গুমোট অনুভুতি পর্ব ৪৪+৪৫

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৪

নর্মাল ওয়ার্ডের বারান্দায় পর্দা দিয়ে কিছু সিট রাখা হয়েছে,কিছু মানুষ হসপিটালের নর্মাল ওয়ার্ডের ব্যয়ভারও বহন করতে না পারলে তাদের এই স্থানে রাখা হয় সম্পুর্ণ অনাদর আর অবহেলায়! যদি ভাগ্যক্রমে ডাক্তার এই রাস্তা দিয়ে যায় আর তাদের দিকে কিঞ্চিত নজর দেয় আরকি! চিকিৎসা বলতে এইটুকুই তারা পায় তারা। বেশিরভাগ রোগি এই অবস্থায় ওইপারে পাড়ি জমায়, কেউবা ভাগ্যের জোরে বেঁচে যায়!

সায়ান পর্দা সরিয়ে এইরকম একটা জায়াগায়ই এসেছে,সামনে প্রায় ষাটোর্ধ একজন নারী শুয়ে আছে ছোটখাটো সিটটিতে,জীর্ণশীর্ণ দেহ, চোখের নিচে কালশিটে পড়ে আছে! মৃত্যুর জন্য যেনো অপেক্ষা করছে! সায়ানের তাকে খুব পরিচিত মনে হয়েছিলো তখন তাই এসেছে এখানে, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চিনতে পারলো। আজ প্রায় ছয়বছর পর তাকে দেখছে।মিনু খালা! মাধবপুর চাইল্ড কেয়ারের হেড ছিলেন উনি যদিও আগের সেই সবল নারী আর এখানের এই দুর্বল নারীর মাঝে কোন মিল নেই তবুও সায়ানের চিনতে ততটা কষ্ট হয়নি কিন্তু উনি এখানে তাও এই অবস্থায়!

আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলো না,সায়ান আস্তে করে তার দিকে দিকে এগিয়ে গেলো তারপর তার মাথায় আস্তে করে হাত রাখলো। কাঁপা কাঁপা পল্লবগুলো নাড়িয়ে সে তাকালো,তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সায়ান দূর থেকে একটা চেয়ার টেনে পাশে বসলো তারপর তার হাত চেপে ধরলো বললো

“কেমন আছো মিনু খালা?আমাকে চিনতে পারছো? আমি সায়ান…সায়ান জামিল খান!”

“ত্ তুমি সায়ান!কোন সায়ান?”

“ওইযে যখন ছোট ছিলাম তখন আমাকে আপনার অরফানেজের একটা মেয়ে আমাকে বাঁচিয়েছিলো!তারপর আমি প্রায় আটবছর পরে আপনাদের সেখানে খোঁজ নিয়েছিলাম সেই মেয়ে সম্পর্কে আর প্রায় ছয়বছর আগে তাকে সেখান থেকে নিয়ে এসেছিলাম! ওর নাম পরী ছিলো মনে আছে?আপনিই তো খুঁজে দিয়েছিলেন।”

“তুমি স্ সেই ছেলে!আমি তো তোমাকেই খুজছিলাম”

মিনু খালা উঠে বসে পড়লো আর সায়ানের হাত ধরে বললো

“অবশেষে আমি তোমাকে পেলাম! এখন আমি মরেও শান্তি পাবো, তোমাকে কথাগুলো বলবো বলেই হয়তো আমি বেঁচে আছি।আমি যে পাপ করেছি তার শাস্তি আমি হারে হারে পাচ্ছি কিন্তু আমি আমার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই”

উনি প্রায় একনিঃশ্বাসে সবটা বললেন তারপর সায়ানের হাত ধরে ছলছল নয়নে তাকিয়ে বললেন

