#চারুলতা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৭
বাতাসটা গায়ে লাগতেই অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনার সম্মুখীন হলাম। আমার পেটটা পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে গেল। আমি কিছুটা ভয়ার্ত হয়ে গেলাম। পেটের এমন অস্বাভাবিক ফুলে যাওয়ার কারণটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। ভয়ের মাত্রা প্রখর হওয়ার আগেই মৃধা বলে উঠল
– ঘাবড়ে যেও না। তোমার গর্ভে সন্তান প্রবেশ করেছে। ঠিক ১৭ দিন পর রাহু যখন সূর্যকে গ্রাস করবে তখন এ সন্তান জন্ম নিবে। তবে সময়ের ব্যবধান নিয়েই আমি চিন্তিত। এ সন্তান যেন শুভ শক্তির আধার হয়েই জন্ম নেয় সে চাওয়ায় মনে ব্যক্ত করছি।
ঘটনার কোনো সার সংক্ষেপ আমার বোধগম্য হচ্ছে না। বাড়ির ভেতটায় প্রবেশ করার পর আরও বেশি ভয় পেয়ে গেলাম যখন লক্ষ্য করলাম মামা আমাদের সামনে দাঁড়ানো। মামার চোখ গুলো রাগে আগুন হয়ে আছে। রক্ত চক্ষু গুলো আমার দিকেই তাক করা। আমার পাশে এসেই চুলের মুঠিগুলো ধরল। মৃধা ততক্ষণে উধাও হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছি না আমার সাথে হচ্ছে টা কী! মামা আমার চুলগুলো টেনে সামনের দিকে আঁচড়ে ফেলে বলল
– তুই আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালাতে চেয়েছিলি না? কত বড় বোকা মেয়ে তুই। তোর কী ধারণা তুই পালিয়ে গেলে আমি টের পাব না? কেমন লাগল আমার গোলক ধাঁধা টা? তুই তো বাড়ির বাইরেই যেতে পারিসনি। আমার সাজানো গোলক ধাঁধায় শুধু দৌড়ে দৌড়ে হাঁপিয়েছিস। এই এরিকের চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সহজ বিষয় না। আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া যদি এতই সহজ হত তাহলে এত শক্তির অধিকারী আমি হতাম না।
মামার কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তার মানে আমি আমার বাড়ির বাইরেই যেতে পারিনি। এতক্ষণ যা ঘটেছে সব অবাস্তব আর মায়াবল। আমার মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে। এ কোন পরীক্ষায় পড়লাম সেটাই চিন্তা করে যাচ্ছি শুয়ে শুয়ে। মামা আমার হাতটা ধরে টেনে তুলে ছেছড়াতে ছেছড়াতে নিয়ে গেল অন্য একটা কক্ষে। সে কক্ষে নিয়ে গিয়ে আমাকে ধরে জোরে আচড়ে ফেলে কক্ষটা বন্ধ করে দিল। ফুলা পেটটা যেন এমন আঘাতে নড়ে উঠল। সবকিছু মায়াবল থাকলেও পেটটা কীভাবে ফুলল বুঝতেছি না। আর মৃধা সেও কী মায়ার তৈরী কেউ ছিল। শরীরটা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে লাগল। এ নরক যন্ত্রণা থেকে কী মুক্তি পাব না? বারবার এ কথায় মনে আসছে। ভীষণভাবে অসহায়ত্ব আমাকে গ্রাস করছে।
