চন্দ্রাণী(০১) রাজিয়া রহমান

0
835

১.
ইউপি নির্বাচনের প্রচারণা চলছে সীমান্তবর্তী কুসুমপুর গ্রামে।জায়গায় জায়গায় নির্বাচনের বিভিন্ন পোস্টার। গ্রামের ৩ বারের চেয়ারম্যান শাহজাহান তালুকদারের কাচারি ঘরে ভীড় ভীষণ। দলে দলে লোকজন আসছে আর যাচ্ছে। বাবুল দাশ দফায় দফায় চা বানাচ্ছে। তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে বিরক্তি। নির্বাচন এখনো প্রায় এক মাসের বেশি দেরি।কুসুমপুরে নির্বাচন এলেই কেমন উৎসব উৎসব ভাব হয়।

কাচারি ঘরের বাহিরে বড় পুকুর ঘাটে বসে আছে শুভ্র।শাহজাহান তালুকদারের দুই মেয়ে এক ছেলে।
বড় মেয়ে চন্দ্রাণী তারপর শর্মী আর সবার ছোট শুভ্র।

শুভ্র একটা বড়শী নিয়ে বসে আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত সে।
তার মনযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে শর্মী দৌড়ে এলো। এসেই শুভ্রর হাত ধরে টেনে নিতে লাগলো বাড়ির দিকে।কাচারি ঘরের অনতিদূরে চেয়ারম্যানের ঘর।
শুভ্র দুই এক বার আপার হাত ছাড়িয়ে ছুটে বের হয়ে যেতে চাইলো কিন্তু আপার শক্ত করে ধরে রাখা বন্ধন ছেড়ে বের হতে পারলো না অথবা কে জানে হয়তো ইচ্ছে করেই বের হলো না।

শর্মী শুভ্রকে চেয়ারে বসিয়ে একটা ষ্টীলের থালায় করে এক থালা ভাত নিয়ে এলো তারপর ভাইকে লোকমা ধরে ভাত খাইয়ে দিলো।

শুভ্র গোঁগোঁ করতে করতে ভাত খেলো।শর্মীর দুই চোখে জল।তার শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ভাইটাকে কে দেখবে শেষ কালে?বোনেরা তো বাবার ঘরে অস্থায়ী মেহমান। কোনো মেয়ে কি এরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করে থাকতে চাইবে?
তা না হলে বাবা মা মারা গেলে ওর কি হবে!

রেহানা রান্নাঘরে বড় ডেকচিতে মাংস কষাচ্ছে।আরেক চুলায় মুগডাল ভাজছে। মুগডালে ভাজা গন্ধে শুভ্র উসখুস করতে লাগলো। শর্মী ভাইকে শান্ত হতে ইশারা করে পাশে ঢেকে রাখা বাটিতে দেখালো ওর জন্য ভাজা মুগডাল রাখা আছে।

রেহানা হাঁক দিয়ে বললেন,”শর্মী তোর হলো?ভাইকে খাওয়াতে দিনের অর্ধেক কাটিয়ে দিলে বাকি কাজ করবি কখন?আমার কি দশ হাত নাকি?
কয়দিক সামলাবো আমি!
আল্লাহ আমার কপালে এসব ঝামেলা লিখে দিছে।”

শর্মী দ্রুত গেলার জন্য ইশারা করলো শুভ্রকে। শুভ্র মজা পেয়ে হাসতে লাগলো। শর্মী মুগ্ধ হয়ে ভাইয়ের হাসি দেখতে লাগলো। আহারে!
কেমন চাঁদের মতন মুখ, আল্লাহ কত রূপ দিয়ে বানিয়েছে। অথচ তার ও খুঁত দিয়ে দিয়েছে। শুভ্রর যেদিন জন্ম হলো, উথাল-পাতাল জোছনা ছিলো সেই রাতে।সবাই বলাবলি করতে লাগলো চেয়ারম্যানের ঘরে আল্লাহ চান্দের টুকরো দিছে।

