ঘাস ফড়িং (১ম পর্ব)
.
মিনুর নরম পেটে কারও স্পর্শ। খানিকটা চমকাল সে। কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ পেল না। পাশে অপরিচিত এক বয়স্ক পুরুষ বসা। মুখে সেঁটে রেখেছে কৃত্রিম উদাসীনতা। এদিকে অনবরত কনুই দিয়ে মিনুর পেটে আলতো চাপ দিচ্ছে। মেয়েরা বোধহয় প্রথম স্পর্শ এদের মতো চরিত্রহীন পুরুষ থেকেই পায়। রাস্তা-ঘাটে কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের থেকে কোনো না কোনো বদমাইশের কালো হাত তাদেরকে প্রথম স্পর্শের অনূভুতিটা দেয়।
মিনুর মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হলেও নিজেকে সামলে নিল। ঝামেলায় জড়ানো যাবে না, অন্তত এই মুহূর্তে৷ কারণ প্রস্রাবের ভীষণ চাপ পেয়েছে। মিনু অন্যদিন এদিকটা হেঁটেই চলে যায়। আজ আইরিন ম্যাডামের চেম্বার থেকে বের হয়ে খানিক হাঁটার পরই প্রস্রাবের তীব্র চাপ পেল। তাই সি.এন.জিতে উঠা। লোকটি কনুই দিয়ে বোধহয় এবার বুকও ছুঁতে চাইছে। মিনু বুঝতে পারে আর সহ্য করতে পারবে না। অস্বস্তি লাগছে।
-‘ড্রাইবার সি.এন.জি থামান, এখানেই নামব।’
মিনু গাড়ি ভাড়া চুকিয়ে হাঁটার গতি বাড়ায়। স্টুডেন্টের বাসায় পৌঁছাতে এখান থেকে মিনিট বিশেক লাগবে। সন্ধ্যায় শহরে একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে আসে। চারদিকের উঁচু উঁচু বাসার জানালার ফাঁক গলে কৃত্রিম তারার আলো যেন উঁকি মারছে। এই সময়টাতে বেশ ভালোই লাগে মিনুর। মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। টিউশনিতে গিয়ে তখন এক কাপ চা খায়। দিনের সকল ক্লান্তি পালায়। হাঁটতে হাঁটতে একটা গলির দিকে মোড় নেয় সে। এদিকে আবছা আলো। রাস্তায় পিছলে পড়েছে উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের ছায়া। আচমকা পাশ থেকে মিনুর হাতে হেঁচকা টান দেয় কেউ। তড়িৎ গতিতে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। মুখোশ পরা। মিনু চিৎকার দেয়। গিলে ফেলতে হল নিজের চিৎকার। শক্তপোক্ত একটা হাত মুখ চেপে ধরে শুন্যে খানিক দূরে রাখা গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। ধাক্কা দিয়ে সীটে ফেলে। সবকিছু খুব দ্রুত ঘটায় মিনু প্রথমে পালানোর তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি।
তবে গাড়ির সীটে মুখোশ পরা দ্বিতীয় লোকটির হাতের মুঠোয় যাবার আগেই মাথা নীচু করে ঢুকতে থাকা লোকটির মুখে স্বজুড়ে লাথি মারে। বিপদে পড়ে মিনুর শরীরে শক্তি, বুকে সাহস আর মাথার বুদ্ধি খুলে গেল কি-না কে জানে। মিনুর লাথি খেয়ে লোকটি মুখে হাত দেয়। সুযোগ কাজে লাগায় মিনু। ধাক্কা দিয়ে লোকটিকে নিয়ে রাস্তায় পড়ে যায় সে। খানিক উঁচু থেকে ধাক্কা দিয়ে কেউ উপরে পড়লে নিজেকে সামলানো মুশকিল। পিচ রাস্তায় পড়ে মুখোশধারীর মাথায় বোধহয় বেশ চোটই লাগল। মিনু তার উপরে থাকায় চোখের পলকে লাফিয়ে উঠে। দৌড়াতে থাকে। মিনু খানিকদূরে গিয়ে বুঝতে পারে লোকগুলো পিছু নিয়েছে৷ একবার পেছন ফিরে তাকায়। দু’জন ওর প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। সামনের একটা দোকান দেখা যাচ্ছে। দু’জন লোক দাঁড়িয়ে দেখছে। কিছু বলছে না। তারা হয়তো চোখের সামনে এমন কিছু দেখে ভয় পেয়েছে কিংবা বিস্ময়ে কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। আবার হতে পারে এরা বিপর্যয়ে উৎসব খোঁজা বাঙালি। দৌড়ের গতি বাড়ায় মিনু। সঙ্গে চিৎকার। সে কি এই দোকানে আশ্রয় নেবে? লোকগুলো নিশ্চয় ঠেলে বের করে দিবে না। মিনু সেদিকে ছুটে। দোকানের কাছাকাছি যাবার পর দু’জন লোক তাকে এগিয়ে এসে মুখোশধারীদের বলল-
‘কি হয়েছে ভাই। আপনারা একটা মেয়েকে এভাবে দৌড়াচ্ছেন কেন?’