অন্ধকার কক্ষে বুঝা যাচ্ছে না এখন দিন নাকি রাত। বাইরে থেকে আলোর সমাগম এ কক্ষে নেই। মাঝে সাঝে শিয়ালের ডাক কানে আসছে আবার কখনও কখনও কুকুরের কান্না। বাচ্চার কান্নাও কখনও কখনও মৃদু হয়ে প্রখর হচ্ছে আবার কখনও কখনও প্রখর হয়ে মৃদু হচ্ছে। ভয়ে গায়ের কাটা লোম দিয়ে দিচ্ছে। আগের ঘটনা গুলো নিয়ে যতই ভাববো ততই ঘটনার আবর্তমানে তলিয়ে পড়ব। কোনো পথেই খুৃঁজে পাব না। সাজানো এ মায়ার শহরে আমি কেবল নিছক একটা কীট। যাকে কিছুক্ষণ পর তার নিজের মামায় ভোগ করবে তারপর বলি দিয়ে দিবে শয়তানের নামে। তবে পেটটা কেন ফুলে আছে। মৃধা কী সত্যিই কোনো সাপ ছিল নাকি মামার মায়ার শহরের এক কাঙ্গালিনি ছিল। মৃধার কথাগুলো কী সঠিক ছিল নাকি সব ভুয়া মিথ্যা ছিল। আমার পেটে কী সত্যিই কোনো শুভ শক্তির আধার লুকিয়ে আছে নাকি এ বাচ্চাটাও মামার স্বার্থ হাসিলের কোনো অধ্যায়। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধায় পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। ঠোঁট দুটো ফেটে চৌচির হয়ে আছে। ঠোঁট নাড়ালেই যেন ব্যথা হচ্ছে। জিভে একদম পানি নেই যে জিব দিয়ে চেটে ঠোঁট ভেজাবো।
দম গুলো ভারী হচ্ছে কেবল। নিজেকে সামলে উঠতে পারছি না একদম। চারদিক একদম নিস্তব। পেটের ভেতর নড়াচড়া অনুভব করতেছি। পেট থেকে কেমন অদ্ভুত আওয়াজ আসছে কানে। হালকা ব্যথাও অনুভব করছি পেটে। মনে হচ্ছে কিছু একটা পেট থেকে বের হবে এখন। পেট ফুলে যাচ্ছে শুধু। আমার ভয় যেন আরও বাড়তে লাগল।পেটের ব্যথা সর্বোচ্চ সীমায় চলে যাচ্ছে ক্রমশেই। নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। ব্যথায় কুকরাতে লাগলাম। চোখ গুলো বন্ধও করতে পারছিলাম না কারণ পেটের ফুলা এখনও কমছে না। তাহলে কী পেট ফেটে বাচ্চা বের হবে। আর মৃধার কথা কী সঠিক? সত্যিই আমার গর্ভে কী কোনো শুভ শক্তি আছে নাকি রয়েছে কোনো অশুভ বাচ্চা। উত্তর মেলাতে গেলে আরও বেশি ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছি। প্রশ্ন যেন মাথাটাকে ব্যথা বানিয়ে দিচ্ছে। নিজেকে সামলাতে পারছি না পেটের ব্যথায়। শরীরে একদম শক্তি নেই তাই ব্যথায় চিল্লানোর শক্তিও পাচ্ছি না।
পেটটা মাত্রা অতিরিক্ত ফুলে গেছে। পেটের এক পাশ ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। রক্তটা ফিনকি দিয়ে বের হয়ে জোরে ছিটকে পড়ছে। পেটে ব্যথার সাথে অসম্ভব জ্বলুনী হচ্ছে এবার। দেখতে দেখতেই পেটটা ফেটে মাটির মতো চৌচির হয়ে গেল। ফুলা পেটটা ফেটে দু দিক দিয়ে ভাগ হয়ে গেল। সে ভাগ করা অংশ দিয়ে বের হলো এক কদাকার শিশু। শিশুটি পেট থেকে লাফিয়ে বের হলো। শিশুটার নাক নেই। নাকের জায়গাটা সমতল। কালো কুচকুচে গায়ের রঙ। চোখগুলো রক্তবর্ণ। দুটো হাত বেশ লম্বা শরীরের তুলনায় আর পাগুলো হাতের তুলনায় ছোট। ঠোঁটগুলো দ্বিখন্ডিত করা। কালো মুখের আদলে সাদা দাঁত গুলো ফিক করে ভেসে আছে। এ বাচ্চাটাকে দেখেই যেন আমার ভয়টা বেড়ে গেল। এ বাচ্চাটার গঠন বলেই দিচ্ছে বাচ্চাটা ভয়ংকর রূপ নিবে আরও। এদিকে আমার ফাটা পেটটার দিকে তাকাতেই আরও চমকে গেলাম।
#চারুলতা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৮ /শেষ পর্ব (১ম খন্ড)
