#জনৈক_প্রেমিক
পর্ব- ০৫
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। মেহমানরা একজন দুজন করে চলে যেতে আরম্ভ করেছেন। অনেকেই বলছে, মেয়ের বাড়ি থেকে কেউ এলো না মেয়ে-জামাইকে নিতে?
বাবারা এখনো কেন আসছে না ভেবে আমার দুঃশ্চিন্তা হতে লাগল। বাবাকে ফোন দিচ্ছি রিং হচ্ছে। কিন্তু ধরছে না। গাড়ির আওয়াজে নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছে না ফোনের আওয়াজ।
এরই মধ্যে আমার ননদ এসে দরজা ধাক্কাতে লাগল।
‘ভাবি! দরজা খোলো! ‘
দরজা খুলে দিতেই শ্রেয়া আমার হাতে দুটো ট্যাবলেট বাড়িয়ে দিল, ‘এই নাও নাপা এক্সট্রা! ‘
তখন শ্রেয়াকে মিথ্যে বললেও নানান দুঃশ্চিন্তায় এখন সত্যি সত্যিই আমার মাথা ব্যাথা করছে।
শ্রেয়ার সঙ্গে ঘর থেকে বের হব তখনি আমার শ্বাশুড়ি মা এলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ বেয়াইরা রওনা দিয়েছেন কি না তোকে ফোন করে জানিয়েছে না-কি মা?
আমি জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ মা। বাবারা তো বারোটার পরপরই রওনা দিয়ে দিয়েছিলেন!’
‘একটাবার ফোন করে দেখতি তারা এখনো আসছেন না কেন? বিকেল হয়ে গেল!’
যদিও আমি এর আগে অনেকবার কল করেছি। তবুও আমার শ্বাশুড়ি মায়ের কথায় আরেকবার ফোন করলাম। এবারও আগের মতোই।
আমি বললাম, ‘রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ তুলছে না!’
তিনি বললেন, ‘হয়তো জ্যামে আটকা পড়েছেন তাই দেরি হচ্ছে। তুই দুঃশ্চিন্তা করিস না!’
আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘মা, আর ছাদে না গেলে হবে? ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে!’
‘না আর যেতে হবে না। তুই শুয়ে বিশ্রাম নে।’
আমার শ্বাশুড়ি মা শ্রেয়ার সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। যেতে যেতে তিনি শ্রেয়াকে বললেন, ‘তোর ভাইয়াকে একটু ডেকে আন তো!’
.
ঘরের লাইট নিভিয়ে শুয়ে ছিলাম। ড্রয়িং রুম থেকে কারো চেঁচামেচির আওয়াজ কানে এলো। ভালো করে শোনা যাচ্ছে না কিছু। আবছা আবছা শুনে যা বুঝলাম প্রত্নর ব্যাপারে কথা হচ্ছে। বারবার দুটো শব্দ এসে ঘুরপাক খাচ্ছে কথার মাঝে ‘প্রত্ন’, ‘শ্রাবণ ‘!
ওদের দুজনের ব্যাপারে এতো গুরুতর কী কথা হচ্ছে! জানার জন্যে আমার কৌতুহল হতে লাগল। আমি উঠে দরজা খুলে রুমের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম শ্রেয়ার সঙ্গে শ্রাবণ কথা বলতে বলতে ড্রয়িংরুমের দিকেই এগোচ্ছে। শ্রাবণ বলছেন, ‘ওনারা আবার কেন এসেছে? ‘
আর কিছু শুনতে পেলাম না। আমার আচমকা শ্রেয়ার শ্রাবণকে ছাদে বলা কথাগুলোর কথা মনে পড়ল। শ্রাবণের ছোট চাচা, চাচীই কি এসেছেন তবে?
ঘটনা জানার উদ্দেশ্যে আমি ড্রয়িংরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এদিকে কেউ তাকালেই আমাকে দেখে ফেলবে। অবশ্য কেউ তাকাবে বলে হয়না। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলায় ব্যস্ত। কথা না বলে ঝগড়া বললে হয়তো ঠিক হবে। তাদের ঝগড়ার মূল বিষয়বস্তু প্রত্নর বর্তমান অবস্থা। শ্রাবণ ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই সবাই থেমে গেল। একজন ভদ্রমহিলা শ্রাবণকে দেখিয়ে আমার শ্বাশুড়ি মা’কে বলল, ‘ওকেই জিজ্ঞাসা করেন ভাবি! সত্যটা কী ওই বলুক!’
ভদ্রমহিলাটি সম্ভবত প্রত্নর মা আর শ্রাবণের ছোট চাচী।
মা বললেন, ‘তোমার কাছে কী প্রমাণ আছে রাশিদা তুমি যে আমার ছেলের ওপর এভাবে দোষ দিচ্ছো?’
