর খুলে একপাশ রেখে পানির বোতল এগিয়ে দিল। ওপাশে সবাই প্রশ্ন করলে আমরিন জানালো নীরা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সবাই কিছুক্ষণ কৌতূহলে চেয়ে আবার আগের মতো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নীরা পানি পান করে মাথা ঠেকাল জানালার কাচে। বাইরের জনবহুল ব্যস্ত সড়কের চারপাশটায় চোখ রেখে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো নীরা। ঘুম এরপর আর এলো না চোখে। ভাবনায় কেবল ঐ জঙ্গল আর ঐ ভয়ংকর মানবমূর্তি রয়ে গেল। গত কিছুদিন ধরে এমনই স্বপ্ন সে দেখছে। কেন যেন অজানা কারনে বুক কাঁপছে। মনে মনে বারংবার বিপদ মুক্তির দোয়া পড়তে লাগল।
চলবে,,,
ক্যাকটাস
পর্ব-১৮
Writer Taniya Sheikh- Tanishq
দীর্ঘ পথ জার্নি শেষে খাওয়া দাওয়া করে অনেকেই নিদ্রা আচ্ছন্ন। অনেকে আবার বৈদ্যুতিক আলোয় যতোটুকু দেখা যায় তাতেই কটেজের আশপাশটা দর্শনে ব্যস্ত। নীরা,আমরিন এবং তাদেরই আরেক সহকর্মী খাদিজা কটেজের একটি কামরায় থাকবে। আরমান সহ বাকি আরও তিনজন ছেলে থাকবে অন্য একটি কামরায়। এছাড়াও বাকি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জন্য আলাদা কামরা ভাড়া করা হয়েছে। নীরা বেশ রাত অব্দি জেগেছিল। ওর রুমের জানালা দিয়ে অন্ধকার দূর পাহাড় অস্পষ্ট দেখছিল সে। আশেপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার গুনগুন শব্দ মনে বিশেষ এক অনুভূতি জাগায় নীরার। এখনও মাথায় দুঃস্বপ্নটার রেশ বিদ্যমান। নীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছে স্বপ্নটাকে ভুলতে কিন্তু পারছেই না। আমরিন কম্বল সরিয়ে মুখ তুলে ঘুমাতে বলার পরই নীরা বিছানায় শুয়ে পড়ে। দু’টো বেড পাশাপাশি। একটাতে আমরিন শুয়েছে অপরটাতে সে আর খাদিজা। নীরার সমস্যা হলো না তাতে কোনো। অচেনা স্থানে ঘুম তেমন ভালো হলো না। ভোরে উঠে ওযু শেষে নামাজ পড়ে নিল নীরা। সকলে মিলে কটেজেই ব্রেকফাস্ট খেতে বসে। খাওয়া শেষে অফিসের গাড়ি করে চলে এলো মেলার স্থানে। তেমন জমজমাট না হলেও বেশ আমেজ পরিলক্ষিত মেলায়। ভীরও যথেষ্ট। ম্যানেজার বললো ক্রমে ক্রমে আরও ভীর হবে। নীরা সকল ধ্যান জ্ঞান লাগিয়ে কাজে মনোযোগ দেয়। অদূরে দাঁড়িয়ে সবকিছুই লক্ষ্য রাখছিল ম্যানেজার। আমরিন ঘুরে ঘুরে সেলসকর্মীদের বুঝিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন বিষয়। দু’টো দিনই তাদের এভাবে কাজের মধ্যে ব্যস্ত গেল। ম্যানেজার মিনহাজ কাজের ফাঁকে প্রিয়তমা আমরিনকে যতোটা পারছে সময় দিচ্ছে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কিছু দুষ্টু মিষ্টি কথা কিংবা অদূর দাঁড়িয়ে দৃষ্টি বিনিময়ে তাদের প্রেম বুঝি রোমান্টিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। নীরাকে একটা প্রডাক্ট সম্পর্কে বুঝিয়ে মিনহাজের দিকে এগিয়ে এলো হাসিমুখে আমরিন। মিনহাজ ঠোঁট কামড়ে ভ্রু নাচাতেই লজ্জায় লাল হয়ে ইশারায় শাসায় আমরিন। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চঞ্চল চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে মিনহাজ বলে,
” আজ রাতে রুমে আসতে পারবে?”
” কী!” আমরিন চোখ পাকাতেই মিনহাজ হেঁসে দেয়। বলে,
” হায়রে নেগেটিভিটি তোমার মধ্যে। তিনবছরে এই চিনেছ আমাকে তুমি? থাক আসা লাগবে না তোমার।”
” রাগ করলে?”
