#চৈত্রের_বিকেল
#পর্ব_৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
কিছু শব্দ স্থিতিশীল অবস্থায় রুহানিয়ার মাথায় চেপে রয়েছে। জিহাদের সরল উক্তিগুলো এখনো কানে বাজছে। সেই সাথে তার করুণ চাহনীও বারংবার চোখের দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে। ঐ মুহূর্তে রুহানিয়ার বলার মতো কিছুই ছিল না। আর না ছিল উত্তর দেওয়ার মতো কোনো ভাষা! তবে এতটুকু সে আগেই বুঝেছিল, জিহাদের মনে তার জন্য কিছু তো একটা আছে! তবে এ কথাও সত্য, এভাবে হুট করেই যে জিহাদ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেবে এটাও সে ভেবে উঠতে পারেনি। বলা বাহুল্য, ঘুণাক্ষরেও সে টের পায়নি।
রুহানিয়ার ইতস্ততবোধ চাহনী জিহাদের দৃষ্টির অগোচর হয়নি। সে রুহানিয়াকে সহজ করতে বলেছিল,
‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই রুহানিয়া। আমি এখনই কোনো উত্তর চাচ্ছি না। আমি শুধু আমার দিকটা ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। আপনি সময় নিন। আপনার পছন্দ, অপছন্দ এবং আপনার সিদ্ধান্তকে আমি সবসময় সম্মান জানিয়েছি আর ভবিষ্যতেও জানাব। আমাদের মাঝে যদি অন্য কোনো সম্পর্ক না-ও হয় তাহলে আমরা বন্ধু হয়েই থাকবে। এতটুকু তো করাই যায় রুহানিয়া? প্লিজ, যোগাযোগ অফ করে দিয়েন না এটা আমার রিকোয়েস্ট।’
রুহানিয়া তখন হ্যাঁ, না কিছুই বলেনি। সম্পূর্ণ নিরব ভূমিকা পালন করেছে। কফিটুকু শেষ করে শুধু বলেছিল,
‘এবার বাসায় যেতে হবে।’
জিহাদ বাধ সাধেনি। নিজে এসে রুহানিয়াকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে। বাড়ি আসার পর থেকেই বারান্দায় পায়চারি করে চলেছে রুহানিয়া। আর বারবার জিহাদের বলা কথাগুলো ভাবছিল। সে আসলে বুঝে উঠতে পারছিল না তার কী করা উচিত, কী বলা উচিত। তার মন আসলে কী চায় সে তো সেই বিষয়েই সন্দিহান। এখন তার কারও সাহায্য, কারও সঙ্গ ভীষণ প্রয়োজন ছিল। বিষয়টা যদি জিহাদকে ঘিরে না হতো তাহলে নিঃসন্দেহে এই বিষয়ে সে জিহাদের সাথেই আলোচনা করত। কিন্তু এখন কাকে সে বলবে মনের কথাগুলো? কে তাকে পথ দেখাবে? মায়ের সাথে তার সম্পর্ক ভালো। তবে ছোটোবেলা থেকেই ভীতিসঞ্চার স্বভাব তার মধ্যে থাকায়, মাকে ভালোবাসার বিষয়ে কখনো মনের কোনো কথা বলা হয়নি। যে কারণে সে কখনো শুভ্রকে পছন্দ করার বিষয়টিও বলতে পারেনি। বিষয়টা নিয়ে যে চৈত্রীর সাথে আলাপ করবে সেটা নিয়েও মনে খুতখুতানি ছিল। চৈত্রী নিজেই তো ছোটো মানুষ ; সে ও-কে কী-ই বা পরামর্শ দিতে পারবে!
চৈত্রী পড়ার টেবিল থেকেই রুহানিয়ার অস্থিরতা খেয়াল করছিল। এতক্ষণ সে কিছুই বলেনি। এমনিতে সে নিজেই কাব্যর অত্যাচারে অতিষ্ঠ। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। অন্যদিকে রুহানিয়ার অস্থিরতার কারণ নতুন করে কী হতে পারে সেটাও সে বুঝতে পারছে না। শুভ্র ভাইয়ার কথা মনে পড়েই কি মন খারাপ? হতেও পারে। সে গুটিগুটি পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে বলল,
‘আপাই? তোমার কি মন খারাপ?’