এদিকে আমার ফাটা পেটটার দিকে তাকাতেই আরও চমকে গেলাম। লক্ষ্য করলাম আমার পেট থেকে অদ্ভুত ভাবে আলোক রশ্নি বের হচ্ছে। আমি এতক্ষণে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার ছিল। মূলত পেট থেকে আলোক রশ্নি বের হওয়ায় চারপাশটা আমার চক্ষুগোচর হয়েছিল। ভয় আমাকে গ্রাস করতে লাগল। অপরদিকে আমার ফাঁটা পেটটা জোরা লাগতে শুরু করল। আলোকরশ্নিটা পেট থেকে গোলাকার বৃত্ত হয়ে বের হয়ে ঘরের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। এদিকে বাচ্চাটার রূপ আরও পরিবর্তন হতে লাগল। এত কুৎসিত বাচ্চা আমার চক্ষুগোচর এর আগে কখনও হয়নি। শরীরটা কেমন জানি ভয়ে শিউরে উঠছে। রক্ত যেন হিম হয়ে যাচ্ছে।
বৃত্তাকার আলোটা চারদিকে অনবরত ঘুরতে ঘুরতে কোথাও যেন মিলিয়ে গেল। ফলশ্রূতিতে ঘরটায় একটু অন্ধকার নেমে এলো। এদিকে একটা সময় পর আমার পেটটা স্বাবাভিক হয়ে গেল। পেট স্বাভাবিক হলেও শরীটায় তেমন শক্তি অবশিষ্ট নেই যাতে করে আমি শুয়া থেকে উঠে দাঁড়াব। অন্যদিকে বাচ্চাটা গড়িয়ে গড়িয়ে আমার দিকে তেড়ে আসতে লাগল। আমার ঘাড়ের কাছে এসে আমাকেই কামড়ে ধরল। দম যেন বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। এবার আমার মৃত্যু হয়ে যাবে বুঝতেই পারছিলাম ৷ এমন সময় কারও উপস্থিতি টের পেলাম। মনে হলো বাচ্চাটাকে কেউ ধরে আমার ঘাড় থেকে ছুটিয়ে দূরে ছুড়ে মেরেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না সে কে! বন্ধ চোখটা খুলে লক্ষ্য করলাম মৃধা আমার সামনে বসা। কিছুটা উৎকণ্ঠার সহিত জিজ্ঞেস করলাম
– মৃধা তুমি? এটা কী কোনো মায়াবল নাকি সত্যিই তুমি?
মৃধা হালকা মুচকি হেসে বলল
– এরিকের মায়াজালে তুমি ফেঁসে গিয়েছিলে এটা সত্য। তবে আমি সত্য ছিলাম। আমি এরিকের বলির শিকার হই। আমার বয়স যখন ষোলো তখন এরিক আমাকে তুলে নিয়ে এসে আমার দেহ থেকে মাথাটা ছিন্ন করে শয়তানের নামে বলি দেয়। আমাকে বলি দেওয়ার পর আমার লাশটা ফেলে দেওয়া হয় নর্দমায়। সেখান থকে এক সাধু আমার মাথাবিহীন লাশটা এনে আমার মধ্যে কিছু শুভ শক্তি দেয়। আর তার বলেই আমি নতুন ময়াশক্তির জীবন পাই। আমার শরীরের রক্তও এরিককে ধ্বংস করার জন্য টগবগ করতেছে। তবে আমি অপারগ । কারণ এরিকের ধ্বংস কেবল তুমিই করতে পারবে। আমি শুধু তোমাকে সাহায্য করতে পারব এর বাইরে কিছু না।
আমি কিছুটা চমকে গেলাম। বিস্ময় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম
– কিন্তু এর আগে যে কাহিনি গুলো তুমি বলেছিলে সেটা কী মিথ্যা?
মৃধা হেসে উত্তর দিল
– তোমাকে সাথে সাথে সত্য বললে বিষয়টা আরও জটিল অবস্থায় চলে যেত। তাই একটা কাহিনি সাজাতে হয়েছিল।
মৃধার কথা শুনে আমি অস্থির হয়ে যেতে লাগলাম। মৃধা আমার অস্থিরতা দেখে বলল
– শান্ত হও চারুলতা। তোমাকেই এরিককে ধ্বংস করতে হবে। আর এজন্য তোমাকে আগে স্থির হতে হবে।
মৃধার কথায় নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা অবিচল রাখলাম । যদিও অস্থিরতার খানিক তকমা বিরাজমান আমার মধ্যে। তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু শত চেষ্টা করেও অস্থিরতা কাটাতে ব্যর্থ হলাম।
আমি অস্থিরতা না কাটিয়েই মৃধাকে বলে উঠলাম
– আমার যে বাচ্চাটা হয়েছে সেটা কী শুভ নাকি অশুভ?