” না! আনন্দিত হয়েছি।” মিনহাজ মুখ কালো করে ফেলে। আমরিন এক হাত কানে আলতো ধরে বলে,
” স্যরি!”
মিনহাজ বললো,” স্যরি কেন? যা ভেবেছ ঠিকই আছে।”
” বাব্বাহ! রাগে নাক ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। আচ্ছা যাও আসব।”
” প্রয়োজন নেই।” মিনহাজ গম্ভীরমুখে বললো
” মিনহাজ! স্যরি বলেছি তো। প্লীজ রাগ করো না। প্লীজ! প্লীজ!” আমরিন ঠোঁট উল্টে ফেলতেই মুচকি হাসে মিনহাজ। বলে,
” হুমম!”
” হুমম কী?” আমরিন বলে।
” তোমার মুন্ডু। রাতে সময় মতো চলে এসো। এদিকটা খেয়াল রেখো আমি আসছি।”
” যাচ্ছ কই?”
” চেয়ারম্যান স্যারের সাথে দেখা করতে। কেন যাচ্ছি এসে বলবো। বাই!’ আমরিনের গাল টেনে মুচকি হেঁসে প্রস্থান করে মিনহাজ। আমরিন গাল ডলতে ডলতে সেদিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসে। নীরা আমরিনকে লক্ষ্য করতে গিয়ে ম্যানেজার ও আমরিনের খুনসুটি স্টলে দাঁড়িয়ে দেখল। অন্য কারো অবশ্য সেদিকে খেয়াল নাই। সবাই ব্যস্ত তাদের প্রয়োজনে। নীরার মনে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে ওদের প্রেম দেখার পর। একটা শূন্যতা অনুভব করলো তাতেই যেন। একাকিত্বটা বড়োই অসহনীয়। একটা তুমি নামক কেউ একজন যদি হতো তার? ধুর! এই ভাঙাচোরা জীবনে তেমন কারো স্বপ্ন দেখা মানা। ভালোবাসাটা বুঝি কোনোদিনই হয়ে উঠবে না কাওকে নীরার। জীবনে পছন্দ, ভালোবাসা বলতে আদৌ কী কেউ ছিল তার? তখনই মনের আকাশে অনেক পছন্দের নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে লুব্ধক হয়ে ভেসে উঠলো রাফসান। রাফসান! নীরার হঠাৎ রাফসানকে প্রথম দেখা সেই দিনের কথা মনে পড়ল। ছি! কী সব ভাবছে সে? তাকে কেন পছন্দ হবে নীরার? সে তো আহনাফের ভাই। আহনাফের মতো না হোক তবুও তার আত্মীয়। নীরা নিজের ভাবনাকে ধিক্কার দিয়ে কাজে মনোনিবেশ করে। বহুদিনের চাপা অনুভূতি আজ কী করে বাইরে এলো? আমমিন মিনহাজকে দেখে? নীরার অস্বস্তি হচ্ছে এতোবছর পর রাফসানকে নিয়ে ভাবায়। নিজেকে খুব করে তিরস্কৃত করলো মনে মনে সে।
রাতে কটেজে ফিরে ডিনার শেষে ম্যানেজার মিনহাজ তাদেরকে জানাল তারা আরও একদিন থাকবে এখানে৷ তাদের সেল যথেষ্ট ভালো হওয়ায় কতৃপক্ষের তরফ থেকে ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে আগামীকাল। সবাই মিলে আগামীকাল ঘুরতে বেরুবে এবং পরদিনই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। সবাইকে বেশ আনন্দিত দেখাল এই খবরে। এই তিনদিনে তারা শুধু কাজই করে গেছে। ঘুরাঘুরি হয়নি কারো। নীরার মনে অবশ্য সবার মতো এতো এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে না। সে ঢাকা ফিরতে পারলেই যেন খুশি হয়। আমরিন কামরায় ছিল না। খাদিজা বেশ আনন্দ নিয়ে বয়ফ্রেন্ডকে আগামীকালের ভ্রমণ সম্পর্কে বলছিল। নীরা চাদর মুড়ি দিয়ে বেতের চেয়ারটা পা গুটিয়ে বসে বসে বাইরেটা দেখায় মগ্ন। বয়ফ্রেন্ডের সাথে খাদিজা হাস্যরসাত্মক কথাগুলো শুনে নীরার মনের বীণাতে টান দেয়। হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বিরবির করে,
” সবার সবাই আছে। কেবল আমারই কেউ নেই। কী নিঃসঙ্গতা! চারিদিকে হাসির ঢেউ। আমার বেলায় শুধু ভাটা।”