চৈত্রীর উপস্থিতি এবং প্রশ্নে কিছুটা সচকিত হয়ে ওঠে রুহানিয়া। স্বাভাবিক থাকার প্রয়াসে বলে,
‘কই? না তো!’
‘তাহলে কি কিছু নিয়ে ভাবছ?’
‘না, তেমন কিছু না।’
‘তাহলে অমন মনমরা হয়ে আছো কেন?’
‘আরে এমনিই। তোর কথা বল। পড়া রেখে এখানে কেন এসেছিস? কিছু বলবি?’
‘এসেছিলাম তো তোমার কী হয়েছে সেটা শোনার জন্য। এখন মনে হচ্ছে এই সুযোগে তোমায় একটা কথা শেয়ার করি।’
টুলের ওপর বসল রুহানিয়া। চৈত্রীর কোলের ওপর দু’হাত রেখে বলল,
‘আচ্ছা বল শুনি।’
‘শুভ্র ভাইয়ার বন্ধু আছে না কাব্য? সে তো আমাকে জ্বালিয়ে মারছে!’
‘কেন? কী করেছে?’
‘কী করেনি সেটা বলো? সারাদিন ফোন দেয়, ম্যাসেজ দেয়। কলেজের সামনে গিয়েও দাঁড়িয়ে থাকে। আজ কী হয়েছে জানো?’
‘কী?’ উৎসাহিত হয়ে প্রশ্ন করল রুহানিয়া।
‘প্রাইভেট পড়ে বের হয়েছি কলেজ থেকে। ঐ সময়ে দেখি সে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জন্য সারপ্রাইজ এনেছিল। কী সারপ্রাইজ সেটা শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।’
রুহানিয়ার কৌতুহল বাড়ল। সে জিজ্ঞেস করল,’কী সারপ্রাইজ?’
‘এনার্জি বিস্কুট!’
রুহানিয়ার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল,’অ্যাঁ!’
‘হ্যাঁ। বলে কিনা এনার্জি বিস্কুট খেলে আমার ঝগড়া করার এনার্জি বাড়বে।’
রুহানিয়া এবার খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে চৈত্রীর কোলে মাথা রেখে গড়াগড়ি খায়। কিছুটা বিরক্ত হয় চৈত্রী। এটা কি হাসির মতো কিছু হলো?
চৈত্রী নাক-মুখ কু্চকে জানতে চাইল,’হাসছ কেন?’
রুহানিয়া কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলল,’হাসির কথা শুনে হাসব না?’
‘কিন্তু আমি খুব বিরক্ত আপু। ঐ লোকটা বলে আমায় নাকি ভালোবাসে।’
রুহানিয়া এবার অবাক হয়ে বলে,’কী! সত্যি?’
‘সত্যি কিনা মিথ্যা তা তো জানিনা। তবে সে আমায় এটাই বলেছে।’
‘মজা করে হয়তো।’
‘আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু এজন্য কি প্রতিদিন এই মজা করা লাগবে তার? আমি কি তার বেয়াইন লাগি?’
‘আচ্ছা কাব্যকে তোর কেমন লাগে?’
‘বিরক্ত লাগে!’
‘এমনিতে কেমন লাগে?’
‘কেমন লাগবে?’
রুহানিয়া চোখ পিটপিট করে তাকায়। সে যা বোঝাতে চাইছে চৈত্রী সেটা বুঝতে পারছে না। তাই সে প্রসঙ্গ বদলে বলল,
‘বাদ দে। আমি তাকে বলে দেবো তোকে যেন আর বিরক্ত না করে।’
চৈত্রী খুশি হয়ে বলল,’থ্যাঙ্কিউ আপাই।’
‘আচ্ছা চৈত্রী একটা কথা বল তো।’
‘কী?’