এসব মুখোশধারীরা ভালো করেই জানে সাধারণ মানুষদের কীভাবে ভরকে দিতে হয়। কেউই উটকো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। মুখোশধারী একজন ধাক্কা দিয়ে দোকানীকে বলল-
‘বাইঞ্চুদের বাচ্চা পথ ছাইড়া গিয়া দোকানের স্যাটার বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাক। না হলে এখানে ব্যবসা করা তোর পাছা দিয়ে ভরে দেব।’
এতো বিপদে থেকেও গালি শুনে মিনুর কান যেন গরম হয়ে গেল। বুকে ধুকপুক বেড়ে গেছে। কিছু মানুষ সারারাত মদ খেয়ে মাতাল হয়েও এসব গালাগাল কাউকে দিতে পারবে না। কিন্তু ওরা কত স্বাভাবিকভাবে কথায় কথায় গালি দেয়। গালি বোধহয় তাদের কাছে ভয় ধরানোর অস্র।
মিনু লক্ষ্য করে দেখল লোক দু’টো কেমন মিইয়ে গেছে। এদের পেছনে দাঁড়ানো কি ঠিক হবে? তাকে দৌড়াতে হবে। ওদের পেছন থেকে সে আবার দৌড়ায়।
খানিকদূরে গিয়ে আচমকা পায়ে ল্যাং মারে কেউ৷ উড়ে পড়ে পিচ রাস্তায়। থুতনি আর বুকে লাগল ভীষণ। বুক কি গলে গেছে? থুতনিতে তীব্র ব্যথা। কিন্তু এসবে খেয়াল করার সময় নেই। উঠে দাঁড়ায় মিনু। যেভাবে হোক পালাতে হবে। উঠতে যেয়ে বুঝতে পারে হাঁটুতে আঘাত পেয়েছে৷ পা টেনে টেনে দৌড়াতে থাকে। ঘন ঘন শ্বাস। হাঁপিয়ে গেছে ভীষণ।
কেউ কী বাঁচাতে আসবে না? সিনেমায় তো কত হয় এমন! আর পারছে না দৌড়াতে। যা হবার হবে। হাঁটুতে দুই হাত রেখে হাঁপাতে থাকে।
বেশ শক্তপোক্ত একটা হাত মিনুর চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বলল,
– ‘কানকি মাগী তোর তেজ বের করবো চল।’
এতো অশ্লীল গালাগাল মিনুকে জীবনে কেউ দেয়নি। গালিই প্রমাণ করছে লোকগুলোর ভেতরে মায়াদয়ার লেশমাত্র নাই। এরা তুচ্ছ কারণে কিংবা হাজার পাঁচেক টাকার জন্য খুন-খারাবী করার মতো মানুষ।
মিনু তারপরও ক্ষীণ আশা নিয়ে চেষ্টা করে, দূর্বল অসহায় গলায় বলে-
– ‘কেন এমন করছেন আমার সঙ্গে? আপনারা কারা? কি চান? পায়ে পড়ি আপনাদের। ছেড়ে দিন আমাকে।’
লোক দু’টো তাকে টেনে নিতে নিতে বলে,
– ‘মাগী চল একটু পরেই বুঝতে পারবি।’
মিনুর শরীরে আর শক্তি নেই। শুধু ক্লান্তি আর ব্যথা। গা ছেড়ে দেয়। লোকগুলো প্রায় শুন্যে তাকে গাড়িতে তুলে। দ্রুত মুখ-হাত বেঁধে ফেলে কেউ৷ গাড়ি চলতে থাকে। পাশের লোকটি কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলে। কথা শেষ হলে আরেকজন জিজ্ঞেস করে কি বলছে?