‘প্রমাণ কেন লাগবে? এই বিল্ডিংয়ের প্রত্যেকটা লোকই শ্রাবণের মেজাজের ব্যাপারে অবগত!’
মা হঠাৎ গলার স্বর অতি কঠোর করে ফেললেন। ‘আমার ছেলের রাগ একটু বেশি বলে এই না যে পৃথিবীর সব খারাপ কাজ সেই করছে।’
সহসা শ্রাবণের চাচী বিদ্রুপ করে হাসলেন। ‘যে ছেলে বিয়ের দিনই সবার সামনে…!’
বলতে গিয়ে অকস্মাৎ চুপ হয়ে গেলেন তিনি। তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম শ্রাবণ হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। শ্রাবণের চোখগুলোকে অসম্ভব রকমের লাল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করছে সে নিজের রাগকে।
মা ছোটো চাচীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হলো? থেমে গেল কেন?’
ছোটো চাচী যেন চুপসে গেছেন। কোনো কথাই বের হচ্ছে না তার মুখ দিয়ে। আমি আশ্চার্যান্বিত হয়ে গেলাম। বাড়ির বড়রাও এত ভয় পায় ওনাকে! উনি তো আর বাঘ-ভাল্লুক নন! বড় জোর কী করতে পারবেন উনি? আসল কথা হচ্ছে বাড়ির বড়রাই লাই দিয়ে দিয়ে ওনার রাগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার শ্বশুর বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো শ্রাবণ নিয়ন্ত্রণে থাকতেন।
শ্রাবণ এই প্রথম মুখ খুললেন। ‘চাচী, আপনি দয়া করে একটু পরপর আমাদের ফ্ল্যাটে এসে চেঁচামেচি করবেন না! বাড়ি ভর্তি মেহমান। তারা আপনাদের কথা শুনলে কী ভাববে একবার ভেবেছেন? আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষও আসবে এখন। আমি চাইনা আপনাদের কারণে তাদের সামনে আমাদের সম্মান নষ্ট হোক!’
ছোটো চাচীর মুখ লাল হয়ে উঠলো অপমানে। তিনি চলে যাবার জন্যে পা বাড়ালেন। শ্রাবণ আবার বললেন, ‘ও হ্যা আরেকটা কথা! আপনার ছেলেকে বলবেন, অন্যের বউয়ের দিকে যেন চোখ তুলে না তাকায়! অন্যের বউকে নিয়ে দিবা স্বপ্ন দেখাটাও কিন্তু অসচ্চরিত্রতার মধ্যেই পড়ে!’
ছোটো চাচীকে দেখে মনে হল তিনি এখনি রাগে ফেটে পড়ে শ্রাবণকে উল্টোপাল্টা কিছু একটা বলে বসবেন! কিন্তু না! নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুতপায়ে এ ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেলেন তিনি।
মায়ের মুখভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তিনি কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। কোনো এক কারণে হয়তো ছেলেকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছেন না!
শ্রাবণের কখন আমার ওপর চোখ পড়েছে জানিনা। উনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। ওনাকে এড়িয়ে যাবার জন্য আমি জলদি পায়ে পুনরায় রুমে চলে এলাম।
রুমে এসে আমি দরজা লাগাতে নিতেই শ্রাবণ এসে এক হাত দিয়ে দরজা টেনে ধরল। আমি সরে গেলাম। উনি হঠাৎ ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
আমার দিকে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘নাও।’
দেখে মনে হচ্ছে ওষুধের প্যাকেট। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী এটা?’
উনি বললেন, ‘মাথা ব্যাথার ওষুধ!’
‘ওহ। লাগবেনা, খেয়েছি!’
উনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাথা কমেছে?’
‘হ্যা।’
শ্রাবণ নিজের ওয়ারড্রবের ড্রয়ারে ওষুধের প্যাকেটটা রেখে দিয়ে বললেন, ‘ভবিষ্যতে কখনো প্রয়োজন হলে এখান থেকে নিয়ে নিও।’
আমি মনে মনে হাসলাম। ভবিষ্যতে এ বাড়িতে থাকলে তো!
শ্রাবণ চলে যেতে নিলেন।
আমি পেছন থেকে বললাম, ‘প্রত্নকে কেন মারলেন?’
শ্রাবণ থেমে পেছনে ঘুরলেন। কিন্তু জবাব দিলেন না। আমি আবার বললাম,’ কেন মারলেন প্রত্নকে? ‘
শ্রাবণ এবার উপহাস করে বললেন, ‘কেন কষ্ট হচ্ছে? ‘
ওনার বাঁকা কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হল। তবুও স্বাভাবিক থেকে বললাম, ‘আপনি কাজটা মোটেও ঠিক করেননি! ‘
মুহূর্তেই শ্রাবণের মুখাবয়ব ভয়ংকর আকৃতি ধারণ করল! দু চোখে রাগ স্পষ্ট! বড় বড় পা ফেলে আচমকা কাছে এসে এক হাতে আমার গাল চেপে ধরলেন, ‘প্রেমিকের জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব তাই না?’