মৃধা হালকা গলায় বলল
– তোমার বাচ্চাটা দুয়েই মাঝে রয়েছে। এখন এটা তোমার কাজ বাচ্চাটাকে তুমি কোন দিকে পরিচালিত করবে। বাচ্চাটাকে তোমাকে দ্রূত আয়ত্ত করতে হবে। অন্যথায় কোনোক্রমে এরিক যদি বাচ্চাটাকে আয়ত্ত করে ফেলে তাহলে আমাদের পরাজয় সুনিশ্চিত।
আমার অস্থিরতা যেন ক্রমেই বেড়ে চলছে। শরীরটা অসাড় হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই। উঠার শক্তিও পাচ্ছিনা। সমস্ত শক্তি দিয়ে উঠতে নিয়েও পড়ে যাচ্ছিলাম। মৃধা আমার অবস্থা দেখে আমার সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দিল। মৃধার হাতের স্পর্শে যেন আমার শরীরের ব্যথা কিছুটা উপশম হলো। আমি কিছুটা শক্তি শরীরে পেতে লাগলাম। তাই শুয়া থেকে উঠে বসলাম। মৃদু গলায় বললাম
– বাচ্চাটা তো উদ্ধত। আমাকে দেখলেই তেড়ে আসে। তাকে আমি কীভাবে শান্ত করব? কীভাবে নিজের আয়ত্তে আনব আমাকে উপায় বলে দাও।
মৃধা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে তা পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে বলল
– বাচ্চাটাকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করো। বাচ্চা তোমাকে খামচে বা কামড়ে ধরলেও তাকে ছেড়ো না। তাকে তোমার শাল দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করো। একবার যদি তাকে শাল দুধ খাওয়াতে পারো তাহলে সে বাচ্চাটার তোমার প্রতি মায়া জন্মাবে আর তুমি তাকে খুব সহজেই আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারবে। আর কাজটা করতে হবে দ্রূত। এরিক এখনও টের পায়নি তোমার বাচ্চাটা প্রসব হয়েছে। তাই যা করতে হবে দ্রূত।
আমি মৃধার কথা শুনে বাচ্চাটার দিকে ক্ষীণ দৃষ্টিতে আলোকপাত করলাম। ঘরের এক কোণে লেপ্টে লেগে শুয়ে আছে। এত কুৎসিত দেখতে যে তার কাছে যেতে ভয় করছে ভীষণ। তবুও আমাকে এ ধ্বংস লীলা থেকে বাঁচতে হলে বাচ্চাটাকে আয়ত্তে আনতে হবে।
আমি বসা থেকে এবার একটু উঠে দাঁড়ালাম। আস্তে করে বাচ্চাটার কাছে গেলাম। রুমটা যদিও আগের মতো অন্ধকার না। কিছুটা আলো কোথায় থেকে যেন প্রবেশ করেছে। যদিও আলোর প্রবেশ পথ বের করার কোনো উপায় নেই আর বের করার মতো কোনো চিন্হ বা পথও নেই। এখন অবশ্য সেসব ভাবার সময়ও নেই। নিজেকে যথাসম্ভব সামলিয়ে নিলাম। বাচ্চাটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। কোনোরকম সাড়া শব্দ পেলাম না। কদাকার বাচ্চাটাকে ধরতেও বেশ ভয় লাগছে। তবুও বাচ্চাটাকে হাতে স্পর্শ করলাম এবং কোলে তুলে নিলাম। বাচ্চাটা আমার কোলে একদম লেপ্টে আছে এখন। মৃধা পাশ থকে বলতে লাগল বাচ্চাটাকে যেন স্তন পান করাই। মৃধার কথায় বাচ্চাটাকে এবার নিজের স্তন পান করার চেষ্টা করলাম। ঠিক সে মুহুর্তে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম। প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম বাচ্চাটা কী আমার আয়ত্তের বাইরে চলে গেল?