– ‘ধারালো ব্লেড দিয়ে মাগীর চোখ আর ঠোঁট কেটে ফেলতে বলল।’
দ্বিতীয় লোকটি বলল-
‘তা পরে কাটা যাবে। মাগীর চেহারা দেখছিস কত সুন্দর। সিনেমার নায়িকারা মাইয়ার চেহারার কাছে বিনা পয়সার বান্দী হওনেরও যোগ্য না।’
সবাই মিলে হা-হা-হা করে হেঁসে উঠে।
লোকটির কথা শুনে মিনু ভয়ের সঙ্গে বিস্মিত হয়। ওর উপর কার এতো রাগ। এমন নির্মম শাস্তি তাকে কে দিতে চায়৷ কেন দিতে চায়? সাধারণ একটা মেয়ে সে৷ টিউশনি আর আইরিন ম্যাডামের ডেন্টাল চেম্বারে কাজ করে প্রতিবন্ধী ভাই আর অসুস্থ মা’র মুখে দু’টো ভাত তুলে দেয়। অথচ মিনুর বয়স এখন বান্ধবীদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় মুখ বাঁকা করে সেলফি তোলার। ফেইসবুক স্টোরিতে নানান ভঙ্গিমায় ছবি দিয়ে জ্যাম লাগানোর। কিন্তু সে এখন যে জীবনটাকে যাপন করছে সেখানে এগুলো হচ্ছে অবেলায় ঘুমিয়ে এলোমেলো স্বপ্ন দেখার মতন। যে স্বপ্নগুলো ঘুম থেকে উঠে মনে করবারও বিন্দুমাত্র প্রয়োজনবোধ করা হয় না। বুক এবং থুতনি থেকে রক্ত বের হচ্ছে৷ ব্যথা করছে ভীষণ৷ কিন্ত সব ব্যাথা চাপিয়ে এই মূহুর্তে প্রস্রাব করা ফরজ হয়ে পড়েছে মিনুর।
—————————————————-
.
‘আমার মুখে কী এতোটাই দুর্গন্ধ, যার জন্য তুমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছো?’
শ্রেয়া কথাটা বলে আশা করছিল নীলাভ মুখ ফিরিয়ে খানিক মুচকি হেঁসে বলবে- ‘কী যে বল শ্রেয়া৷’
কিন্তু না, নীলাভ শুধু উত্তরে বলেছে- ‘সেরকম কিছু নয় শ্রেয়া, তুমি ঘুমাও।’
শ্রেয়ার ভীষণ মন খারাপ হবার কথা৷ কিন্তু তাকে দেখে তেমন মনে হচ্ছে না। রসিকতা করে নীলাভকে শুনিয়ে শ্রেয়া আপন মনে বলল, ‘কিছু তো একটা আছে শ্রেয়া। কিন্তু তোমার তো কোনো ছোঁয়াচে রোগ নেই৷ সকালে দাত ব্রাশ গোসল সবই করা হয়েছে। তারপরও স্বামী দূরত্ব বজায় রাখছে কেন কে জানে!’