আমরিন বেশ রাত করে কামরায় ফিরল। খাদিজা ঘুমিয়ে গেলেও নীরা তখনও নির্ঘুম। নীরা কম্বলের ফাঁকে অন্ধকারে চেয়ে দেখল আমরিনকে। বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে অনামিকার জ্বলজ্বলে আংটিটা বার বার নাড়িয়ে দেখছিল সে। নীরার মনে পড়ল বিকেলের কথা। আরেকবার ভালো করে তাকাল নীরা আমরিনের দিকে। পুরো পৃথিবীর আনন্দ যেন তারই চোখে মুখে উপচে পড়ছে। হাসলে আমরিনকে বেশ লাগে দেখতে। নীরার ঘুম না আসা অব্দি তাকিয়ে দেখল আমরিনের আংটি নিয়ে খেলা। স্বপ্ন পূরণ হলে বুঝি এমনই খুশি হয় মানুষ৷
আজ সারাদিন ঘুরবে বলে কটেজ থেকে বেরিয়েছে ম্যানেজার মিনহাজ, আমরিন,নীরা, খাদিজা, আরমান এবং তাদেরই দু’জন সহকর্মী। বাকিরা কটেজে আছে৷ মিনহাজ ওদের কক্সবাজার সি বিচ ঘুরিয়ে নিয়ে এলো হিমছড়ি ঝর্ণা দেখাতে। পাহাড়ের গা বেয়ে অবিরাম ঝরে পড়ছে পানির ধারা। নীরা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইল প্রকৃতির রূপে বিমোহিত হয়ে। এই উদার প্রকৃতির বুকে আসলেই মানুষ ভেতরের জ্বালা যন্ত্রণা খুব সহজে ভুলতে পারে। ঝর্ণার জলের ছোঁয়া দু’হাত, দু’পা সিক্ত করলো নীরা। স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে চক্ষু জুড়িয়ে গেল ওর। আরমান এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বললো,
” ঝর্ণা দেখেই টাসকি খেয়ে গেলি। পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখলে তো অজ্ঞান হয়ে যাবি রে তুই।” শব্দ করে হেঁসে উঠলো আরমান। সবাই তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে বুঝল আবার বুঝল না। তাতে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ কারো মধ্যে নেই। তারা এসেছে প্রকৃতির রূপ দর্শনে। অন্য কিছু ভেবে সময় কিংবা মনোযোগ নষ্ট করতে চাইলো না কেউ। বিকেলে দিকে চলে এলো হিমছড়ি পাহাড়ের নিচে। দু’পাশে নানা জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসে আছে স্থানীয় দোকানিরা। নীরা শারমিন, মেহের এবং শিলার জন্য পছন্দ মতো জিনিস কিনে নিল। নিজের পছন্দের একটা শালও নিল সে। বার্মিজ শাল। বেশ দেখতে। পুরোনোটা ব্যাগে ভরে নতুনটার ভাঁজ ভেঙে গায়ে জড়িয়ে নিল। নিজের পয়সায় শখের জিনিস কিনে খুশি তার মুখে ঝলমল করে। মিনহাজ তাড়া দিল উপরে উঠবে বলে। নীরা বাকি কেনাটাকা নেমে এসে করবে ভাবল। সবার পিছু পিছু এসে দাঁড়াল পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ির কাছে। আরমান বললো এটা নাকি তিনশ ফিটের মতো দীর্ঘ। সবাই উঠার আগেই আআ,, করে উঠল। এতো দীর্ঘ সিঁড়ি উঠতে পারবে কীনা মিনহাজ জিজ্ঞেস করলো আমরিনকে। মিনহাজের কথাতে ছিল ব্যঙ্গ। আরমিন খুব বুঝল সেটা। গলা উঁচু করে বললো অবশ্যই যাবে সে। নীরা খাদিজার দিকে তাকাতেই ওরা ম্লান হাসি দিয়ে সম্মতি জানাল। শুরু হলো পাহাড়ের গায়ে তৈরি সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে ওঠা। মূল উচ্চতায় উঠতে দুই ধাপে সিঁড়ি ডিঙাতে হয়। এক ধাপ ডিঙিয়েই সবার অবস্থা কাহিল। নীরা এমনিতেও হ্যাংলা পাতলা। সিঁড়ি মাড়াতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। যতো উপরে উঠছিল শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা হচ্ছিল খুব। তবে সেই কষ্ট ছাপিয়ে সবার মাঝে আনন্দ বিরাজ করছে আরমান এবং ম্যানেজার মিনহাজের হাস্যকর কথাবার্তায়। আজ যেন কেউ সিনিয়র জুনিয়র নয়। সবাই হাসি ঠাট্টা করতে করতে উঠে এলো সর্বোচ্চ চূড়ায়। সকল কষ্ট এই ক্ষনে কমে গেল তাদের। একপাশে কক্সবাজার সমুদ্রের একাংশ অন্যপাশে সবুজে ঘেরা পাহাড়ের