#চারুলতা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৮ /শেষ পর্ব (শেষ খন্ড)
ঠিক সে মুহুর্তে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম। ঘরটা সজোরে কাঁপতে লাগল। বাচ্চাটা আমার বুকে জোরে কামড়ে ধরল। আমার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। পাশ থেকে মৃধা বলে উঠল
– বাচ্চাটার মধ্যে অশুভ শক্তি প্রবেশ করেছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতে না পারলে এরিককে ধ্বংস করা যাবে না। আর এরিক এ যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে গেলে সারা পৃথিবী কালো জাদুর হাতে জিম্মি হয়ে যাবে।।আমাদের কিছু একটা করতে হবে।
মৃধার কথা শুনে আমার হাত পা কাঁপতে লাগল সে সাথে বাচ্চাটাকে বুক থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারছিলাম না। বুক দিয়ে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। জানি না কী হতে চলল। তবে জয়ের আশঙ্কা এখানে ক্ষীণ। পুরো ঘরটা এবার বিদঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। মৃধার নিঃশ্বাস শোনা গেলেও তাকে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এদিকে আমি সমস্ত শক্তি খাটিয়ে বাচ্চাটাকে স্তন থেকে ছুটিয়ে জোরে আঁচরে ফেললাম। বাচ্চাটা কোথায় গিয়ে পড়েছে জানি না। অন্ধকার রুমে চক্ষুগোচর কিছু না হওয়ায় একটু দৃঢ় গলায় মৃধাকে ডাকতে লাগলাম। মৃধার কোনো সাড়া শব্দ মিলছে না। শুধু কয়েকটা গুঙানোর আওয়াজ শুনা যাচ্ছে সে সাথে ভারী নিঃশ্বাসেরও। মনে হচ্ছে কেউ কারও গলায় চেপে ধরে শ্বাসরোধ করছে।
আমার ভয়টা ক্রমশ বর্ধমান হতে লাগল। ভেতরটায় কম্পিত হতে লাগল। চুপ হয়ে গেলাম। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না আমার। এদিকে গুঙানোর আওয়াজটা প্রখর হয়ে মৃদু হয়ে গেল।
আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গুটি মেরে আছি। নিজেকে সামলে রাখা এ মুহুর্তে ভীষণ কঠিন। ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল। আলোটা জ্বলার সাথে সাথে আমার শরীরটা শিউরে উঠল। আমার সামনেই মৃধার নিস্তেজ দেহ পড়ে আছে। আর তার বুকের উপর বাচ্চাটা বসে খিলখিল করে হাসছে। বুঝতে আর বাকি রইল না বাচ্চাটা অশুভ শক্তিতে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। আমার পরাজয় হয়তো সুনিশ্চিত। জয়ের কিঞ্চিৎ আশাও রাখতে ইচ্ছা করছে না আমার। তবুও নিরাশ হয়ে জীবন দেওয়ার চেয়ে মরার আগে একটা বার চেষ্টা করে মরাই শ্রেয়। তাই নিজেকে একটু স্থির করলাম। বাচ্চাটাকে কী করলে এ অভিশপ্ত বাচ্চা শুভ শক্তি লাভ করবে সে চিন্তায় করতে লাগলাম। চিন্তাটা বেশিক্ষণ করার সুযোগ পেলাম না। এর মধ্যেই মামা রুমে প্রবেশ করল। বাচ্চাটা পুরোপুরি মামার আয়ত্ত্বে চলে গেল। আর মামা এসেই আমাকে উলঙ্গ করে ফেলল। সে সাথে মাথায় জোরে আঘাত করল। আমি অচেতন হয়নি তবে শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছে। কী হচ্ছে টের পেলেও শরীর নাড়াতে পারছি না। মামা আমার সমস্ত শরীরে কাচা হলুদ মেখে দিল তারপর আমার চুলগুলো ধরে টানতে টানতে আমাকে নিয়ে গেল পিশাচ মূর্তির সামনে। আমার বাকশক্তি এবং শরীরের সমস্ত শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে মূর্তির সামনে রেখে কী যেন বিড়বিড় করছে মামা। আর সারা শরীরে গোলাপ জল ছিটাচ্ছে আর বাচ্চাটাকে আমার বুকের উপর বসিয়ে দিল। এতে করে আমার নিঃশ্বাস আরও ভারী হয়ে গেল।