“আমি তোমাকে সেদিন মিথ্যে বলেছিলাম, সত্যি বলতে টাকার লোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি যাকে পরী ভেবে এসেছো সে পরী নয় বরং চন্দ্রিকা ছিলো। সম্পর্কে আমার দুঃসম্পর্কের ভাতিজি, জন্মের সময় মা মরে যাওয়াতে তার বাবা তাকে মেনে নেয়নি দ্বিতীয়পক্ষের সন্তান ছিলো কিনা!আমার মায়া হওয়ায় তাকে এখানে নিয়ে আসি কিন্তু একসময় কেউ একজন টাকার লোভ দেখিয়ে বলে চন্দ্রিকাকে ছোট্ট পরী হিসেবে বলতে আর আমি রাজি হয়ে যাই। টাকার লোভ যেমন ছিলো তেমন চেয়েছিলাম চন্দ্রিকা যাতে ভালো থাকে আর তাই আজ হয়তো আমার এই দশা!চন্দ্রিকা তোমার পরী থেকে পাক্কা দেড় বছরের ছোট, ও সে নয় যাকে তুমি খুঁজছিলে!”

সায়ান থমকে গেলো, এরমানে যাকে এতোদিন ওর জীবনের সেভিয়র ভাবতো সে আসলে চন্দ্রিকা নয় বরং অন্যকেউ। আসলে সায়ান অবাক হচ্ছে না, আর যাইহোক চন্দ্রিকার মতো মেয়ে কারো জীবন বাচাতে পারেনা।কিন্তু তাহলে আসল পরী কে?আর সে এখন কোথায়?সায়ান মিনু খালার দিকে তাকিয়ে দ্রুত প্রশ্ন করলো

“তাহলে সেই ছোট্ট পরী কোথায়?কোথায় পাবো আমি তাকে?”

“আমি নিজেও জানিনা সে কোথায় আছে আর কি অবস্থায় আছে আর এতোগুলো বছর হয়ে গেছে তাই সে ঠিক কেমন দেখতে তাও আমার মনে নেই। তুমি আসার প্রায় অনেক বছর আগে তাকে সেখান থেকে অন্যকেউ নিয়ে গিয়েছে হয়তো। কারণ তোমার মনে নেই হয়তো কিন্তু তুমি থাকা অবস্থাই আশ্রমে হঠাৎ ভয়ানক আগুন লাগে আর তুমি খুব অসুস্থ ছিলে সেই সময় আর সেই মেয়েটি তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে আগুনে পড়ে গিয়েছিলো! ততক্ষণে তোমার পরিবার তোমাকে এসে নিয়ে যায় আর ওই মেয়েটির কারণে তুমি অক্ষত অবস্থায় ছিলে।ওই মেয়েটির চিকিৎসার খরচ দিয়ে তোমার পরিবার সেখান থেকে চলে যায় আমরা ট্রিটমেন্ট করাই তাকে কিন্তু সে পুরোপুরি সুস্থ হয়না, এখনো হয়তো তার শরীরে পোড়ার দাগ আছে আর আমি যদি ভুল না হয়ে থাকি তবে পিঠে দাগ আছে হয়তো! যাইহোক আমাদের আশ্রমের অনেক ক্ষতি হওয়াতে আমরা সকল বাচ্চাকে এডপ্ট দিয়ে দিচ্ছিলাম তাই কে কাকে নিয়ে গেছে তা আমাদের জানা নেই শুধুমাত্র চন্দ্রিকা আর কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাইকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। পরী মেয়েটাকেও হয়তো কোন পরিবার নিয়ে গিয়েছিলো! যাইহোক তুমি যখন খোঁজ নিতে এসেছিলে তখন আগের কোন রেকর্ড আমাদের ছিলো না তাই না করে দিয়েছিলাম প্রথমে কিন্তু পরে টাকার লোভে পড়ে আমি মিথ্যের আশ্রয় নেই আর তাই হয়তো আজ আমার এই অবস্থা!”

সায়ান চুপ করে বসে রইলো,সেই ছোট্ট পরী ওকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রান পর্যন্ত সংকটে ফেলে দিয়েছিলো অথচ ও আজ পর্যন্ত তাকে খুঁজেই পায়নি। ওর জীবন বাঁচানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়া হয়নি, তার দায়িত্ব নেয়া হয়নি এমনকি ও জানেও না সে কি অবস্থায় আছে। ওর এই মস্ত বড় ভুলের জন্য সে কি তাকে ক্ষমা করবে?কিন্তু তাকে খুঁজে তো বের করতে হবে!সায়ান ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলো

“তার কোন রেকর্ড!আমি তাকে কি করে খুঁজে বের করতে পারি?কিছু তো জানেন আপনি!”