সৌন্দর্য্য। নীরা পাশের বেঞ্চিটায় বসে শ্বাস ছেড়ে এই নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করছে। স্বর্গ সম্পর্কে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাড়াতেই বুঝি স্রষ্টা পৃথিবীতে এতো সুন্দর নয়নাভিরাম দর্শনীয় স্থান সৃষ্টি করেছে। এই সৌন্দর্যের কোলে আসলেই মানুষের ভাবনা চিন্তা পরিবর্তন হতে বাধ্য। সবকিছু জুড়েই কেবল রয়ে যায় সৌন্দর্য্যের রেশ। সবাই এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। নীরা পাহাড়ের এককোনে দাঁড়িয়ে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল যতোদূর দৃষ্টি যায়। হঠাৎ সামনে দিকের পায়ে তৈরি রাস্তার পাশে বেড়ে ওঠা ঝোপের মধ্যে একটা খরগোশ দেখল সে। নীরা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতেই কান খাড়া করে তাকাল খরগোশটা। নীরাকে এগিয়ে আসতে দেখে ছুটে পালিয়ে গেল সামনে। নীরাও সেটার পিছু নিল। তার খেয়ালই নেই সে লোকজনের ভীর ছেড়ে নেমে এসেছে নির্জন পাহাড়ের নিচে। আবার সামনে খরগোশ দেখে নীরা ছুটে গেল সেটা ধরতে। এবারও পারল না। একদম গভীরে নেমে এলো জঙ্গলের। হাঁটুসমান ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে গেল টিপটিপে পায়ে। তার ধ্যান জ্ঞান যেন ঐ খরগোশেই নিবদ্ধ।
অস্তাচল সূর্যকে দেখছে সবাই। একটু একটু করে ডুবে গেল সূর্য। আকাশে রয়ে গেল রক্তিম আভা। চারপাশে ম্লান আলো ফুটতেই সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল নিচে নামার জন্য। মিনহাজ সবাইকে নিয়ে নিচে নামছিল হঠাৎ আরমান বলে উঠল,
” স্যার নীরা কই?”
” নীরা কই মানে কী? একটু আগেই না দেখলাম ওকে।”
” আমিও তো তাই দেখেছিলাম। খাদিজা নীরা কই?” আরমান চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে।
খাদিজা কিছুই বলতে পারল না। নীরা যখন খরগোশটার পেছনে পেছনে নেমে গিয়েছিল, তখন খাদিজা মোবাইল ব্যস্ত ছিল। তার সেটা মনে পড়তেই বললো সে। মিনহাজ, আরমান দৌড়ে গেল সেখানে। কোনো মানুষের চিহ্নও নেই সেই স্থানে। অনেকে গন্তব্য স্থলে ফিরতে নিচে নামছে আর যারা আছে তারা উপরের দিকেই আছে। ছুটাছুটি শুরু করল নীরাকে খুঁজতে সবাই। আরমান বেশ খানিকটা ঐ পথে খুঁজেও নীরার কোনো চিহ্ন পেল না। ভয়ে চিন্তায় সবাই অস্থির হয়ে পড়ে। অনেক খুঁজেও যখন নীরাকে পাওয়া গেল না হতাশ হয়ে বসে রইল সবাই। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। এখানে নিখোঁজ হওয়ার ঘটার সম্ভাবনা তেমন নেই। তবুও পুলিশ বিষয়টা গুরুত্বের সাথে নিল। যতোদূর খোঁজার খুজল তারা। কিছুই পেল না। নীরার বোনকে জানানো হলো। শারমিন মোবাইল কানে নিয়ে চিৎকার করে ওঠে খবর শুনে। তাকে কোনোভাবেই শান্ত করতে না পেরে পুলিশ অফিসার কল কাট করল। শারমিনের হাত পা কাঁপছে। কী করবে কিছুই বুঝে উঠল না সে। বহুকষ্টে নিজেকে একটু শান্ত করে মেহেরকে জানাল। মেহের শারমিকে সান্ত্বনা কী দেবে? সে নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়ল এমন ঘটনায়। শোয়েব পুলিশ অফিসারের সাথে যোগাযোগ করে জানাল তারা শীঘ্রই সেখানে আসছে। শোয়েবের অনুরোধে মেহের নীরার মিসিং হওয়ার কথাটা জানাতে মোবাইল করল রাফসানকে। রাফসান সবেমাত্র বাসায় ফিরে কাপড় পাল্টে বিছানায় বসেছিল। মেহেরের কল পেয়ে চমকিত হলো সে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে কল রিসিভ করতেই যা শুনলো, তাতে তার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। একটা কথারও জবাব রাফসান দিতে পারল না। মেহের বার বার ডাকল, রাফসান! রাফসান!” রাফসান নির্বাক, অনুভূতিশূন্য মানুষের ন্যায় বসে রইল। রাফসানের এমন আচরনে অবাক হলো মেহের। কল কেটে দিল রাফসানের সাড়াশব্দ না পেয়ে। রাফসানের চোখে ভেসে উঠল নীরার মুখখানি। মুহূর্তে চাদর গায়ে জড়িয়ে ছুটে নেমে এলো নিচে। রাহেলা ডায়নিং এ বসা ছিল।