শুভ্র পেটে হাত দিয়ে দেখালো পেট ভরে গেছে আর খাবে না।

শর্মী আর জোর করলো না।।ইদানীং তার নিজের ও খেতে ইচ্ছে করে না,কেমন বমি পায় খেতে গেলে। গপাগপ চোখ বন্ধ করে নিজে বাকি দুই লোকমা খেয়ে ছুটলো রান্নাঘরে।এর বেশি খেলে বমি করে দিবে জানে শর্মী। ছুটতে ছুটতে টের পেলো অন্তর্বাসের ভেতর লুকিয়ে রাখা ছোট বাটন ফোনটা দুই বার ভাইব্রেট করেছে।

মেসেজ এসেছে বোধহয়। এখন চেক করার সময় নেই, দেরি হলে রেহানা মেয়ের পিঠে হাতা ভাঙবে।

বারান্দায় বসে সুপারি কাটতে কাটতে সেতারা বানু বললেন, “আস্তে দৌড়া রে ছেরি,সোমত্ত মাইয়া এমনে ছুটতে নাই।লোকজন দেখলে খারাপ কইবো।”

শর্মী কিছু বললো না, দাদীর সাথে কথা বলার সময় নাই তার।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখে রেহানা হাত পুড়িয়ে বসে আছে। শর্মী মা’কে সরিয়ে দিয়ে পিড়িতে বসে।রেহানা বসে বসে শাপ শাপান্ত করতে থাকে মনার মা’কে। আজ দুই দিন মনার মা কাজে আসে না।
পাশে বসে পাটায় শুকনো মরিচ বাটতে বাটতে জমিলা বললো, “এরপরেও তো আপনে ওরে বেশি পছন্দ করেন।যাওনের কালে এটা ওইটা দিয়া দ্যান।”

রেহানা মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, “তুই চুপ থাক।আমি ভালো কইরা বুঝি কার কোনটা দরকার। তোর বুড়া বাপের লাইগা যে মাসে মাসে পনেরশ টাকা পাঠাই তোর বেতনের বাহিরে,তখন কেউ কিছু কয়?নিজেরটা নিয়া খুশি থাক।মনার মা’র স্বামী নাই,ঘরে তিনটা পোলাপান। মা বাড়িত গেলে সব পোলাপানই ছুইট্টা আসে দেখতে মা কি নিয়া আসছে।সেখানে যদি কিছু না দেখে পোলাপানের মন খারাপ হয়।সারাদিন মা’রে না দেখনের কষ্ট পোলাপান ভুইলা যায় মায়ের কাছে খাওন দেখলে।”

জমিলা কথা বাড়ায় না।ভাবী মিছা কথা কয় নাই।জমিলার মা যখন লোকের বাড়ি কাজ করতো, তখন জমিলারা দুই বোন ও এমন করে অপেক্ষা করতো।বেশির ভাগ দিনেই মা এক থালা ভাত নিয়ে ফিরতো।এক থালা ভাত চারজন মানুষ ভাগ করে খেতো।
চোখের সামনে সেসব ভাসতে থাকে জমিলার।দুই চোখ ভিজে উঠে।

শর্মী তাড়া দিয়ে বলে,”খালা,তাড়াতাড়ি করেন।মাছ ভাজতে হইবো আপনার। ”

রেহানা হাতে ফুঁ দিচ্ছে। শুভ্র মা’য়ের হাতে ফুঁ দেওয়া দেখে কি মনে করে বার্না মলমটা নিয়ে এলো।

বারান্দা থেকে দেখে সেতারা বানু বললেন, “বোবা,হাবা হইলে কি হইবো, মায়ের কষ্ট ঠিকই বুঝে। ”

শর্মী তেঁতে উঠলো ভাইয়ের নামে এরকম শব্দ ব্যবহার করতে শুনে। দুই বোনের চোখের মনি এই ভাই।দুজনের কেউ-ই ভাইকে কেউ মন্দ কথা বললে সহ্য করতে পারে না।

রেহানা ইশারা করে শর্মীকে চুপ থাকতে বলে শাশুড়ির উদ্দেশ্য বললেন, “জগতের নিয়ম এইডাই আম্মা।এই যে আপনের পোলা এতো ব্যস্ত মানুষ হইয়াও ঘরে আইসা আগে আপনের ঘরে যায়,আপনের কি লাগবো না লাগবো শুনে বাবুল রে দিয়া সব আনাইয়া রাখে অথচ দেখা যায় ঘরে মাছ নাই অথবা তেল নাই।কিন্তু সেসব আনানোর কথা ভুলে যায়।”