না, নীলাভের কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
শ্রেয়ার মাঝেও বিয়ের পর যেন তুমুল পরিবর্তন এসেছে।
নীলাভ ভাইয়ের উপর বিয়ের আগে সে যে পরিমাণ অধিকার ফলাতো। এখন তাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে কেন যেন অধিকার ফলাতে যায় না।
ব্যাপারটা কেমন উল্টো, কিন্তু সত্য।
———————————
অতীত
——
নীলাভ হচ্ছে শ্রেয়ার মামাতো ভাই। তাদের বাসা থেকে পড়াশোনা করছে সে। শ্রেয়া হচ্ছে মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তাই ওর মা-বাবা খানিক আগ্রহ নিয়েই নীলাভকে নিজের বাসায় রেখেছেন। শ্রেয়ার বাবাও বিদেশে থাকেন।
তখন থেকেই শ্রেয়ার সমস্ত কিছু যেন নীলাভকে ঘিরে।
সারাক্ষণ অকাজে ওর রুমে যাওয়া। সেধে সেধে ঝগড়া করা। বাইরে গেলে হঠাৎ কোনো সার্ট পছন্দ হলে নীলাভের জন্য নিয়ে আসা আরও কত কী।
কিন্তু নীলাভ সব সময়ই তাকে এড়িয়ে চলেছে। শ্রেয়া একদিন ওর বান্ধবীর বোনের বিয়েতে যাবার জন্য খুব সময় নিয়ে সেজেছিল। বাসা থেকে বের হবার আগে কি ভেবে জানি অকাজেই নীলাভের রুমে গেল। তাকে দেখে নীলাভ খানিক্ষণ তাকায়। শ্রেয়া উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে- ‘কেমন লাগছে আমায়।’
নীলাভ যেন অনেকটা মুখস্থের মতোই বলে দেয়-
-‘শয়তান্নীর মতো লাগছে। তোর চিকন হাত-পা দেখে মনে হচ্ছে একেবারে মুরগীর ঠেং। মুখে এসব কি দিয়েছিস ওয়াক কি বিচ্ছিরি। এতো চিকন করে ভ্রু আবার প্লাক করছিস না-কি। এরকম ভ্রু প্লাক করে সিনেমায় কেউ অভিশপ্ত ভয়ংকর মহিলার আত্মার অভিনয় করে মানুষকে ভয় দেখাতে পারবি। আর ওড়না না দিয়ে যে গলার আশপাশ দেখাচ্ছিস। কোনো ছেলে কি তোর এদিকে তাকাবে মনে করছিস? বেয়াক্কল গলার হাড্ডি দেখা যাচ্ছে তোর। মাংস বলতে কিচ্ছু নাই। বিড়ালেরও আগ্রহ হবে না। তোর যা শরীর যত ঢাকবি ততই মঙ্গল।’
একটা মেয়েকে এই কথাগুলো যে কি পরিমাণ প্রভাবিত করতে পারে নীলাভের হয়তো ধারণা নেই। তবে শ্রেয়া বেশ শক্ত মানসিকতার মেয়ে। তাবুও কেমন ধুপ করে নিভে গেল। মুখময় রাতের কালো আঁধার নেমে এলো। চুপচাপ নীলাভের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কান্নায় শরীর বারংবার কেঁপে উঠছিল। নিজের রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে। সেদিন আর বিয়েতে যায়নি শ্রেয়া। পরবর্তী মাস দুয়েক নীলাভের সামনেও আসেনি। সব সময় কেমন চুপচাপ, মনমরা হয়ে থাকে।
তবে ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হয়।
নীলাভের এমন কঠিন স্বভাব দেখে শ্রেয়া একদিন ওর রুমের সমস্ত থ্রিলার উপন্যাস সরিয়ে প্রেমের কবিতা আর প্রেমে টইটম্বুর সব প্রেমের উপন্যাস রেখেছিল।
সেটা নিয়ে দু’জনের কত ঝগড়াঝাটি। নীলাভ বলে আমার থ্রিলার উপন্যাস ছাড়া কিছুই পড়তে ভালো লাগে না। সুতরাং এগুলো সরিয়ে আমার থ্রিলার উপন্যাসগুলো বের করে দাও।
শ্রেয়া বলে- ‘এগুলো পড়ে পড়েই তুমি একটা পাথর মানব হয়েছো। আজ থেকে এগুলো পড়া বাদ।’
নীলাভ গিয়ে ফুফুর কাছে নালিশ করেও বিশেষ কাজ হতো না। শ্রেয়ার মাও ভীষণ রোমান্টিক ধাঁচের মহিলা।
তিনি উল্টো নীলাভকে বলে দিতেন- ‘দেখ বাবা, এই মেয়ের বিচার তুই আমার কাছে দিস না। যেভাবে পারিস নিজে সামাল নিতে শিখ।’
শ্রেয়ার দৌড় এখানেই শেষ নয়। প্রায়ই নীলাভের ভোরে ঘুম ভেঙে যেত বুকে ভারি কিছু অনুভব করে।
চোখ মেলে দেখতে পেত শ্রেয়া বুকে মাথা রেখে খুব নীরবে, আপনে, যতনে শুয়ে আছে।
সে ধাক্কা দিয়ে তুলে বলতো- ‘এটা কী তোর স্বামীর বুক পেয়েছিস? তোর কী লজ্জা-শরম বলতে কিছু নেই? আমি কিন্তু ফুফুকে গিয়ে বলবো তোমার মেয়েকে বিয়ে দাও। সে যারতার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাচ্ছে।’
শ্রেয়া বিস্মিত হয়ে বলতো, ‘যারতার বুকে মাথা রেখেছি মানে? আমি কী এতো খারাপ মেয়ে নীলাভ ভাই?’