“তার কোন রেকর্ডই নেই কারণ ওই আগুনে সব শেষ হয়ে গিয়েছিলো, আমার শুধু এইটুকু মনে আছে যে তাকে কেউ একজন আশ্রমের দরজায় ফেলে দিয়ে গিয়েছিলো। দামী তোয়ালে দিয়ে পেচানো ছিলো সে আর দেখে মনে হচ্ছিলো কয়েকঘন্টা পুর্বে সে হয়েছে! আর হ্যা…”

সায়ানের থেকে চোখ সরিয়ে উনি যেনো কিছু একটা খুজতে ছিলো আর পেয়েও গেলো।ছোট্ট একটা কৌটা থেকে একট চেইন বের করলো সাথে একটা লকেট! উনি এটা সায়ানের হাতে ধরিয়ে বললো

“এইটা সেই মেয়ের গলায় পরানো ছিলো আর আমি দামী হওয়ায় নিজের কাছে রেখেছিলাম। সেই সময় তোমাকে দেয়ার কথা মনে ছিলো না কিন্তু কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো তোমার সাথে দেখা হবে আর হয়েও গেলো। কোন দিন ওকে পেলে দিয়ে দিও এটা আর হ্যা বলো আমায় ক্ষমা করে দিতে!আমি এখন মরেও শান্তি পাবো।”

সায়ান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর সাহিলকে ফোন করে বললো তাকে ভালো ওয়ার্ডে শিফট করতে, তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত অলরেডি হয়ে গেছে নতুন করে কিছু করার নেই। সায়ান আসতেই রুশি চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়ালো আর প্রশ্ন করলো

“কোথায় ছিলেন আপনি?সেই কখন থেকে ওয়েট করছি!”

“স্যরি বউ ওয়েট করানোর জন্য”

তারপর রুশিকে আস্তে করে হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো আর মৃদু গলায় প্রশ্ন করলো

“কি বলেছে ডক্টর?”

“বলেছে বাবু আর তার মা দুজনেই সুস্থ আছে!আচ্ছা আপনি কোথায় গিয়েছিলেন বললেন নাতো!”

“একজন পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিলো তার সাথেই কথা বলেছিলাম। আচ্ছা তুমি যদি জানতে পারো এতোদিন তুমি ভুল তথ্য জানতে, তুমি যাকে নিজের লাইফ সেভিয়র ভাবতে সে আসলে তোমার জীবন বাচায়নি বরং সে অন্যকেউ ছিলো আর তুমি তাকে খুঁজেই পাওনি এখন পর্যন্ত। কি করতে তুমি?”

“চন্দ্রিকা তাহলে আপনার জীবন বাঁচায়নি তাইনা?”

“উঁহু!ছোট্ট পরী অন্যকেউ ছিলো আর আমি এতোবছর তা জানতামই না”

রুশির কেনো যেনো খুব খারাপ লাগলো আর ভয় হতে শুরু করলো। অনেকটা ভয় নিয়ে প্রশ্ন করলো

“যদি ছোট্ট পরীকে একদিন খুঁজে পান তবে কি করবেন?তাকে বিয়ে করবেন?”

সায়ান রুশির থমকে গেলো আর রুশির দিকে তাকালো, রুশি তখনো নিচের দিকে তাকিয়ে। ও রুশির হাত চেপে ধরে বললো

“আমি অলরেডি বিবাহিত রুশি!নতুন করে বিয়ে করার প্রশ্নই আসেনা,আমার বউ আছে ঘরে। কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসার পার্থক্য আমি বুঝি যদিও তুমি আসার আগে ভালোবাসার মানে জানা ছিলো না কিন্তু এখন আমি এটা জানি তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। আমার শ্বাসপ্রশ্বাসে মিশে গেছো তুমি! যদি তাকে কোনদিন খুঁজেও পাই তবে সে আমার দায়িত্ব থাকবে, যদি ভালো অবস্থায় থাকে তবে আমরা দুজন মিলে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো আর যদি না থাকে তবে তার দায়িত্ব নিবো। তুমি তোমার হাজবেন্ডের ঋণ পরিশোধ করতে পাশে থাকবে না?”

