গুমোট অনুভুতি পর্ব ২৭

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২৭

শীতের দুপুরের রোদ খুব মৃদু হয়,শরীরে আলাদা আরাম দেয়। গ্রাম বাংলার বাচ্চা থেকে বুড়ো মানুষগুলো গোসল সেরে সারি বেঁধে রোদ শুকাতে বসে পড়ে, কেউ বা সদ্য গোসল করে আসাতে রোদের মাঝেও কাঁপতে থাকে, চাদর মুড়িয়ে শীত কমানোর প্রচেষ্টায় থাকে। শহরের মানুষ শীতকাল সঠিকভাবে উপভোগ করতে পারে না, তারা হাড় কাঁপানো শীতের আনন্দ বা কষ্ট কোনটিই উপলব্ধি করতে পারে না। চারপাশে জনসমাগম এতোই বেশি যে প্রকৃত শীত ধরা যায়না, তবে কিছু ভেতরের দিকে গ্রামের মতো এলাকার দিকে এলে আর বাইরে থাকলে শীতের উপলব্ধি করা যায় কিছুটা হলেও।

এই যেমন এই মুহুর্তে সায়ান বুঝতে পারছে, পরনে কালো শার্ট খুব বেশি মোটা নয়, তাই পৌষ মাসের শীতের কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে ও। দুহাত দিয়ে নিজেকেই যেনো জড়িয়ে ধরার ব্যার্থ প্রচেষ্টা করলো তবে নিজের স্থান থেকে এক চুলও নড়লো না, আশেপাশে মিইয়ে যাওয়া কিছু কাশফুল গাছ দেখা যাচ্ছে, এখন কাশফুলের সময় নয় তবে এখানে কিছু অংশ দেখে সায়ান অবাক না হয়ে পাড়লো। এছাড়া পুরো মাঠটাই ফাঁকা, দূর দুরান্তে কিছুই চোখে পড়ছে না তবে কানে গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে। সায়ান চুপচাপ বসে রইলো, নিজের জীবনের হিসাব মিলাচ্ছে।

ও কিছুতেই ভাবতে পারছে না চন্দ্রিকা এমন একটা কাজ করবে। ধীরেধীরে যেনো চন্দ্রিকা নামক মেয়েটির আসল চেহারা ওর সামনে ফুটে উঠছে! কতোগুলো জঘন্য কাজ ও করে ফেললো বিনা দ্বিধায়,এই চন্দ্রিকাকে ও চেনে না। ছয়বছর পুর্বে যখন সেই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখেছিলো তখন সত্যি বলতে ওর খুব মায়া কাজ করেছিলো, জীর্ণশীর্ণ দেহ আর মলিন চেহারা দেখে ওর খুব দুঃখ হয়ে ছিলো। ওর খারাপ লেগেছিলো যে ওর প্রান বাঁচিয়েছে সে এতোটা শোচনীয় অবস্থায়! নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো যে ও আগে কেনো খুজে পায়নি এই মেয়েটিকে?প্রায় সাথে সাথেই নিজের সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু সেই আশ্রমের প্রধান বেঁকে বসলেন, প্রশ্ন করে বসলেন যে কি পরিচয়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে!

সায়ান থমকে ছিলো কয়েক মুহুর্তের জন্য, কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। এটা নিশ্চই বলতে পারবে না যে ও চন্দ্রিকাকে এডপ্ট করে নিয়ে যাবে কারণ ওদের বয়সের পার্থক্য ছিলো মাত্র ছয় বছর। সায়ান ভেবে পাচ্ছিলো না যে কি বলে সে তার ছোট্ট পরিকে এখান থেকে নিয়ে যাবে যে তার জীবন বাঁচিয়েছে। ও বড্ড কৃতজ্ঞ ছিলো তার প্রতি, হুট করে বলে ফেললো যে ও মেয়েটিকে বিয়ে করবে যখন মেয়েটি প্রাপ্ত বয়স্ক হবে। বিশ বছর বয়সে বেশ সাহসিকতার সাথে জবাব দিয়েছিলো সেদিন, তারপর চন্দ্রিকাকে নিজের সাথে নিয়ে আসে। মেয়েটাকে সাথে করে নিজের বাসায় নিয়ে আসে, প্রায় অনেকদিন পর্যন্ত ভালোই ছিলো খান বাড়িতে। চন্দ্রিকার সাথে ঠিক মতো দেখা হতো না ওর, সে নিজের মতো থাকতো আর ও ওর মতো। কিন্তু বাঁধ সাধল মিসেস খান, হুট করেই চন্দ্রিকাকে মারার প্ল্যান করে যাতে সায়ান খুব কষ্ট পায় আর চন্দ্রিকাও খুব ভয় পেয়েছিলো সাথে হসপিটালে ছিলো অনেকদিন। নিজের যে জীবন বাঁচিয়ে তার শোচনীয় অবস্থা মেনে নিতে পারেনি ও তাই রাগের বসে ঘর ছেড়ে দেয়।চন্দ্রি সেদিন ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে বলেছিলো