‘কাব্য যদি তোকে সত্যিই ভালোবাসে তাহলে কী করবি?’
‘আব্বু-আম্মুকে বলে দেবো।’
রুহানিয়া হেসে ফেলে। বলে,’যদি বিয়ে করতে চায়?’
‘সে তো আজও বিয়ের কথা বলেছে। বলে যে, জিহাদ ভাইয়ার সাথে সেও বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে কিনা।’
শেষ কথাটা মুখ ফসকে বলে জিভ কাটে চৈত্রী। রুহানিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলে,
‘জিহাদের সাথে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে মানে?’
‘কিছু না আপাই। আমি যাই, অনেক পড়া বাকি।’
রুহানিয়া চৈত্রীর হাত টেনে ধরে আবার দোলনায় বসিয়ে দেয়। গম্ভীর হয়ে বলে,
‘কী লুকাচ্ছিস আমার থেকে?’
রুহানিয়া বেশ ভালো করেই চেপে ধরেছে চৈত্রীকে। যাকে বলে ছাই দিয়ে ধরা। সত্যি কথা না বলে আর উপায় নেই বুঝতে পেরে গতকাল কাব্যর বলা সব কথা সে রুহানিয়াকে বলে দেয়।
রুহানিয়া দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,’তার মানে তুইও সব জানিস?’
চৈত্রী অবাক হয়ে বলে,’তুমিও জানো? মানে জিহাদ ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসার কথা বলেছে?’
রুহানিয়া সোজা হয়ে বসল। নখ দিয়ে নখ খুঁটতে খু্ঁটতে বলল,’হুম। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে।’
চৈত্রী প্রফুল্লিত হয়ে বলল,’তুমি কী বললে?’
‘এখনো কিছুই বলিনি।’
‘ওমা! কেন?’
‘ভাবার জন্য সময় দিয়েছে। কাব্য যখন তোকে বিয়ের কথা বলেছে তুই কী বলেছিলি?’
‘পাগল? আমি আবার কী বলব? আমি কি তাকে বিয়ে করব নাকি!’
‘কেন? করলে কী সমস্যা? ছেলেটা তো অনেক সুন্দর।’
‘হুহ ছাই! কত সুন্দর সুন্দর ছেলে আমার পিছে ঘুরে।’
‘তো তোর কি ঐসব সুন্দর ছেলে থেকে কাউকে পছন্দ?’
‘ইশ না! আমার কাউকেই সেভাবে ভালো লাগে না। মানে ভালোবাসার প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই।’
‘সেকি! তোর এই বয়সটাই তো আগ্রহের, কৌতুহলের। তোর বয়সী ছেলে-মেয়েরা রঙিন চশমা পরে রঙের দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায়। যা দেখে, যাকে দেখে তাকেই ভালো লাগে।’
‘কিন্তু আমার বেলায় তো এমন কিছু হয় না আপাই।’
‘তুই তাহলে নিরামিষ। তবে এটাই ভালো জানিস। এই সময়টা যে নিজেকে সংবরণ করে রাখতে পারে সে-ই ঠিক পথে থাকতে পারবে।’
‘এজন্যই মনে হয় কাউকে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু কাব্য ভাইয়াটা বড্ড বেশি জ্বালায় আমাকে।’
রুহানিয়া মুখ টিপে হেসে বলে,’তাহলে বিয়ে করে তুই তাকে জ্বালানো শুরু করে দে।’
‘পাগল নাকি! কখনোই না। সে আমার থেকে কত্ত বড়ো!’
‘তোর থেকে বয়সে অনেক বড়ো বলেই কি তাকে তোর ভালো লাগে না?’
‘জানিনা আপাই। আমার এসব ভালো লাগে না। আমি কখনো প্রেম করব না।’
‘আচ্ছা বাদ দে। এসব নিয়ে বেশি ভাবিস না। প্রেম করবি না সে তো না হয় বুঝলাম। আবার কাউকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলিস না। আমিও আগে বলতাম, আমি কখনো রিলেশনে জড়াব না। অথচ দেখ, এমন একজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম যার জন্য আমি মৃ’ত্যু’র পথও বেছে নিয়েছিলাম। ঐসময়ে ভাগ্যিস দেবদূত হিসেবে জিহাদ এসেছিল!’