রুশি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, সায়ান ওকে ছেড়ে যাবে এটা ও জানে তবুও কেনো যেনো প্রশ্ন করলো! রুশি মুচকি হেসে বললো

“আমি সবসময় আপনার পাশে থাকবো!”

“প্রমিস করেছেন কিন্তু মিসেস খান! এইযে এই হাত ধরেছেন আর ছাড়া যাবে না কিন্তু, আপনি চাইলেও আমি ছাড়তে দিবো না”

“ওকে!”

রুশি কারের ভেতরে বসলো এমন সময় মেসেজ আসলো ফোনে। ও বের করতেই সায়ান আর নিহার কিছু ছবি দেখতে পেলো যা দেখে মনে হচ্ছে তারা খুব ইনটিমেট!সাথে একটা মেসেজ

“আমি ফোন থেকে সব ডিলিট করে দিয়েছি,তুমিও সেটা ডিলিট করে দাও”

রুশি বাঁকা হাসলো আর মেসেজ করে বললো

“ওয়েল ডান, আমি ওই রেকর্ডিংটা আসলে ডিলিট করতে চাইছিনা। যখন মুড ভালো থাকবে তখন করে দিবো নাহয় কে জানে তুমি আবার কখন কি করো!”

অপরপাশ থেকে মেসেজ আসলো না বরং সোজা ব্লক মেরে দিলো ওকে যা দেখে রুশি জোরেই হেসে দিলো!সায়ান ভ্রু কুচকে বললো

“কি নিয়ে হাসছো?আমাকেও বলো!”

“উঁহু বলা যাবে না সিক্রেট।”

“আজকাল মিসেস খান বড্ড সিক্রেট রাখছে দেখছি! এমনকি কি যা নিজের হাজবেন্ডের সাথেও শেয়ার করা যায়না?আর দুপুরে তুমি কি করে জানলে আমি ওইখানে আছি?আর ওই রুমেই বা কি হয়েছে?”

“সিক্রেট তো বলা যাবে না, আচ্ছা কোন একদিন বলবো ওকে?বাট আজকে না”

সায়ান সায় দিলো আর রুশি ফোন নাড়তে লাগলো!ওর নিজের বুদ্ধিমত্তার জন্য খুব প্রাউড ফিল করছে,ভাবতেই যেনো খুশি খুশি লাগছে। আসলে আজ সকালে সায়ানের কনভারসেশন ও শুনেছিলো কিন্তু নিহার হুট করে ওইখানে সায়নকে যেতে বলার কথা শুনে খটকা লাগলো। ও ভেবেছিলো সায়ান বলবে কোথায় যাচ্ছে তাহলে ও সাথে যাবে কিন্তু সায়ান কিছু বলেনি হয়তো টেনশনে ফেলতে চায়নি তবে রুশি নিশ্চিত হতে পারলো না তাই ওইসময় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরার বাহানায় নিজের ফোনের রেকর্ডার অন করে সায়ানের কোর্টে রেখে দিয়েছিলো। সায়ান ওর সাথে কথায় ব্যাস্ত থাকায় বুঝতে পারেনি, তারপর অনেক্ষন পর সায়ান না আসায় ও টেনশনে পড়ে যায়। এমনসময় নিহা ওর ফোনে কিছু ছবি পাঠায় যা দেখে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ও নিজে তাই সেখানে যায় আর বডিগার্ডদের বলে দরজা খুলতে, তারা সেটা বিনা আওয়াজে খুলতেই ও ভেতরে গিয়ে দেখে নিহা কাঁদছে। ও কিছু না বলে সায়ানের জ্ঞান ফিরতেই তাকে ওই রুম থেকে যেতে বলে আর রুমে ঢুকে সায়ানের কোর্ট থেকে নিজের ফোন বের করে সেই রেকর্ডিং অন করে।