“আমি ভয়ে আছি সায়ান, ঠিক মতো ঘুমাতে পারছিনা। মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করলে কেউ মেরে ফেলবে, প্লিজ সেভ মি। আমার মতো অনাথকে সাহায্য করো।”

“আমি তোমার পাশে আছি চন্দ্রিকা, তুমি পেয়ো না। আমি থাকতে কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না”

“কিন্তু আমি আপনার পাশে কি পরিচয়ে থাকবো? সবাই তো দিনশেষে আমার দিকে আঙুল তুলবে আর কোথাও আমি সেফ থাকবো না”

সায়ান চুপ হয়ে গেলো তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বললো

“ইউ আর মাই ফিয়ন্সি ফ্রম নাউ অন। আমার বাগদত্তার গায়ে হাত দেয়ার সাহস কারো নেই। তুমি যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হবে এবং গ্রেজুয়েশন কম্পলিট করবে তখন আমরা বিয়ে করবো।”

সায়ান আর চন্দ্রিকার সম্পর্কের কথা পুরো দুনিয়া জানতো তাই এরপর কেউ চন্দ্রিকার দিকে আঙুল তুলে নি। তবে চন্দ্রিকা নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক অনেকবার দাবি করলেও সায়ান এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়নি, ও নিজেকে এবং চন্দ্রিকাকে সময় দিতে চেয়েছিলো কিন্তু তার মাঝেই হঠাৎ রুশি চলে ওর জীবনে। নাহ রুশি চলে আসেনি বরং চন্দ্রিকা ওকে ইচ্ছে করে নিয়ে এসেছে ওর লাইফে।আর সত্যি বলতে সায়ান খুব খুশি যে রুশি ওর লাইফে আছে, ও খুব খুশি যে ও বাবা হতে চলেছে আর তার থেকেও অনেক বেশি খুশি যে ওর বাচ্চার মা অন্য কেউ নয় বরং রুশি!

সায়ান চোখ বন্ধ করে নিলো,চন্দ্রিকার এই রুপটা ও কখনো আশা করে নি। সেই ছোট পিচ্ছি মেয়েটি যার একটা নিষ্পাপ চেহারা ছিলো তার সাথে এর যেনো কোন মিল নেই। এতোদিন যে চেহারা দেখে ওর মায়া হতো আজ সেই চেহারা দেখে শুধুমাত্র মনে হয়েছে ‘কি নিখুঁত অভিনয়!”
তাহলে আগের সেই কান্না,বারবার ভালোবাসা জাহির করা সব অভিনয় ছিলো না?

নারী সত্যিই রহস্যময়ী! এদের চেনা বড় দায়, সহজ সরল চেহারার পেছনে কতো শত রহস্য লুকিয়ে।আর রহস্যের মায়াজালে নিজেকে বোকা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। আচ্ছা রুশিও তো নারী কিন্তু তার মাঝে এতো জটিলতার কোন আঁচ নেই নাকি ও সেই জটিলতা দেখতেই পায়না। রুশির মাঝেও কি এরুপ রহস্য বিরাজ করে?আর যদিও করেও তবে সায়ান খুঁজতে চায় কিন্তু বুঝতে চায়না কারণ রহস্য উদঘাটন হয়ে গেলে আগ্রহ নিতান্তই কমে যায় আর ও চায়না রুশিকে জানার, বোঝার ওর কাছে থাকার বিন্দুমাত্র আগ্রহ কমুক। ও আজীবন এই রহস্যে নিজেকে হারাতে চায়।