‘আপাই, আমার মনে হয় জিহাদ ভাইয়াকে তোমার ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ভাইয়া মনে হয় আসলেই তোমাকে অনেক ভালোবাসে।’
রুহানিয়া স্মিত সহাস্যে বলল,’কী জানি!’
চৈত্রীর মা জেসমিন বেগম রুমে ঢুকে চৈত্রীকে না পেয়ে নাম ধরে ডাকেন। চৈত্রী হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে বলে,
‘আম্মু আমি বারান্দায় ছিলাম।’
জেসমিন বেগম দুধের গ্লাস আর সেদ্ধ ডিম টেবিলের ওপর রেখে বললেন,’পড়া বাদ দিয়ে বারান্দায় কী এখন? রুহি কোথায়?’
‘আপাইও বারান্দায়। আপাইর সাথেই ছিলাম এতক্ষণ।’
‘এখন খেয়ে পড়তে বোস।’ বলে তিনি বারান্দায় যান। রুহানিয়াকে আনমনা হয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেন,
‘সবসময় রুমে ঢুকে বসে থাকিস কেন? আমার সাথেও তো একটু গল্প-গুজব করতে পারিস। নাকি আমি বুড়ি হয়ে গেছি?’
রুহানিয়া হেসে ফেলে। বসা থেকে উঠে জেসমিন বেগমের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘কী যে বলো না কাকি! তোমার এখনো যা সৌন্দর্য রয়েছে, আমি তো তার ধারেকাছেও নেই।’
তিনি রুহানিয়ার গাল টিপে বলেন,’হয়েছে। এখন চল নাস্তা করবি।’
রুহানিয়া জেসমিন বেগমের সাথে ড্রয়িংরুমে যায়। খেতে খেতে দুজনে অনেক গল্পই করে। রুহানিয়া এক মনে ভাবছে তাকে সবকিছু শেয়ার করবে কিনা। আবার বলতে গিয়ে সংকোচের কারণে বলতে পারছে না। জেসমিন বেগম বোধ হয় রুহানিয়ার ভাবসাব কিছুটা বুঝতে পারলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘এমন ইতিউতি করছিস কেন? কিছু বলবি?’
‘হ্যাঁ! না, কিছু না।’
‘ভয় পাচ্ছিস কেন? কিছু বলতে চাইলে আমায় নির্ভয়ে বলে ফেল। দেখি কোনোভাবে তোকে সাহায্য করা যায় কিনা।’
রুহানিয়া কিয়ৎক্ষণ জেসমিন বেগমের মুখপানে তাকিয়ে থেকে পাশে গিয়ে বসল। হাত চেপে ধরে বলল,
‘বকবে না কিন্তু!’
তিনি হেসে বললেন,’পাগলি মেয়ে! বকব কেন? তুই ভয় না পেয়ে বল।’
শুভ্রর বিষয়টুকু গোপন রেখে বিয়েবাড়ি থেকে জিহাদের সাথে পরিচয়, এখানে এসে দেখা করা, বন্ধুত্ব এবং আজকে জিহাদের দেওয়া বিয়ের প্রস্তাব সবকিছুই বিস্তারিত জেসমিন বেগমকে বলল রুহানিয়া। সব মনোযোগ দিয়ে শোনার পর জেসমিন বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুইও কি জিহাদকে ভালোবাসিস?’