সবটা শুনে বুঝতে পারে নিহা সব আগে থেকেই প্লেন করে রেখেছিলো। ও সায়ানকে ঘুমের মেডিসিন দেয় আর সায়ান ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর নিহালের সাহায্যে সায়ানকে রুমে এনে ওর কোর্ট খুলে পাশে রাখে আর ইচ্ছে করে বিভিন্ন এংগেলে ছবি তুলে ওকে পাঠায়। ওর ইচ্ছে ছিলো রুশি যাতে সায়ানকে ছেড়ে দেয় আর আবার এবাড়িতে ফিরে আসে তাহলে নিহালেরও একটা চান্স থাকবে। ওর পালক মাও এতে শামিল ছিলো তাই তিনি আগেই পাশের বাসায় চলে যান আর নিহাল চিলেকোঠায়!রুশি ওই রেকর্ডিং শুনাতেই নিহা ঘাবড়ে যায় কারণ এটা ওর স্বামীর কানে গেলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে যা ও এই মুহুর্তে চায়না আর তাই রুশি বলেছে সব ছবি, ভিডিও ওকে পাঠিয়ে তারপর ডিলিট করে দিতে নাহয় ও সব নিহার হাজবেন্ডকে দেখাবে!নিহা ভয় পেয়ে ও যা বলেছে তাই করেছে। আসলে কপাল বলে একটা জিনিস আছে, যেই পঁয়ত্রিশ বছরের লোকের সাথে রুশির বিয়ে দিতে চেয়েছিলো তারা সে এখন নিহার স্বামী! টাকা পয়সা দিক থেকে সুখে থাকলেও মানসিক দিকে থেকে ও সুখে নেই তা দেখেই বুঝা যায়!কথায় আছে না অন্যের জন্য কুয়া খুড়লে সেই কুয়াতে মানুষ নিজেই পড়ে! যা হয়েছে ভালোই হয়েছে এখন নিহা যদি শুধরায় আরকি নাহয় ও এখন আর ছেড়ে কথা বলবে না।

ওর স্বামী, ওর সংসার, সবকিছু ওর!তাতে অন্যকাউকে হস্তক্ষেপ করতে দিবে না আর একচুলও ভাগ দিবে। যা ওর তা নিজের করে কি করে রাখতে হয় তা ওর ভালো করে জানা আছে! অন্যসব দুর্বল নারীদের মতো ভুল বুঝে চলে যাবে না ও বরং সত্যের মোকাবিলা করবে!নিজের অধিকারে অন্যকাউকে ভাগ বসাতে ও দেবে না, কক্ষনো না!সায়ান যেহেতু ওকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে এর মানে ও আর পিছু হটতে পারবে না, সারাজীবন ওর হয়েই থাকতে হবে সায়ানকে! এটা যদি পসেসিভনেস হয় তবে হ্যাঁ ও সায়ানের প্রতি পসেসিভ খুব বেশিই হয়তো কিন্তু যেটা ওর সেটা ওরই থাকবে!
গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৫

ভার্সিটির লাস্ট সেমিস্টার পরিক্ষার শেষ দিন ছিলো আজ,পরিক্ষা শেষে সবাই নিজ নিজভাবে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। রুশি ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো, প্রেগন্যান্সির ছয় মাস চলে বর্তমানে কিন্তু এক্সাম মিস করতে চায়নি তাই এসেছে ভার্সিটিতে! সায়ানকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে, এমনকি সায়ান নিজে ওকে ভার্সিটি পৌঁছে দেয় আর গাড়িতে ওর জন্য ওয়েট করে! সায়ান ভেতরে সিটে বসিয়ে দিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু রুশি কোন প্রকার সমালোচনা চায়না এমনকি এটাও শুনতে চায়না যে সায়ানের মাধ্যমে এক্সামে ভালো করেছে!

