#ঘর_বাঁধিব_তোমার_শনে
#নুসাইবা_ইভানা
পর্ব-৩৪
জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না।সময় খুব দ্রুত চলে যায়। সেদিনের পর কেটে গেছে দীর্ঘ ছয় মাস।ছোট্ট শেহরোজ এখন এক পা’দু’পা করে হাঁটতে শিখেছে।অস্ফুট স্বরে বাবা বলতে শিখেছে। সুমু শেহরোজ কে কোলে নিয়ে মামুনি বলা শেখাচ্ছে। ছোট্ট শেহরোজ কি আর সেসব বোঝে সে সুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে খিলখিল করে হেসে ওঠে। কি স্নিগ্ধ সুন্দর সেই হাসি।ফাহিন এসে শেহরোজকে কোলে নিয়ে বলল,মামু কা ভান্জে। ও বললে মামু বলবে। মামুনি না। সুমু বলল,না আগে মামুনি বলবে,শেহরোজের কি হলো কে জানে কেঁদে উঠলো শব্দ করে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে ভেজা চুল শুকাতে ব্যস্ত মিহি।কখনো এপাশ কখন ওপাশ করে চুল শুকাচ্ছে। তার দিকে কেউ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে দিকে বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই। বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে শাফিনের চোখে কেমন নেশা ধরে গেল। এলোমেলো শাড়ি আর আধ ভেজা চুল।মিহিকে যেন অপরুপা লাগছে। শাফিন উঠে এসে মিহির চুলে মুখ ডুবালো।হঠাৎ স্পর্শ মিহি কিছুটা কেঁপে উঠলো। শাফিন বলল,বিয়ের পাঁচ বছর পরে কিসের কাঁপা-কাঁপি? শাফিন মিহেকে নিজের সাথে আরো মিশিয়ে নিলো।
মিহি মৃদু স্বরে বলল,দিন দুপুরে কি অসভ্যতা শুরু করলা।কেউ এসে পরবে তো?
শাফিন মিহিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে মিহির ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বল,হুশ আমার রোমান্সে বাঁধা দিবা না।আর রইলো দিন দিপুরের কথা। বউয়ের সাথে রোমান্স করার জন্য টাইম মেইনটেইন করতে হয় না।মিহি শাফিনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।
শাফিন বলে,তোমাদের মেয়েদের এই এক সমস্যা যখন তখন ইমোশনাল হয়ে আমাদের রোমান্টিক মুডের বারোটা বাজিয়ে দাও।
মিহি কোন উত্তর দিলো না। বরং আরো নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরলো শাফিনকে। মিহির মনে উঁকি দিচ্ছে সেদিন হাসপাতালের বেডে র*ক্তে মাখামাখি অবস্থায় থাকা শাফিনের চেহারা।
উদয় মিহিকে নিয়ে হসপিটালে উপস্থিত হতেই মিহি এক ছুটে শাফিনের কাছে চলে যায়। যদিও শাফিন তখন অচেতন হয়ে পরে আছে। মিহি বারবার করে শাফিনকে ডাকতে থাকে। ঈশান মিহিকে সরিয়ে নিয়ে বলে, শান্ত হোন মিস মিহি। এটা ভেঙে পরার সময় না।
মিহি চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলে, আর কত শান্ত হব। আর আপনি আপনি ঠিক আছেন কি করে! আপনি বলেছিন শাফিনের কিছু হতে দেবেন না। তাহলে ওর এই অবস্থা কি করে হল?
ঈশান নিজেই হিসাব মেলাতে ব্যস্ত কি ভাবে হল এসব!
মিহি ঈশানের কলার ধরে বলে শাফিনের কিছু হলে আমি আপনাকে ছাড়ব না।
লিরা এসে বলে,স্যার শাফিন স্যারের ব্লাড লাগবে। ইমার্জেন্সি নয়ত খারাপ কিছু হবে।
ঈশান বলল,হসপিটালে ব্লাড ব্যাংকে যোগাযোগ কর।
– এই হসপিটালে ও নেগেটিভ রক্ত নেই স্যার।
উদয় বলল,আমি আশেপাশের ব্লাড ব্যংক গুলোতে খোঁজ করে দেখি।
এরমধ্যেই নার্স এসে বলল,দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করতে। নয়তা পেশেন্ট কে বাঁচানো সম্ভব হবে না।
ঈশান বলে,আপনি আমার থেকে ব্লাড নিতে পারেন। আমার ব্লাড গ্রুপ ও নেগেটিভ।
ঘন্টা খানিক পর ডক্টর অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এলেন। মিহি ডক্টরকে দেখেই বলতে লাগল,শাফিন ঠিক আছে তো? ওর কিছু হবে না তো?
