#ঘুণপোকা
#পর্ব_৬
বাহিরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার গ্লাসে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। একমনে সিগারেট ফুঁকছে সৈকত৷ জানালার গ্লাসে তাকিয়ে একটু একটু করে জমতে থাকা পানিগুলো দেখছে সে। ইমরান চেয়ার ছেড়ে উঠে সোফার অন্য অংশে বসলো। আসন ধরে বসে সৈকতকে জিজ্ঞেস করলো,
– উনাকে কি গিফট করেছিলেন?
– গোল্ড ব্রেসলেট।
– সেদিনই তো প্রথম আপনাদের দুজনের একসাথে ঘুরতে বের হওয়া তাই না?
– উহুম, দুজন না। চারজন।
– মানে?
– শুধু আমরা দুজন ঘুরতে বেড়িয়েছি এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। প্রতিবার ও পুরো ফ্যামিলি সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করতো। বিশেষ করে সাবিহাকে৷ ওকে ছাড়া রুপু বেড়াতে যেতেই চাইতো না৷ সাবিহা লজ্জা পেতো আমাদের দুজনের সাথে বেড়াতে যেতে। ও কখনোই আমাদের সাথে যেতে চাইতো না৷ সাবিহা ভাবতো ও আমাদের সঙ্গে গেলে আমাদের বিরক্ত করা হবে৷ ও চাইতো আমরা আলাদা একটু সময় কাটাই। মাঝেমধ্যে রুপু ওকে ধরে বেঁধে নিয়ে যেতে পারতো আবার কখনো পারতো না। সাবিহা দরজা আটকে নিজের ঘরে বসে থাকতো কিংবা পড়ার বাহানায় বান্ধবীর বাসায় চলে যেতো৷ আমার মা বাবাকেও সাথে করে নিয়ে যেতো কখনো কখনো।
– উনি কি সবাইকে সাথে নিয়ে থাকতে পছন্দ করে?
– হুম, খুব৷ ফ্যামিলিই ওর সব। বিশেষ করে সাবিহা। অজানা কারনবশত সাবিহার প্রতি ওর বিশেষ দুর্বলতা ছিলো একদম প্রথম দিন থেকেই৷ সাবিহাও রুপু বলতে বেহুশ। রুপু যদি বলে সাবিহা ডানে যাও তো যাবে, যদি বলে বামে যাও তো যাবে৷ আঠার মত লেগে থাকতো দুজন দুজনের সাথে৷ বিয়ের পর রুপু যতবার বাবার বাড়ি গিয়েছে একবারও সাবিহাকে রেখে যায়নি। প্রত্যেকবার ওকে সাথে করে নিয়ে যেতো। শুধু ওর বাবার বাড়ি কেন? ও যেখানে বেড়াতে যেতো সেখানে সাবিহাকে ধরে নিয়ে যেতো। এমনকি ফ্রেন্ডদের সাথে হ্যাংআউটে গেলেও সাবিহাকে রেখে যেতো না৷ একটা পর্যায়ে পরিস্থিতি এমন জায়গায় যেয়ে দাঁড়ালো যে রুপুর ফ্রেন্ডরা সাবিহার ফ্রেন্ড হয়ে গেলো।
– আপনার বোন আর ওয়াইফ কি সেইম এজ ছিলো?
– নাহ্। সাবিহা তিনবছরের ছোট ছিলো রুপুর চেয়ে।
– বয়সের পার্থক্য তো খুব বেশি না৷ এজন্যই হয়তো এত মিল ছিলো।
– উহুম। বয়সের পার্থক্য বেশি হলেও মিল থাকতো। বয়স বিবেচনা করে মেলামেশা করার মত মেয়ে রুপু না৷ যেকোনো বয়সী মানুষের সাথে দারুন ভাব জমাতে জানে মেয়েটা। আমার বোন থেকে শুরু করে আমার মা বাবা, আত্মীয় স্বজন, পাশের ফ্ল্যাটের আট বছরের নীলাদ্রি, উপরতলার ৭৫ বছরের জামান আংকেল সবার সাথে রুপুর দারুন ভাব ছিলো। আমার ঐ বিল্ডিংয়ের কার সাথে রুপুর ভাব ছিলো না সেটা জিজ্ঞেস করো! রুপুকে বিয়ে করার আগে ঐ বিল্ডিংয়ের কাউকে আমি ঠিকমত চিনতাম না, তারাও আমাকে চিনতো না৷ বিয়ের পর থেকে সবাই আমাকে চিনে। আমিও সবাইকে চিনি। রুপু আমাদের পরিচয় করিয়েছে৷ এরপর থেকে যখনই রুপু বাপের বাড়ি যেতো বেড়াতে তখনই আমি সিড়ি দিয়ে উঠানামার সময় লোকজন জিজ্ঞেস করতো,
রুপন্তি কোথায়? ওকে আজকাল দেখি না যে!