রুহানিয়া নতমুখে বলল,’আমি ঠিক জানিনা কাকি। তবে মানুষটার প্রতি ভীষণ ভরসা, বিশ্বাস রয়েছে। তার ব্যবহার, আচার-আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে সর্বদা।’
‘দেখ রুহি, বিয়ের ব্যাপারে ছেলে আর মেয়ের সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারপর আসে পরিবারের কথা। জিহাদ তো ওর দিক থেকে ক্লিয়ার। এখন তোকেও তোর দিক থেকে ক্লিয়ার করতে হবে। ভালোবাসা না থাকলেও বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই সম্পর্ক শুরু করা যায়। পরবর্তীতে ভালোবাসাটাও তখন আপনা-আপনি তৈরি হয়ে যায়। কেননা যেকোনো সম্পর্কের ভীত-ই তো বিশ্বাস। সেখানে তুই নিজে বললি জিহাদকে তুই অনেক বিশ্বাস করিস, ভরসা করিস। আর একজন মা হিসেবে তোর চোখের ভাষাও আমি পড়তে পারি। তুই নিজেও জিহাদকে ভালোবাসিস এটা কি তুই জানিস?’
রুহানিয়া অবাক হয়ে তাকায়। জেসমিন বেগম মৃদু হেসে বলেন,’হ্যাঁ। কয়েকদিন গেলে অবশ্য তুই নিজেও এটা উপলব্ধি করতে পারবি। তুই যদি আগে শিওর হয়ে নিতে চাস, তাহলে জিহাদের মতো আমিও বলব কিছুটা সময় নে। ভেবে দেখ তোর মন কী বলে। তারপর না হয় একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে।’
রুহানিয়া জেসমিন বেগমের কাঁধে মাথা রেখে বলল,’থ্যাঙ্কিউ কাকি। তোমার সাথে বিষয়টা শেয়ার করার পর এখন নিজেকে কিছুটা হালকা লাগছে। আর আমারও মনে হয়, কিছুটা সময় নেওয়াই ভালো হবে। তারপর উত্তর কী আসে সেটাও প্রথম তোমাকেই বলব।’
তিনি রুহানিয়ার চিবুক ছুঁয়ে হেসে বললেন,’পাগলি একটা!’
_______
আজ তিনদিন হবে কাব্য আর চৈত্রীকে ফোন করে না। ম্যাসেজ করে না। এমনকি কলেজের সামনেও আসে না। সেদিনের পরদিনও তো কাব্য তার স্বভাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হুট করে তবে কী হয়ে গেল? কাব্যর এমনটা করায় চৈত্রীর খুশি হওয়ার কথা থাকলেও সে খুশি হতে পারল না। উলটো তার মনে কেমন সংশয় জেগেছে। মানুষটা সুস্থ আছে তো? এসব ভেবে ভেবে নিজের মনেই আবার প্রবোধ বকে বলে,
‘ধুর! কেন তুই ওর কথা ভাবছিস চৈত্রী? তুই যা চেয়েছিলি তাই-ই তো হয়েছে। সূতরাং তুই এখন থেকে মুক্ত।’
মনে মনে সে এসব কথা এবং আরও নানান ধরণের কথাবার্তা বলে মনকে বুঝিয়ে নিয়েছে। কলেজ ছুটির পর অবচেতন মনেই সে আশেপাশে তাকায়; এই আশায় যে, হয়তো কাব্য আজ এসেছে। কিন্তু তার মনকে নিরাশ হতে হয়। সে বাড়িতে ফিরে দেখে মেজ কাকা-কাকি, দিশা, মামা-মামি আর সমুদ্র এসেছে। চৈত্রীকে দেখেই সমুদ্র ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘তুমি এসেছ সুইটহার্ট! কখন থেকে তোমার অপেক্ষা করছিলাম।’
মামি তখন বললেন,’মাত্র কলেজ থেকে এসেছে চৈত্রী। আগে ও-কে ফ্রেশ হতে দাও।’
সমুদ্র জিভ কেটে বলল,’ওহ, স্যরি সুইটহার্ট।’
চৈত্রী আগে সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে তারপর নিজের রুমে এলো। সঙ্গে দিশাও এলো। হিজাবের পিন খুলতে খুলতে চৈত্রী দিশাকে জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু হয়েছে নাকি?’
দিশা অবাক হয়ে জানতে চাইল,’কী হবে?’
