খোলা জানালা পর্ব ১

বাসর ঘরে বসে আমার বর নাঈমের সাথে গল্প করছি।নাঈম আমার হাত ধরে বসে আছে।আর ঠিক তখন দরজায় কেউ ঠুকঠুক করে শব্দ করলো।নাঈম উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ঘরে এসে প্রবেশ করলেন আমার শাশুড়ি। তিনি এসেই আমার গলা থেকে সোনার চেইনটা একটানে ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর জোর করে হাত থেকে বালা দুটো খুলে নিলেন।বালা খোলার সময় মনে হলো এই বুঝি আমার হাতটা ছিঁড়ে যাচ্ছে! তারপর যে কান্ডটা করলেন তা আরো ভয়ংকর। কোন সাধারণ মানুষ কোনদিন এমন কাজ করতে পারবে না। কিন্তু আমার শাশুড়ি করলেন। তিনি একটানে আমার কান থেকে ঝুমকো দুটো ছিঁড়ে নিলেন।আর নিলেন নাকফুলটাও। সঙ্গে সঙ্গে আমার কানের লতি থেকে আর নাকের মাংস থেকে দরদর করে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো।আর ব‍্যাথায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠলো সারা শরীর। আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম।গা কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো। মুহুর্তে রক্তে আমার শাড়িখানা ভিজে উঠলো।আর বিছানায় বিছানো গোলাপী চাদর,সাদা গোলাপ ভিজে লাল টুকটুকে হয়ে উঠলো।
আমি ভয়ার্ত চোখে আমার শাশুড়ির দিকে তাকালাম। তার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।ও পাশে নাঈম কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার শরীরও কেমন থরথর করে কাঁপছে।
আমি এবার অসহায়ের মতো হাউমাউ করে কেঁদেই উঠলাম।
আমার শাশুড়ি তখন আমায় ধমকে উঠলেন।ধমকে উঠে বললেন,’চুপ।একদম চুপ।গলা বাড়াইলে গলাও ছিঁইড়া ফেলবাম টান মাইরা!’
আমি চাপা কান্নার গলায় বললাম,’আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেন?’
আমার শাশুড়ি তখন বললেন,’প্রতিশোধ নিচ্ছি প্রতিশোধ।তোর বাবা আজহার মাস্টারের সাথে আমার বিয়ে ঠিক ছিল। কিন্তু তোর মা ছলে বলে তাকে নিয়ে পালিয়েছিলো! সেই বিয়ে ভাঙার কত কষ্ট ছিল তা আমি কাউরে বুঝাইতে পারবো না।কত অপমান আমার হয়েছিল তাও বুঝাতে পারবো না। আমি দু দুটো বছর ঘরের ভেতর দমবন্ধ হয়ে পড়ে ছিলাম।ঘর থেকে বের হতে পারিনি লজ্জায়। আর তখন থেকেই আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম এর প্রতিশোধ যতদিন আমি না নিতে পারবো ততদিন আমি শান্তিতে ঘুমাবো না।আজ আমার প্রতিশোধ নেয়া শুরু হলো!’
শাশুড়ির কথাগুলো শুনে আমার মাথা কেমন ভণভণ করে ঘুরতে লাগলো।ইনি কী সব কথা বলছেন! আমার মা তো এমন নন। তিনি কখনই তো এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে পারেন না!
কান আর নাকের ব‍্যাথা আমায় পাগল বানিয়ে তুলছে। আমি সহ্য করতে না পেরে আবার কাঁদছি। কিন্তু ভয়ে চুপিচুপি কাঁদছি।নাঈম এবার তার মাকে আস্তে করে বললো,’আম্মা যাও তো এবার। হয়েছে তো! একজন মানুষের সাথে কীভাবে আরেকজন মানুষ এমন হিংস্রতা দেখায়?’
নাঈমের কথা শেষ করতে দেরি হলো কিন্তু তার গালে তার মায়ের হাতের চড় পড়তে দেরি হলো না।
আমার শাশুড়ি তার গালে চড় দিয়ে বললেন,’লায়েক হয়ে গেছস তুই?লায়েক হয়ে গেছস?গলা টিইপা দমডা বাইর কইরা ফেলবো!আজ থাইকা আমার কথার বাইরে যদি কিছু করবি তাইলে জানে মাইরা ফেলাইবো!’
নাঈম ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো।
এবার আমার শাশুড়ি আমার সাথে কথা বললেন। তিনি আমার কাছে এসে বললেন,’একটা খেলা দেখাইবো এখন।খেলা দেখবা বউ?’
আমি শুধু জলভরা চোখে শাশুড়ির দিকে তাকালাম। কিন্তু কথা বললাম না।
এবার আমার শাশুড়ি নাঈমের দিকে তাকালেন।
তারপর বললেন,’নাঈম,আমি যা বলবো এখন থাইকা তুমি কিন্তু আমার সাথে গলা মিলাইবা বাজান। আমার কথার বাইরে কিছু করলে তো জানোই!’
তারপর আমার শাশুড়ি এক অদ্ভুত কান্ড করলেন। তিনি চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন আশে পাশের মানুষদেরকে।
‘তোমরা‌ কেউ আসলা না গো আসলা না , আমার বউ পাগল হয়ে গেছে।কী সব্বোনাশ করছে গো দেখো আইসা তোমরা। নিজের নাক কান নিজেই ছিঁইড়া ফেলছে।’
বাইরের মানুষদের ডাকতে ডাকতে তিনি তার হাতে থাকা চেইন বালা আর কানের ঝুমকো ছড়িয়ে ফেললেন মেঝেতে।
এবার তিনি মেঝেতে বসে কান্না শুরু করলেন।একে একে তখন আত্মীয় স্বজন আর আশে পাশের ঘরের মানুষগুলো আসতে শুরু করলো। তিনি তখন কাঁদতে কাঁদতে মাথা চাপড়ে বলতে লাগলেন,’কী সব্বোনাশ করলো গো, আমার পোলারে পাগল বউ গছাইয়া দিলো!’
আমার শাশুড়ির এসব কান্ড দেখে আমার বুক কেমন কেঁপে উঠলো অজানা ভয়ের আশঙ্কায়। কেন জানি তখন আমার মনে হলো,আমি ভীষণ বড় বিপদের মধ্যে পড়ে গেছি। এই বিপদ থেকে বাঁচা আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে যাবে!’