আমার কি মনে হতো জানো?
– কি?
– সেইদিন আর খুব বেশি দূরে না যেদিন পুরো পাড়াসুদ্ধ লোকের সাথে ও ভাব জমিয়ে আমাকে পরিচয় করাবে। এরপর মহল্লার লোকজন আমাকে চিনবে মহল্লার সেরা আড্ডাবাজ মেয়ের হাজবেন্ড হিসেবে।
– আপনার বাবা মায়ের সাথেও সম্পর্ক খুব ভালো তাই না?
– ভালো মানে! বলো যে দুর্দান্ত সম্পর্ক। শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে কোনো মেয়ের এমন সম্পর্ক থাকা একটা বিরল ব্যাপার৷ রুপু সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্মের পাগলা ভক্ত। আমার মা বাবা সাবিহা এই তিনজনকে নিয়ে সে মুভি দেখতো৷ কখনো কখনো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে বাবার গায়ে হেলে পড়তো। আবার কখনো কাঁদতে কাঁদতে মায়ের আঁচল দিয়ে চোখ মুছতো। সবচেয়ে শকিং ব্যাপার কি ছিলো জানো? ও ঐসব মুভির গানে সাবিহাকে নিয়ে নাচানাচি করতো আর বাবা মা আরেকঘর থেকে বসে ওদের দেখতো৷ বিয়ের দুইমাসের দিকে এক রাতে আমি দেখতে পেলাম আমার মা ওদের সাথে হেলেদুলে নেচে যাচ্ছে আর বাবা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের তিনজনকে দেখছে।
– ইন্টারেস্টিং!
– আরও গল্প আছে ওদের। বৃষ্টি নামলেই ওরা চারজন ছাদে চলে যেতো ভিজতে৷ প্রায়ই সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম বাসায় কেউ নেই। ওরা চারজন দলবেঁধে চলে গেছে বাহিরে নাস্তা করতে। ওরা নাস্তা করে ফিরে আসার সময় আমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসতো। প্রায় রাতেই ওদের গল্পের আসর বসতো। রাত দুইটা তিনটা পর্যন্ত চলতো ওদের গল্প। কয়দিন পরপরই মা, রুপু, সাবিহা মায়ের শাড়ী গহনা পড়ে অহেতুক সাজগোজ করতো। বাবা আবার খুব আনন্দ নিয়ে ছবি তুলে দিতো। রুপু আসার পর আমার বাসার চেহারা পুরোপুরি বদলে গেলো। যেই বাসায় আগে সারাদিনেও কারো কন্ঠস্বর খুঁজে পাওয়া যেতো না, সেই বাসায় সারাক্ষণ কথার শব্দে মুখর থাকতো। রুপন্তি খুব কথাপ্রিয় মানুষ৷ যাকেই পাবে তার সাথে ননস্টপ কথা বলতেই থাকবে। কতশত কথা যে বলতে জানে মেয়েটা! ওর ছোটবেলার গল্প, ওর স্কুল কলেজের গল্প, ওর বান্ধবী, বাপ-ভাই, মামা, চাচা চৌদ্দগুষ্ঠির গল্প শোনাতো। আমার ঘরের লোকজন খুব মন দিয়ে ওর গল্পগুলো শুনতোও। কখনো তাদেরকে আমি বিরক্ত হতে দেখিনি। হঠাৎ আমার মনে হচ্ছিল রুপুর মত আমার ঘরের লোকগুলোও কথা বেশি বলা শুরু করেছে। আমার ফ্যামিলির খুব সুন্দর সময় কাটছিলো রুপুকে নিয়ে৷ এক কথায়,বলতে পারো মন ভালো করা একটা পুতুল পেয়েছিলো আমার বাসার লোকজন৷ বাসায় গেস্ট আসলেই আমার মা বাবা বসে যেতো রুপুর প্রশংসার ঝুলি নিয়ে। আমার আত্মীয় স্বজনের মাঝে বেশ ভালোই সাড়া পড়লো রুপুকে নিয়ে৷ আমার আত্মীয়দের মধ্যে যে-ই রুপুকে সামনাসামনি দেখতো সে-ই রুপুর বিশাল ভক্ত হয়ে যেতো।
– আর আপনি? আপনার সাথে কেমন সম্পর্ক ছিলো?