‘জানিনা বলেই তো জানতে চাচ্ছি। হুট করে সবাই মিলে আসলি যে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?’
দিশা বলল,’আরে হ্যাঁ। সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। তুই জানতি না আমরা আসব?’
‘না।’
‘বলিস কী! কাকি ফোন করেছিল রাতে। আমাদের জরুরী তলব বলে ডেকে পাঠিয়েছে।’
‘কিন্তু জরুরী তলবটা কী?’
‘তুই কি এটাও জানিস না?’
চৈত্রী অসহায়ের মতো করে তাকিয়ে বলল,’মনে তো হচ্ছে, আমি কিছুই জানিনা রে।’
‘শুভ্র ভাইয়ার বন্ধু জিহাদ ভাইয়ার কথা কি মনে আছে তোর?’
‘আছে।’
‘সে নাকি আপুকে পছন্দ করে। বিয়ে করতে চায়। তাই কাকি আমাদের ডেকে পাঠিয়েছে। এখান থেকে গ্রাম তো বেশি দূরে হয়ে যায়। তাই আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে আমরা এখানে এসেছি।’
চৈত্রী এসব কথা শুনে বেশ অবাকই হলো। এক রুমে থেকেও রুহানিয়ার মনের ভাব সম্পূর্ণ বুঝতে পারেনি চৈত্রী। এমনকি রুহানিয়া নিজে থেকেও তাকে কিছু বলেনি। রুহানিয়াও যে জিহাদকে পছন্দ করে এবং বিয়েতে রাজি এ কথাটা তাকে একবার বললে কী এমন হয়ে যেত? মনে মনে দুঃখ পাওয়ার পাশাপাশি চৈত্রীর একটু অভিমানও হলো রুহানিয়ার ওপর। সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
‘সবাই তাহলে বিয়েতে রাজি?’
‘আরে না! আজ জিহাদ ভাইয়া তার আব্বু-আম্মুকে নিয়ে এই বাসায় আসবে। আগে দুই পরিবার ছেলে-মেয়ে দুজনকে দেখবে। খোঁজ-খবর নেবে। তারপর না বিয়ের ব্যাপারে আগাবে।’
‘জিহাদ ভাইয়ার আব্বু-আম্মু না গ্রামে থাকে?’
‘হু। এইযে আমাদের মতোই রাতে বলে রেখেছিল সকালেই চলে আসার জন্য।’
চৈত্রী হতাশ হয়ে বলল,’ভালোই।’
তারপর জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল কাপড় পালটানোর জন্য। সে ফ্রেশ হয়েও আর রুমের বাইরে গেল না। অভিমানি মনটা প্রাণোচ্ছল কারও সঙ্গ চাচ্ছিল। দিশা এতক্ষণ থাকলেও এখন সেও ড্রয়িংরুমে সবার সাথে ব্যস্ত। হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। সমুদ্র চলে এসেছে রুমে। হাতে আপেল আর কমলা। সে চৈত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার কি মন খারাপ সুইটহার্ট?’
চৈত্রী মৃদু হেসে বলল,’না।’
‘আচ্ছা এগুলো খাও।’
‘আমি তো এখন কিছু খাব না।’
‘আমি এনেছি, তুমি খাবে না?’
সমুদ্র এমনভাবে কথাটি বলল যে চৈত্রী আর ফিরিয়ে দিতে পারল না। সে আপেল নিয়ে খেতে শুরু করে। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। মামি রুহানিয়াকে রেডি করানোর জন্য রুমে নিয়ে এসেছে। জেসমিন বেগমের একটা শাড়ি পরিয়ে, সাজিয়ে দিচ্ছেন মামি। চৈত্রী চুপচাপ দেখছে। কোনো কথা বলছে না। রুহানিয়াকে দেখে তার অভিমানের পারদ বাড়তে শুরু করে। সে যে খুব ভালোবাসে তার আপাইকে! অথচ এত বড়ো একটা খবর একটাবারও তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে পড়ল না। এত নিষ্ঠুর!