নীলাভ আরও চড়াও হয়ে বলতো, ‘তো যারতার বুক না? আমি কী তোর বিয়ে করা স্বামী?’
শ্রেয়ার তখন কেমন মুখের ভাষা ফুরিয়ে যেত। থুতনি বুকের সাথে লাগিয়ে বলতো, ‘টেবিলে এসো, মা নাস্তার জন্য ডেকেছেন।’
শ্রেয়া একদিন নীলাভের ডায়েরি পড়ে বুঝতে পারে এই ছেলেটা আসলে পাথর মানব না।
কিন্তু লেখাটা পড়ে শ্রেয়া ভীষণ অবাক হয়৷ এই লেখাটি সমস্ত মেয়েদেরকে নিয়ে লেখা না-কি? “মায়াবতী” না লিখে “মায়াবতীরা” কেন! এটার কারণ কী? এই লেখা কি আসলেই নীলাভের না-কি অন্য কোথাও থেকে লিখে রেখেছে।
শ্রেয়া আবার ডায়েরির লেখাটি মনযোগ দিয়ে পড়ল-
“একলার রাতে ভীষণ ইচ্ছে করে নষ্ট হতে।
ইচ্ছে করে জগতকে জটিল করা সমস্ত নিয়ম-কানুন ভেঙে অবাধ্য হতে।
চারপাশে চোখভরা মায়া নিয়ে এতো এতো মায়াবতীরা ঘুরে বেড়াবে অথচ নিজের লোভাতুর মনকে প্রতিনিয়ত শাসন করতে হবে এটা কোনো কাজের কথা নয় যে।
কী হয় যদি হঠাৎ একদিন কোনো মায়াবতীর সামনে লাল টুকটুকে একটি ফুল নিয়ে পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলি, ‘তোমার এলোকেশে নাক ডোবানোর অধিকার চাই।
আমার হাতের লাল টুকটুকে ফুলের পাপড়ির মতোন তোমার যে মাতাল করা দু’টি ঠোঁট আছে, সেখানে আমার প্রেমহীনতায় ফেটে যাওয়া শুকনো ঠোঁট ছুঁয়ে দেবার অধিকার চাই।
না না বড্ড বেশি হয়ে গেল, ঠোঁট থাক। তোমার কপালে পবিত্র গ্রন্থের মতোন চুমু খাবার অধিকার চাই।
জানেন? ভীষণ তাড়া পাচ্ছি ভেতর থেকে। বেলা যে কম হয়নি।
ফজর চলে গেল কবে, জোহর দরজার কড়া নাড়ছে।
আমার কী নষ্ট হবার ইচ্ছে করে না বল?
জগতে কেন এতো এতো মায়াবতী থাকতে প্রেমহীনতায় আমার হৃদয় মরুভূমির মতোন ফেটে যাবে?