প্রেগন্যান্সির মাত্র ছয়মাস চলে বিদায় পেট বেশি উঁচু হয়নি এখনো তাই এখনো অতটা বুঝা যায় না আর শীতকালের গরম স্যুয়েটার পরার কারণেও আরো বুঝতে পারে না। সায়ান যদিও বডিগার্ড পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু রুশি তাতেও রাজি হয়নি,খামোকা লাইমলাইট নিয়ে কি লাভ?সায়ান গাড়িতে বসে এসবই ভাবছিলো, এই মেয়েটা তার কোন কথা শুনেনা। ডক্টর বলেছে সাবধানে থাকতে আর ওর সেসব যেনো মাথায়ই নেই।সায়ান চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে গেটের দিকে, একে একে সবাই গেট দিয়ে বের হচ্ছে কিন্তু রুশির নাম নিশানা দেখছে না তাই সায়ান গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো!

এদিকে রুশি চোখ মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে,কিছুক্ষণ পুর্বে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নিজের ড্রেসের সাথে বেঝে পড়ে যাচ্ছিলো কিন্তু একটা ছেলে ওর হাত ধরে ফেলে যাতে ও বেঁচে যায়। আজ পড়ে গেলে কি হতো তাই ভেবে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো ওর!আরো কয়েক সিঁড়ি বাকি ছিলো তাই ভয়টা আরো বেড়ে গেলো, সেইদিনের সিঁড়ির ঘটনা এখনো মনে পড়লে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় ও। রুশি ঠিক হয়ে দাঁড়াতেই ছেলেটি কোন প্রকার কথা না বলে হাঁটা শুরু করলো, রুশি তার পেছনে ছুটলো। তার কিছুটা পেছনে থেকেই বললো

“একটু দাঁড়াবেন? আপনার সাথে ম্যাচ করে হাটতে পারছিনা”

ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়লো আর পেছনে ফিরে রুশির দিকে তাকালো। রুশি তার কাছে খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলো তারপর হাপাতে হাপাতে বললো

“থ্যাংকস আজকে আমাকে বাঁচানোর জন্য, আপনি না থাকলে আসলে কি হতো আমি জানিনা”

ছেলেটি মাথা নেড়ে চলে যেতে নিয়েও কি মনে করে পেছনে ফিরে বললো

“এই অবস্থায় এভাবে চলাফেরা না করলেই তো পারেন। আপনার হাজবেন্ড কি কিছু বলে না আপনাকে?হাউ ইরেস্পন্সিবল!সবসময় আপনাকে বাচানোর কেউ থাকবে না তাই চলতে না পারলে বাসা থেকে বের হবেন না প্লিজ!”

রুশি মাথা নিচু করে ফেললো,আশ্চর্যের বিষয় হলো ছেলেটার টোনে কোন প্রকার তাচ্ছিল্য ছিলো না বরং কন্সার্ন ছিলো! রুশি মুচকি হেসে বললো

“ওকে!আপনি কি এখানেই পড়েন?”

“হুম এবার সেকেন্ড ইয়ারে উঠবো, আজ এক্সাম শেষ হলো।”

“ওহ আমরা একই ইয়ার! কোন ডিপার্টমেন্ট?”

“ভেটেনারি ডিপার্টমেন্ট যেটা আপনারও”

“আপনি মানে তুমি আমার ক্লাসের? আর আমি কখনো নোটিসই করিনি!”

“মেয়েদের নোটিস করোনা আর তো ছেলে!”

“ওহ হয়তো! তাহলে থ্যাংকস হিসেবে এক কাপ কফি তো খাওয়াই যায় তাও আমার ট্রিটে!”

“খেতে পারি তবে যদি আপনার হাজবেন্ড রাজি হয়!”