মিনেট দুয়েকের মধ্যে আমার শরীর আরও স্তব্ধ হয়ে গেল আমি বুঝতে পারছিলাম এ যুদ্ধে আমি হেরে যাব জিতে যাবে কালোজাদু। আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। কানে শুধু আওয়াজ আসছে। কম্পনের আওয়াজ পাচ্ছিলাম কেবল। এর মধ্যেই কানের কাছে কারও কণ্ঠের আগমন পেলাম। কণ্ঠটা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম মৃধার কণ্ঠ। আমি কিছু বলতে চাইলেও মুখ দিয়ে বের করতে পারছি না। এদিকে মৃধা ক্ষীণ গলায় বলল
– দ্বিতীয় বারের মতো আমার জীবন এরিকের হাতে শেষ হলো। চারুলতা এখনও সময় আছে সবকিছু ঠিক করার। তুমি তোমার মনের জোর দিয়ে শরীরটা সচল করো তারপর বুকে বসে থাকা বাচ্চাটাকে তোমার শরীরের যেকোনো অংশ কেটে শরীর থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত বাচ্চাটার মুখে লেপ্টে দাও বাচ্চাটা তাহলে অশুভ শক্তির অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে আর এরিকও ধ্বংস হয়ে যাবে।
আমি কথাগুলো শুনার পর বেশ কষ্টসাধ্য হলেও মৃধার কথা অনুযায়ী কাজ করলাম। বাচ্চাটার মুখে আমার শরীরের একাংশ কামড়ে সেটা থেকে রক্ত বের করে লেপ্টে দিলাম। সাথে সাথে ঘরটা জোরে কম্পিত হয়ে পিশাচ মূ্র্তিটা ভেঙে গেল আর মামাও পুরোপুরিভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সে সাথে আমার মৃত্যু ঘটল। আমার মৃত্যু ঘটলেও আমি এ বাড়ির আশে পাশে অতৃপ্ত হয়ে ঘুরছি ফিরছি। কারণ আমার লাশটা এ পর্যন্ত সঠিক উপায়ে সৎকার হয়নি। সেদিন শুভ শক্তির জয়লাভ হলেও আমার মৃত্যু রোধ হয়নি। বহু বছর এ বাড়ি পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। কিছুদিন পূর্বে একজন বাড়িটাকে বেশ কৌশলে নিজের বলে দাবি করে বাড়িটাকে একটু গুছিয়ে নিয়ে তোমাদের কাছে ভাড়া দিয়ে দেয়। আমি বেশ কয়েকবার তোমাদের সামনে আসার চেষ্টা করেছি সত্যটা বলার জন্য, তবে তোমাদের প্রাপ্ত ভয়ের জন্য আর পারিনি। কথাগুলো চারুলতা স্থিতিকে বলে চুপ হয়ে গেল।
স্থিতি স্তব্ধ হয়ে বসে আসছে। এ বাড়িটা মূলত পুরনো একটা বাড়ি। শহর থেকে বেশ দূরে অবস্থান করায় এ বাড়ির দিকে তেমন লোক সমাগম নেই। বর্তমানে এ বাড়িটা ভুতুরে বাড়ি নামেই পরিচিত। তাই এদিকে মানুষ আাসার সাহস তেমন পায় না। স্থিতি ভুতুরে বিষয় গুলো নিয়ে গবেষণা করার দরুণ তার বন্ধু সৌভিক নিয়ে এ বাড়িতে আসে। এ বাড়িটায় আসার পর থেকেই একের পর এক কান্ড কাহিনি ঘটতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সে কাহিনির সূত্র ধরেই চারুলতার আত্মার সাথে দেখা। স্থিতি এখনও নীরব। সৌভিক নীরবতা ভেঙে চারুলতার দিকে তাকিয়ে বলল
– তুমি যা করেছো তা নিঃসন্দেহে অনেক উত্তম কাজ। তবে তোমার মুক্তি কীভাবে হবে বলো?
চারুলতা হালকা গলায় জবাব দিল
– বাড়িটার পেছনে নারিকেল গাছের তলায় সাত হাত মাটি খুড়লেই আমার হাড় পাওয়া যাবে সেগুলো দাফন করলেই আমার মুক্তি মিলবে।
স্থিতি এবার নড়েচড়ে বসে বলে উঠল
– তুমি ভালো থেকো। আমরা তোমার মুক্তির ব্যবস্থা করছি।
কথাটা বলেই স্থিতি আর সৌভিক দৌড়ে গেল বাড়ির পেছনটায়। সেখানে নারিকেল গাছের তলায় সাত হাত মাটি খুড়ার পর চারুলতার হাড় গুলো পেল। তারপর সেগুলো দুজন মিলে বাড়ি থেকে খানিক দূরে দাফনের ব্যবস্থা করল।
হাড়গুলো দাফন করার সাথে সাথে বাড়িটা হালকা কাঁপুনি দিল সে সাথে একটা বাজ পাখি উড়ে গেল। বুঝতে আর বাকি রইল না চারুলতার আত্মার মুক্তি মিলল।
সৌভিক আর স্থিতি নিজেদের কাজগুলো সম্পন্ন করে সবগুলো তথ্য লিপিবদ্ধ করল তারপর বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। সে সাথে চারুলতার ঘটনারও সমাপ্তি ঘটল।
সমাপ্ত