মুখ বাকিয়ে হাসলো সৈকত। এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে আয়েশ করে বসে বললো,
– রুপুর সাথে একদম শুরুর দিন থেকেই আমার মনের মিল হয়নি। রুপু আর আমি হলাম দুই মেরুর মানুষ। ওর সাথে আমার কিছুই মিলতো না। আমি কথা কম বলা পছন্দ করতাম আর ও কথা বলতে। আমাকে পেলেই হলো! সে তার কথার ঝুলি খুলে বসে যেত। এমন মানুষকে নিয়েও গল্প করতো যাকে আমি চিনি না এবং ভবিষ্যতে তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তবুও আমি শুনতাম। শুনতাম বললে ভুল হবে। আমাকে সেসব গল্প শুনতে হতো। রুপু জোর করে শোনাতো। ওকে আমি সরাসরি অনেক কথা বলতে পারতাম না যেহেতু নতুন বিয়ে হয়েছে। ওকে বিভিন্নভাবে বুঝাতাম যে আমি ওর এত এত গল্প শুনতে মোটেই ইন্টারেস্টেড না। ও সেসবে পাত্তাই দিতো না৷ নিজের মত গল্প বলতেই থাকতো৷ আমি কি করছি, কোথায় যাচ্ছি, বাসায় কতক্ষন নাগাদ ফিরবো সর্বক্ষন এসব জানতে চাওয়া আমার কাছে খুবই বিরক্ত লাগতো। মনে হতো কেউ বুঝি আমার স্বাধীনতা নিয়ে টানাটানি করছে। কখনোই কেউ আমাকে এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতো না। নবনী কিংবা আমার বাসার লোকজন কেউই না। সবাই জানতো বারবার আমাকে এসব জিজ্ঞেস করলে আমি খুব রেগে যাই।
– ভাবী কি এই কাজটা করতো?
– হ্যাঁ। বিয়ের পরদিন থেকেই ও আমাকে ঘড়ি ধরে একঘন্টা পর পর কল করতো। কি করছি, কোথায় আছি, বাসায় ফিরবো কখন এই তিনটা প্রশ্নই করতে থাকতো৷ প্রথম কয়েকদিন সহ্য করেছি। সাত আটদিন যাওয়ার পর আর পারছিলাম না৷ তখন বাধ্য হয়েই বললাম, আমাকে বারবার কল করলে আমি বিরক্ত হই। কাজে ডিস্টার্ব হয় আমার৷ বারবার কল না করলে খুশি হবো৷ দিনে এক দু’বার কথা বললেই তো যথেষ্ট তাই না?
ও খুব অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তারপর বললো,
– কেন? বিরক্ত কেন হবা?
– কাজে ডিস্টার্ব হয়। তাছাড়া আমি কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি এসব বারবার জিজ্ঞেস করা আমার খুব অপছন্দ।
– কেন? অপছন্দ কেন হবে?
– অপছন্দ কেন হবে এটার উত্তর তো আমি দিতে পারবো না৷ পছন্দ অপছন্দের তো নির্দিষ্ট কারণ থাকে না৷ ভালো লাগে না, ব্যস লাগে না।
– তোমার ভালো না লাগলে তো আমি কি করবো? আমি কল করবোই। আমি খোঁজ নিবোই। আমি তোমার একমাত্র বউ৷ আমি তোমার খোঁজ না নিলে কে নিবে?
– খুব অধিকার খাটাতো তাই না?