বলেই অন্যদিকে ইশারা করলো, রুশি সেদিকে তাকিয়ে সায়ানকে দেখতে পেলো। ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো কিন্তু সায়ান এসেই সেই ছেলেটিকে হুট করে ঘুষি মারলো। আচকমা ঘটনায় রুশি থমকে গেলো, সায়ানকে থামানোর কথা ভুলে গেলো মুহুর্তের জন্য। সায়ান ছেলেটিকে মারলেও ছেলেটি উল্টা মারলো না এমনকি ডিফেন্স পর্যন্ত করলো না। তার ঠোঁটের কোনে হাসি লেগেই আছে। রুশি গিয়ে সায়নকে থামাতে লাগলো কিন্তু থামাতে পারছে না। রুশি চিল্লিয়ে বললো

“সায়ান প্লিজ স্টপ!ও একটু আগে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে সো প্লিজ স্টপ!”

সায়ান কিছু সময়ের জন্য থেমে গেলো তারপর আরো জোরে মারতে শুরু করলো আর বললো

“হাউ ডেয়ার ইউ!তুমি ওকে টাচ করলে কি করে?ওর দিকে নজর দিলে কি করে তুমি?ও শুধু আমার!তোমাকে ওই চন্দ্রিকা পাঠিয়েছে তাইনা?আবার নতুন করে কোন প্লট করছো তোমরা! এবার যদি ওর দিকে এতোটুকু আঁচ আসে না জিন্দা পুতে ফেলবো তোমাদের দুজনকে বলে দিলাম!”

রুশি এতোক্ষনে বুঝতে পারলো সায়ানের রেগে যাওয়ার মানে, এই ছেলের চন্দ্রিকার সাথে কোন কানেকশন আছে নিশ্চই! রুশি সায়ানকে ছাড়িয়ে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া ধরলো আর সেই ছেলেকে ঠোঁটের ইশারায় স্যরি বললো যা দেখে সে হাসলো তারপর চিল্লিয়ে বলতে লাগলো

“মিস.রুশি! কফির অফার মনে রাখবেন কিন্তু আর হ্যা আমার নাম শাহেদ… শাহেদ নওয়াজ!ডোন্ট ফরগেট দেট!”

সায়ান তেড়ে আসতে চাইলেও রুশি দিলো না, দ্রুত গাড়িতে নিয়ে বসালো। সায়ান জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো হয়তো রাগ থামানোর চেষ্টা করছে। সায়ানের যতই রাগ থাকুক সেটা রুশির সামনে কখনো ও প্রকাশ করেনা কারণ একসময় ওকে কেউ একজন বলেছিলো “নারীরা ফুলের মতো,তাদের উপর জোর প্রয়োগ করলে নষ্ট হয়ে যাবে”

তাই সায়ান নিজের জেন্টেল সাইড সমসময় রুশিকে দেখায়,সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো

“তুমি আর ওই ছেলের সাথে কখনো মিশবে না, চন্দ্রিকার ছায়াও তোমাদের উপর পড়ুক সেটা আমি চাইনা। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!”

রুশি মাথা নাড়লো, যদিও ছেলেটিকে খারাপ মনে হয়নি তবুও সায়ানের কথায় যুক্তি আছে, আর যাইহোক চোখের দেখা ভুলও হতে পারে।

_______________________

হাই স্পিডে হাইওয়েতে গাড়ি চালাচ্ছে শাহেদ! ঠোঁটের কোনে রক্ত জমে আছে, শরীর এমনকি চেহারার অনেক জায়গাও জখম হয়ে আছে! ওর ঠোটের কোনে মৃদু হাসি!আজকে সায়ানের রিয়াকশন দেখে অনেক খুশি ও। সেই রাগ, সেই জেলাসি দেখেছে ও সায়ানের চোখে যেটা একদিন ওর চোখে বিরাজ করতো!গাড়ির স্টেয়ারিং চেপে ধরে বিড়বিড় করে বললো

“নিজের স্ত্রীর সাথে অন্যকেউকে দেখে জ্বলেছে তাইনা সায়ান? আমারো জলতো যখন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটি তোমার কাছে থাকতো আর তোমাকে নিয়ে ভাবতো। তোমাকে পেতে চাইতো, আমি শুধু তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি যাকে তুমি ভালোবাসো তাকে অন্য ছেলের সাথে হেসে কথা বলতে দেখলে কতোটা খারাপ লাগে!”