সেতারা বানু বিরক্ত হন।এই বউটা মুখে মুখে সবসময় চোপা করে। মুখ ঝামটা মেরে বলেন,”এইরকম চোপা করবা না,মাইয়ারা তোমার থাইকা এগুলাই শিখবো।পরে বিয়ার পর আর ওরা স্বামীর ঘর করতে পারবো না চোপার জন্য। বেবাক মানুষ তো আমার মতো না মাইন্না নিবো।আমার পোলা যেটুকু করে ওই টুকুই। তুমি তো পানিও দাও না।”

রেহানা হাতে ভালো করে মলম দিয়ে বললো, “আমি তো পানি দিই না,আরো তো তিনজন আছে আপনার পুত্রবধূ। তারা তো সবাই আপনার খেদমত করতে উদগ্রীব হয়ে থাকে।তাগো ঘরে যান।তা তো যান না।”

সেতারা বানু মুখে লাগাম দেয়।এখন কথা বাড়ানোর সময় না।সবাই কে তার চেনা আছে।রেহানার মুখে বিষ হইলেও মনে কিছু নাই।বরং তার জন্য অনেক মায়া।অন্যরা মুখে মিষ্টি কথা কয় কামের বেলা কেউ না।সব কয়টা হাড়ে মাংসে বজ্জাত।পোলাগুলা ও তেমন ভিজা বিড়াল।মিনমিন করে বউ গো সামনে। মায়ের জন্য যে কিছু করবে সেই মুরোদ নাই।

শর্মীর ফোন আবারও ভাইব্রেট করে। গরম তেলে কাতলা মাছের টুকরো ছাড়তে ছাড়তে শর্মী টের পায় কল এসেছে এবার।এদিকে উঠে যাবার ও সুযোগ নাই।মাছ ভাজার গন্ধ পেয়ে শুভ্র রান্নাঘরের খুঁটির সাথে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।

শর্মী মাছ উল্টাতে উল্টাতে ভাবে আজকে খুব রাগ হবে নিয়াজ।সকাল থেকে কোনো কথা বলতে পারে নি, একটা মেসেজ ও দেয় নি।বাবু নিশ্চয় রেগে বোম হয়ে থাকবে।

রেহানা মেয়েকে সাবধান করে বললো, “দেইখা মাছ ছাড়,হাত পুড়বি গরম তেলে আবার আমার মতো। এই সংসারে আইসা শুধু জইলা পুইড়া মরলাম।কারো কাছে দাম পাইলাম না।”

শর্মী মুচকি হাসতে থাকে যেদিন আব্বার সাথে যেদিন মনোমালিন্য হয় মা এরকম কথ বলা শুরু করে।

শর্মী একটা বাটিতে বড় সাইজের এক টুকরো মাছ তুলে দিয়ে শুভ্রর হাতে দেয়।শুভ্রর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে যায় মাছ দেখে।গরম মাছে হাত দিয়ে গোঁগোঁ করে উঠে। দুই চোখ ভিজে উঠে নিমিষেই।
তাড়াতাড়ি ঠান্ডা পানির বালতি এগিয়ে দেয় শর্মী।

রেহানা চুপ করে দেখে।এই অবুঝ ছেলেটাকে নিয়ে তার দিনরাত চিন্তা।কিছুই বুঝে না এই ছেলেটা।

শর্মীর ফোন আবারও ভাইব্রেট হচ্ছে। জমিলা এখনো মরিচ বাটছে।শর্মী তাড়া দিয়ে বললো, “খালা তাড়াতাড়ি করেন।আমার হাতে এখনো কত কাম।আপনি মাছ ভাজতেন তাও আমি ভাজতাছি।ঘর ও গুছাইতে হইবো আমার। ”
রেহানা উঠে বললো, “আমি যাই ঘর গুছিয়ে রাখি।”
রেহানা উঠে যেতে শর্মী বাথরুমের নাম করে উঠে যায়।তারপর ফোন বের করে নিয়াজকে কল দেয়।