কিছুক্ষণ বাদে জিহাদ ওর পরিবারসহ বাড়িতে উপস্থিত হয়। সঙ্গে তিতাস আর কাব্যও এসেছে। শুভ্র আর পুতুল ওদের আসার মিনিট দশেক আগেই চলে এসেছে। রুহানিয়াকে দিয়েই নাস্তা পাঠানো হয়। সবাই ড্রয়িংরুমে উপস্থিত ছিল একমাত্র চৈত্রী ছাড়া। সমুদ্র জোর করে ও-কে টেনে নিয়ে যায়। জিহাদ চৈত্রীকে দেখে হেসে বলে,
‘ভালো আছো?’
চৈত্রী মাথা নাড়িয়ে মৃদু হেসে বলল,’আলহামদুলিল্লাহ্ ভাইয়া। আপনারা সবাই ভালো আছেন?’
জিহাদ উত্তর নিয়ে ওর বাবা-মাকে বলল,’তোমাদের বলেছিলাম না আমার একটা ধর্মের বোন আছে? এইযে ও-ই সে।’
ওর বাবা-মা চৈত্রীকে পাশে বসালেন। শুভ্র হেসে বলে,’আমার এক বোনকে বউ করতে চলে এসেছিস। আরেক বোনকে নিজের বোন বানিয়ে ফেলেছিস। ব্যাপার কী তোর? আমার সব বোনকে কেড়ে নিবি নাকি?’
শুভ্রর কথায় সবাই হেসে উঠল। রুহানিয়ার সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলে সবাইকে অন্যরুমে পাঠিয়ে দিলেন জেসমিন বেগম। এখন শুধু বড়োরা সবাই ড্রয়িংরুমে আছে।
বাকি সবার স্থান হয়েছে চৈত্রীর রুমে। চৈত্রী আড়দৃষ্টিতে খেয়াল করছে, কাব্য কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। এমনকি চৈত্রীর দিকে একবার তাকাচ্ছেও না। রুহানিয়া আর জিহাদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। রুমে আছে শুভ্র, পুতুল, তিতাস, কাব্য, দিশা, সমুদ্র আর চৈত্রী। কাব্যর হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কারণ খুব করে জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল চৈত্রীর। হঠাৎ করে অভিমানগুলো যেন তরতর করে বাড়তে শুরু করেছে। সবকিছু মিলিয়ে তার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। সবাই কি তাকে এড়িয়ে চলছে? কিন্তু কেন?
ঐ সময়ে কারেন্ট চলে যায়। গরমে হাসফাস লাগছিল। শুভ্র তখন সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘চল ছাদে যাই।’
সবাই রাজি হয়ে যায়। সবাই আগে আগে যাচ্ছে,আর সবার শেষে আছে চৈত্রী। তার কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। সমুদ্রের জন্য বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে। ছাদে এসে চৈত্রীর একটা ভুল ধারণা ভাঙে। কাব্য আসলে চুপচাপ নয় বরঞ্চ তাকেই এড়িয়ে যাচ্ছে। বাকি সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। দিশা আর সমুদ্রের সাথে দুষ্টুমিও করছে। সবার মাঝে থেকেও চৈত্রীর নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। তার উপস্থিতি যেন কেউ টের-ই পাচ্ছে না। এতটা অবহেলা কেন করছে সবাই? চৈত্রী চেষ্টা করছিল নিজেকে স্বাভাবিক রাখার। দিশার সাথে কাব্যর দুষ্টুমিগুলো চোখে বাঁধছিল। এমনটাই বা কেন হচ্ছে?
রুহানিয়ার দৃষ্টি পড়ে চৈত্রীর ওপর। বিষন্ন চৈত্রীকে দেখে সে এগিয়ে আসে। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে?’