আত্মীয় স্বজনরা একে একে আমার চারপাশ এসে ঘিরে ফেললো। একজন বৃদ্ধ মহিলা এসে আমার মুখের কাছে ঝুঁকে বললো,’সব্বোনাশ সব্বোনাশ,বউয়ের চোউখ দেখো কেমন টকটকা লাল ।এর জ্বীন আছে। কবিরাজ ডাকো তাড়াতাড়ি। নাইলে বিপদ হইবো’
আরেকজন অল্প বয়সী মহিলা তার মুখটা কেমন করে বলে উঠলো,’আরে এইসব কিছু না ।দেখেন গিয়া মাইয়ার নাগর আছে। নাগরের সাথে আগে ভাগেই ঢলাঢলি হয়ে গেছে। এখন জামাইর হাতে ধরা পড়বার ভয়ে এমন করতাছে!’
এই কথাটা শুনে আমার মেজাজ সত্যি সত্যি খুব বিগড়ে গেল।আর আমি তখন ওই মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম,’মুখ সামলে কথা বলুন বলছি!’
এই কথা বলতেই আমার শাশুড়ি ওখানে উপস্থিত সবাইকে বললেন,’সবাই জলদি বাইর হইয়া যান।ঘর তালা দিয়া দেই। নাইলে কখন কী করে পাগলে আল্লাহ জানে!’
আমার শাশুড়ির কথায় সবাই তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমার শাশুড়ি তখন নাঈমকে বললেন,’তুইও বাইর হইয়া যা এইখান থাইকা।’
নাঈম যেতে চাইলো না।সে ঠিক দাঁড়িয়ে রইল।
এবার আমার শাশুড়ি নাঈমকে ধমকে উঠতেই নাঈম ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তারপর আমার শাশুড়ি সবার শেষে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। ঘরের ভেতর থেকে আমি চিৎকার করে বললাম,’প্লিজ!দরজাটা বন্ধ কইরেন না! আল্লাহর দোহাই দরজাটা বন্ধ কইরেন না। আমি এইখানে একলা ভয়ে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো!’
কিন্তু তিনি আমার অনুনয় শুনলেন না। দরজায় তালা আটকে দিয়ে চলে গেলেন!

রাতে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ করে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।আর হঠাৎ করে বিছানার পাশে জানলায় ঠুকঠুক শব্দ শুনে ঘুম থেকে উঠলাম প্রচন্ড ভয় নিয়ে। তারপর —-

#চলবে


#খোলা_জানালা
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here