রিলাক্স পেশেন্ট এখন সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত। তবে জ্ঞান ফিরতে ঘন্টা দু’য়েক সময় লাগবে।চিন্তার কিছু নেই।
ঈশান ডক্টরের সাথে ডক্টরের কেবিনে আসল।ঈশান ডক্টরকে জিজ্ঞেস করল কি হয়ে ছিল শাফিনের?
– ওনার খাবারে কেউ বি*ষ মিশিয়ে ছিলো। আর এটা কোন সাধারণ বি*ষ নয়।এর ক্রিয়া এতোই মারাত্মক যে,ত্রিশ মিনিটে এটি মানব শরীরে ছড়িয়ে পরে, কিডনি থেকে শুরু করে নাড়িভুড়ি সব নষ্ট করে দেয়।ত্রিশ মিনিট পার হয়ে গেলে সেই ব্যক্তিকে আর বাঁচানো সম্ভব না। আপনি যদি সময় মত তাকে হসপিটালে না আনতেন। তবে হয়ত আমাদের কিছু করার ছিলো না।
ঈশানের আর বুঝতে বাকি নেই। এই কাজটা কে করেছে,লিনা শাফিনকে পানি দিয়েছিল। ঈশান ডক্টরের চেম্বার থেকে বের হয়ে সোজা চলে যায় থানায়। সেখানে যেয়ে লিনাকে বলে, ভেবেছিলেন পালিয়ে বাঁচতে পারবেন। কিন্তু আপসোস সেটা হলো না। এবার দু’জনেই এক সাথে নিজেদের পাপের সাজা ভোগ করুন। ওপস দু’জন কেন? আপনাদের ছেলে নয়ন চৌধুরীকেও আমেরিকান পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
লিনা বলে,আমি যেতে যেতে শাফিনকেও শেষ করে দিয়েছি এতেই আমার শান্তি
– ইশশশ এইখানেও আপনার শান্তিতে সে গুড়ে বালি।
– মানে!
– মানে কিছুই না। আগামীকাল যখন কোর্টে হাজির করা হবে তখন৷ নিজ চোখে দেখে নেবেন।
– তুমি মিথ্যে বলছ। এটা হতেই পারে না।
ঈশান একজন লেডি কনস্টবল কে ডেকে বলে,এই ম্যাডামের খাতির যত্নের ব্যবস্থা করুণ।যাতে এর মুখ থেকে কথা না বের হয়।
বেশ কিছু সময় পর শাফিন মিহিকে বলে,তা এভাবেই জড়িয়ে ধরে জনম পার করার ইচ্ছে নাকি বোকাফুল?
শাফিনের কথায় মিহি বলে, পারলে তো তাই করতাম।
শাফিন মিহিকে বলে, শুকনো কথায় চিড়ে ভিজবে না।
এভাবে জড়িয়ে ধরে তৃষ্ণা মিটবে না। বলেই মিহিকে কোলে তুলে নেয়।
মিহি শাফিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,এখন না প্লিজ।শাফিন মিহির কথা না শুনে ধিরে ধিরে মিহির ঠোঁট দুটো দখল করে নেয়।ঠিক সেই সময় শেহরোজের কান্নার শব্দ কানে আসতেই মিহি বলে তাড়াতাড়ি ছাড়ুন শেহরোজ কাঁদছে। শাফিন মিহিকে ছেড়ে দিয়ে নিজেই যেয়ে শেহরোজকে কোলে নেয়। সাথে সাথে কান্না বন্ধ। শাফিন বলে নিজের বাপের রোমান্স সহ্য হলো না বাবাই।ভুল টাইমে এলার্ম বাজাতে হল।এভাবে চলতে থাকলে তোমার আর ভাই বোন আসবে না।
ফাহিন বলে,আমরা এখানেই আছি দুলাভাই।
মিহি শেহরোজকে নিয়ে বলে,আমার বাবার বুদ্ধি আছে কখন কি করতে হয় জানা আছে।
______________________________________________
উদয় লিপিকার (লিরা)কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। লিপিকা উদয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। উদয় বলল, আসলে আমরা ভালোবাসা আর ভালোলাগার মধ্যে পার্থক্য না বুঝেই বিরহে বিলীন হয়ে রই। তুমি দ্বিতীয় বার জীবনে না এলে বুঝতেই পারতাম না জীবন এতো রঙিন। ধন্যবাদ প্রিয় দ্বিতীয় বার আমাকে সুযোগ দেয়ার জন্য। তোমার জন্য আজ আমি পূর্ণ।
লিপিকা উদয়ের কপালে ভালোবাসা এঁকে দিয়ে বলে,ধন্যবাদ আমাকে তোমার জীবনে জায়গা দেয়ার জন্য। আমার জীবনকে ভালোবাসায় পূর্ণ করার জন্য।
এতো রোমান্টিক মূহুর্তে হুট করেই উদয় উঠে বসে বলে,আমার ভিষন লজ্জা পাচ্ছে।
লিপিকা আশ্চর্য হয়ে বলে,কেন?