– প্রচুর। আমি অফিস থেকে বের হয়ে প্রায়ই বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যেতাম। রুপুর সেটা একদম সহ্য হতো না। একমাত্র শুক্রবার ছাড়া বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেলে রুপু খুব বিরক্ত করতো। সাড়ে আটটার মধ্যে বাসায় না ফিরলে ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিতো৷ বলতো, সারাদিন তো বাইরে থাকো৷ রাতে একটু তোমার সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পাই সেটাও হতে দাও না। চলে যাও বন্ধুদের সাথে গল্প করতে।
– আপনি উনার বাঁধা মেনেছেন বলে তো মনে হয় না।
– আরে নাহ্। পাগল তুমি! আমাকে আটকানোর ক্ষমতা কারোই ছিলো না৷ রুপুরও না। আমি যেতামই ওদের সাথে দেখা করতে। আর বাসায় ফেরার পর শুরু হতো ওর ঘ্যানঘ্যান।
– অভিযোগ করবে না এমন মেয়ে চেয়েছিলেন। আশা সব মাটিতে মিশে গেলো সেই কষ্টেই তো বোধ হয় শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন।
– শুধু কি এতটুকুই! আরো কত কি সমস্যা! আমি বাহির থেকে ঘরে আসলে সবার আগে গোসল করি। এর আগে বিছানায় বসিও না। আর নয়তো আমার ভীষন অস্বস্তি হয়। আর রুপু কি করতো! প্রায়ই আমি বাসায় ফিরলেই আমার পিছন পিছন ঘরে আসতো। অফিসের কাপড় অবস্থাতেই আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আটকে রাখতো। ফ্রেশ হতে যেতে দিতো না। অফিসের কাজ করছি কিংবা বন্ধুদের সাথে কনফারেন্স কলে কথা বলছি এমন সময় এসে বিড়ালের মত জড়োসড়ো হয়ে কোলে উঠে বসে যেতো। অকারণে তখন এসে ঠোঁটে চুমু দিতো৷ ওর যন্ত্রণায় শান্তিমত ফোনে কথা বলতে পারতাম না। সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ না করেই আমার চোখে মুখে এলোপাতাড়ি চুমু দিতো। কি যে নোংরা মনে হতো ওকে! কখনো কখনো জোর করে আমার সাথে বাথরুমে ঢুকে যেতো। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে বলতো,
– এ্যাই সিকু, একটু শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আমাকে নেচে দেখাও তো।
হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠলো ইমরান। বললো,
– নেচে দেখাতেন?
– রুপু একটা পাগল। পাগলের কথায় পাগলামি করবো নাকি! ও দাঁড়িয়েই থাকতো৷ ওকে কোনোমতেই বের করতে পারতাম না৷ ধমকে কাজ হতো না৷ ধমক খেয়েও নির্লজ্জের মত হাসতো আর বলতো,
– আহ্ একটু নাচোই না৷ মাঝেমধ্যে আমারও তো একটু বিনোদনের দরকার হয়৷ হাজবেন্ড হিসেবে আমাকে বিনোদন দেয়া তোমার দায়িত্ব।
ও এসব হাবিজাবি বলতেই থাকতো৷ আর আমি বাধ্য হয়ে ওর সামনেই গোসল করতাম। রাতে ঘুমাতেও পারতাম না ঠিকমত। লম্বা লম্বা হাত পা এনে গায়ের উপর তুলে দিতো। ওকে সরাতে চাইলে আরো শক্ত করে ধরে রাখতো। বলতো, সিকু একদম বিরক্ত করবা না৷ আমাকে ঘুমাতে দাও। উনি আরাম করে আমার গায়ে হাত পা তুলে ঘুমাতো আর আমার ঘুমের ডিস্টার্ব করতো।
– আপনার ঘুম কেন ডিস্টার্ব হবে?
– ঘুমের সময় আমি একটু স্পেস নিয়ে ঘুমাতে পছন্দ করি। ঘুমের সময় গায়ের উপর হাত পা রাখা আমার খুবই অপছন্দ। আমার ঘুম হয় না।
– ভাইয়া, আপনার এত সমস্যা কেন আমাকে একটু বলবেন? ভাবী যা কিছু করতো সেগুলো কিন্তু সব ছেলেরাই তার ওয়াইফের কাছে এক্সপেক্ট করে। আর আপনি বিরক্ত কেন হতেন সেটাই তো বুঝলাম না।
(চলবে)
#মিম