আমি অগ্নি দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালাম, ‘ছাড়ুন আমাকে!’
উনি ছাড়লেন না। ওভাবেই বললেন, ‘ভবিষ্যতে যদি ওকে কখনো তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখি, এবার তো শুধু হাত-পা ভেঙেছি! তখন একদম কবরে পাঠিয়ে দেবো!’
আমি বাধ্য হয়ে আমার হাত দিয়ে ওনার হাত সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম, ‘একদিন আপনার এত রাগের জন্যই আপনার ভালোবাসার মানুষগুলোকে হারাবেন!’
শ্রাবণ আমার গাল থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলেন। এরপর অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ ভালোবাসার মানুষগুলোকে হারাতে চাই না বলেই রাগ দেখাই!’
বলে এক মূহুর্তও দেরি করলেন না। হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
.
বাবারা যখন এলেন তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। রাস্তায় না কি জ্যাম ছিল। আবার তাদের ভাড়া করা মাইক্রোও নষ্ট হয়ে যায়। তাই এত দেরি হল।
বাবার সঙ্গে ফুফা আর আমার ছোটো বোন রিহা এসেছে শুধু। ঘরে ঢুকে আমার শ্বাশুড়ি মায়ের সঙ্গে সবাই কুশল বিনিময় করলেন।
গতকালকেই এসেছি নিজের বাপের বাড়ি ছেড়ে। অথচ মনে হচ্ছে কতো যুগ পেরিয়ে গেছে মাঝে। আমি বাবা আর রিহাকে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছিস, মা? ‘
‘আমি ভালো আছি বাবা। তুমি কেমন আছো?’
বাবা জবাব না দিয়ে ঝাপসা চোখে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছেন তার বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে।
আমি বাবাকে আবার বললাম, ‘ও বাবা, বলো কেমন আছো!’
বাবা বললেন, ‘আমার বড় পরীকে ছাড়া আমি কীভাবে ভালো থাকবোরে মা!’
আমি আর চোখের জল আটকাতে পারলাম না। কেঁদে দিলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
রিহাও কাঁদতে লাগল। আমি বললাম, ‘কাঁদছিস কেন তোর তো খুশি হবার কথা! এখন আর তোর আদর-ভালোবাসার ভাগীদার কেউ নেই!’
রিহা গাল ফুলিয়ে বলল, ‘আপু!’
আশেপাশে সবাই হাসতে লাগল। এতক্ষণ হয়তো তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ফ্যামিলি ড্রামাই দেখছিল!
.
খাবারদাবার সব গন্ধ হয়ে গেছে। পোলাও, রোস্টসহ অন্যান্য সব আইটেমই খাবার অনুপযোগী। স্বাভাবিক। এতক্ষণ অব্দি কি এসব খাবার খোলায় রাখলে ভালো থাকে! মা ফ্রিজে কিছু খাবার তুলে রেখেছিলেন। কিন্তু নতুন কুটুমদের তিনি সেসব খাবার খাওয়াবেন না। ফ্রিজে রাখা মানে না কি বাসি হয়ে যাওয়া। আর বাসি খাবার কী করে তিনি নতুন কুটুমদের খাওয়াবেন!
তাই তিনি এখন নতুন করে সবকিছু রান্না করছেন। বাবা, ফুফা অনেকবার করে নিষেধ করলেও তিনি শুনলেন না।
শ্রাবণ সামনের রেস্টুরেন্ট থেকে স্ন্যাকস জাতীয় খাবার কিনে আনলে মা নিজেই সবাইকে পরিবেশনা করলেন।
রান্নার কাজে মা’কে সাহায্য করতে গেলে মা জোর করে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি একা একা এতদিক কীভাবে সামলান আমার বুঝে আসেনা!
ড্রয়িংরুমে সবার সাথে গিয়ে বসলে বাবা আমাকে ইশারায় আমার ঘরে যেতে বললেন। বুঝলাম বাবা হয়তো জরুরী কিছু বলবেন। ঘরে আসতেই বাবা অত্যন্ত গম্ভীর কন্ঠে আমাকে বলল, ‘এ বাড়িতে তোর যা যা আছে সবকিছু ঠিকমতো গুছিয়ে নে মা! যাতে আর কখনো এ বাড়ির চৌকাঠ না মাড়াতে হয়!’
চলবে…
লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা
(