আমার ভীষণ দুষ্টু হতে ইচ্ছে করে।
কোনো শাড়ী পরিহিত মানবী জানালার ওপাশের আকাশটা আনমনে দেখবে, আচমকা পেছন থেকে আমার দুষ্টু হাত তার পেট চেপে ধরে জড়িয়ে নেবে।
একলার রাতে আরও কতকিছু ইচ্ছে করে।
ইচ্ছে করে খুব যতনে, আপনে, নীরবে কোনো মানবীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বেঘোরে ঘুমোতে।”
শ্রেয়া ডায়েরিটা পড়ে দারুণ অবাক হয়। এই ছেলেটার মাথায় এতোকিছু নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অথচ তার সামনেই কেবল ইনোসেন্ট।
সেদিন শ্রেয়া বাইরে গিয়ে একটি খয়েরী রঙের শাড়ী আর লাল টুকটুকে ফুল নিয়ে হাজির।
নীলাভ যখন কলেজ থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে।
শ্রেয়া শাড়ী পরে ফুল হাতে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে পর্দা ফাঁক করে দেখে কানে হেডফোন গুঁজে নীলাভ মোবাইল টিপছে।
শ্রেয়া ধীরে ধীরে বিছানার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ডাকে, ‘নীলাভ ভাইয়া।’
নীলাভ হকচকিয়ে তাকায়। তার সামনে জগতের সবচেয়ে সুন্দর একটি দৃশ্য।
যুবতী একটা মেয়ে খয়েরি রঙের শাড়ী পরে তার সামনে লাল টুকটুকে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু নীলাভ ভাবলেশহীন হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?’
শ্রেয়া ফুলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– ‘আমার চোখে কী মায়া নেই? মাথায় কী এলোকেশ নেই? তুমি এই লাল ফুল নিয়ে আমার পথ আগলে যা ইচ্ছে হয় তার অধিকার চাও।’
নীলাভ সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলল এই মেয়েটা তার ডায়েরি পড়েছে।
মেজাজ খারাপ হলেও নিজেকে সামলে বলে, ‘লুকিয়ে কারও ডায়েরি পড়া ঠিক না। যাইহোক, এখন এসব পাগলামি ছেড়ে রুম থেকে গেলে খুশি হব।’
শ্রেয়া মন খারাপ করে রুম থেকে চলে যাবে তখন আবার ডাকে নীলাভ।
শ্রেয়া হাসি হাসি মুখে বলল-
– ‘কি?’
– ‘তুই একটু আগে কি বললি। তোর চোখে কি মায়া নাই। মাথায় কি এলোকেশ নাই। তার উত্তর হচ্ছে আসলেই নাই। বিন্দুমাত্র নাই। যা এবার।’
শ্রেয়ার মন খারাপ করে চলে গেল। নীলাভের এসবে কিছু যায় আসে না। কারণ তারও আজ মন খারাপ।
কোনোভাবেই মিনুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। ওর কাছের বান্ধবীরাও কিছু জানে না। তবে ওর বান্ধবীরা বলেছে কিছুদিন আগে সমকামীতায় ধরা পরে যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ইমাম না-কি মিনুর বাবা। সেদিন থেকে মিনুর কোনো অস্তিত্ব নেই। ঠিকানা নিয়ে ওর গ্রামের বাড়িতেও গিয়েছিল।
মিনুর বাবা গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছেন। প্রতিবন্ধী এক ভাই আর মা সহ মিনু হঠাৎ উধাও। গ্রামের কেউ-ই জানে না। শেষদিন যেদিন মিনুর সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়। তখন মিনু কেন জানি শ্রেয়ার নাম্বার চাইছিল৷ কিন্তু শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে এখনও মিনু ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি।
মিনুর গ্রাম থেকে এসে ভীষণ একাকীত্ব অনুভব করে নীলাভ। রাতে ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। আপন মনে সিগারেট টানে। তার চোখে কী ঝাপসা হয়ে আসা জল? থাকতে পারে। নীলাভের মাথায় এখন টুকরো টুকরো কত স্মৃতি উঁকি মারছে। কলেজে প্রথম ক্লাস। বোরকা পরা একটি অপরিচিত মেয়েকে দেখে সবাই বিস্মিত হয়। ভ্রমণে যাবার সময় ভাগ্যক্রমে মেয়েটির পাশের সীটে বসা। বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমানো৷ প্রথম চুমু আরও কত কি…! ভাবনায় ছেদ পড়ে কাঁধে কারও হাতের কোমল স্পর্শে।
অশ্রুভেজা ঝাপসা চোখে দেখতে পায় শ্রেয়া।
– ‘কী হয়েছে নীলাভ ভাই?’ এতো কোমল করে কথা বলে না চঞ্চল শ্রেয়া। আজ গলায় কেমন মমতা নিয়ে জিজ্ঞেস করছে।
নীলাভ নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে-
– ‘শ্রেয়া তুমি এসময়ে ছাদে কী করছো?’