শাহেদ নিজের ফ্লাটে পৌঁছে চাবি দিয়ে দরজা খুললো আর চন্দ্রিকাকে সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখলো।চন্দ্রিকা ওকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো তারপর এগিয়ে এসে বললো

“এই অবস্থা হলো কি করে?কোন এক্সিডেন্ট করেছেন নাকি?”

“নাহ তোমার সায়ান আমার এই হাল করেছে।”

“সায়ান হঠাৎ এমন করবে কেনো?কি হয়েছে আপনাদের মাঝে?সায়ান হুট করে এমন মারামারি করার মানুষ তো না!”

শাহেদ কথাটা হজম করতে পারলো না,চন্দ্রিকার হাত চেপে ধরে নিজের কাছে এনে বললো

“নিজের সায়ানের প্রতি এতো বিশ্বাস অথচ সে তোমাকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। আর শুনো আমি ডিফেন্স করিনি পর্যন্ত, নিজের বউয়ের সাথে কথা বলা দেখে সহ্য হয়নি তার!”

কথার মাঝেই চন্দ্রিকা হুট করে ঠোঁটের কাটা জায়গায় চাপ দিলো

“আহহহহ পাগল নাকি?”

“ওহ আপনি ব্যাথাও পান?”

“কেনো আমাকে মানুষ মনে হয়না?”

“তা না আসলে আপনি ডিফেন্স করেননি যেহেতু তার মানে ব্যাথা পাননা। যাইহোক আপনি এইটুকুন একটা ছেলে হয়ে সায়ানের সাথে পেরে উঠতেন না। ”

“ওহ হ্যালো! কারাঠে চ্যাম্পিয়ন আমি। তোমার আমার সাথে জীবনেও পারতো না যদি আমি লড়তাম। আর এইটুকুন ছেলে মানে কি?তোমার থেকে বড় আমি, হ্যাভ সাম রেস্পেক্ট!”

“হাহ আমাকে আপনার থেকে আর কতো বড়ো?দেখতে তো আমার ছোটই মনে হয়, বাইরে গেলে বলবে আপনি আমার ছোট ভাই!”

“আমি তোমার ছোট ভাই!এই তুমি সাইজ দেখছো তোমার?এইটুকুন মেয়ে!আবার আমাকে ছোট বলো, আমাকে মোটেও ছোট মনে হয় না বরং আমাকে বড়ই দেখা যায়।বাজে বকবা না”

“শুনুন যতই বড়ো দাবি করুন নিজেকে আমার কাছে ছোটই লাগে আপনাকে। তাইতো আপনার সাথে একই ফ্লাটে থাকতে হেজিটেশন ফিল হয়না কারণ আপনি ছোট ভা…”

চন্দ্রিকার কথার মাঝেই শাহেদ একদম কাছে এগিয়ে গেলো, ওদের ঠোঁটের মাঝে হয়তো কয়েক ইঞ্চি পার্থক্য। শাহেদ চন্দ্রিকার কানের সামনে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো

“আরেকটু কাছে আসলে কিন্তু আমাকে আর ছোট মনে হবে না, বেশি ছোট ছোট বললে বড়দের মতো কিছু করতে ইচ্ছে। তাই আমাকে অযথা ক্ষেপিও না, নাহয় আমি কিন্তু মানুষটা ভালো নই!”

বলেই চন্দ্রিকাকে ছেড়ে নিজের রুমে চলে গেলো আর চন্দ্রিকা জোরেজোরে শ্বাস নিতে লাগলো। নিজের হার্টবিট যেনো নিজেই শুনতে পাচ্ছে এমন অবস্থা, আগে যদিও শাহেদ ওকে জড়িয়ে ধরেছিলো কিন্তু আজকে অন্যরকম ছিলো! কেনো এমন লাগছে নিজেও বুঝতে পারছে না তবে আজকে শাহেদের কাছে আসা খারাপ লাগে নি ওর। ও হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলো!

#চলবে

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)
#চলবে

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here