চৈত্রীর এবার কান্না চলে আসছে। যার ওপর অভিমানের শুরু সে-ই এসে আবার জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে! সে কাঁদল না। কান্না আটকে রুহানিয়ার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
‘কিছু না।’
চৈত্রীর এমন আচরণে রুহানিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মামির ডাকে বিস্তারিত জানার সুযোগ হলো না। তাকে বাধ্য হয়েই নিচে নামতে হলো। রুহানিয়া চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চৈত্রী সবার দৃষ্টি এড়িয়ে দূরে আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। বড়ো একটা পেয়ারা গাছের আড়ালে লুকিয়ে দু’ফোটা অশ্রু বিসর্জন দিলো সে। কান্না থামিয়ে যখন পেছনে তাকাল তখন দেখতে পেল সেখানে কেউই নেই। জনশূন্য ছাদে তাও আবার রাতের বেলায় সে একা ছাদে এটা ভাবতেই ভয়ে গা ছমছম করে উঠল তার। দৌঁড়ে যে নিচে নামবে সেটাও পারছিল না। পা যেন তার টলছিল না একদম। ঐ সময়ে কাব্যর কণ্ঠ কানে আসে তার।
‘নিচে আসো। রুহি আপু যেতে বলেছে।’
চৈত্রী ভয়ে ভয়ে পিছু তাকিয়ে কাব্যকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল। দৌঁড়ে এগিয়ে গেল সামনে। মুখ ফসকে বলে ফেলল,
‘আপনি এতক্ষণ কথা কেন বলেননি আমার সাথে?’
‘তুমি চাও না তাই। তবে তুমি যে সত্যিই আমায় অপছন্দ করো এটা আমি জানতাম না। তবে মনে হয় না জিহাদ কিংবা রুহি আপুকে দিয়ে বলানোর কোনো দরকার ছিল। অবশ্য ওদেরকে না বললে হয়তো আমি বুঝতেও পারতাম না যে, আসলেই আমি তোমাকে অনেক বিরক্ত করি।’
চৈত্রীর মন খারাপ হলো। সেদিন যে রুহানিয়াকে বলেছিল সেসব কথাও মনে পড়ে গেল। তার মানে রুহি আপু জিহাদকে দিয়ে কাব্যকে বলিয়েছে সেসব। চৈত্রী কিছু বলতে যাবে কাব্য তখন বলল,
‘যাই হোক, তোমাকে আমি আর জ্বালাবো না। নিচে চলো।’
কিছু বলার সুযোগ না পেয়েও চৈত্রী ব্যথিত হলো। কাব্যকে অনুসরণ করে যাওয়ার পথে হুট করে অদ্ভূত একটা প্রশ্ন এলো তার মানে। সে আতঙ্কিত হয়ে বলল,
‘আপনি কি সত্যিই কাব্য? নাকি কাব্য সেজে এসেছেন? ভূত!’
কাব্য হকচকিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলল,’মানে কী?’
চৈত্রী আর কিছু না ভেবে চোখ বন্ধ করেই জোরসে চিমটি বসিয়ে দিলো কাব্যর হাতে। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল কাব্য। নখ ডেবে মাংস উঠে গেছে। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘এটা কী করলে!’
‘স্যরি! আসলে আমি দেখছিলাম…’
চৈত্রীর কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই কাব্য ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে তার হাতের দিকে ধরেছে। সেদিকে দৃষ্টি পড়তেই চৈত্রী ঘাবড়ে যায়। কথা বন্ধ হয়ে যায় তার। কাব্যর হাত থেকে র’ক্ত পড়ছে। সে তৎক্ষণাৎ কাব্যর হাতটি ধরে কাঁদোকাঁদো মুখে বলল,
‘আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি বিশ্বাস করুন!’
কাব্য কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। অদ্ভূত এক দৃষ্টিতে তার ধরে রাখা হাতের দিকে তাকায় একবার। আরেকবার তাকায় চৈত্রীর কাঁদোকাঁদো নিষ্পাপ মুখটির দিকে।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। দু’দিন গল্প দিতে পারিনি। তবে বড়ো একটা পর্ব দিয়েছি। কেউ আর অভিযোগ করবেন না কিন্তু!
হ্যাপি রিডিং।]