– আমি বাবা হচ্ছি এটা সবাইকে কি ভাবে বলব।আমার নিজেরই ভাবতে লজ্জা লাগছে।
লিপিকা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে উদয়ের দিকে।
উদয়ের কলার ধরে বলে, বউয়ের সাথে রোমান্স করতে লজ্জা লাগে না।বাবা হবে সেই কথা বলতে লজ্জা লাগে। কেন রে তুই কি গে নাকি।
– এই এসব কি বলছ। আর তুই করে বলছো কেন?
– বেশ করেছি বলেছি। আরো বলবো৷
-আচ্ছা রাগ করতে হবে না। আমি না হয় শরম গরম ভাত দিয়ে খেয়ে নেব।
রাতের বারোটা ছাড়িয়ে গেছে শাফিন অপেক্ষায় আছে শেহরোজ কখন ঘুমাবে। শেহরোজ ঘুমিয়ে পরতেই শাফিন মিহিকে কোলে তুলে পাশের রুমে নিয়ে আসে। মিহি বলে,শেহরোজ উঠে যাবে।
– উঠবে না ছেলের কানে কানে বলে এসেছি বাবা তোর খেলার সাথী আনার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি তুই ডিস্টার্ব করিস না। মিহি শাফিনকে জড়িয়ে ধরে বলে, দিনদিন অসভ্যতা বেড়েই যাচ্ছে। শাফিন মিহিকে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলে,অসভ্যতা কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি এখন তোমাকে বোঝাবো।
সকালের মিষ্টি রোদ মুখে পরতেই ঘুম উবে যায় মিহির। শেহরোজ তার বাবার কোল ঘেসে ঘুমিয়ে আছে। মিহি দু’জনের কপালেই নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,এই জীবন আর কিছু চাওয়ার নেই। কথা শেষ করার আগেই নিজের ঠোঁটে কারো ঠোঁটের স্পর্শ পায় মিহি। শাফিন মিহির ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে বলে,আমার চাওয়ার আছে। ছোট্ট একটা মিহা।আমার পূর্ন পরিবার চাই শাফিন,শেহরোজ,মিহি, মিহা।মিহি বলে এভাবেই কেটে যাক জীবন।শাফিন মিহি আর শেহরোজকে ধরে বলে, এভাবেই কেটে যাবে জীবন। আমাদের ভালোবাসা রয়ে যাবে আমরণ।
______________________________________________
প্রায় শেষ রাত খোলা বারান্দার এক কোনে বসে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে এক যুবক। কি এখ শুন্যতা ঘিরে রেখেছে তাকে। স্লো মোশনে মিউজ বাজছে,,
কত আশা ছিলো মনে ঘর বাঁধিব তোমার সনে।
চাঁদহীন আকাশটা ডেকে আছে কালো মেঘে। ঠিক যেমন ঈশানের হৃদয়টা মেঘে ঢেকে গেছে।আকাশের মেঘ তো বৃষ্টি নামলেই কেটে যাবে।তবে ত্র হৃদয়ের মেঘ এ জন্মে হয়ত আর কাটবে না। জনম জনম থেকে যাবে।
আকাশের পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলতে লাগলো ঈশান।
“তুমি তো অন্য ঘরের ঘরনী। আমার জন্য তুমি এধরাতে আসোনি।তবে কোন আফসোস নেই আর না আছে আক্ষেপ। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা পবিত্র। যতদিন ধরাতে ঈশান থাকবে তত দিন ঈশানের ভালোবাসাও থাকবে।তা কখনো জানা হবে না তোমার। কখন জানবেনা,” রাতের আধারে চাঁদের আয়নাতে; কেউ তোমায় কল্পনা করে রাত যাপন করে।কারো নিশ্বাসের প্রতিটি প্রার্থনায় তুমি মিশে আছো।তবুও ভালোবাসি তোমাকে। যদিও পথ ভিন্ন তবুও ভালোবাসা হবে না ছিন্ন। হৃদয়ের কুটিরে তোমার জন্য সুপ্ত অনূভুতি রয়ে যাবে।তোমার প্রেমে পড়লে হয়তো আমাদের বিচ্ছেদ হতো।অদ্ভুত বিষয় হলো আমি তোমাকে ভালোবেসেছি।আর ভালোবাসা নিরবিচ্ছিন্ন। তুমি যেখানেই থাকো আমার ভালোবাসা তোমার সাথে থাকবে।শুধু আমরণ আফসোস থাকবে।কত আশা ছিলো মনে, #ঘর_বাঁধিব_তোমার_শনে
সমাপ্তি