ছেলেকে এমন পাগলের মতো ছুটতে দেখে দৌড়ে দরজার কাছে গেলেন তিনি। রাফসান কোনোদিকে খেয়াল না করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। সে জানে না কোথায় যাচ্ছে। শুধু জানে তাকে নীরার কাছে যেতে হবে। সেটা কোথায়! কিছুই জানা নেই। সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসছে। চোখের জলে চশমার গ্লাস ভিজে ঝাপসা লাগছে সামনের সব। গাড়ি এলোমেলো ড্রাইভ করছে রাফসান। মাথায় শুধু একটা বিষয়ই আছে।তাকে যতোদ্রুত সম্ভব কক্সবাজার পৌঁছাতে হবে।
নীরা যখন বুঝল সে পথ হারিয়ে পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে, তখন দিশেহারা হয়ে পড়ল। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই মনে পড়ল সেই দুঃস্বপ্নের কথা। এমনই কোনো গহীন জঙ্গল ছিল। নীরার হৃদপিণ্ড দ্রুত চলছে। কোনপথে এগোবে ঠাহর করে উঠতে পারলো না। চোখের সামনে ঝোপঝাড় আর ঘাস। কোনো মানুষের চিহ্নই সেখানে নেই। নীরা মনে মনে সাহস জুগিয়ে সামনের পথে ভীরু পায়ে এগোচ্ছে। না এ পথ তার চেনা নয়। নীরা ঘুরতেই হাতির ডাক শুনতে পেল। দিকবিদিক শূন্য হয়ে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে ছুটতে লাগলো ভয়ে ভয়ে। পথ তো পেলই না উল্টো অন্ধকার ঘন জঙ্গলে এসে থামল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঠিক সেই স্বপ্নের মতো। নীরা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গায়ের কামিজের কোনা মুঠ করে। শ্বাস ছাড়তেও তার ভয় করছে। বিস্ফোরিত চোখে অন্ধকারে চোখ ঘুরাতে লাগল। হঠাৎ খ্যাচখ্যাচ পায়ের আওয়াজ শোনা গেল একটু দূরে। নীরা কান খাড়া করে শুনছে। চোখের সামনে সবটাই আঁধার এই মুহূর্তে। নীরা কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে একইভাবে। আওয়াজটা ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসছে তার। এই অন্ধকারে কোথায় যাবে সে? চোখ খিচে বন্ধ করে রইল।যখন দেখল কিছু ঘটল না। চোখ টিপ টিপ করে তাকাল। তখনই মাথায় ভারি কিছুর আঘাত পড়ায় ছিঁটকে পড়ল ঘাসের উপর। ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠতেই আঁধার ফুঁড়ে সম্মুখে দপ করে জ্বলে উঠলো মৃদু আলোর টচ। নীরা আতঙ্কিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল। কালো চাদরে ঢাকা দীর্ঘদেহি মানবমূর্তি এসে দাঁড়াল নীরার সামনে। ভারী গলায় ব্যঙ্গ করে টেনে বললো,
” বউ মা-আ!” নীরার দিকে ঝুঁকে মুখ থেকে চাদর সরাতেই নীরা ভয়ে জমে গেল। কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল সামনে ঝুঁকে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখামাত্র। মানুষটা সবগুলো হলদেটে দাঁত কেলিয়ে বিদঘুটে ভঙ্গিতে হেঁসে বললো,
” চিনছ আমারে? বাবলু চাচা! তোমার শ্বশুরের খাস লোক।”
নীরা আর কিছুই ভাবতে পারল না। ভয়ে, আতঙ্কে জ্ঞান হারায় সাথে সাথে।
চলবে,,,