একরাশ বিরক্তি নিয়ে নিয়াজ কল রিসিভ করে বলে, “এতক্ষণ পর সময় হইছে তোমার? নির্বাচন করবে তোমার বাপ।কিন্তু ব্যস্ততা তোমার। মনে হয় এবার তুমি দাঁড়াইবা।”

শর্মী ফিসফিস করে বললো, “আজকে উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র,উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ওসি ওনারা সবাই দুপুরে আমাগো বাড়িতে খাইবো।এরজন্য একটু ব্যস্ত কাজকর্ম নিয়ে। ”

নিয়াজ হেসে বললো, “শালারা আস্ত হারাম**।আমার বাপের থাইকা ও খায়,তোমার বাপের থাইকা ও খায়।তবে এবার তোমার বাপ জিতবো না। আমার বাপেই জিতবো।”

শর্মী হেসে বললো, “আকাশে চাঁদ উঠলে যেমন সবাই দেখবো, ভোট হইলেও সবাই দেখবো কে জিতে।রাখি এখন।”

নিয়াজ বললো, “রাইতে আসমু কিন্তু। ”

লজ্জায় শর্মী লাল হয়ে কল কেটে দেয়।তারপর বের হয়ে যায় বাথরুম থেকে।

মেহমান আসতে আসতে বিকেল হয়ে যায়। সবাই পেটভরে খেয়ে রান্নার ভীষণ তারিফ করে। রেহানার বুক গর্বে ভরে যায়।তার দুই মেয়েই রান্নাবান্না করতে পছন্দ করে। আর দুজনের রান্নার হাতই ভালো।

বাবুল দাশ রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে খেতে খেতে বললো,”বৌদি, তোমার মেয়ের রান্দন একেবারে দ্রৌপদীর মতন। এমনে এমনে কি আমি মা কই!”

রেহানা ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে বলেন, “আপনেরে কইছি না আমারে এসব হিন্দুয়ানী নামে ডাকবেন না।ভাবী কইবেন নাইলে আপা কইবেন।আর এমনে বাড়ির ভিতরে আইতে নিষেধ করছি না।”

বাবুল দাশ সরল হেসে বললো, “বৌদি, আমি এতো বছর এই বাড়িতে কাম করি আইজ পর্যন্ত আপনের দিকে তাকাই নাই।আপনে যে আমার লগে দেখা দিবেন না ওইটা আমার মাথায় আছে।আমি তো শুধু আমার মা জননীগো দেখতে আসি।”

শর্মী বাবুল দাশের প্লেটে আরেক পিস খাসির মাংস দিয়ে বললো, “কাকু আরাম কইরা খান।এই বাটিতে রসগোল্লা রাখা আছে,খাইবেন কিন্তু।”

বাবুল দাশে চোখে পানি চলে এলো। এই বাড়ির মেয়ে দুইটা এতো বেশি ভালো!

রাতে রেহানা নিজের রুমে শুয়ে ছিলো। শুভ্র ঘুমিয়ে গেছে সন্ধ্যার দিকে। শর্মী অপেক্ষা করছে নিজের রুমে নিয়াজের জন্য।
নিয়াজের বাবা কাদের খাঁন আর শাহজাহান তালুকদার দুজনেই প্রতিদ্বন্দ্বী। টানা তিন বার কাদের খাঁন শাহজাহান তালুকদারের প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে,তিনবারেই হেরেছে। এবার চতুর্থ বার ও নির্বাচন করবে।

শর্মী জানে না এর ভবিষ্যৎ কি!
একে অন্যের ছায়া মাড়ায় না ওনারা।অথচ শর্মী কি-না ওকেই ভালোবাসলো।
যদিও শর্মী জানতো না নিয়াজ কার ছেলে।নিয়াজ ও হয়তো জানতো না।
অথচ ভাগ্য তাদের মিলিয়ে দিতে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে।

চলবে…….

#চন্দ্রাণী(০১)
রাজিয়া রহমান

সবার রেসপন্স চাই। যার সামনে পোস্ট যাবে কাইন্ডলি একটা কমেন্ট করবেন।

জয়েন করুন আমার গ্রুপ রাজিয়ার গল্প কুটির এ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here