শ্রেয়া আচমকা দু’হাত বাড়িয়ে নীলাভের মুখটা ধরে বলে-
– ‘নীলাভ ভাই তোমার কী হয়েছে আমাকে বল। কিছুদিন থেকে তোমাকে এমন লাগছে কেন? কী হয়েছে তোমার?’
নীলাভ লক্ষ্য করে শ্রেয়ার বয়স যেন এই মুহুূর্তে অনেক বেড়ে গেছে। সে কী বলবে ভেবে পায় না।
কেবল শ্রেয়ার হাতটা আলগোছে ছাড়িয়ে বলে- ‘কিছু হয় নি আমার। আমি ঠিক আছি।’
শ্রেয়া কিছুক্ষণ একমনে তাকিয়ে বলল- ‘আমি যাচ্ছি।’
নীলাভের আচমকা কী যে হল। হঠাৎ মুখ ফসকে বলল, ‘তুমি যেওনা শ্রেয়া, আমার ভীষণ একা লাগছে।’
শ্রেয়া তড়িৎ গতিতে ঘুরে তাকায়। নীলাভ ভাইয়া তাকে তুমি করে বলছে কেন? কার জন্য একাকীত্ব লাগছে?
শ্রেয়া জল টলমল চোখে বলে, ‘একাকীত্ব লাগবে কেন নীলাভ ভাই? আমি আছি না?’
নীলাভ আচমকা শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে শুরু করে। শ্রেয়ার পুরো শরীর কেঁপে উঠে। ভেতরকার সমস্ত অলিগলিতে একফালি শীতল বাতাস। শ্রেয়ার হঠাৎ মনে হল নীলাভ ভাই তার ভালোবাসাটা এতোদিনে বোধহয় বুঝেছেন।
ধরে আসা গলায় মাথায় হাত রেখে বলে, ‘আজ তোমার কী হয়েছে নীলাভ ভাই?’
– ‘শ্রেয়ারে আমার মিনু হারিয়ে গেছে। যাকে আমি ভালোবাসতাম। যাকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখতাম। সে আমাকে ছেড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ভীষণ একা লাগছে শ্রেয়া। আমি ভীষণ একা।’
শ্রেয়ার মাথায় আসমান ভেঙে পড়ে। খানিক আগে সূর্যের দেখা মিলেছিল। এখন আবার মেঘ এসে সূর্যটাকে ঢেকে দিল। ভেতর গুলিয়ে কান্না আসে। দু’জনের কান্না প্রিয়জন হারানোর।
শ্রেয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুমি একা নও নীলাভ ভাই। আমি আছি তো। চলো নীলাভ ভাই রুমে চলো।’
নীলাভকে হাত ধরে রুমে নিয়ে আসে শ্রেয়া। বিছানায় শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। খানিক পর আদুরে শিশুর মতন ঘুমিয়ে যায় নীলাভ। শ্রেয়া গভীর মমতায় চেয়ে থাকে৷ ঘন ভ্রু। অল্প অল্প দাড়ি উঁকি মারছে। ঘন কালো চুল। গায়ের রঙ শ্যামলা। লাল টুকটুকে একটা সেন্টু গেঞ্জি পরনে। শ্রেয়ার চোখ ফেটে কেন জানি জল আসে। চোখ যেন এক অবাধ্য নদী। যখন তখন ঢেউ উঠে। শ্রেয়া প্রথমে ঘুমন্ত নীলাভের মুখে গাঢ় মায়ায় হাত বুলিয়ে এনে ঠোঁট ছোঁয়াল।
——-চলবে— (সবাই কমেন্ট করবেন)
ঘাস ফড়িং ( ১ম পর্ব )
——লেখা: MD Jobrul islam
.