রুশির কথা ভাবতেই সায়ানের ঠোঁটের কোন হাসি ফুটে উঠলো,মেয়েটা বড্ড অদ্ভুত! সবার থেকে আলাদা, এই এতোদিন বিয়ের বয়স হলো ওদের কিন্তু কখনো সায়ানের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি। নিজ থেকে সায়ানের সাথে থাকতে চায়নি, সায়ান খুব করে চায় রুশি ওর উপর অধিকার দেখাক। ওর কলার চেপে জোর করে বলুক

“ইউ আর মাই ম্যান!ওই সব চন্দ্রিকাকে যতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন ততই মঙ্গল”

সায়ান আলতো হাসলো, রুশির বাঘিনী রুপ দেখতে ইচ্ছে করছে ওর। রাগলে রুশিকে ঠিক কেমন লাগে তা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে, নিশ্চই সরু নাকটা লাল হয়ে যাবে! চোখগুলো বড় বড় হয়ে যাবে আর কপাল কুচকে যাবে। অসম্ভব সুন্দর লাগবে হয়তো!সায়ানের ভাবনার মাঝেই কেউ একজন ধপ করে পাশে বসলো তারপর সায়ানের গায়ে চাদর দিয়ে দিলো। সায়ান পাশে তাকিয়ে দেখলো ইনান, ও খানিকটা অবাক হলো। তা দেখে ইনান বললো

“অবাক হওয়ার কিছু নেই, আদিকাল থেকেই জানা যদি সায়ান জামিল খান হুট করে হারিয়ে যায় তাহলে তাকে এখানেই পাওয়া যাবে। কারণ তার মন খারাপ হলে তিনি দুনিয়াদারি ছেড়ে এখানে এসে দুঃখ বিলাশ করেন।কিন্তু দুঃখবিলাস করছেন ভালো কথা, আই এপ্রিশিয়েট ইট বাট ফোন কেনো অফ রাখেন? বাড়ির সবাই টেনশন করছে সেদিকে কি আপনার খেয়াল আছে? আন্টির টেনশনে বিপি হাই হয়ে গেছে আর সামু তাকে সামলাচ্ছে। এদিকে রুশি নাকি না খেয়ে…”

ইনানের কথার মাঝ পথেই থামিয়ে দিলো সায়ান আর শান্ত স্বরে বললো

“ভাবি! রুশি ভাবি হবে তোর। আমার বউ তো ভাবিই হবে তাইনা?”

উত্তরে ইনান কিছু বললো না,শুরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কাউকে চাইলে এতো সহজেই ভোলা যায়না আর সে যদি হয় চার বছরের ভালোবাসা! শত চেষ্টা করলেও মনের কোন এক কোনে থেকেই যায় কিন্তুর সামুর সাথে খুব থাকলে খুব একটা মনে পড়ে না। ওর বিশ্বাস একসময় ও ভুলেই যাবে ওই পাগলির পাল্লায় পড়ে হয়তো ও নিজেও তাই চায়!ভুলে যেতে নিজের ফেলে আসা অতীতকে যার থেকে ও কিছুও পায়নি শুধুমাত্র অপুর্ণতা ছাড়া!

ইনান সায়ানের দিকে তাকালো, চেহারায় সিরিয়াস ভঙ্গি। ইনানের মনে হলো সায়ানকে কিছু কথা বলা উচিৎ, এটা হয়তো সবার ভবিষ্যতের জন্যই ভালো কারণ এতে তিন তিনটি মানুষের জীবন জড়িয়ে। এই বিষয়ে কথা বলা হয়তো আগেই প্রয়োজন ছিলো তবে এখনো বেশি দেরি হয়নি।ও শান্ত স্বরে বললো

“সায়ান! আমার কিছু বলার ছিলো তোকে অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম তোকে বলবো কিন্তু বলা হয়নি আজ সুযোগ যেহেতু পেয়েছি তাই বলেই দেই।”

#চলবে
(ছোট করে দেয়ার জন্য স্যরি আর হ্যা কালকের পর্বে কিছু আছে আপনাদের জন্য)

  • LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here